ভালোবাসার রোজ,পর্ব:১৪+১৫

0
989

#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-১৪]
#আফরোজা_আনজুম

ক্লাস শেষে বেরিয়ে মিষ্টি আপুর চোখাচোখি হলাম। সে যেন আমারই অপেক্ষায় ছিল। পাশে তার ফ্রেন্ড ইমা আপুও আছে। মিষ্টি আপু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ” ক্লাস শেষ?”

আমি স্বভাবসুলভ হেসে হ্যা বললাম। সে বললো, ” তাহলে চলো ওদিকে যাই।”

আমিও তাদের সাথে চললাম। তার কথায় মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় আমাকে। হাঁটার মাঝে ফোন দিলাম নিঠুল ভাইকে। রিসিভ করে নি সে। মিষ্টি আপু বললো, ” কাকে ফোন করছো? গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে নাকি!”

” আজ ঐ গাড়িতে যাবো না। নিঠুল ভাইকে ফোন করছি। আমাদের বাড়ি যাবে বলেছে। তার সাথেই যেতে বলেছে।” স্বাভাবিকভাবে বললাম আমি।

” নিঠুলকে তুমি ভালোবাসো, তাই না?”

মিষ্টি আপুর কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। অসহায় দেখালো তাকে। আমি কী বলবো বুঝতে পারলাম না। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে আবারও বললো, ” নিঠুলের সাথে তোমাকে যায়! গ্রামের ভুলা ভালা সাধারণ মেয়ে তুমি। স্ট্যাটাস, রূপ, গুণ, শিক্ষা কোনোদিক থেকেই তো ওর সাথে ম্যাচ হয় না তোমার। এই ভার্সিটিতে পড়ো। দেখোই তো তোমার চেয়েও পারফেক্ট কতশত মেয়ে আছে এখানে। অনেকেরই ক্রাশ সে। এমন একটা ছেলে তোমাকে ভালোবাসে! শুনো, একটা উপদেশ দিই তোমাকে। নিজের স্ট্যাটাসের সাথে মিলে এমন কাউকে বেছে নাও। তাহলেই ভালো তোমার জন্য। উপরের লেভেলের কারো সাথে জড়িও না। নিজের লেভেল দেখো আগে।”

তার হাসিমুখে বলা কথাগুলো শুনে ভাষা হারিয়ে গেলো আমার। কী সুন্দর ঠান্ডা মাথায় হাসিমুখে অপমান করলো আমায়। তার চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জবাব দিলাম,

“আমি আগেই বুঝেছি আপনি তাকে পছন্দ করেন। তাই আমাকে এসব বলছেন তাই না! আমার লেভেল, স্ট্যটাস সম্পর্কে জানা আছে। নিঠুল ভাইও জানে সব। তার তো কোনো সমস্যা নেই!”

মিষ্টি আপু তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো, ” তুমি বড্ড বোকা। ”

পাশ থেকে ইমা নামের মেয়েটা বলে উঠলো, ” বোকা বলছিস একে! বোকা হলে নিঠুলের মতো ছেলেকে ফাঁসালো কীভাবে!”

তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” শুনো মেয়ে, মিষ্টির সাথে নিঠুলের রিলেশন ছিল। ভার্সিটির প্রথম দিক থেকেই শুরু হয়েছিল। দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে। এইতো কিছুদিন আগে একটা ঝামেলা হলো। আর এরই সুযোগ নিলে তুমি। নিঠুল তোমাকে ভালোবাসে না, বুঝেছো! সে তোমার সাথে কিছু সময় কাটিয়েছে মাত্র। মিষ্টি আর নিঠুল এখনো দুজন দুজনকে ভালোবাসে৷ তাদের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে। অনেক দূর বলতে কতটুকু তা আশা করি তোমাকে ভেঙ্গে বুঝাতে হবে না। যাই হোক, এখন আবার রিলেশন কন্টিনিউ করতে চায়। এদের মাঝে শুধু শুধু এলে তুমি। তাই বলছি নিজ থেকে সরে যাও। এতে তোমারই ভালো হবে।”

