#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৫।
বাড়িটা পুরোনো। তবে দেখতে ভীষণ সুন্দর। চারদিকে গাছপালা আর সুন্দর আলোকসজ্জায় সাজানো। এই বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই খুব শৌখিন মানুষ। কী সুন্দর করে সবকিছু সাজিয়ে রেখেছেন।
গাড়ি থেকে নেমেই পৃথা উৎফুল্ল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘এটাই কি আপনার বাড়ি?’
অর্ণব তার দিকে চেয়ে বলল,
‘না, এটা অন্য একজনের বাড়ি। আমরা আজ থেকে এই বাড়িতেই ভাড়া থাকব।’
পৃথা মুখ ছোট করে বলল,
‘ওহহ।’
ভেবেছিল, এটাই বোধ হয় তার শ্বশুরবাড়ি। ছিমছাম, তবে চমৎকার সুন্দর।
অর্ণব পৃথাকে নিয়ে বাড়ির গেইটের সামনে যায়। কেচি গেইটে ঝুলে থাকা তালাটা দুবার বাড়ি দিয়ে ডাকে,
‘চাচা, আমরা এসেছি। গেইট খুলুন।’
তার ডাকের কিয়ৎক্ষণের মাঝেই একটা মধ্যবয়সী লোক গেইটের সামনে এলেন। তিনি চশমাটা ভালো ভাবে মুছে চোখে লাগিয়েই দাঁত বের করে চমৎকার ভাবে হাসলেন। আহ্লাদ নিয়ে বললেন,
‘বউমা, তুমি এসেছ?’
পৃথা অবাক হলো। তাকে বউমা বলল? তাও আবার এতটা আবেক নিয়ে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সে। অর্ণব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চাচাকে হেসে বলল,
‘জি চাচা, বউমা এসে পড়েছে। আজ থেকে আপনার বউমা এখানেই থাকবে।’
চাচা খুশি হয়ে দ্রুত গেইটের তালা খুলে দিলেন। অর্ণব পৃথাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। চাচা বললেন,
‘আজকে আমার এখানে থাক। আমি খাবার রেঁধে রেখেছি। খাওয়া দাওয়া করে আজ আমার সাথেই ঘুমাবে।’
‘না না চাচা, আমি উপরে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। এমনিতেই আমাদের জন্য এতক্ষণ জেগে ছিলেন, এখন গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’
‘বউমা, তোমার কোনোপ্রকার কষ্ট হলে আমাকে বলবে কিন্তু।’
পৃথা মাথা হেলিয়ে বলল,
‘আচ্ছা।’
‘ঠিক আছে বাবা, যাও বউমাকে নিয়ে উপরে যাও। আমি গেইটে তালা দিয়ে রুমে যাচ্ছি।’
অর্ণব সিঁড়ি বেয়ে পৃথাকে নিয়ে দুতালায় গেল। উপরে উঠতেই পৃথা বুঝতে পারল, বাড়িটা আসলে একটু বেশিই পুরোনো। দরজাটাও নিচের দিকে ভেঙে আছে। ভেতরের অবস্থা কেমন কে জানে।
অর্ণব তালা খুলে। পৃথাকে বলে,
‘চলো।’
পৃথা অর্ণবের পেছন পেছন বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। তবে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে তার ধারনা সব পাল্টে যায়। বাসার ভেতরের অবস্থা পুরো অন্যরকম। কী সুন্দর, পরিপাটি। কোথাও একটুও বিশৃঙ্খলাও নেই। সবকিছু নিঁখুত ভাবে গুছানো। খুব বেশি কিছু না থাকলে একটা ছোট্ট সংসার পাতার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই আছে। পৃথা বেশ অবাক হয়। ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখে। অর্ণব বলে,
‘পছন্দ হয়েছে?’
পৃথা অবাক হয়ে বলে,
‘এসব কিছু কি আপনি এনেছেন? নাকি আগে থেকেই ছিল?’
‘আগে থেকে কী করে থাকবে। সব আমাদের জিনিস।’
‘আমাদের মানে? আপনার সাথে কি এখানে আগে আর কেউ থাকত? এই, আপনি আবার আগে থেকেই বিবাহিত নন তো? এসব দেখে তো মনে হচ্ছে, আপনি আগে থেকেই সংসার করে আসছেন। আমাকে সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি বিবাহিত?’
অর্ণব শব্দ করে হাসে। পৃথার দিকে তাকাইতেই সে আরো জোরে হাসতে আরম্ভ করে। মেয়েটার চোখ মুখ কেমন কুঁচকে আছে, যেন এক্ষুনি সে কেঁদে ফেলবে। পৃথা রাগ দেখিয়ে বলে,
‘আশ্চর্য, হাসছেন কেন? আমি কি কোনো হাসার কথা বলেছি?’
অর্ণব হাসি থামায়। বলে,
‘হ্যাঁ, আমার আগে একটা সংসার ছিল। একটা সুন্দরী বউ ছিল। তবে হুট করেই একদিন আমার বউ আমাকে ভুলে যায়। আর তার আমার কথা একটুও মনে পড়ে না, এই সংসারের কথা মনে পড়ে না। সে আমার থেকে অনেক দূরে সরে যায়। আমি চেয়েও আর তাকে ফেরাতে পারিনি। তাই আজ তার প্রতি অভিমান করে তোমায় বিয়ে করেছি। এখন সেও বুঝুক, আমি তাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারি। তাকে আর আমার প্রয়োজন নেই, কারণ এখন আমার পৃথা আছে।’
পৃথার মনটা বিষাদে ভরে যায়। সে কখনও ভাবেওনি যে লোকটা বিবাহিত হতে পারে। আগে জানলে এমন বিবাহিত ছেলেকে সে কখনোই বিয়ে করত না। পৃথার চুপসে যাওয়া চোখ মুখ দেখে অর্ণব বলল,
‘কী হলো, কষ্ট পেলে?’
