স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় অপরূপা জানতে পারলো বড় আপা অন্তরা নাকি কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। ফুফাতো বোন মিতা হেসে বললো, “তোদের রক্তে মনে হয় এই নোংরা ব্যাপারটা আছেরে অপরূপা। দেখ না, তোর মা ও তো এভাবে পালিয়ে বিয়ে করেছে মামাকে। সেই মায়ের মেয়ে তোরা,তুই ও এরকমই করবি।”
রূপার ইচ্ছে হলো একবার বলে, “তাহলে তো তুই ও তোর বাবার মতো তিন বিয়ে করবি।” কিন্তু বললো না রূপা।কাউকে এভাবে অপমান করা রূপার ধাতে নেই।
খবরটা শুনেই রূপার চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ের রক্তাক্ত দেহ।বাবা নিশ্চয় মা’কে ভীষণ মেরেছে এই খবর শোনার পর। রূপার বাবার ধারণা যেখানে যেই অঘটন ঘটে সব কিছুর জন্য রূপার মা সালমা দায়ী। আর বাবাকে ইন্ধন যোগাতে ফুফু আর দাদী তো আছেই।
রূপার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো,প্রচন্ড তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে এলো।ওড়না বড় করে মাথায় টেনে দিলো রূপা।তবুও পথে যেই রূপাকে চিনতে পারলো সেই বললো,”কিরে অপরূপা। তোর বড় বোইন কই?পোলাডা কে রে?”
রূপা জবাব না দিয়ে দ্রুত পা চালালো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মিতা মজা পাচ্ছে ভীষণ। অপরূপা আর মিতা দুজনেই একই ক্লাসে পড়ে। মিতার বাবা মোজাম্মেল তৃতীয় বিয়ে করার পর মিতার মা বাবার বাড়ি চলে এসেছে মেয়েকে নিয়ে আরো দশ বছর আগে। সেই থেকে আর ওই বাড়ির সাথে তাদের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। গতবছর মিতার বাবা মারা যাওয়ার পর সম্পর্ক হওয়ার শেষ সূত্র ও ছিন্ন হয়ে গেলো।
বাড়ি এসে রূপা দেখলো মা রান্নাঘরের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। ছোট বোন অনিতা মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে কান্না করছে তাকে ৫ টাকা দেয়ার জন্য। রাস্তার মাথায় রূপা আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে এসেছে। বুঝতে পেরেছে অনিতা আইসক্রিম খাওয়ার জন্য টাকা চাইছে মায়ের কাছে।
রূপা জানে তার মা কপর্দকহীন,একটা পয়সা ও তার কাছে নেই।
রূপার বাবা সিরাজ হায়দারের বাজারে একটা মুদি দোকান আছে। তার একার আয়ে ৯ সদস্যের বিশাল সংসার চলে। তিনবেলা ৯ জন খেতে গেলে হিসেব করলে ২৭ প্লেট দৈনিক খাবার লাগে তাদের।পরিবারের ব্যয় অনুরূপ আয় নেই তার।পুরুষ মানুষের হাতে টাকা পয়সা যতো কমতে থাকে তার মেজাজ তত বাড়তে থাকে।
রূপার বাবার অবস্থা ও তেমন। তার দোকানের পাশেই বড় একটা মুদি দোকান দিয়েছে গ্রামের সাদেক আলী। ৮ বছর সৌদি আরব থাকার পর দেশে এসে বাজারে বড় করে মুদি দোকান দেয়ার পর রূপার বাবার দোকানের বিক্রি-বাট্টা কমতে শুরু করে।
রূপারা ৪ বোন,তার সাথে মিতার পড়াশোনা, জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া সব কিছুর যোগান দিতে সিরাজ হায়দারের নাকানিচুবানি অবস্থা এখন।
রূপা ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে অনিতার হাতে দিয়ে বললো, “যা,দুইটা আইসক্রিম আনবি।একটা তোর আর আরেকটা মেজো আপার জন্য।যা গরম পড়ছে,আপা ঘেমে গেছে হয়তো পড়ার টেবিলে।”
অনিতা টাকা নিয়ে ছুটতে ছুটতে গেলো। মিতা সালমা বেগমের হাত ধরে বললো, ” অন্তরা আপা না-কি পালাইয়া গেছে মামী?ঘটনা কি সত্যি না-কি? এজন্য আপনে এরকম তব্দা মাইরা রইছেন মামী?”