স্তব্ধ হয়ে গেলাম কথাগুলো শুনে। নিঠুল ভাইয়ের রিলেশন ছিল মিষ্টি আপুর সাথে! কিন্তু সে আমাকে বলে নি। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার৷ তাদের কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না। বিশ্বাস না হলেও কী। অসম্ভব কিছু তো নয়। প্রথমে তো আমারও তাই মনে হয়েছে। তার সাথে আমার মিলে না। তাইতো তার প্রতি আমার আবেগ-অনুভূতিগুলো চেপে রেখেছিলাম। সে-ই তো এলো নিজ থেকে। মিষ্টি আপুর সাথে দূরত্ব সৃষ্টির পর-ই কী সে আমাকে বেছে নিয়েছে ক্ষণিকের জন্য! কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। বুক ফেটে কান্না আসছে। মিষ্টি আপু এগিয়ে এসে বললো, ” ভালোভাবে বুঝিয়েছি। আশা করি কোনো প্রবলেম ক্রিয়েট করবে না।”

কথাটা বলেই চলে গেলো তারা। নিঠুল ভাই ফোন করছে বারবার। কল কেটে বসে পড়লাম বেঞ্চে। তার কাছ থেকে এমনটা আশা করি নি। অনুভূতিগুলো আমার মনেই থাকতো না হয়! সে কেন ক্ষণিকের জন্য নিজের শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এলো আমার কাছে! এমন ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

এর দুইদিন পর নতুন ভাবি সহ পুরো পরিবারকে দাওয়াত করলো রেবা আন্টি। ঐদিনের পর থেকে নিঠুল ভাইকে ইগনোর করা শুরু করলাম। শতবার কল এসেছে বোধহয় তার। ম্যাসেজগুলোও সিন করি নি। দাওয়াতে সবাই যেহেতু যাবে তাই অগত্যা আমাকেও যেতে হলো। ঘরে একা রেখে যাওয়ার মতো কাজটা কখনো করে না আম্মুরা। তাদের বাসায় গিয়ে একবার চোখাচোখি হলো মাত্র। সে একবারও আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো না। তখন নিশ্চিত হলাম মিষ্টি আপুর কথা ঠিক তাহলে। মিষ্টি আপু যে আমায় সব বলেছে এটা নিশ্চয়ই নিঠুল ভাইকে জানিয়েছে। আমার ধারণা ভুল হলো। বিকেলের দিকে সবাই ছাদে গেলো। খারাপ লাগছে বলে আমি গেলাম না। রিনি আপুর রুমে শুয়ে ছিলাম। একটু পর দেখলাম নিঠুল ভাই এসেছে ধুপধাপ পা ফেলে। চমকে উঠে বসে পড়লাম আমি। সে এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বললো, ” এই কী সমস্যা তোর? কয়দিন পর পর কী হয়! এড়িয়ে চলছিস কেন আমাকে! সেদিন ক্যাম্পাসে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম ধারণা আছে তোর!”

হাতের কাছে আমার মোবাইল দেখে সেটা নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মেরে বললো, ” এটা কেন রেখেছিস? আমার কল, ম্যাসেজ দেখিস নি! ভালোবাসি বলে মাথায় উঠে গেছিস! নাকি গোপনে নতুন কাউকে জোগাড় করেছিস!”

তার চোখেমুখে চরম রাগ ফুটে উঠেছে। এই চেহারা দেখে ভয় পেলাম আমি। তাও বিছানা থেকে নেমে বললাম, ” গোপনে কেন প্রকাশ্যে কাউকে জোগাড় করলেও তোমার কী? আর তোমার ফোন, ম্যাসেজের রিপ্লাই কেন করবো? আমাকে বোকা পেয়ে ব্যবহার করেছো তুমি। যেই না বুঝেছো তোমার প্রতি দূর্বল আমি অমনি তার সুযোগ নিলে। তোমার সুইটির সাথে ঝামেলা হওয়ার পর আমার কাছে এসেছো। একদম মিথ্যে অভিনয় করবে না আমাকে সাথে। সুইটির কাছে যাও না! আমি তো সরে গিয়েছি। মিথ্যে অভিনয় করতে হবে না আমার সাথে।”

বলতে বলতে কেঁদে দিলাম আমি। আমার কথা শুনে সে শান্ত হলো। এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললো, ” তোকে কে কী বলেছে বল তো! এখানে সুইটির কথা কেন আসছে?”

