#তুমি_অপরূপা (০৭)
সিরাজ হায়দারের জ্বর রাতে আরো বেশি হলো। জ্বরের প্রলাপে সিরাজ হায়দার অন্তরা অন্তরা বলে ডাকতে লাগলেন।সালমা বসে বসে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে।
মেয়েরা সবাই ঘুমাচ্ছে। বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছে সালমা একা।দুচোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু কিন্তু বুকের ভেতর অস্থিরতা।
অনামিকাও অন্তরার মতো করবে না তো!
নিজেদের পাপের শাস্তি কি তবে আল্লাহ এভাবেই দিয়ে দিচ্ছেন তাদের?
বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে অনামিকা।দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে সে।অথচ সে এক ফোঁটা ও ঘুমাতে পারে নি। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার।শাহেদ কি বললো এটা?
সত্যি কি শাহেদের পরিবার আসবে না?
শাহেদকে ছাড়া অন্য কাউকে তো অনামিকা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।কেনো ভাববে সে?
শাহেদের মতো করে কেউ তাকে ভালোবাসতে পারবে?
এই যে রাস্তায় হুট করে চুমু খাওয়া,রিকশায় বসলে শক্ত করে হাত চেপে ধরা,লেপটে যাওয়া চোখের কাজল মুছে দেওয়া,রিকশায় বসলে হঠাৎ করেই চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে এলো চুলে নাক ডুবিয়ে দেওয়া এসব কি অন্য কেউ করবে কখনো?
কাঁদতে কাঁদতে অনামিকা সিদ্ধান্ত নিলো আগামীকাল সে শাহেদের সাথে দেখা করবে।যেভাবেই হোক যাতে তার বাবা মা’কে সে পাঠানোর ব্যবস্থা করে সে ব্যাপারে কথা বলবে।
শাহেদের বাবা হাসানুজ্জামান ভাতে ডাল মাখতে মাখতে শাহেদকে বললো,”তোর ফুফাতো বোন রেনু আসছে যে বিকেলে দেখছস?”
শাহেদ কিছু বললো না। সকালে অনামিকার সাথে কথা বলার পর থেকে শাহেদের সাথে বাবা মায়ের সাথে এক দফা ঝগড়া হয়ে গেছে। হাসানুজ্জামান কিছুতেই অনামিকাকে বিয়ে করাবেন না বলে জানিয়ে দিলেন।তিনিই দুপুরে কল দিয়ে বোনের মেয়েকে বাড়িতে এনেছেন।
খেতে বসে তাই ছেলেকে আবারও বললেন,”তোর ফুফুর লগে আমার আগেই কথা হইছে।রেনুরে আমি তোর বউ বানামু।বিয়াতে রেনুর বাপ ৩ লক্ষ টাকা দিবো।তোরে বিদ্যাশ পাঠামু আমি।ইদ্রিসের পোলা কুদ্দুসের লগে কথা হইছে।১ মাসের মইধ্যে ভিসা পাঠাইবো।টাকা লাগবো ৪ লক্ষ।আমি ৫০ হাজার দিতে পারমু বাকি টাকা তোর শশুর বাড়ি থেকে নিমু।আর কাজ ও ভালো। উট,ছাগল চড়াবি মাঠে।ঝামেলার কিছু নাই।একটু রোইদ বেশি এই ছাড়া সবই ঠিক আছে। ”
শাহেদ খাওয়া শেষ করে উঠে বললো, “আব্বা শুনেন,আবারও কইতেছি আমি,অনামিকা ছাড়া কাউরে বিয়া করমু না।দরকার হইলে বিদ্যাশ যামু না আমি।”
হাসানুজ্জামান পানির জগ একটা আছাড় মে/রে বললেন,”বান্দির পোলারে আমি এতো ক্ষণ ধইরা বুঝাইতেছি আর ও কি বুঝছে?
