#বেনেবউ
#পর্ব_৭ (বীরভূম ভ্রমন)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
শর্ত মোতাবেক আজকে নিভ্রের সাথে ইপ্সিতার বের হবার কথা। ইপ্সিতা নীল রঙের একটা ড্রেস পড়ে বেরিয়ে গেল, যাবার আগে মাকে বলে গেল ফিরতে দেরি হবে।
স্ট্যান্ডের কাছে আসতেই দেখা মিললো নিভ্রের। সাদা শার্টে আরো সুর্দশন লাগছে ওকে। ইপ্সিতা পাশে দাঁড়িয়ে শুকনো কেশে বলল,
– ‘কোথায় যাবেন?’
নিভ্র পাশে তাকিয়ে নীল পরিকে দেখে এক মুহুর্ত থেকে গেল। ইপ্সিতার মুখে কোনো সাজ নেই তবুও অসম্ভব সুন্দর লাগছে।
– ‘কি হলো বলুন।’
পুনরায় ইপ্সিতার ডাকে নিভ্রের ধ্যান ভাঙে।
– ‘হ্যাঁ বলো। কোথায় যাওয়া যায় তুমিই বলো।’
– ‘আমি কি বলবো, আপনি বলুন।’
– ‘দ্যাখো আমি তো বীরভূমের মানুষ নয়, কর্মসূত্রে এইখানে থাকি তুমি তো এইখানের মেয়ে তুমিই বলো।’
– ‘তাহলে শান্তিনিকেতন চলুন।’
– ‘যাওয়াই যায়।’
দুজনে বাসে উঠে বসলো। দুজন পাশাপাশি। বাস নিজের গতিতে চলতে লাগল।
বীরভূম কথার অর্থ বীরের ভূমি। তবে এখানকার মাটি লাল হওয়াতে বীরভূম লাল মাটির দেশ হিসাবেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলা ভারতের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক পর্যটন কেন্দ্র। ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অতীতে রক্ষিত বীরভূম জেলা।
বীরভূমের কথা মনে আসলেই প্রথমে যে জায়গাটির কথা মাথাতে আসে সেটি হলো বোলপুরের শান্তিনিকেতন। রবি ঠাকুরের ভূমি নামেও বেশ জনপ্রিয় শান্তিনিকেতন। শান্তিনিকেতন সৌন্দর্য, সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি নিখুঁত মিশ্রণ। শান্তিনিকেতন মূলত একটি শিক্ষাকেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে খোলা আকাশের নীচে, গাছের তলায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করাতেন। বর্তমানে শান্তিনিকেতন গান, নাচ, অঙ্কন ছাত্রছাত্রীদের জন্য উল্লেখযোগ্য একটা প্রতিষ্ঠান।
অনেকটা জার্নি করার পর অবশেষে গন্তব্য স্থলে পৌঁছালো। শান্তিনিকেতনের ভেতরে ঘুরতে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়, শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে “নন্দন আর্ট মিউজিয়াম ও গ্যালারি টাও ইপ্সিতার মন কেড়ে নিয়েছে।
জাদুঘরটি কলা ভবনের অংশ, এতে সঙ্গীত ভবন এবং কালো বাড়িও রয়েছে। রবি ঠাকুরের অনুরোধে, রামকিঙ্কর বাইজ, নন্দলাল বসু এবং সুরেন্দ্রনাথ কর-এর তত্ত্বাবধানে ১৯২৩ সালে কলা ভবন নির্মিত হয়েছিল। এই জাদুঘরটি নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখার্জি, রামকিঙ্কর বাইজ এবং অন্যান্যদের মতো শিল্পীদের ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে। এই জাদুঘরে একটি লাইব্রেরি এবং একটি প্রদর্শনী হল উভয়ই রয়েছে।যাদুঘরের দেয়াল অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় দিকেই ম্যুরালে আচ্ছাদিত।
ওরা বেড়িয়ে পড়ে যদিও ইপ্সিতা আর একটু সময় থাকতে চেয়েছিল কিন্তু নিভ্র আরো কয়েকটা জায়গা ঘুরে দেখবে বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছে।
শান্তিনিকেতনের চারপাশের সবুজ বন, তাজা বাতাস, নির্মল পরিবেশ এবং নিকটবর্তী কোপাই নদীর মোহনীয়তা ইপ্সিতাকে মুগ্ধ করেছে। কোপাই নদীর তীরে অবস্থিত অমর কুটির ইকো ট্যুরিজম, পরিচ্ছন্ন ও সু-পরিচালিত পার্কটি প্রচুর সবুজ বনে ঘেরা। পাশাপাশি হওয়াতে ওটাও ঘুরে নিলো ওরা।
– ‘শান্তিনিকেতনে পৌষ মাসে কিংবা দোল উৎসবের সময় আসলে বেশি জমকালো থাকে।’ (ইপ্সিতা)
– ‘কি হয় তখন?
