তুমি অপরূপা পর্ব ২৭

0
1083

#তুমি_অপরূপা(২৭)

রূপা চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো। সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই, সেভাবেই।
একটা হাহাকার বুকের ভেতর। কার জন্য এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে?
সেই ময়না পাখি কি কখনো ধরা দিবে তার মন পিঞ্জিরায়?
এই যে বিনিদ্র রজনীরা সাক্ষী, সাক্ষী প্রিয় গীটার, সাক্ষী আকাশের তারারা,সমুদ্রের নিঃসঙ্গতার সাক্ষী এরা সবাই।এরা জানে সমুদ্র ভালো নেই।এরা শুনে একটা ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের আর্তনাদ।
এরা দেখে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে সমুদ্র। এরা বুঝে বোবা হৃদয়ের নিঃশব্দ চিৎকার।
অথচ যার জন্য সোনার দেহ পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, যার জন্য বুকের বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেই তার খবর রাখে না।সে জানেই না ভেতরে ভেতরে একটা মানুষ ভীষণ ভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, তথাকথিত সেই ব্যক্তিত্ব যদি সমুদ্র ধরে রাখে তাহলে কি রূপা তার হবে?
নিজের একটা মানুষ থাকে মানুষের এজন্য, যাতে তার কাছে ভেঙেচুরে নিজেকে খুচরো পয়সার মতো জমা রাখতে পারে। তার কাছে আসলে যাতে ভান করতে না হয়।আমি যা,আমি মন থেকে যেমন ঠিক সেভাবেই নিজেকে প্রকাশ করা যায় যাতে।
যাতে তার সামনেও গাম্ভীর্যের অদৃশ্য মুখোশ পরে থাকতে না হয়।নিজের ব্যক্তিত্ব, ইগো,গাম্ভীর্য বজায় রেখে যদি কাউকে আপন করে নিতে হয় তবে সেখানে মনে হয় কিছুটা ফাঁক ফোকর রয়ে যায়।
সেখানে অন্তত নিজের ১০০ ভাগ প্রকাশ করা যায় না।আর যার কাছে নিজের শতভাগ প্রকাশ করা যায় না,নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া না যায় তবে যে যাই বলুক সমুদ্রের মনে হয় সেখানে “আমি সম্পূর্ণভাবে তোমার” এই কথাটা বুক ফুলিয়ে বলা যায় না। কেউ না জানুক,নিজে তো জানবে আমি পুরোপুরি তার হতে পারি নি।

সমুদ্র রূপাকে পুরোপুরি চায়,নিজেও পুরোপুরি তার হতে চায় যাতে কখনো অবচেতন মন ও বলতে না পারে কখনো সমুদ্র কিছু নিয়ে ভান করেছে। সে নিজের কাছে নিজে স্বচ্ছ থাকতে চায়।এতে তাকে সস্তা ভাবলে ভাবুক,সে বরং এই শব্দটাকে পজিটিভলি নিবে।
সস্তা বলুক,পাগল বলুক যা ইচ্ছে তাই বলুক।
আপন মনে হাসে সমুদ্র।
তারপর গলা ছেড়ে গান গায়,”লোকে পাগল বলুক,মাতাল বলুক আমি…..
তোমার পিছু ছাড়বো না….”

কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ঘুরাঘুরির পর সমুদ্র আবারও বাসের কাউন্টারে গেলো।ঢাকায় ফিরে যাবে এখন আবার। এখানে তো তার কোনো কাজ নেই,থাকবে কোথায়।
যাকে সঙ্গ দিতে এসেছিলো সে তো তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে এবার আর চিন্তা নেই।