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁদছি। উত্তর না পেয়ে সে আমার হাত চেপে ধরে শক্ত হাতে। পুনরায় জিজ্ঞেস করে কথাটা। তাও উত্তর না পেয়ে রেগে যায়। বলে, ” আমার রাগ উঠাচ্ছিস তুই। একটু আগের কথাগুলো বুঝিয়ে বল আমাকে। আমাকে ইগনোর করার কারণটা কী?”

” না বোঝার ভান করছো? তোমার সুইটি সব বলেছে আমায়। তাকেই তো ভালোবাসো। এর মাঝে আমার অনুভূতি নিয়েও খেললে। এখন আবার তার কাছেই ফিরে গিয়েছো।”

সে আমার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে কঠিন চোখে তাকায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সুইটি লেখা নামটায় কল করে লাউড স্পিকারে দেয়। ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই নিঠুল ভাই গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, ” রোজকে কী বলেছো তুমি? তোমার সাথে আমার রিলেশন ছিল?”
সুইটি ওপাশ থেকে আমতা আমতা করে বললো, ” না মানে আমি তো…”

” সরাসরি জবাব দাও। তোমার সাথে আমার রিলেশন ছিল! তোমাকে কখনো এমন কিছু বলেছি বা এমন আচরণ করেছি যাতে তুমি বুঝতে পারো আমি তোমাকে ভালোবাসি?”

” তোমাকে আমি ভালোবাসি নিঠুল। সেই প্রথম থেকে। তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।”

” সেটা বুঝতে পেরে আমি তোমাকে প্রথমেই বলে দিয়েছি যে আমার মনে অন্য কেউ আছে এবং শেষ পর্যন্ত সে-ই থাকবে। আমার প্রথম ভালোবাসা সে। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমি ভাবতে পারি না। বলেছি?”

ওপাশ থেকে কিছু বললো না সে। নিঠুল ভাই আবার বললো, ” তাহলে তুমি কেন শুধু শুধু আমাদের মাঝে আসছো? তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করি নি আমি। ভালো বন্ধু ভেবেই পাশে ছিলাম। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক ছিল তা এখানেই শেষ।”

সুইটি ওপাশ থেকে উঁচু গলায় বললো, ” তুমি যাকে ভালোবাসো সে তো তোমাকে বিশ্বাসই করে না। এমন লো ক্লাসের মেয়েকে তুমি ভালোবাসো!”

নিঠুল ভাই উত্তর না দিয়ে কল কেটে দিলো। ফোন রাখলে তার দিকে তাকাই আমি। সে আমার হাত ছেড়ে বলে, ” ছোট থেকেই সবকিছু থেকে আগলে রেখেছি তোকে, শাসন করেছি, পাশে থেকেছি। তুইও আমাকে ছোট থেকে দেখে আসছিস। একসময় ভালোবাসাটা প্রকাশও করলাম। তাও তোর এমন মনে হলো! আমার চরিত্র নিয়ে কথা বললি, সুযোগসন্ধানী ভেবেছিস আমাকে। ওকে। তোর ভাবনা আর অন্যের কথা নিয়েই থাক। আর কখনো আসবি না আমার সামনে।”

কথাগুলো বলে সে চলে গেলো। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না। অবশ্য আমার কিছু বলার মুখ থাকলে তো! কিন্তু সুইটি দের কথাগুলো কীভাবে অবিশ্বাস করি! তার সাথে তো আমার যায় না। এতো এতো মেয়ে থাকতে সে আমায় ভালোবাসে কেন এই প্রশ্নটাই তো মনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা। তাদের কথাগুলো বিশ্বাস করে নিচু মনের পরিচয় দিয়েছি নিজেকে। নিঠুল ভাই প্রচন্ড রেগেছে। তাও শান্তি লাগছে সুইটি নামের দুষ্টু মহিলাটির কথাগুলো মিথ্যে হওয়ায়।

মন মেজাজ হালকা হওয়ায় ছাদের দিকে গেলাম। ভাবী আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ” মাথা ব্যাথা কমেছে? ”

আমি হেসে মাথা নাড়ালাম। আরমান ভাইয়াকে ডেকে বললাম, ” ভাবীর পাশে দাঁড়াও তো! তোমাদের খুব সুন্দর লাগছে। কয়েকটা ছবি তুলি।”

” নিঠুলকে দেখেছিস নিচে? আমাদের ছবি তুলবে বলে ক্যামেরা আনতে গিয়ে গায়েব হয়ে গেছে সে,” আরামান ভাইয়া বললো।

