তুমি অপরূপা পর্ব ২০

0
1088

#তুমি_অপরূপা(২০)

জুয়েল টেবিলে খেতে বসে অন্তরাকে ডাকলো।অন্তরা ওয়াশরুমে ছিলো, অন্তরা বের হতে হতে দেখতে পেলো রেশমা প্লেটে করে জুয়েলের জন্য খাবার আনছে।
এতোটা বাড়াবাড়ি ও অন্তরার পছন্দ নয়।অন্তরা ভেবেছিলো জুয়েলকে সে রেশমাকে থাকতে দেওয়ার কথা বলবে,কিন্তু রেশমা জুয়েলের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে দেখে অন্তরার বুকে যেনো কাঁটা বিধলো।

সামনে না এসে ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো অন্তরা।
রেশনা খাবার প্লেট এনে রাখতেই জুয়েল উঠে দাঁড়ালো। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললো, “আমার খাবার আমি তোর কাছে চেয়েছি?তুই কেনো খাবার দিতে এলি?”

রেশনা বেশ কাঁচুমাচু হয়ে বললো, “আমি তো শুধু এনে সামনে দিলাম,বিশ্বাস করুন আমি আপনার খাবার ধরে ও দেখি নি,আমার হাতের যে আপনি খাবেন না তা আমি জানি।আপনার বউ খাবার বেড়ে রেখেছে আমি তো শুধু এনে দিলাম।”
।জুয়েল রাগতস্বরে বললো, “না,তুই এনে ও দিবি না।তোর হাতে যা ছুঁবি তাই নোংরা হয়ে যাবে।তুই নিজেই তো নোংরা মেয়েমানুষ। ”

রেশমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জুয়েল অফিসের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়ে গেলো। অন্তরা দৌড়ে গিয়ে জুয়েলকে ধরে বললো, “না খেয়ে কোথায় যাচ্ছেন। আমি এনে দিচ্ছি খাবার। আসুন।”

জুয়েল এলো না,দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আমি খাবো না।আমি যেনো অফিস থেকে এসে ওকে না দেখি।আমি নয়তো খু//ন করে ফেলবো ওরে।”

জুয়েল চলে গেলো। অন্তরা এসে রেশমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনি চলে যান,উনি চান না আপনি থাকেন। ”

রেশমা শক্ত হলো এবার কিছুটা। কঠিন ভাবে বললো, “আমার অধিকার ছাইড়া আমি যামু না। আমাগো এহনো ছাড়াছাড়ি হয় নাই।আমি রানার বাপেরে ছাড়মু না,সই দিমু না আমি। কি করতে পারে কে দেখমু।”

রানা ঘুমে ছিলো, মায়ের এরকম জোরে কথা শুনে জেগে উঠলো ঘুম থেকে। তারপর ঘুমঘুম স্বরে বললো, “মা,ও মা,আমারে কোলে লও।”

রেশমা ছুটে গিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসলো। রানা তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে রাখলো।

এতো স্নিগ্ধ, এতো মায়ার এই দৃশ্য দেখে অন্তরার দুই চোখ ভিজে গেলো আপনাতেই।কতো দিন কেটে গেছে মা’য়ের গায়ের গন্ধ পায় না। বাবাকে দেখে না কতো দিন!
ভীষণ ইচ্ছে করে তাদের দেখতে। কিন্তু হায় ভাগ্য!
কোনো দিন ও হয়তো তা সম্ভব হবে না।

বাবা মা যদি তাড়িয়ে দেয় সেই যন্ত্রণা তো অন্তরা কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না তখন।

রেশমা বেশ আটঘাট বেঁধে নেমেছে এবার।জুয়েলকে সে অন্তরার চাইতে বেশি চেনে। জুয়েলের দুর্বলতা অন্তরার চাইতে বেশি জানে।তাই জুয়েলকে কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে তা রেশমা জানে।তবে বেশি তাড়াহুড়া সে করবে না।আস্তে আস্তে সামনে এগুবে।

————–

শাহেদ বিদেশ যাবার পর মাত্র এক দিন অনামিকার সাথে কথা বলেছে।অনামিকার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে শ্বশুর বাড়িতে।হাসানুজ্জামান এবং রোজিনা দুজনেই অনামিকাকে বেশ ভালোভাবেই খাটিয়ে নিচ্ছে।
ঘুম থেকে উঠেই অনামিকা নামাজ পড়ে ছুটলো রান্নাবান্নার যুদ্ধে। ভয় নিয়ে রান্না করে অনামিকা,আজকাল রোজিনা বেগম কথায় কথায় অনামিকাকে চড় থাপ্পড় দেন।বিশেষ করে রান্নার কোনো ত্রুটি হলে তো আর কথা-ই নেই।

