#তুমি_অপরূপা (০২)
সিরাজ হায়দারের ডাক শুনে মিতার মা সুরভি বের হয়ে এলো ঘর থেকে।ভাইয়ের বউকে তাদের কারোরই বিশেষ পছন্দ নয়।এজন্য ভাই যখন ভাবীকে বকাঝকা বা মা/রধোর করে তখন একটা প্রশান্তি অনুভব করে সুরভি। দুই কলম লেখাপড়া করেছে বলে সবসময় অহংকার নিয়ে থাকে সালমা।আশেপাশের বাড়ির মহিলারা বাড়িতে আসলে সুরাইয়া বেগম আর তার মেয়ে সুরভি যখন কার কোথায় কি হলো,কে কি করলো সেসব আলোচনায় ব্যস্ত সালমা তখন অবসর থাকলে বসে বসে কাঁথা সেলাই করে। কতো দেমাগি হলে সবাই ডাকাডাকি করার পরেও গিয়ে বসে কথা বলে না!
উল্টো জ্ঞান দেয় এসব না-কি গীবত করা,নিজের পাপের পাল্লা ভারী করা। এসব শুনলে সুরভির মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারা তো আর বানিয়ে মিথ্যা বলছে না।বরং কেউ কোনো দোষ করলে সেসব একজনকে অন্যজন জানাচ্ছে, আলোচনা করছে।এর জন্য কিসের গুনাহ?
প্রচন্ড গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। মাঠঘাট ফেটে চৌচির। বৃষ্টির জন্য আহাজারি চারদিকে।সুরাইয়া বেগম বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে বসেছেন সুপারি কাটতে।এই শীতল পাটি তার নিজের হাতে বানানো। পাটিবেত কেটে এই শীতল পাটি বানিয়ে বিক্রি করেন সুরাইয়া বেগম। মিতার জন্য টাকা জমাচ্ছেন।নগদ দেড় লক্ষ টাকা হয়েছে তার জমিয়ে জমিয়ে।সেই কথা ঘুণাক্ষরেও ছেলেকে জানান নি তিনি।তিনি আর তার মেয়ে ছাড়া কেউ জানে না।
সুরভি মায়ের পাশে বসতে বসতে বললো, “আজকে খুব শিক্ষা হইবো ভাবীর।”
সুরাইয়া বেগম মেয়েকে এক খিলি পান বানিয়ে দিয়ে বললেন,”ঠিকই আছে।বেহায়া মাইয়া মানুষ, নিজে যেমন মাইয়া ও বানাইছে তেমন। আজকে তো হেই শয়তানি মাইয়া ও নাই,ভাগছে নাগর লইয়া।আজকে কে বাঁচাইতে আইবো মা মা কইরা দেখমু।”
সিরাজ হায়দার বারান্দায় বসে ঘেমে জবজবে শরীর থেকে শার্টটা খুললেন।তারপর ঘরের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, “সালমা নাই নি ঘরে? জবাব দেও না ক্যান?বাইরে আসতে বলছি না আমি?”
রূপা খাবার প্লেট রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের ফর্সা মুখখানা ফ্যাকাশে লাগছে আজ ভীষণ। বড় আপা থাকলে তো আপা প্রতিবাদ করে, বাবার সামনে গিয়ে মা’কে আড়াল করতে যায়।আপা যতবার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বাবা ততবার হাতের লাঠি ফেলে দিয়েছে। কিন্তু আজ কি হবে?
শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে সালমা বের হয়।সিরাজ হায়দার স্ত্রীকে দেখে বললেন, “কই ছিলা?এতো বার ডাকা লাগছে কেনো?”
সালমা জবাব দিতে পারলেন না।সিরাজ হায়দার বললেন,”একটা পাখা দিয়া যাও আর এক গ্লাস লেবুর শরবত বানাও আমার জন্য। আর শুনো,শরবতে চিনি দিও না।একটু নুন দিয়া বানাইলেই হইবো।সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়তেছে।চিনির দাম কতো এখন জানো?শা**লা বাঁইচা থাকন এখন মস্ত বড় অন্যায়।”
সালমা দৌড়ে খাবার ঘরে ঢুকে গেলেন।বলা যায় এক প্রকার পালিয়ে বাঁচলেন তিনি।সুরাইয়া বেগম আর সুরভি কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হলেন।তারা ভেবেছিলেন কি আর হলো কি!
তবে কি সিরাজ হায়দার এখনো কিছু শুনেন নি?
ভাইকে উসকে দিতে সুরভি বললো, “ঘটনা শুনছেন ভাইজান?”
সিরাজ হায়দার পাখা ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন,”কিসের ঘটনা? ”
সুরভি আমতাআমতা করে বললো, “আপনার বড় মাইয়া অন্তরা তো এক পোলার লগে ভাইগা গেছে শুনেন নাই?সারা গ্রামের মানুষ ছি ছি করতেছে।আর আপনি কিছু জানেন না?”