আমি সিরাইজ্জার হাড়ির খবর ও জানি বুঝছস।ও পারবো তোরে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করতে?
পারবো না।আর ওর মাইয়াগো চরিত্র ও ভালা না।একটা তো কার লগে পালাইছে সেটা ও কেউ জানে না।ওই ঘরের মাইয়া আমি ঘরে তুলমু না।আগামী সপ্তাহের মধ্যে তোর বিয়া হইবো রেনুর লগে।”
শাহেদ জবাব না দিয়ে চলে গেলো।
পরদিন সকালে অনামিকা কলেজে এলো। শাহেদ আগেই অপেক্ষা করছিলো। অনামিকা শাহেদের দিকে তাকাতেই শাহেদ দেখলো অনামিকার চোখ ভিজে আছে। পুরো পথ এই মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসেছে সে নিশ্চিত।
মুহূর্তে শাহেদ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।অনামিকা কিছু বলার আগেই শাহেদ বললো, “আজকেই আমরা বিয়ে করবো অনামিকা। আমি বাড়িতে বুঝাইতে কম চেষ্টা করি নাই।আব্বা ১ সপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়ে করাবে বলে সিদ্ধান্ত ও নিয়ে নিছে।আমার কাছে তোমাকে নিজের করার বিকল্প কোনো উপায় নাই আর।”
আঁতকে উঠে অনামিকা বললো, “না না,এটা কেম্নে সম্ভব!
বড় আপা যেই পথে হাঁটছে সেই পথে আমি হাঁটমু না।আব্বা এই আঘাত আর সহ্য করতে পারবো না। আপনি বাড়িতে যেভাবেই পারেন বুঝাইতে চেষ্টা করেন।”
শাহেদ কপাল কুঁচকে বললো , “সোজা কথা কই শুনো,আব্বা রাজি হইবো যদি বিয়াতে তোমার আব্বা যৌতুক দিতে পারে ৩-৪ লক্ষ টাকা তাইলে।এবার তুমি কও তোমার বাপ কি পারবো?”
অনামিকার মুখ শুকিয়ে গেলো এই কথা শুনে। মাথা নাড়িয়ে বললো, “আমার আব্বার অবস্থা তো জানেনই আপনি। অসম্ভব আব্বার পক্ষে।”
শাহেদ বললো, “তাইলে বলো এবার উপায় কি?
আমি যা কই সেটা শুনো তুমি, আমরা বিয়া কইরা নিলে তো আর কারো কিছু করার থাকবো না।একবার বিয়া হয়ে গেলে আমার বাপে না মাইনা নিয়া কই যাইবো। ”
অনামিকা বললো, “আমার আব্বা?”
শাহেদ বললো, “তোমার আব্বাও হয়তো একটু কষ্ট পাইবো এখন কিন্তু কয়দিন আর।কিছুদিন গেলে সব ভুলে যাইবো সবাই।ভাইবা দেখো অনামিকা,যদি আমরা নিজেরা বিয়া না করি তবে এই জন্মে আমি আর তুমি এক হইতে পারমু না।এইটা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।”
অনামিকা ভেবে দেখলো শাহেদ ভুল বলে নি। শাহেদের কথায় রাজি হয়ে গেলো অনামিকা।
সেদিন বিকেলেই শাহেদ আর অনামিকা বিয়ে করে নিলো।
বিয়ের পর শাহেদ অনামিকাকে বাড়ি যেতে দিলো না।নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো।
হাসানুজ্জামান বারান্দায় বসে তার বোন রাবেয়ার সাথে কথা বলছে। অনামিকার হাত ধরে শাহেদ বাড়িতে এসে বাবা মাকে সালাম করলো দুজনে।