পরবর্তী বাসে সমুদ্র আবারও ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

রূপার হাত পা কাঁপছে। এতো ভয় লাগছে কেনো?
বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামতেই ভয়ের একটা শীতল স্পর্শ রূপাকে ছুঁয়ে গেলো।
সমুদ্রের সাথে এক বাসে আসার পরেও তো তার এতো ভয় লাগে নি।এখন কেনো এই অজানা ভয় তাকে চেপে ধরছে?
ভেতরে যতই যাচ্ছে ততই মন বলছে বাড়ি আসা উচিত হয় নি। চারদিকে এশার আজান হচ্ছে। রূপা অন্ধকারে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।
দাদীর ঘর থেকে হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে।
তাদের ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলছে গুনগুন করে অনিতা পড়ছে মনে হয়। অল্প অল্প শোনা যাচ্ছে তা।

সিরাজ হায়দার আজ একটু সকাল সকাল দোকান বন্ধ করলো। মনটা অস্থির হয়ে আছে আজ।
অনুর সাথে কথা হয় নি তিন চারদিন হলো। যতোই মেয়ের উপর রাগ থাকুক এখন কেনো জানি মন পুড়ছে মেয়ের জন্য। মনে হচ্ছে মেয়েয়া যদি এই সময়টায় দেশে থাকতো, বাড়িতে থাকতো।
এই সময়টা একটা মেয়ের জন্য কেমন সেনসিটিভ সময় তা তিনি জানেন। কে জানে,ওখানে নিজের সব রান্নাবান্না, ঘরের কাজ করতে কতটা কষ্ট হয় মেয়ের!
খেতে পারে কি ঠিক করে?
আহা,বাড়িতে থাকলে তো তিনি নিজে খাইয়ে দিতেন।
মেয়েদের মা যেহেতু অসুস্থ সেহেতু তিনি নিজেই তো খাওয়াতেন মেয়েকে।
১০০ বার খাওয়াতেন।মেয়ের যা ইচ্ছে করে তাই এনে দিতেন মেয়েকে।

সিরাজ হায়দারের চোখে জল এলো।মেয়েটার এই অবস্থায় ওরা মেয়ের হায়ে হাত তুলেছে, সব কাজ করিয়েছে। আল্লাহ সহায় ছিলো বলে,নয়তো প্রথম তিন মাসে তো নানা রকম রিস্কের ব্যাপার থাকে অনেকের।
ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার।

যেদিন অনামিকাকে নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো।
দোকানে বসে ছিলেন তিনি।সেই মুহুর্তে কল এলো তার ফোনে।বিদেশের নাম্বার দেখে কিছুটা অবাক হলেন।তবুও রিসিভ করলেন।ভালোমন্দ কুশলাদির পর যখন শাহেদ নিজের পরিচয় দিলো ফোনটা রেখে দিতেই যাচ্ছিলেন তিনি কিন্তু রাখলেন না৷ শাহেদের কাতর স্বরের অনুরোধ শুনে।শাহেদ অনুনয় করে বললো, “আব্বা প্লিজ আমার কথা একটু শোনেন,আপনার মেয়েটা অসুস্থ আব্বা।আমাদের বাড়িতে ও ভালো নেই। সুযোগ পেলেই আমার মা ওর গায়ে হাত তোলে,আজকেও ওকে মেরেছে অকারণে। আমি ওকে ওখানে রাখতে চাচ্ছি না আব্বা।আমি জানি আপনি রাগ হচ্ছেন আমার এসব কথা শুনে।ভাবছেন আপনার মেয়েকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করার পরেও তাকে যথাযথ ভালোবাসা, মর্যাদার সাথে রাখতে পারি না।আমি ওকে এই দেশে নিয়ে আসার সকল ব্যবস্থা করতেছি আব্বা।ততদিন পর্যন্ত আপনি আপনার কাছে এনে রাখেন।আপনার মেয়েকে আমি সারাটা জীবন রানী করে রাখবো বলে কথা দিয়েছিলাম,আমি আমার কথা রাখতে চাই।আমাকে একটু সাহায্য করুন,আর অল্প কয়েকটা দিন। ”

শাহেদের কথার মধ্যে কিছু একটা ছিলো। যা জমে থাকা রাগের মধ্যে পানি ঢেলে দিয়েছে।
সেদিনই ছুটে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন তিনি।

ভাবতে ভাবতে বাড়ি চলে এলেন।উঠোনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে গলা খাকারি দিলেন তিনি।তারপর টর্চ লাইট জ্বালতেই চমকে উঠলেন।রূপা!
তার আদরের অপরূপা!