সুরাইয়া বেগম ফোড়ন কেটে বললো, “ও জানবো কেমনে?আমার পোলা কি ঘরে বইসা থাকে?খাটতে খাটতে আমার সোনার চান কেমন শুকাইয়া গেছে। যাগোরে ভালো রাখনের লাইগা কলুর বলদের মতন আমার পোলা কাম করে তারা তো সেই খাটনের দাম দেয় নাই।আমার পোলার মান সম্মান আর রাখলো না।কেমন মা হইলে মাইয়া নাগর লইয়া পালাইয়া যায় বুঝছ না তুই?মা’র লগে যোগসাজশ কইরাই মাইয়া এই কাম করছে।মা যেমনে আমার পোলার লগে পালাইয়া আইছে মাইয়ারেও তেমন বুদ্ধি দিছে পালানোর।ভালা কইরা একটা মা/ইর দিলেই দেখবি তোর বউ গড়গড় কইরা সব কথা কইবো। ”
সিরাজ হায়দার বাজারে থাকতেই খবর পেয়েছেন। এতো দিন যারা তার দোকানে মুখ ও দেয় নি আজ তারাও তার দোকানে একটা সিগারেট নেয়ার জন্য,একটা সাবান নেওয়ার জন্য এসে জিজ্ঞেস করে, “হায়দার ভাই,পোলাডা কেডা?
আগে কেউ টের পায় নাই মাইয়ার যে আরেক পোলার লগে চক্কর আছিলো?
মাইয়ার মা’র তো জানার কথা, মা-রা সবসময় বাড়িত থাকে। মাইয়াগো এজন্যই পড়ালেখা করান উচিত না এতো বেশি।”
এসব কথা সহ্য করতে না পেরেই সিরাজ হায়দার বাড়ি চলে এলেন।লজ্জার চাইতে বুকে কষ্ট জমাট বেঁধেছে বেশি তার।
মায়ের কথা শুনে সিরাজ হায়দারের মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগলো। সালমা এনে শরবত দিলো।শরবত নিতে গিয়ে সিরাজ হায়দার বউয়ের দিকে এক মুহূর্ত তাকালেন।এক মুহূর্ত তাকিয়েই দেখলেন ভীত চোখে ফুটে উঠেছে কেমন আতংক।
সিরাজ হায়দার শরবত শেষ করে মা’কে বললেন,”সবই আমি শুনছি মা।তবে মা,সবসময় সবকিছুতে সালমাকে জড়াইও না।
আর তুমি তো এখন খুশি। খাওনের একটা মুখ কমছে।তোমার সোনার টুকরা ছেলের উপর থেকে একটু চাপ কমছে।নয়তো দেখো না,এই মেয়েকে বিয়ে দিতে গেলেও তো আমার কতোগুলো টাকা খরচ হতো। ”
সুরাইয়া বেগম বুঝতে পারলেন না ছেলে তাকে কটাক্ষ করে কথা বলছে না-কি।
সালমা যেনো হতবাক হয়ে গেলো স্বামীর কথা শুনে। তেমনই হতবাক হয়ে গেলো তার মেয়েরা।রূপা ভাতের থালা রেখে বের হয়ে এলো।গিয়ে অনামিকা আর অনিতার কাছে গেলো। সিরাজ হায়দার ঘরে যেতেই সালমা গেলো পিছন পিছন। সিরাজ হায়দার গিয়ে মেয়েদের পাশে বসলেন।অনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন।তারপর হঠাৎ করেই কাঁদতে লাগলেন।
তার বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় করছে তা কাকে বুঝাবেন তিনি!
বাড়ি ফিরে আর আদরের বড় মেয়ের মুখখানা দেখবে না,মেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে আড়াল থেকে দেখতেন তিনি তা কেউ জানে না।মাঝেমাঝে হাতে টাকা এলে মেয়েদের অগোচরে মেয়েদের স্কুল ব্যাগে টাকা রেখে দিতেন।
আজ তার জোড়ের পাখি থেকে একটা পাখি উড়ে গেলো।
মেয়েদের সাথে কখনো নরম স্বরে কথা বলেন নি তিনি। অথবা মেয়েরা কখনো বাবার সাথে খুব কথা বলতো না।তবুও মেয়েদের প্রতি বাবা হিসেবে ভালোবাসা কম ছিলো না তার।অভাব অনটনে থেকেও কখনো মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ করতে চান নি তিনি।
কখনো ভাবেন নি এভাবে তার মেয়ে কারো হাত ধরে পালিয়ে যাবে।
চোখের পানি মুছে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন,”তোমরা বড় হইছো,নিজেগো ভালো মন্দ নিযেরা বুঝতে শিখছো বা বুঝতে শিখবা।তোমাগো বোইনের মতন যদি তোমাগো ও কাউরে কোনো দিন মনে ধরে, তবে এভাবে আমার বুক খালি কইরা চইলা যাইও না।আমারে একবার জানাইও।আমি মাইনা নিমু।তবুও আমারে কষ্ট দিয়া যাইও না।”
রাতে ঘুমাতে গিয়ে বহুদিন পর সিরাজ হায়দার বউকে নরম গলায় ডাকলেন।সালমা আবারও বিস্মিত হলো। সালমার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,”এতো গুলো বছর তোমার বাবা মা,ভাইয়ের উপর আমার একটা রাগ আছিলো সালমা।তবে সেই রাগ একটু কমলো কবে জানো?যেদিন আমার অন্তরার জন্ম হয়।তারপর আরেকটু কমলো যেদিন আমার অন্তরা আমারে বাবা কইয়া ডাকছে।সেদিন এক মুহূর্তের লাইগা আমার ও মনে হইছে আমার কন্যার মুখে বাবা ডাক শুইনা আমার যেমন আনন্দ হইতাছে তোমার বাবা মায়ের ও তো এই অনুভূতি ছিলো যখন তুমি তাগোরে এইভাবে প্রথম বার বাবা মা বইলা ডাকছো।ছেলে সন্তানের চাইতে মেয়ে সন্তান আমার কাছে বেশি প্রিয় ছিলো। আল্লাহ আমার সেই ইচ্ছে জানে বইলাই আমারে চারটা মেয়ে দিছে। কিন্তু এই চারজনের মধ্যে আমার অন্তরা আছিলো আমার বেশি আদরের।ক্যান জানো?
