#তুমি_অপরূপা (১১)
বর্ষাকালের এক মেঘাচ্ছন্ন সকাল। অন্ধকার হয়ে আছে চারদিকে। শাহেদ ভাবলো আজকে কাজে যাবে না।অনামিকার জ্বর কমছে না দেখে শাহেদের ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।
সকাল বেলা ক্ষিধে,অসুস্থতায় অনামিকা আরো কাহিল হয়ে গেলো। রাতে জ্বরে বেহুশ ছিলো বলে কিছু খাওয়াতে পারে নি শাহেদ তাই সকাল হতেই অনামিকাকে জিজ্ঞেস করলো, “কি খাইবা অনামিকা? আমারে কও,দোকান থাইকা কিছু আইনা দিই?”
অনামিকা মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো। বুকের ভেতর এক পাহাড় সমান অভিমান। শাহেদ যদিও সেই অভিমানের খোঁজ পেলো না তবে উঠে গেলো বাহিরে।রোজিনা থমথমে মুখে রান্নার আয়োজন করছেন।শাহেদ বের হতেই জেদ দেখিয়ে রান্নাঘরের হাড়িপাতিল অযথা ঠুসঠাস শব্দ করে রাখতে লাগলেন।মায়ের এই অযথা রাগ শাহেদের ভালো লাগলো না।তাই মাকে আর কিছু না বলে বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
দোকান থেকে কনডেন্স মিল্কের কৌটায় করে এক কৌটা দুধ চা,৮ টা পরোটা নিয়ে বাড়ি এলো।
তারপর রুমে গিয়ে অনামিকাকে জোর করে তুলে এনে বারান্দায় বসিয়ে দিলো।
অনামিকার ভীষণ শীত লাগছিলো দেখে রোজিনার একটা শাল এনে গায়ে দিয়ে দিলো।তারপর কাপে চা নিয়ে অনামিকাকে পরোটা চুবিয়ে চুবিয়ে খাওয়াতে লাগলো।
এই একটু যত্ন,একটু ভালোবাসায় অনামিকার মনে জমে থাকা সব অভিমান গলে জল হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে অনামিকা মনে মনে বললো, “আপনার এই একটু ভালোবাসা,যত্নের জন্য আমি আপনার মায়ের সব অবহেলা সহ্য করতে রাজি আছি।”
রোজিনা রান্নাঘর থেকে ছেলের এসব দেখছেন আর ফুঁসছেন।
ছি ছি ছি! কতো নির্ল/জ্জ ছেলে হলে মায়ের সামনে বউয়ের এরকম গোলামী করে রোজিনা ভেবে পেলেন না।বিয়ে হতে না হতে এই ছেলের লাজ লজ্জা সব উদাও হয়ে গেছে!
শেষে কি-না বইয়ের গো/লামী করছে সে!
তার ছেলেটা যে এরকম ভেড়া হয়ে যাবে তা তো তার ভাবনাতেও ছিলো না।
অনামিকাকে খাইয়ে দিয়ে শাহেদ একটা ভেজা ন্যাকড়া এনে অনামিকার হাতের তালু,পায়ের তালু মুছে দিলো।পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে চুল কোনোমতে বেঁধে দিলো।তারপর ঔষধ এনে দিলো।
কিছুক্ষণ পর অনামিকা শরীরে একটু শক্তি পেলো,আস্তে আস্তে জ্বর ছেড়ে দিলো।
রোজিনা নীরবে ভাবতে লাগলেন ছেলের এই অধঃপতনের কথা!