“আমার অপরূপা”বলেই সিরাজ হায়দার এগিয়ে এলেন।ছোট বাচ্চার মতো রূপাও এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। রূপা জানে না, কোন অজানা কারণে তার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। কান্নাভেজা স্বরে সিরাজ হায়দার বললো, ” আইছস মা,ভালো করছস।কতো দিন তোরে দেখি না।আমার ঘর মাতিয়ে রাখতো যারা একসময় আইজ তারা কেউ নাই।এক সময় প্রতি দিন ঘুম ভাঙ্গলেই চিন্তা করতাম আজকে এতোগুলো মুখে খাবার জুটামু কিভাবে?
অথচ আইজ চিন্তা করি আবারও যদি আমার চারটা পরীরে একলগে পাইতাম তবে আর এক মুহূর্তের লাইগা ও দূরে যাইতে দিতাম না।না খাইয়া থাকতাম লাগলে।তবুও মাইয়াগোরে বুকের মইধ্যে রাখতাম।
মা রে,সন্তান বড় হইলে এমনে দূরে চইলা যাইতে হয় ক্যান?
ক্যান ওরা ছোট বেলার মতো কইরা বুকের ভেতর পাখির ছানার মতো ঘাপটি মাইরা থাকে না?
এতো বড় ক্যান হয় সন্তান?”

রূপা জানে না কি উত্তর দিবে।উত্তর কি আদৌও তার জানা আছে?
সিরাজ হায়দার মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।সালমা এক দৃষ্টিতে চালের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “মা…ও মা…..।”

সালমা চমকে উঠে বললো, “কে,কে?কে ডাকে?”

-“আমি ডাকছি মা।”

“কে,অনু? আমার অনু?না-কি আমার অন্তু?কে কথা কয় না ক্যান?কে ডাকে আমারে?
অনিতা কই আমার? ও মা অনিতা, কই গেছস?”

রূপার ভীষণ কষ্ট হয়।মা সবার কথা বললো অথচ তার কথা বললো না কেনো?
তার কথা কি মা’য়ের একটুও মনে নেই?
কোন অপরাধে মা তাকে এভাবে ভুলে গেলো?

“না মা,আমি তোমার রূপা,অপরূপা। ”

সালমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। কোনো এক অজানা কারণে সালমা রূপাকে এখন সহ্য করতে পারছে না।সালমার চেহারায় হিংস্র ভাব ফুটতে লাগলো চিৎকার করে বললো, “ক্যান আইছস তুই?বাইর হইয়া যা।তুই কেউ না আমার। তোর লাইগা আমরা গেরামে থাকতে পারি না।নাগর লইয়া ভাইগা গেছস না তুই, আবারও ফিরা আইলি ক্যান?তোর নাগর কই এখন?তোর লাইগা এতো অসম্মান আমাগো। তোরে আমি শেষ কইরা দিমু।”

রূপা বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো মা’য়ের দিকে।সালমা ছুটে আসতে নিতেই সিরাজ হায়দার ধরে ফেললো তার হাত।তারপর কঠিন এক ধমক দিতেই থেমে গেলো সালমা।তার মুখ থামলো না।বিড়বিড় করে বললো, “না না,শেষ কইরা দিমু আমি তোরে।তুলনায় চইলা যা যেখান থাইকা আইছস।তোর মতো দুশ্চরিত্রা মাইয়া আমার লাগবো না। আমার মাইয়াগোরে বিয়া দিতে পারমু না তোর লাইগা।তোরে আইজ আমি শেষ কইরা দিমুই।”