– ‘পৌষ মেলার সময়, বিশাল মেলার আয়োজন করা হয় আর এটি কারিগর, লোকগায়ক এবং নৃত্য শিল্পীদের সংযোগ স্থল। যদিও কখনো আসা হয়নি লোকমুখে শুনেছি।’
– ‘এইবার তাহলে কোথায় যাবো?’
– ‘একদিনে কটা জায়গা ঘুরবেন?’
– ‘যতগুলো পারবো।’
ইপ্সিতা নিভ্রের দিকে তাকাল, এই ছেলে পাগল নাকি?
– ‘সৃজনী শিল্পগ্রামে যাবে?’
– ‘কোথায় এটা?’
– ‘বোলপুরেই।’
– ‘নামটা বেশ ইউনিক, যেতে তো ইচ্ছা করছে।’
– ‘তাহলে চলো।
সৃজনী শিল্পগ্রাম শান্তিনিকেতনের বীরভূমে অবস্থিত ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারের একটি ছোট গ্রাম্য পর্যটন স্পট। কমপ্লেক্সটি ২৬ বিঘা জমি জুড়ে বিস্তৃত এবং ঐতিহ্যবাহী কুঁড়েঘরের মতো আকৃতির নয়টি জাদুঘর অন্তর্ভুক্ত। শিল্পগ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী কুঁড়েঘরে ১০০০টিরও বেশি নিদর্শন রাখা আছে।
এই শিল্প গ্রামে অধিগ্রহণ ২৫ বছরেরও বেশি সময় আগের।
শিল্পগ্রামের শান্তিপূর্ণ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষকে আকর্ষণ করে এবং তাই এটি এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠছে।
এই সাংস্কৃতিক স্থলে একটি লোক চিত্রকলা আর্ট গ্যালারিও রয়েছে। শিল্পগ্রামে বোলপুরের ‘আদি বিম্ব’ ও ‘আদি ক্রান্তি’ নামে একটি মণ্ডপ রক্ষিত করে। যা পূর্ব ভারতের আদিবাসী বীরদের সম্মান জানানোর জন্য স্থাপন করা হয়েছে।
ঘোরাঘুরি শেষ করে খাওয়া দাওয়া করে নিয়ে, নতুন জায়গার উদ্দেশ্য রওনা দেয়।
– ‘ইপ্সিতা হেতমপুর রাজবাড়িতে গিয়েছো কখনো?’ (নিভ্র)
– ‘না।’
– ‘চলো তাহলে।’
বীরভূমের সিউড়িতে অবস্থিত হেতমপুর রাজবাড়ি।
রাজপ্রাসাদটি জমিদার, বাংলার নবাব এবং রাজকীয় রাজাদের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল।
চমৎকার প্রাসাদটি তার অত্যাশ্চর্য স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত যার মধ্যে রয়েছে অলঙ্কৃত পোড়ামাটির মন্দির, খিলানযুক্ত গেটওয়ে এবং ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের প্রাসাদ। রাজবাড়িটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এখানে ৯৯৯ টি দরজা রয়েছে সেইজন্য বিশাল অট্টালিকাটির নাম রাখা হয়েছে হেতমপুর হাজারদুয়ারি বা হাজার দরজার প্রাসাদ।
এছাড়াও রাজবাড়ির আশেপাশে গ্রামীন পরিবেশ সকলকে মুগ্ধ করে। তাছাড়া এই অঞ্চলের আশেপাশে অনেক পোড়ামাটির মন্দির রয়েছে যেগুলির স্থাপত্যের একটি অনন্য শৈলী রয়েছে।স্থানটি প্রকৃতপক্ষে বীরভূমের অতীতের জাঁকজমক ও গৌরবের প্রতীক।
– ‘মুর্শিদাবাদের হাজার দুয়ারী প্রাসাদের অনুকরণে করা নাকি?’ (ইপ্সিতা)
– ‘কি জানি। রাজাগুলো বেঁচে থাকলে ভালো হতো।’
– ‘কেন?’
– ‘না জিজ্ঞেস করতাম হাজার দুয়ারী প্রাসাদের অনুকরণে করেছেন নাকি।’
ইপ্সিতা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। নিভ্র যে ওর সাথে মজা নেবার জন্য এই কথাটা বলেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না।
– ‘এইবার বাড়ি চলুন।’
– ‘না। আর একটা জায়গায় ঘুরবো তারপর বাড়ি ফিরবো।’
– ‘আবার কোথায়?’
– ‘সোনাঝুড়ি বন।’
– ‘বিকাল হয়ে যাচ্ছে আপনি কি বনে যাবেন?’