শাহেদ কল দিলো ১১ টার দিকে, অনামিকা তখন পুকুর ঘাটে হাড়িপাতিল ধুচ্ছিলো। শাহেদ অনামিকার কথা জিজ্ঞেস করতেই রোজিনা বেগম বললেন, “বাবা রে,আমার কথা তো আর বিশ্বাস করস না।এখন কতো বেলা হইছে দেখ,তোর বউ সকালে উইঠা নাশতা খাইয়া আবারও গিয়া শুইছে। তুই যতদিন দ্যাশে আছিলি তোর বউ ও ভালো মতো চলছে,এখন কি হইছে কে জানে,তোর লগে কথা কওয়ার জন্য ডাকলেও আসে না,সারাদিন রুমের ভেতর দরজা বন্ধ করে বইসা থাকে। ”

শাহেদ কিছুটা চিন্তিত হলো। অনামিকার থেকে এরকম ব্যবহার প্রত্যাশিত নয়।কিন্তু রোজিনা বেগম যেভাবে কেঁদে বলছেন তাতে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
রোজিনা নাক টেনে বললেন,”বাবারে,মনে করছি তুই নাই,বউরে নিয়া থাককু,পোলার বউরে মাইয়ার মতো যত্ন করমু কিন্তু এখন দেখি কপালে এতো সুখ নাই।বউ তো আমাগো লগে কথাও কইতে চায় না। ”

শাহেদ ডিউটির জন্য রেডি হয়েছে,গাড়ি এসেছে নেওয়ার জন্য। মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে শাহেদ ফোনে রেখে দিলো। গাড়িতে বসে বসে শাহেদের দুই চোখ আপনাতেই জ্বলতে লাগলো। যার কথা শুনে রাজি হয়েছিলো সব ছেড়ে এই প্রবাসে আসতে,সেই কি-না আজ!

অনামিকা ভেবেছিলো আজকে হয়তো শাহেদ তার সাথে কথা বলবে।কিন্তু আজকেও শাশুড়ির সাথে কথা বলে ফোন রেখে দেওয়ায় অনামিকার ভীষণ কষ্ট হলো।
বিমানে উঠলে কি মানুষ এভাবেই বেঈমান হয়ে যায়?

রোজিনা ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করতে করতে বললেন, “আমার পোলার কপাল খারাপ। এমন বউ বিয়া করছে এখন না পারে গিলতে না পারে ফেলতে।গলায় কাঁটার মতো বিইধা আছে পোলার। ”

অনামিকা হতভম্ব শাশুড়ির কথা শুনে। এতোটাই অপ্রিয় হয়ে গেলো সে শাহেদের!
কেনো!
কি দোষ করেছে সে!
অনামিকা এখানে কি অবস্থায় আছে তা জানতে তো চাচ্ছেই না,উল্টো অনামিকাকে গলার কাঁটা বলছে শাহেদ!

মন শক্ত করলো অনামিকা। বেশ,শাহেদ যদি তাকে এতোই অপ্রিয় ভাবে,কথা বলার দরকার ও মনে না করে তবে অনামিকা ও শাহেদের সাথে কথা বলবে না।

————–

রূপার সাথে রত্না পান্নার ভীষণ ভাব হয়ে গেলো। এই আত্মকেন্দ্রিক শহরে বন্ধু পেয়ে রূপা ও যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
কলেজ থেকে ফিরে দুই বোন মিলে রূপাদের ফ্ল্যাটে গেলো। মাহি রত্না,পান্নাকে দেখে বিগলিত বদনে এগিয়ে এসে বললো, “আরে তোমরা! গরীবের দরজায় হাতির পা দেখছি আজ!
কি মনে করে এলে!”