হাসানুজ্জামান হতভম্ব হয়ে গেছেন।শাহেদ হেসে বললো, “আব্বা,বিয়া কইরা বউ নিয়া আসছি আব্বা।শ্বশুর বাড়ি থাইকা ৩-৪ লাখ টাকা যৌতুক নিয়া কি করমু যদি সারাজীবন যারে নিয়া সংসার করমু সে নিজের মনের মানুষ না হয়।দরকার নাই আমার ৩-৪ লাখ টাকা, দরকার নাই আমার বিদেশ। ”
পায়ের জুতা খুলে হাসানুজ্জামান ছেলের গালে মারতে মারতে বললেন,”কু*ত্তার বাচ্চা,তুই এখনই আমার বাড়ি থাইকা বের হয়ে যা।তোর মতো পোলা আমার দরকার নাই। আমার কথার দাম তোর কাছে যখন নাই তখন আমার ঘরে ও তোর জায়গা নাই।আমি ও দেখমু এই ভালোবাসা,প্রেম পিরীতি দিয়া পেট ভরে কয়দিন!দুনিয়া এতো সোজা না।বাইর হ আমার বাড়ি থাইকা।”
শাহেদের মা রোজিনা অনামিকার মা বাবা নিয়ে গালাগালি করতে লাগলো।
শাহেদ হেসে অনামিকাকে নিয়ে বের হয়ে এলো। অনামিকার হাত ধরতেই টের পেলো অনামিকা কাঁপছে। নিরবে দুই চোখের জল ফেলছে অনামিকা।
শাহেদ অনামিকার হাত ধরে বললো, “ভয় পাইও না।তোমার দায়িত্ব যখন একবার নিছি তখন যতক্ষণ নিঃশ্বাস আছে এই দেহে ততক্ষণ তুমি আমারই থাকবা।আমার বুকে থাকবা।”
শাহেদ অনামিকাকে নিয়ে খালার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো।
হাসানুজ্জামান আর রোজিনা দুজনেই বের হয়ে সিরাজ হায়দারের বাড়িতে গেলো। সিরাজ হায়দার বারান্দায় রঙ চা দিয়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন।গায়ে একটা ছেড়া চাদর।গা এখনো গরম তার।এই ইইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে তার শীত শীত লাগছে।
হাসানুজ্জামান গিয়ে সিরাজ হায়দারের কলার চেপে ধরলেন,তারপর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে বললেন,”আমার পোলার পিছনে নিজের মাইয়ারে লাগাইয়া দিলি?তোগো তো রক্তই নষ্ট রক্ত।তুই বিয়া করছস চুরি কইরা মাইয়া ভাগাইয়া আইন্না,তোর বড় মাইয়া এ গেছে সেই পথে।এখন তোর মাইজ্জা মাইয়া ও আমার পোলার মাথা খাইয়া আমার পোলার লগে ভাগছে।”
রোজিনা সালমার সামনে গিয়ে বললো, “মাইনসের সহজ সরল পোলাগো মাথা খাওন কি আপনি শিখান মাইয়াগোরে?
আমার বোকাসোকা পোলার মাথা কেম্নে খাইছে আপনার মাইয়া?আমি নিশ্চিত আমার পোলার লাইগা তাবিজ করছেন আপনারা মা মাইয়া।
আইজ আমার পোলারে বিয়া কইরা আমার কোল থাইকা কাইড়া নিছে আপনের মাইয়া।মাইয়াগোরে তো মানুষ বানান নাই,বানাইছেন বাজারের ন**টি।পোলাগো মাথা নষ্ট করে এজন্য। ”
সিরাজ হায়দার আর সালমা কিছুই বুঝতে পারলো না প্রথমে। পরে বুঝতে পারলো অনামিকা শাহেদকে বিয়ে করেছে।
চেঁচামেচি শুনে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ও আশেপাশের মানুষ এসে হাজির হয়েছে। পরক্ষণেই সারা পাড়া রটে গেছে অনামিকাও অন্তরার মতো পালাইয়া গেছে।
লজ্জায়,অপমানে সইতে মা পেরে সালমা তখনই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো।
চলবে….
রাজিয়া রহমান