সিরাজ হায়দার সালমাকে ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে তাদের রুমে দিয়ে এসে বললেন,”তুই একটু জিরাইয়া ল মা।দরজা আটকাইয়া রাখ।”

রূপা ভেবে পেলো না কি করবে!
মা কেনো তাকে কিছুতেই বুঝতে পারে না। মা কি আর কখনোই তাকে ভালোবাসবে না?
কান্না আসে রূপার।বুকের ভেতর থেকে চেপে রাখা কান্নারা সবাই বের হয়ে আসতে চায়।

সিরাজ হায়দার রান্নাঘরে ছুটলেন।মেয়ে এসেছে কতো দিন পরে।দুটো ডিম ভাজবেন,একটা মাছ ভাজি করবেন।

রূপা বসে কান্না করছে। দরজায় টোকা দিতেই রূপা উঠলো দরজা খুলতে।পর মুহূর্তে দরজা না খুলে আগে টিনের ফোঁকর দিয়ে তাকাতেই দেখলো সালমা দাঁড়িয়ে আছে।
রূপা কিছু না ভেবেই দরজা খুলতেই সালমা ঝাঁপিয়ে পড়লো রূপার উপর। গলা টিপে ধরে বললো, “শেষ করে ফেলবো আমি তোরে।তোর লাইগা গেরামে মুখ দেখাইতে পারি না। তোর লাইগা সবাই আমাগো শরম দেয়।তুই ম/র।”

অনিতা দৌড়ে গিয়ে বাবাকে বললো, “আব্বা,মা আপার গলা টিইপ্যা ধরছে।”
সিরাজ হায়দার সব ফেলে ছুটে এলেন।এসে টেনে সালমাকে সরানোর চেষ্টা করলেন।সালমার গায়ে যেনো হাতির মতো শক্তি এসেছে। অনেক কষ্টে সালমাকে রূপার থেকে আলাদা করলেন।
রূপার নিশ্বাস নিতে পারছে না।হাঁফাতে লাগলো। সিরাজ হায়দার কি করবেন ভেবে পেলেন না।

সালমা সরে গিয়ে এক কোণে বসে কাঁদতে লাগলো অনু,অন্তু করে।
সেই রাতে কারো খাওয়া হলো না।কেউ ঘুমাতে পারলো না।সবাই জেগে রইলো নিজের জায়গায়।

পরের দিন সকালে রূপা ঘুম থেকে উঠে বাবার কাছে গিয়ে বললো, “আমি চলে যামু আব্বা।”

সিরাজ হায়দার জবাব দিতে পারলেন না।কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।রূপা বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবার বয়স এই এক রাতে অনেকখানি বেড়ে গেছে যেনো। কেমন বৃদ্ধ মনে হচ্ছে আজ বাবাকে।বাবা মা’কে বৃদ্ধ হতে দেখার মতো শোক মনে হয় আর কিছুতে নেই।

সিরাজ হায়দার রূপাকে নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এলেন । মেয়েকে বাসে তুলে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।বাস ছেড়ে দিলো একটা সময় পর।তারপর আস্তে আস্তে দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেলো বাস।অপলক তাকিয়েই রইলেন সিরাজ হায়দার। বুকের ভেতর শূন্য হতে হতে এক সময় মনে হলো ভীষণ একা তিনি।
জীবন এরকম কেনো?
আর কি কখনো সব ঠিক হবে না?

চলবে……

রাজিয়া রহমান

(জানি পর্ব ছোট হয়েছে। আরো কিছুটা লিখে আগামীকাল পোস্ট দেওয়ার ছিলো, তবুও আজকে দিয়ে দিলাম।ছোট পর্ব নিয়ে অভিযোগ কইরেন না আজ।অনেক টাইপিং মিস্টেক হতে পারে, অগ্রীম ক্ষমাপ্রার্থী।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here