#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_১৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
পৃথুলা নিজের বাসায় ফিরে এসেছে। বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা দরজা খোলার শব্দ শুনে পাশের রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। প্রায় ভূত দেখার মতো অবাক হয়ে বললেন,
“এতদিন কই আছিলা?”
প্রথম দিকটায় পৃথুলা বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। অবশ্য এতকিছু ভাবারও নেই। সবাই তো আর দেশের নিউজ নিয়ে পড়ে থাকে না। এত মাথা-ব্যথাও নেই তাদের। কোথায় খু-ন হচ্ছে আর কোথায় কে কি’ড’ন্যা’প হচ্ছে এসব খোঁজ রাখার সময় অধিকাংশ মানুষেরই নেই। বলা যায়, এই খোঁজ রাখার প্রয়োজনও মনে করে না সকলে। আর তো তাই বাড়িওয়ালাও পৃথুলাকে দেখে কোনোকিছু আন্দাজ করতে পারেনি।
পৃথুলা স্মিত হেসে বলল,
“এক বান্ধবীর বিয়ে ছিল চাচা। সেখানে গেছিলাম।”
“গেছ ভালো কথা। বইলা যাইবা না? ফোনও তো বন্ধ কইরা রাখছ।”
“ফোন নষ্ট হয়ে গেছে চাচা। ব্যস্ত ছিলাম তাই ঠিক করা হয়নি। আজ করব।”
“ওহ। আইচ্ছা যাও হাত-মুখ ধুইয়া বিশ্রাম নাও একটু।”
পৃথুলা রুমে ঢুকে আগে শাওয়ার নিল। তোয়াল চুল থেকে খুলে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল সে। চুলের পানিতে বিছানা ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার কিছুই ভালো লাগছে না। বারংবার আরশানের কথা মনে হচ্ছে।
.
.
আরশান তার নিজের অফিসে বসে আছে। সামনে শিমুল। আরশানকে চিন্তিত দেখে শিমুল জানতে চাইল,
“আপনি কি পৃথুলাকে মিস করছেন?”
আরশান ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল। সে পৃথুলার কথা ভাবছিল না বরং রাফসানকে কী করে ছাড়ানো যায় সেটা নিয়ে ভাবছিল। সে নড়েচড়ে বসে বলল,
“এরকমটা মনে হওয়ার কারণ?”
“কোনো কারণ নেই স্যার। জাস্ট মনে হলো, তাই এমনিই বললাম।”
“আমি ভাবছি, রাফসানের কেসটা নিয়ে। এখনো কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেলাম না। এভাবে আর কতদিন রাফসানকে জেলে রাখব?”
“কিছু তো করার নেই স্যার। আর প্রমাণ ছাড়া তো তার কোনো শাস্তিও আদালত দিতে পারবে না। ভালো কোনো এডভোকেট ধরতে হবে। কোনোভাবে যদি জামিন করানো যায় আরকি!”
“কিছু তো একটা করতেই হবে। এভাবে হাত গুটিয়ে তো আর বসে থাকা যাবে না।”
“আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। দেখবেন, সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে।”
আরশান কিছু বলল না। শিমুল বলল,
“পৃথুলা মেয়েটাকে মিস করছি। শেষবার দেখাও হলো না।”
“মায়ায় পড়ে গেছ?”
“মেয়েটাই ওরকম। আপনি নিজেও তো মায়ায় পড়েছেন।”
“কী যা তা বলছ!”
“সত্যি বলছি।”
“অযথা বিষয় নিয়ে তর্ক করছ শিমুল। এখন আমার কথা শোনো, পৃথুকে সন্দেহের বাইরে কিন্তু রাখা যাবে না। যেহেতু শিলার বোন তাই নজরে রাখতে হবে। লোক লাগাও। ওর সব আপডেট আমার চাই।”
“জি স্যার। আমি সব ব্যবস্থা করছি। একটা কথা বলব?”
আরশান চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
“বলো।”
“আপনার মুখে পৃথু ডাকটা অসম্ভব ভালো লাগে। কেন বলুন তো?”
আরশান স্তব্ধ হয়ে যায়। পৃথুলার পাগলামি, বকবকানি এখন খুব মনে পড়ছে। সে আনমনেই বলল,
“জানিনা।”
_______
দোলা শপিং-এ এসেছে কিছু টুকটাক কেনাকাটা করার জন্য। এই একটা কাজ করলেই তার মন অল্পটুকু হলেও ফ্রেশ হয়। তাই নিজেকে এবং মনকে একটু শান্ত করতেই সে শপিং করতে এসেছে। নিজের জন্য সে কিছুই কিনল না। মায়ের জন্য শাড়ি এবং বাবার জন্য শার্ট কিনে সে অর্নামেন্টসের দোকানে ঢোকে। মায়ের জন্য চুড়ি নিতে হবে। চুড়ির কালেকশন দেখতে দেখতে তার নজর যায় একজোড়া দুলের দিকে। সে সেলসম্যানকে ডেকে বলে,
“ভাইয়া, ঐ দুলটা দেখান তো।”
সেলসম্যান দুল নামিয়ে দিল। দোলা একটা দুল পরে আয়নায় নিজেকে দেখছিল। ঠিক তখনই পেছন থেকে পুরুষালী কণ্ঠে ভেসে আসে,
“স্বর্গের পরীর মতো লাগছে।”
দোলা পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। হিমেল দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে। মাকে ছাদে হাই দিতে দিতে এখন মেয়েকেও ফলো করা হচ্ছে। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দোলা বলল,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“এই শপিংমল আসা আমার নিষেধ নাকি?”