– ‘আরে চলো না।’
খোয়াই সোনাঝুরি বন হল বীরভূমের একটি অপূর্ব জায়গা যা নিখুঁত প্রশান্তি দেয়। শান্ত গ্রামীণ পরিবেশ এবং সবুজের মাঝে লুকিয়ে থাকা ঘন জঙ্গল। বনের ঘন ছাউনি ছাড়াও, মৃদু বাতাস, গিরিখাতের মতো গঠন এবং শান্ত ও স্নিগ্ধ ভাবে প্রবাহিত খোয়াই নদী।
নিভ্র আর ইপ্সিতা বনের ভেতরে গেল না। বিকাল পেড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে ফিরে যেতে হবে এইবার।
– ‘এইবার তো চলুন।’
– ‘সোনাঝুড়ি এসেছি আর একটা জায়গায় ঘুরবো আর আজকে তো আবার শনিবার।’
– ‘কেন? কি আছে?’
– ‘চলো গেলেই দেখতে পাবে।’
কিছুটা পথ আগিয়ে যাবার পর একটা হাট বসেছে। কত কত মানুষের ভীড় জমেছে।
সোনাঝুরি শনিবার বাজার যা খোয়াই বনের অনন্য হাট (শনিবারের হাট) নামে পরিচিত যেখানে স্থানীয় কারিগররা হস্তনির্মিত জাতিগত গয়না, পোশাক, শোপিস, কাঁথাস্টিচ এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের সুস্বাদু জিনিস বিক্রি করে। ইপ্সিতা কয়েকটা জিনিস কিনে নিলো, নিজের জন্য কয়েকটা গহনা, বাড়িতে সাজিয়ে রাখার জন্য দুটো শোপিস, দুটো কাঁথা ঘর সাজানোর কয়েকটা জিনিস। আর একটা জিনিস নিলো তবে সেটা নিভ্রের চোখের আড়ালে। একটা হাতের কাজ করা পাঞ্জাবি।
কেনাকাটা শেষ করে কোপাই নদীর ধার দিয়ে আসতে গিয়ে দেখল বাউলরা গান করছে। বাউল গানের কথা মনে পড়লেই লালন ফকিরের নামটা মনে পড়ে যায়। ঘোরাঘুরি শেষ এইবার ফিরে আসার পালা।
এই স্থানগুলো ছাড়াও বীরভূমের আরো অনেক দর্শনীয় স্থান আছে।
“বল্লভপুর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য” এই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বোলপুরের কাছে অবস্থিত একটি সুন্দর এলাকা। এই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বনভূমি অঞ্চলটি অনেক উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আশ্রয়স্থল। এই অভয়ারণ্যের প্রধান আকর্ষণ হল স্পটেড হরিণ এবং ব্ল্যাক বাক। আর এই অভয়ারণ্যে অনেক মাটির ঘরও রয়েছে।
“মামা ভাগনে পাহাড়”
বীরভূমের দুবরাজপুরের একটি প্রাকৃতিক বিস্ময় হল মামা ভাগনে পাহাড়।
একটি উচ্চতায় অবস্থিত নিদারুণ ল্যান্ডমার্কটি একটি গোলাকার পাথরের অস্বাভাবিক ভারসাম্যপূর্ণ গঠনের জন্য বিখ্যাত যা অন্য একটি দাড়িয়ে থাকা পাথরের উপর শুয়ে আছে। আক্ষরিক অর্থে বোঝাতে গেলে এই পাথরের উদাহরণটি মানবসভ্যতার দ্বারা বহন করা অপরাধবোধের বোঝা বোঝায়। অল্প জনবসতিপূর্ণ জমির মধ্যে ধূসর রঙের গ্রানাইট পাথর অনেক পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ক্রমশ এই পাথর, মামা-ভাগনে পাহাড় নামে পরিচিত হয়।
“প্রকৃতি ভবন” বা নেচার আর্ট মিউজিয়াম শান্তিনিকেতনের বল্লভপুর এলাকার একটি রত্ন। জাদুঘরটি প্রকৃতির ঐশ্বর্য এবং সৌন্দর্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এটিতে কিছু অনুপ্রেরণাদায়ক ভাস্কর্য এবং শিল্পের উদাহরণ রয়েছে এবং শুকনো কাঠ, প্রাকৃতিক ড্রিফ্টউড এবং ধাতুর অন্দর প্রদর্শন রয়েছে। খোলা বাগানটি প্রকৃতির সৃজনশীলতা এবং প্রাকৃতিক শিলা ভাস্কর্য দিয়ে শোভিত। জাদুঘরে, শিল্প ও কারুশিল্পের অনন্য নমুনাও রয়েছে যা
আরেকটি চমৎকার জিনিস হলো পাখির পাথরের ভাস্কর্য।
#চলবে…