সুরাইয়া বেগম রূপার দাদীর নাম।বারান্দায় বসে বসে সুপারি কাটছেন।মিতার কথা শুনে বললেন,”ঠিকই আছে,আল্লাহর বিচার আল্লাহ করছে।মা’র যেমন লাজলজ্জা আছিলো না, আমার পোলার গলায় ঝুইলা পড়ছে মাইয়া ও হইছে তেমন। গাভী যেমন, বাছুর তো তেমনই হইবো।”
মিতা হাসতে হাসতে ঘরের দিকে চলে গেলো। সালমা বেগম সবার অলক্ষ্যে চোখ মুছলেন।
একটু পর অনিতা এলো আইসক্রিম নিয়ে,অনিতার হাতে আইসক্রিম দেখে সুরাইয়া বেগম ডাক দিলেন অনিতাকে।একটা আইসক্রিম অনিতার থেকে নিয়ে মিতাকে ডাক দিলেন।
ক্রুদ্ধ হয়ে অনিতা বললো, “এইটা কি হইলো দাদী,আপনে আমার থেকে নিছেন নিজে খাইবেন বলে। এখন মিতা আপারে দিলেন ক্যান?আমার আইসক্রিম দেন আমারে,আমি এটা অনামিকা আপার জন্য আনছি।”
সুরাইয়া বেগম খেঁকিয়ে উঠে বললেন,”মুখপোড়া মাইয়া,বান্দর কোনহানকার। আমার নাতনি স্কুল থাইকা কতো কষ্ট কইরা আইছে তা চোখে পড়ে না তোর?মা মাইয়া ৫ জন মিইল্লা আমার পোলারে ধ্বংস করার জন্য বইসা রইছে।আমার নাতনিরে পথের কাঁটা ভাবে। ভালোমন্দ কিছু খাইতে দেয় না।আল্লাহর বিচার আল্লাহ করে ঠিকমতো। ”
সালমা উঠে এসে অনিতার পিঠে ধুমধাম কয়েকটা কি/ল বসিয়ে দিলো।যার ফলে অনিতার আইসক্রিম মাটিতে পড়ে গেলো। মুহুর্তের মধ্যে অনিতা তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো। মায়ের হাতে পি/টুনি খেয়ে অনিতার অভ্যাস আছে, অনিতা কান্না করছে তার আইসক্রিমের জন্য।কতো দিন পরে আজ আইসক্রিম খেতে পেলো তাও খাওয়া হলো না দাদীর জন্য।
১০ বছর বয়সী অনিতার কাছে এর চাইতে শোকের আর কিছু নেই।বাড়িতে যে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো সেসব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই।
মিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে হাসতে লাগলো অনিতার দিকে তাকিয়ে। অনিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো, “আহ!কি যে স্বাদ। এতো ভালো লাগতাছে আইসক্রিমটা!”
এসব শুনে অনিতার বুক ফেটে কান্না এলো। মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগলো অনিতা।
রূপা ঘরে ঢুকে অনামিকার পাশে গিয়ে বসলো। সামনে ইন্টার পরীক্ষা অনামিকার।অনামিকা পড়তে বসেছে। অপরূপা গিয়ে বোনের কাঁধে হাত রাখতেই অনামিকা নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো। অপরূপা ও কাঁদতে লাগলো নিঃশব্দে। বাহিরের কেউ জানতে পারলো না ঘরের ভেতর দুই বোন অঝোরে কান্না করছে।
অপরূপার চোখ মুছে দিয়ে অনামিকা বললো, “আব্বা আজকে আম্মাকে আস্ত রাখবে না রূপা।আম্মার জন্য আমার ভীষণ ভয় হয়।”
অপরূপা ভয়ার্ত স্বরে বললো, “আপা কার সাথে গেছে রে আপা?আমরা একই সাথে, একই বিছানায় শুয়েও কিছুই টের পাই নি কেনো?”
অনামিকা দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বললো,”আমিও তো সেটাই ভাবছি রূপা।আর ছেলেটা কে তাও তো জানি না। ”
রূপা স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করে সবে খাবারঘরে গিয়ে ভাত দুই লোকমা মুখে দিলো। সেসময় শুনতে পেলো বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সিরাজ হায়দার হুংকার দিয়ে বলছেন,”অন্তরার মা!”
বাবার চিৎকার শুনে রূপার হাত থেকে ভাতের প্লেট পড়ে গেলো মাটিতে।কতোগুলো ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চারদিকে।
সালমা বেগম স্বামীর ডাক শুনে ছুটে এসে খাবার ঘরে লুকালেন।মেয়েকে খাবার ঘরে দেখে কিছুটা লজ্জা পেলেন সেই সাথে ভয়ে আপনাতেই তার চোখের জল চলে এলো। আজ তাকে কে রক্ষা করবে?
সুরাইয়া বেগম ছেলেকে দেখেই কেঁদে উঠে বললেন,”বাবারে,তুই আইছস?সব্বনাশ তো কইরা দিছে তোর মুখপুড়ি মাইয়া।সব তোর বউয়ের দোষ। মাইয়ারে সে চোখে চোখে রাখতে পারলো না। আর বুঝি মুখ দেখানো যাইবো না কাউরে।”
সিরাজ হায়দার আবারও হুংকার দিয়ে বললেন,”সালমা…..”
চলবে……..
রাজিয়া রহমান
#তুমি_অপরূপা(০১)