” আমি তো সোজা চলে এসেছি। দেখি নি। ”

আরমান ভাইয়া ভাবীকে টেনে পাশে দাঁড় করিয়ে বললো, ” আচ্ছা। তোর মোবাইলে তোল।”

ভাবী লাজুক হাসলো। কয়েকটা ছবি তোলার মাঝে নিঠুল ভাইকে দেখলাম ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। সে নিজেই তুললো তাদের ছবি। পিচ্চিরা ক্যামেরা দেখেই ছবি তুলতে দৌঁড় লাগালো। দুই পরিবারের সকলের একসাথে তুললো অনেকগুলো। সবশেষে ভাইয়া ভাবীর ক্লোজ ছবিও তুললো। এর মাঝে ভুলেও আমার দিকে তাকালো না নিঠুল ভাই। মন খারাপ হলো ভীষণ। নিজে সবকিছু না জেনে অন্যের কথা শুনে সব বিশ্বাস করে নেওয়া একদম ঠিক হয় নি। এভাবেই তো সম্পর্কে ভাঙন ধরে।

#চলবে…

#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -১৫]
#আফরোজা_আনজুম

সন্ধ্যা থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি ঝরছে। থামার কোনো নাম নেই। রেবা আন্টি কয়েকবার এসে ড্রয়িংরুমে হেঁটে গেলো। মুখে এক কথা,’ নিঠুল কোথায় আছে কে জানে! ফোনও তুলছে না। এই ঝড়ের ভেতর না বলে বের হয়ে চলে গেছে।আসলেই একটা চড় মারবো বেয়াদবকে।’

রিনি আপু বললো, ” আম্মা, আমাকে বলেছে তো! রুপম ফোন করে যেতে বললো।”

” তুই আমাকে বলিস নি কেন তখন?”

আঙ্কেল এসে বসলো সোফায়। আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” এতো অস্থির হচ্ছো কেন তুমি? ও তো ছোট নয় যে তোমার এতো চিন্তা করতে হবে! চিন্তা বাদ দিয়ে কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দাও তো রেবা!”

” সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে পড়ে থাকে। আমার খবর নেয় না, মনে পড়ে না। চায়ের নেশা উঠলে রেবার কথা মনে পড়ে।” আন্টি রাগে গজগজ করে বললো।

আঙ্কেল হাসলো। ঠাট্টা করে বললো, ” তোমার কথা মনে থাকে বলেই তো চা খেতে আসি তোমার কাছে। নয়তো পাশের বাসার ভাবীর কাছে যেতাম। ”

” মেয়েরা আছে এখানে। আজেবাজে বলিও না। ” আন্টি কপট রাগ দেখিয়ে কথাটা বলে কিচেনে চলে গেলো।

রিনি আপু আর আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। রিনি আপু হেসে বললো, ” তুমি কীভাবে কীভাবে যেন আম্মাকে থামিয়ে দাও।”

” থামাতে আর পারলাম কই! সারাজীবন তো সে-ই আমাকে থামিয়ে দিয়ে এসেছে। এখন ছেলের বউ আছে তাই একটু ছাড় দিচ্ছে।” কথাটা জোরেই বললো যাতে আন্টি শুনতে পায়।

রিনি আপু উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বললো, ” তোমার চা আর আসবে না। আমিই যাই।”

কলিং বেল বাজলো এর মাঝে। আমি উঠে দরজা খুলে দেখলাম নিঠুল ভাই এসেছে। ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ভেজা শার্ক গায়ের সাথে সেঁটে আছে, কপালে থাকা এলোমেলো চুল বেয়ে পানি পড়ছে। সে আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে দরজা থেকে আমার হাত সরিয়ে ঢুকে পড়লো। একটু আগে তাকে দেখে যে ভালো লাগাটা অনুভব হলো নিমিষেই তা খারাপে পরিণত হলো। সে বোধহয় আমাকে আশা করে নি। নিঠুল ভাই এসেছে শুনে আন্টি কথা শুনিয়ে দিলো একগাদা। সে চুপ ই থেকেছে। বিপরীতে একটা কথাও না শুনে আন্টি আরও রেগে গেলো। আমি নিঠুল ভাইয়ের রুমে গেলাম। সে বোধহয় ওয়াশরুমে। জিনিসের ছড়াছড়ি তার রুমে। বিভিন্ন রকমের কাগজ, ব্যানার, তার, লাইট আরো কী কী সবে ঠাঁসা রুমটা। তাই বড় রুমটা গোছানো থাকলেও কেমন এলোমেলো মনে হয়। বিছানা থেকে তার মোবাইলটা নিলাম। পাওয়ার অফ। চার্জে দিচ্ছিলাম তখনই সে বের হলো। খালি গায়ে দেখে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। মিনিটেই সে তেড়ে এসে উঁচু গলায় বললো, ” আমার রুমে কী করছিস তুই? আমার সামনে আসতে বারণ করেছি না!”