শেষে কি-না বউয়ের পা ও মুছে দেয়! নিশ্চয় তাবিজ করে ছেলেকে বশ করেছে এই মেয়ে।রোজিনা ধৈর্য ধরতে পারলো না। কখন হাসানুজ্জামানকে জানাবেন এই ভেবে অধৈর্য হয়ে গেলো।
শরীর একটু ভালো লাগতেই অনামিকা শাহেদকে বললো, “আপনে আপনার কাজে যান,আমি এখন ঠিক আছি।”
শাহেদ সময় দেখে বললো, “আইজ তো দেরি হইছেই, থাকুক আইজ যামু না আর।”
রোজিনার ভীষণ রাগ হলো ছেলের কথা শুনে। কই,এই বয়সে শাহেদের বাপ তো কোনো দিন এরকম করে তার সাথে কথা বলে নি। এখনো কি বলে!
না তো!
শারীরিক প্রয়োজনে কাছে আসা ছাড়া কখনো কি একবার জিজ্ঞেস করেছে ভালো আছে কিনা!
কখনো না।
আর এখন তো এসব করার বয়স,মানসিকতা কোনোটাই নেই।অথচ এই মেয়েটার কি ভাগ্য!
রোজিনার ভীষণ হিংসা হলো।শাহেদ মায়ের কাছে পরোটা নিয়ে দিয়ে এলো।রাগ করে রোজিনা ছুঁড়ে ফেলে দিলো উঠানে।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো শাহেদ!
রোজিনা নির্বিকার কাজ করতে লাগলো। অনামিকা বুঝতে পারলো এই রাগ কেনো।
তবুও কিছু বললো না। শাহেদ কথা না বাড়িয়ে অনামিকাকে নিয়ে রুমে চলে গেলো।
বিছানায় শুয়ে অনামিকার মনে হলো যেদিন বাড়ি থেকে এসেছে বাবার ভীষণ জ্বর ছিলো দেখে এসেছে, বাবার জ্বর কি সেরেছে?
দুপুরে শাহেদের বাবা বাড়ি এলেন।রোজিনার মুখ থমথমে দেখে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। রোজিনা জবাব দিলো না। বিরক্তি নিয়ে শাহেদকে ডাকলেন খেতে যেতে।
শাহেদ অনামিকাকে নিয়ে খেতে এলো।
অনামিকা খেয়াল করেছে রোজিনা কিন্তু অনামিকাকে খেতে আসতে বলে নি। অনামিকা এসে পাটিতে বসার পর রোজিনা প্লেট আরেকটা এনেছেন। যেনো রোজিনা জানতেন-ই না ঘরে চতুর্থ একজন মানুষ ছিলো বা আছে।
লজ্জা লাগলো অনামিকার।
অনামিকার কান্না এলেও কাঁদলো না সে।ভুলের মাশুল যে দিতে হবে তা তো জানাই ছিলো।
হাসানুজ্জামান গমগমে গলায় বললেন,”তোর ভিসা আইছে,এখন টাকা জোগাড় কর। কেমনে করবি তুই জানস।”
অনামিকা চমকে উঠলো। শাহেদ বিদেশ চলে যাবে তাকে রেখে!
এই বাড়িতে তাকে রেখে যাবে!
কই শাহেদ তো তাকে কিছু বলে নি।
এই বাড়িতে অনামিকাকে একা রেখে যাওয়া আর জিন্দা ক-ব-র দেওয়া একই কথা। রোজিনা আর হাসানুজ্জামান তাকে থাকতে দিবে না কিছুতেই তখন।
শাহেদ খেতে খেতে বললো, “আমি বিদ্যাশ যামু না আব্বা।বিদ্যাশ আমার ভাল্লাগেনা।ওই দ্যাশে মেলা গরম।আর মরুভূমি আপনে বুঝেন আব্বা!