পান্না মুচকি হেসে বললো, “রূপার কাছে এসেছি আমরা।”

বাংলার ৫ এর মতো হয়ে গেলো মাহির চেহারা মুহূর্তেই।আবারও সেই গেঁয়ো মেয়েটা!
অপরূপা গোসল করে বের হয়েছে মাত্র,চুল বেয়ে জলকণা টুপটুপ করে ফ্লোরে পড়ছে।
রত্না বললো, “জামা কাপড় ছাদে দেবে শুকাতে? চলো, আমরা ও যাবো ছাদে।তোমাকে আমার একটা গোলাপ গাছ দেখাবো,এমন আনকমন গোলাপ তুমি এর আগে কখনোই দেখো নি আমি শিওর। ”

ফ্ল্যাটের সবাই যার যার মতো ব্যস্ত থাকে সর্বদা,অপরূপা স্বস্তি পেলো। অন্তত অবসর সময়ে এই দুই বোনের সঙ্গ তো পাবে সে।
জামা কাপড়ের বালতি নিয়ে রূপা ছাদে গেলো, কিছুটা যেতে রত্না বললো, “আরে,আমার কাপড়ের বালতি তো বাসায়,তুমি উঠো,আমরা আমাদের বালতি নিয়ে আসি। ”

রূপা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে উঠে গেলো ছাদের দিকে। নিচে এসে দুবোন হাই ফাইভ দিয়ে হাসতে লাগলো।

ছাদে এসে রূপা আপনমনে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে কাপড় মেলতে লাগলো। রূপক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপরূপাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট একটু একটু করে জ্বলছে।
সমুদ্র কেনো এই মেয়েটাকে পছন্দ করলো!
কি বিশেষত্ব আছে এই মেয়েটার!

কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগলো রূপক।কোমর সমান লম্বা তেলতেলে বিনুনি করা চুলগুলো আজ ছেড়ে দেওয়া। ভেজা চুল বেয়ে পড়তে থাকা জলকণা রোদের কারণে চিকচিক করছে। যেনো চুল বেয়ে মুক্তোদানা ঝরে পড়ছে।
রূপকের রূপকথার গল্পের কথা মনে পড়লো, সেই বন্দিনী রাজকন্যা, যার চোখের জল মুক্তো হয়ে পড়ে।

মেয়েটার ফর্সা মুখখানায় কোনো কৃত্রিমতা নেই,সার‍্যলতা আছে।হালকা গোলাপি সুতির জামা পরনে।
এতো স্নিগ্ধ লাগছে কেনো!
এই যান্ত্রিক শহরের,সব কৃত্রিমতার ভীড়ে,সকল নকলের ভীড়ে মেয়েটা যেনো চোখের শান্তি।

সিগারেট পুড়তে পুড়তে রূপকের হাত পুড়তে লাগলো। চিৎকার করলো না রূপক। মেয়েটা যদি বুঝতে পারে রূপক আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে তবে রূপককে ভুল বুঝতে পারে। পানির ট্যাংকের পেছনে সরে দাঁড়ালো রূপক।

রূপা রত্না পান্নার অপেক্ষা করতে লাগলো আর গুনগুন করে গাইতে লাগলো, “ধরো যদি চেনা গন্ধে
মেতে উঠি চেনা ছন্দে
যদি ছুঁতে চাই আবারও
জানি ছোঁয়া তবু বারণ……”

রূপক মুগ্ধ হলো গান শুনে। রূপা কলেজের সামনে দোকান থেকে খাতা কিনতে গিয়ে গানের এইটুকু শুনেছিলো। শুনেই মুখস্থ হয়ে গেছে। সেই থেকে গেয়েই চলেছে।

রত্না পান্না এলো আরো কিছুক্ষণ পর। হাতে করে আচার নিয়ে এলো।
গল্প করতে করতে ওরা ছাদের অন্যদিকে যেতেই রূপক ছাদ থেকে নেমে গেলো।

রুমে এসে রূপক অস্থির হয়ে পায়চারি করতে লাগলো। কি করতে যাচ্ছে সে!
সমুদ্রকে কষ্ট দিতে যাচ্ছে!
অথচ এক সময় সমুদ্রের কষ্ট ছিলো রূপকের ও কষ্ট।

কিন্তু কি করবে রূপক!
এই সমুদ্র,সমুদ্রের মা কি বাজেভাবে সেদিন আঘাত করেছে কথা দিয়ে রূপককে।ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো রূপকের অন্তর।
যার কোলে কোলে থেকেছে শৈশবের অনেকটা সময়, মায়ের মতো যার আদর পেয়েছে সেই মানুষকে অপমান করে কথা বলেছে ওরা।

না,মনকে কিছুতেই আস্কারা দিবে না রূপক।কষ্ট দিবে সমুদ্রকে।সমুদ্র বুঝুক তাহলে আসল প্রেমের কি জ্বালা।কেনো মানুষ ভালোবাসার জন্য ঘরছাড়া হয় হাড়ে হাড়ে টের পাক সমুদ্র।

চলবে……!

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here