সে এগিয়ে আসাতে আমি পিছিয়ে গেলাম। ফিকে গলায় বললাম, ” তুমিই তো এসেছো আমার সামনে।”

সে কিছু না বলে আমার হাত ধরে বের করে দিলো রুম থেকে। খেতে বসেও আমাকে এড়িয়ে চললো যা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। নিজ থেকে বুঝিয়ে না বললে সে হয়তো আর কথাই বলবে না আমার সাথে। রাতে আপুর রুমে গেলাম ঘুমাতে। আপু ফোনে কথা বলছে নিলয় ভাইয়ার সাথে। কথা বলছে না; কথা কাটাকাটি করছে। লাউড স্পিকারে ছিলো বিধায় আমিও শুনতে পেলাম নিলয় ভাইয়ার কথা। আপুকে থামিয়ে দিয়ে নিলয় ভাইয়া বললো, ” এই রাত বিরাতে রিনা খানের রোল প্লে করছো কেন রিনি?”

রিনি আপু রাগে ফোসফাস করে বললো, ” হ্যা। এখন তো আমি রিনি থেকে রিনা খান হয়ে গেছি। যখন প্রেম করতে তখন বলতে রিনি,তুমি আমার চিনি, মিনি। আর বিয়ের পর! বিয়ের পর কথায় কথায় বলে রিনা খান। ”

” আচ্ছা আমি আসলে নিয়ে যাবো বললাম তো! সবসময় বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করে। ঐসব কথা বাদ দাও। একটু মিষ্টি কথা বলো তো! তোমাকে আজ সুন্দর লেগেছিল শাড়িটাতে। আমি যেদিন বাসায় যাবো সেদিন পরবে সেটা, ঠিক আছে! সারাদিন তোমাকে সামনে বসিয়ে রেখে দেখবো আমি। ”

রিনি আপুর রাগ উবে গিয়ে মুখে লজ্জিত ভাব এলো। লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। বললাম, ” ভাইয়া, সারাদিন শুধু আপুকেই দেখবেন? অন্যদেরও একটু দেইখেন।”

নিলয় ভাইয়া থেমে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আপুকে বললো, ” ও আছে আমাকে বলবে না? আবার স্পিকারেও দিয়ে রেখেছে।”

কথাটা বলে ফোন রেখে দিলো। আমি হেসে আপুকে বললাম, ” এই যা!ফোন রেখে দিলো! এতো লাজুক ভাইয়া! এতো লজ্জা নিয়ে ভাইয়া তোমাকে প্রপোজ করেছে কীভাবে? তোমাদের যে সম্পর্ক ছিল তা তো কেউ বিশ্বাসই করে নি। ”

” বিশ্বাস না করারই কথা। দেখতি না সামনাসামনি থাকলে চোখ তুলেও তাকাতো না লজ্জায়! কথা তো দূর। সবার সামনে ভদ্র সেজে থাকতো ; এদিকে ফোনে আমার কান ফাটাতো। আর প্রপোজ করেছে বিয়ের রাতে। তাও আমি জোর করেছি বলে।”

” তো তোমাদের প্রেম হলো কীভাবে? ভাইয়া বলেছে নাকি তুমি?” উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

” নিঠুল বলেছে।”

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম, ” মানে?”