দ্যাশে যেমনে আছি,আলহামদুলিল্লাহ এমনেই থাকি,আর চাকরির লাইগা চেষ্টা করি।”
হাসানুজ্জামান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,”দ্যাশের এই ২ টাকার চাকরি আমার দরকার নাই।আমার ট্যাকা লাগবো। এই ২ ট্যাকার চাকরি কইরা ভাত খাওন এতো সোজা না।এখন তো আমার ঘাড়ে বইসা বউ লইয়া খাইতাছেন,এর লাইগা বুঝেন না। লাত্থি দিয়া বউ সহ যদি বাড়ি থাইকা বাইর কইরা দিতাম তাইলে বুঝতেন আপনের ১০ হাজার ট্যাকার কামে তিন বেলা ভাত পেটে ঢুকতো না।এতো দিন একলা করতেন আর এখন তো দুই জন মিইল্লা আমার অন্নধ্বং/স করতাছেন,গায়ে লাগে না।আমার তো গায়ে লাগে।”
অনামিকার দুই চোখ টইটম্বুর হয়ে গেলো জলে।এরকম কথা অনামিকা কোনো দিন শুনে নি।তাদের সংসারে তো তারা ৯ জন মানুষ ছিলো। সিরাজ হায়দার একা ৯ মানুষের প্রতিদিন ৩ বেলা খাবারের জোগাড় করতেন।কই,কখনো তো তিনি বলেন নি যে সবাই মিলে তার অন্নধ্বংস করছে!
তিনি একজন মানুষ তো খাওয়া দাওয়া, কাপড় চোপড়,অসুখ,পড়ালেখা সব কিছু করতেন সবার জন্য। কখনো তো কাউকে অভিযোগ করেন নি তিনি।অথচ এখানে অনামিকা আসছে দুই দিন।এখনই খাওয়ার খোঁটা শুরু করে দিছে!
শাহেদ অনামিকার চোখ মুছে দিয়ে বললো, “খাবার শেষ করো।এতো অল্পতেই যদি এভাবে ভেঙে পড়ো তবে সামনে আগাবো কিভাবে দুজনে?আমারে যখন বিশ্বাস করছো তুমি, তবে মনে রাইখো তোমার বিশ্বাস ভুল মানুষের উপরে ছিলো না। ”
বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, “আব্বা,১০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি কইরা আমি আর আমার বউ দুজন শান্তিতে সংসার করতে পারমু।কিন্তু তা যদি করি তবে তোমরা সেটা মেনে নিবা না। চিন্তা কইরো না,আইজ ১০ হাজার টাকা বেতন পাই তো কি হইছে একদিন আরো বেশি ও পামু।”
রোজিনা বিরক্ত গলায় বললেন, “দুনিয়া থাইকা লাজ লজ্জা সব উইঠ্যা গেছে। বাপ মায়ের সামনে আমার বউ,আমার বউ করতে তোর শরম করে না?
আমাগো সময় তো তোর বাপে গুরুজনের সামনে আমার দিকে তাকাইয়া ও দেখতো না,আমার বউ কইয়া কথা কওন তো দূরের কথা।
আর এখন কতো অসভ্যতা দেখি,বউয়ের গোলা/মী করে বিয়ার ২ দিন না যাইতেই।”
শাহেদ হাত ধুয়ে প্লেটে পানি দিয়ে প্লেট ধুয়ে দিয়ে বললো, “না মা,আমার একটু ও শরম করে না। ক্যান করে না জানো?কারণ অনামিকা আমার বউ।আমি তো পাশের বাড়ির কারো বউরে আমার বউ কইতাছি না।যারে কালেমা পইড়া বিয়া করছি তারে কইতাছি।যতোদিন বাঁইচা আছি এক পৃথিবী মানুষের সামনে ও চিৎকার কইরা কইতে পারমু,অনামিকা আমার বউ।আমি আমার বউরে অনেক বেশি ভালোবাসি।এটা অসভ্যতা না মা এটা মানসিক শান্তি।
কে কি মনে করবো এতে সেটা আমার চিন্তার বিষয় না।
হালাল সম্পর্কের শান্তি তো এইখানেই মা।”
রোজিনা বেগম আর হাসানুজ্জামান যেনো বোবা হয়ে গেলেন ছেলের উত্তর শুনে।মুহুর্তেই হাসানুজ্জামানের মুখ থমথমে হয়ে গেলো।
চলবে……
রাজিয়া রহমান