কারণ আমার অন্তরা যে আমারে প্রথম বার বাবা কইয়া ডাকছে।আমার অন্তরা বাবা কইয়া ডাকছে বইলাই তো আমি জীবনে প্রথম বার জানতে পারছি বাবা হওনের মধ্যে কতো আনন্দ,সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনতে কতো মধুর লাগে।
আইজ যখন আমার মাইয়া আমারে ছাইড়া কারো কাছে চইলা গেলো তখন আমি পুরোপুরি বুঝতে পারছি তোমার বাপ মা,ভাইয়ের কষ্ট সালমা।তাগো উপরে আমার যেই অভিমান আছিলো আইজ তা একেবারে নাই।আইজ আমিও বুঝি তোমার বাপ মায়ের ও বুকের ভেতর এমন ভাংচুর হইছে তুমি আমার হাত ধইরা চইলা আসার পর।
এতো দিন ধইরা কোনো দিন তোমারে আমি কই নাই তোমার বাপ মা’র লগে যোগাযোগ করতে।তারা জানেও না তাদের মাইয়া আদৌও বাঁইচা আছে কি-না। তবে আইজ তোমার কাছে অনুরোধ তাগো লগে তুমি যোগাযোগ করো।সন্তান এভাবে চলে গেলে যে এতো কষ্ট হয় তা যদি আগে জানতাম সালমা তবে মাটি কামড়াইয়া তোমারে হারানোর কষ্ট সহ্য করতাম তাও তোমার বাপ মায়ের বুক থাইকে তোমারে নিয়া পালাইয়া আসতাম না।
আমি জানি অভাব অনটনে মাথা গরম হইলে মাঝেমাঝে তোমার গায়ে হাত তুলি।এতো দিন আমার অন্তরা আছিলো, তোমারে রক্ষা করতো। আজ থাইকা তোমারে রক্ষা করনের কেউ নাই।আমি কথা দিলাম সালমা আমি আর কোনো দিন তোমার গায়ে হাত তুলমু না।আইজ মনে হইতাছে আমি যেমন কারো মাইয়ার গায়ে যখন তখন হাত তুলতেছি শুধুমাত্র সে আমার স্ত্রী এই অধিকারে। আমার মাইয়া যখন আইজ অন্য কারো স্ত্রী হইবো তার স্বামীর ও সেই অধিকার হইবো।সালমা সেও কি এই অধিকারের জোরে আমার আদরের মাইয়ার গায়ে হাত তুলবো?
আমার চারটি মাইয়াই তো তোমার মতো ফর্সা হইছে,তোমারে মা/রলে যেমন তোমার গায়ে দাগ পইরা যায়।আমার মাইয়ার গায়েও তো এরকম দাগ পইরা যাইবো সালমা।
আমার একটুখানি মাইয়া কেমনে সহ্য করবো সেই সাথে যন্ত্রণা!
আমি আগে ক্যান বুঝি নাই সালমা?
আল্লাহ যদি আমার পাপের শাস্তি আমার মেয়েরে দিয়ে দেখায়।এইটা আমি কেমনে সহ্য করমু?”
সিরাজ হায়দার হাউমাউ করে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।নিরবে কাঁদছে সালমা ও।
সালমা নিজে ও মা হবার পর প্রথম বার অনুভব করতে পারলো বাবা মায়ের মূল্য। আর আজ অনুভব করতে পারলো বাবা মা’কে এভাবে ছেড়ে চলে গেলে বাবা মায়ের বুকের ভেতর কতটা রক্তক্ষরণ হয়।যেই রক্তক্ষরণ শরীরের না,বরং ভেতর থেকে একটা মানুষের মনকে ভেঙে চুরমার করে দেয়।আজ বুঝতে পারলো সেদিন বাবা মা’কে ছেড়ে চলে আসার পর বাবা মায়ের কাছে কেমন অসহায়ের মতো লেগেছে।
চলবে…….
রাজিয়া রহমান