” মানে নিঠুল জানিয়েছে আমাকে যে তার ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে। পরে আমি তাকে ম্যাসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে কী করেছে জানিস! পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। নিঠুল নাকি আমার সাথে মজা করেছে, তেমন কিছু নয়। পরে নিঠুলকে ফোন করে অনেক কথা শুনালো। নিঠুলও কথার প্যাঁচে বের করে নিয়েছে তার মনের কথা। আমি নিঠুলের সাথেই ছিলাম। নিলয় যখন জেনে গেছে আমি সব শুনেছি তখন আর লুকায় নি। তারপরও আমিই এগিয়েছি। এখন কী বলে জানিস! নিঠুল না বললে নাকি আমি কোনোদিনও জানতাম না তার মনের কথা।”

মনটা ভালো হয়ে গেলো মুহূর্তে। রিনি আপুর হঠাৎ করে অন্য জায়গায় বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়। কাবিন করে রাখবে এমন কথাও হয়েছে। আগের দিন নিলয় ভাইয়া এসে সবাইকে জানায় সে আপুকে ভালোবাসে। আপুও তাদের সম্পর্কের বিষয়ে জানায়। যে ছেলে লজ্জায় মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না, কথা বলে না, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সেই ছেলের সাথে মেয়ের সম্পর্ক চলছে তা অবিশ্বাসের ছিল সবার কাছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে আপুকে বললাম, ” আমি আসছি একটু পর। তোমাদের কথা বলার সুযোগ করে দিলাম। ”

” শুয়ে পড় তুই। ও আর ফোন করবে না। ”

আপুর কথা কানে না নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। আন্টিকে দেখলাম নিঠুল ভাইয়ের রুম থেকে আসছে। আমাকে দেখে বললো, ” দেখেছিস সন্ধ্যায় ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছে! ”

” সন্ধ্যায় কোথায় গিয়েছিল আন্টি? ”

“হসপিটালে গিয়েছিল নাকি কোন রোগীকে রক্ত দিতে।”

থেমে আবার বললো, ” উঠে এসেছিস কেন? কিছু খাবি?”

” না। এমনি এসেছি।”

” আচ্ছা। শুয়ে পড় তাহলে। তোর আঙ্কেলকে ঔষধ দিতে হবে। যাই। ”

গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নিঠুল ভাইয়ের রুমে পা রাখলাম। কাঁথা গায়ে দিয়ে ডান হাত মাথার নিচে রেখে লম্বালম্বি হয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। তার পাশে বসে কপালে হাত রাখতেই উষ্ণতা অনুভব করলাম। চোখ মুখ শুকনো লাগছে। হঠাৎ করে তার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিতে ইচ্ছে করলো। সে তো এখন ঘুমিয়ে আছে। একটা চুমু তো খাওয়া যায়। তার জাগ্রত অবস্থায় এই কাজটা করার সাহস নেই আমার। ভাবতে ভাবতে ঝুঁকে গেলাম তার দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলাম তাকে। এতো কাছ থেকে এতো সময় নিয়ে দেখার সুযোগ হয় নি কখনো। মুখটা আরেকটু এগিয়ে নিতেই চট করে চোখ খুলে ফেললো সে। চমকে উঠে পিছিয়ে গেলাম আমি। ভয়ে, লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঘুমিয়েই তো ছিল ; টের পেলো কীভাবে! সে আমার কোমর জড়িয়ে তার কাছে টেনে নিয়ে বললো, ” সামনে আসতে বারণ করেছিলাম। তুই তো একেবারে আমার গায়ের উপর চলে এসেছিস। ”

এতো কাছ থেকে তার পুরুষালি কণ্ঠে কেঁপে উঠলাম আমি। বুক ধুকপুক করছে। মাথা নিচু করেই ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম নিজেকে। সে আরো জোরে চেপে ধরে। জ্বরের মাঝেও এতো শক্তি পায় কোথায়!

” এতো রাতে আমার ঘরে এসে আমার ঘুমের সুযোগ নিচ্ছিস!”

” আমি তো… আমি তো এমনিই এসেছি। উল্টাপাল্টা কী সব বলছো তুমি! ”

” আমি উল্টাপাল্টা বলছি, না! চুরের মায়ের বড়ো গলা। কোন মতলবে এসেছিস আমি জানি না!”

” কোন..কোন মতলবে এসেছি?”