“নিষেধ নয়। কিন্তু আপনি আমাকে ফলো করে এসেছেন।”
“না তো! আমি তো এখানে এসেই আপনাকে দেখলাম। ফলো করিনি সত্যি বলছি।”
দোলা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল,
“বেশ! এবার তাহলে যান।”
“কোথায় যাব? আমি তো এই দোকানে এসেছি কিছু কেনার জন্যই।”
দোলা আর কথা বাড়াল না। কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে। সে নিজের মতো গয়না দেখছে। হিমেল দেখছে পায়েল। সে কেশে দোলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,
“শুনছেন?”
দোলা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“সমস্যা কী? বিরক্ত করছেন কেন? জেলের ভাত খাওয়ার শখ জেগেছে?”
“প্লিজ কুল, কুল! রেগে কেন যাচ্ছেন? পুলিশ হয়েছেন বলে কি কথায় কথায় জেলে ঢোকানোর ভয় দেখাবেন?”
“ভয় দেখাব কেন? ডিরেক্ট জেলে নিয়ে পুরব। ই’ভ’টি’জিং করার শখ মিটিয়ে দেবো।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ্! আমি ভালো ছেলে। ই’ভ’টি’জিং করি না। একটু সাহায্য চাওয়ার জন্য ডেকেছিলাম। দেখুন তো, এখানে কোন পায়েলটা সুন্দর।”
“আমি দেখব কেন?”
“আসলে এক বান্ধবীকে গিফ্ট করব। কিন্তু মেয়েদের গয়না সম্পর্কে আইডিয়া নেই আমার।”
দোলা নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল,
“পারব না।”
এরপর সে কিছু না কিনেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। হিমেল মুচকি হেসে মনে মনে বলে,
“কতদিন আমায় ইগনোর করতে পারো,আমিও দেখব।”
.
.
গত দু’দিন ধরে পৃথুলা বাড়িতেই রয়েছে। অফিসে এখনো যায়নি। বসের যে কত কথা শুনতে হবে তা কে জানে! মনে শঙ্কা এবং ভয় নিয়েই সে তৈরি হয় আজ অফিসে যাওয়ার জন্য। স্বাধীন জীবনের অভ্যাস যেন হুট করেই বিলীন হয়ে গেছে। কেন যে মানুষটা তাকে কি’ড’ন্যা’প করল এবং কেনই বা এভাবে মায়ায় জড়িয়ে ছেড়ে দিল। আর হয়তো কখনো দেখাও হবে না। আরশানের ঠিকানা, ফোন নাম্বার কোনোটাই সে জানে না। চেনার মধ্যে এক চেনে শুধু আতোয়ার চৌধুরী কোম্পানীটা; যেখানে আরশান তাকে নিয়ে গেছিল। কিন্তু সেখানেও তার একা যেতে সাহসে কুলাবে না। কেমন যেন গা ছমছম করা ভয় সেখানে! আরশানের সঙ্গে করা দুষ্টুমিগুলোর কথা ভাবতেই তার ওষ্ঠে হাসি ফুটে ওঠে।
সময়গুলোর কথা ভাবতে ভাবতেই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। বাস স্ট্যান্ডে লোকজনের ভিড় নেই। অবশ্য বাসও নেই। বাসের দেখা না পেয়েই একেকজন সিএনজি, রিকশা করে নিজেদের গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। পৃথুলা হাত-ঘড়িতে সময় দেখল। এখনো তার হাতে অজস্র সময় রয়েছে। তাই সে আরেকটু অপেক্ষা করতে চায় বাসের জন্য। সে স্ট্যান্ডে হাঁটাহাঁটি করছিল আপনমনে। ঠিক তখনই কেউ তাকে ঝড়ের গতিতে জায়গা থেকে সরিয়ে নেয়। পৃথুলা হকচকিয়ে গেলেও খেয়াল করেছে যে একই সময়ে একটা বাইকও তাকে পাস করে গেছে। সে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখতে গেলে আগন্তুক পৃথুলার গাল চেপে ধরে রেখে বলে,
“রাস্তার কিনারে হাঁটাহাঁটি করা লাগে কেন?”
পৃথুলা বিস্মিত, স্তব্ধ। কিছুক্ষণ আগের কথা ভুলে গেছে আরশানকে দেখে। খুশিতে সে লাফিয়ে উঠে বলে,
“আপনি! হায় আল্লাহ্! আমি তো সারপ্রাইজড হয়ে গেছি।”
“এভাবে রাস্তায় আর হাঁটাহাঁটি করবেন না।”
আরশানের কণ্ঠে তীব্র রাগ। আর একটু হলেই বাইকে থাকা ছেলেটি ছু-রি দ্বারা আঘাত করত পৃথুলাকে। ভাগ্যিস দৃশ্যটা দেখেনি পৃথুলা।
পৃথুলা খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে,
“আমি তো ভাবতেই পারিনি আবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।”
আরশান এ কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
“আপনাকে না বলেছিলাম, মাস্ক পরে থাকবেন?”
“গরমের মধ্যে মাস্ক পরতে ভালো লাগে না। চলুন কোথাও গিয়ে বসি।”
“আমার সময় নেই। আসছি।”
আরশান চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই পেছন থেকে পৃথুলা বলে,
“সময় নেই তবে এখানে এসেছিলেন কেন? ঐ ছেলেটির হাত থেকে আমায় বাঁচানোর জন্য? আপনি জানলেন কী করে কেউ আমাকে মা-রা-র জন্য আজ এখানে আসবে? বাই এনি চান্স, আপনিই ওদের পাঠাননি তো মিস্টার আরশান চৌধুরী?”
আরশান পৃথুলার মুখপানে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]