কথাটা বলার সাথে সাথেই সে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিল। হঠাৎ আক্রমণে হকচকিয়ে গেলাম। পাঁচ ছয় সেকেন্ড পর সে ছাড়িয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো এবং বললো, ” এই মতলবে।”

তার হাত সরিয়ে উঠতে চাইলাম আমি। সে ছাড়লো না। দুষ্টু হেসে বললো, ” ঠোঁটটা এখনো শুকিয়ে আছে। দাঁড়া আরেকটু ভিজিয়ে নেই।”

লজ্জায় কান লাল হয়ে গেলো আমার। তার হাতে জোরে চিমটি কাটলাম। মৃদু চিৎকার করে ছেড়ে দিলো সে। ততক্ষণে আমি উঠে দরজার দিকে চলে গেলাম। পেছনে ফিরে বললাম, ” এই মতলবে এসেছিলাম আমি।”
.
.
.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সুখবর পেলাম। রিনি আপু কনসিভ করেছে। রিনি আপু লাজুক মুখে আন্টিকে তা জানাতেই আন্টি খুশিতে চিল্লিয়ে উঠে আপুকে জড়িয়ে ধরে। খুশি হবেই না বা কেন! তিনবছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই খুশির সংবাদটা শোনার জন্য। নিঠুল ভাই দৌড়ে চলে যায় মিষ্টি আনতে। আন্টি বড় চাচীকে ফোন করে জানিয়ে দেয়। রিনি আপুকে পারে না কোলে নিয়ে বসে থাকে। রিনি আপু নিলয় ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলো তখন নিঠুল ভাই ফোনটা টেনে নিয়ে কংগ্রাচুলেশন জানায়। শাশুড়ী-দেবরের কাণ্ডে লজ্জায় রুমে বসে আছে রিনি আপু। এতো কিছুর মাঝেও নিঠুল ভাই আমাকে এড়িয়ে চলছে। কাল রাতের কথাও মনে নেই হয়তো। বিকেলে আন্টিকে বললাম আমি চলে যাবো। আন্টি না করলেও বুঝিয়ে বললাম। আন্টি নিঠুল ভাইকে দিয়ে আসতে বললে সে সোজা বলে দেয়, ” আমার কাজ আছে। আজকে পারবো না। থাকতে বলো ওকে।”

” কতো করে বললাম শুনছে না ও। তুই দিয়ে আয়।”

” বাইকে যাবো তাহলে। আসতে বলো।”

” কার বাইক? বাইক চালাতে বারণ করেছি তোকে।” আন্টি রাগী গলায় বললো।

” আমি বাইক চালাতে জানি, আম্মা। সমস্যা হবে না। এবার ভাইয়া আসলে একটা নিয়ে নিবো দেখো।”

” কথা শুনিস না তুই! মেয়েটাকে আমি তোর সাথে দিবো বাইকে! গাড়িতে করে যা।”

” গাড়িতে গেলে টাকা খরচ হবে শুধু শুধু। আব্বুর, ভাইয়ার কত কষ্টে কামানো টাকা! তার চেয়ে বাইক চালিয়ে যাই!”

” এক চড় মারবো, ফাজিল। এখন বাবা, ভাইয়ের কষ্ট বুঝছে সে! গাড়িতেই যা।”

সে আন্টির কথা শুনছে না। বাইকে হলে নিয়ে যাবে নয়তো না। বন্ধুর কাছ থেকে নাকি শিখেছে বাইক চালানো। তার জন্য নিতে চাইলেও আন্টির ঘোর আপত্তির কারণে নিতে পারছে না। আন্টিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমাকে উঠতে বলে বাইকে। একটু একটু ভয় লাগছে তাই তার দিকে ঝুঁকে বসলাম। সে বুঝতে পেরে তাকে ধরে বসতে বলে। আমি পেছন থেকে হাত এগিয়ে তাকে হালকা জড়িয়ে ধরি। কিছু বলে নি সে। সাহস করে হাতের বাঁধন শক্ত করে তার পিঠে মাথা রাখলাম। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে। তার শার্ট থেকে পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ আসছে। চোখ বন্ধ করে নিলাম আমি। একটু যেতে কিছুর সাথে ধাক্কা লাগলো বাইক। কিছু বুঝে উঠার আগেই বাইক ছিটকে রাস্তার পাশে পড়লো। চারপাশে মানুষ জড়ো হলো। পাশে নিঠুল ভাইয়ের অর্ধেক শরীর বাইকের নিচে পড়ে আছে। সে উঠতে চায়ছে। সামনে দেখতে পেলাম অারেকটা বাইকের পাশে একটা লোক পড়ে আছে। লাল রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। নিঠুল ভাইকে কাতর কণ্ঠে বলতে শুনলাম, ” ওর কাছে যান দয়া করে। ওকে তুলুন আগে।”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here