‘আপনি আমায় আগে কেন বলেননি যে আপনি বিবাহিত?’
‘বললে বিয়ে করতে?’
‘না, করতাম না। কখনোই করতাম না।’
‘সেই জন্যই বলিনি। সেসব কথা এখন থাক। তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার আনছি।’
পৃথা কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রুমে চলে যায়। অর্ণব বুঝতে পারে, পৃথা কষ্ট পেয়েছে। পাক, সাময়িক কষ্টে কারোর খুব বেশি ক্ষতি হয়না।
পৃথা শোয়ার রুমে গিয়ে দেখে, সেই রুমটাও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছোট্ট একটা খাট পাতা। পাশে ছোট এক টেবিল। ডানপাশে একটা আলমারি। আর তার পাশেই একটা বড়ো আয়না। রুমের এক কোণে একটা বুক সেলফও আছে।
পৃথা তার ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে ব্যাগ থেকে তার একটা জামা বের করে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখে, অর্ণব তার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। লুঙ্গি আর একটা পাতলা টি শার্ট গায়ে অর্ণবকে বেশ স্বামী স্বামী লাগছে। পৃথা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে বলে,
‘আপনার আগের বউ যদি এখন হুট করে আবার ফিরে আসে, তখন?’
অর্ণব তাকিয়ে বলে,
‘তখন কী, দুই বউ নিয়ে সুন্দর সংসার করব।’
পৃথা ক্ষেপে যায়। অর্ণবের দিকে ফিরে বলে,
‘যদি এমন চিন্তা করে থাকেন, তাহলে আগেই বলে দিন, আমি আবার বাবার কাছে চলে যাব।’
অর্ণব মৃদু হেসে বলে,
‘চলে যাও।’
পৃথা রাগে গদগদ হয়ে বলে,
‘এখন তো বলবেনই, চলে যাও। বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে, এখন তো আর চাইলেই কিছু করতে পারব না। জেনে শুনে এখন আমি আমার সাথে এমন করবেন। আমার আপনাকে বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে।’
অর্ণব খাবারটা পাশে রেখে পৃথার কাছে এগিয়ে যায়। পৃথা রাগে ফুঁসছে। অর্ণব আস্তে করে গিয়ে তার গালে স্পর্শ করে। পৃথা ভ্রু কুঁচকে হাত সরিয়ে দেয়। অর্ণব তার দিকে আরো এগিয়ে গিয়ে তার আধ ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
‘তুমি আমার কত মেহনতের প্রেম, তোমাকে আমি এমনি এমনি কী করে যেতে দেই বলো? একবার হারিয়েছি বলে কি বার বার হারাতে দিব? কখনোই না। আর হারাতে দিব না। নিজের সবটুকু দিয়ে তোমায় আগলে রাখব।’
পৃথার মন গলে যায়। রাগ হাওয়া হয়ে উড়তে থাকে। নরম সুরে বলে,
‘তাহলে বলছিলেন কেন, আগের বউ ফিরে এলে তাকে নিয়ে সংসার করবেন? আমি কখনোই সতীনের ঘর করতে পারব না।’
অর্ণবের খুব হাসি পায় পৃথার কথা শুনে। কিন্তু, এখন হাসলে পৃথা আরো রেগে যাবে, এই ভেবে সে চেপে যায়। বলে,
‘মজা করছিলাম। আমি জানি, সে আর ফিরবে না। আর ফিরলেও কী, আমি তো আমার প্রেমাঙ্গনা কে পেয়েই গেছি।’
‘আচ্ছা, কথাটা যেন মনে থাকে।’
‘হু, থাকবে। এখন খেতে চলো।’
পৃথা খেতে বসে। খাবার হিসেবে ছিল, দুই পিস মাছ ভুনা, এক বাটি ডাল, আর দুইটা ডিম ভাজা।
পৃথা অনেকদিন পর আজ পেট ভরে একটু ভাত খেল। এতদিন তো খাবার আগেই সব বমি করে ভাসাতো। আজ আর বমি হয়নি। খেয়ে দেয়ে শরীরটা একটু সুস্থ লাগছে। খাবার শেষ করে পৃথা প্লেটগুলো তুলতেই অর্ণব বলে,
‘তুমি রেস্ট নাও। আমাকে দাও, আমি সব রেখে আসছি।’
পৃথা হেসে অর্ণবের হাতে সব প্লেট দিয়ে দিল। মনে মনে খুশি হলো, এমন একটা জামাই থাকলে আর কী লাগে।
সব প্লেট পরিষ্কার করে গুছিয়ে এসে অর্ণব দেখে, পৃথা শুয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছে। সে হাত মুছে এসে পৃথার পাশে শুয়ে পড়ে। পৃথার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,
‘তো, এবার শুরু করা যাক।’
পৃথা মুখের সামনে থেকে ফোনটা সরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী?’
অর্ণব ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
‘কী আবার, বাসর।’
পৃথার শরীর নিমিষেই জমে যায়। চোখে মুখে ছেয়ে আসে ভীষণ অসহায়ত্ব।
চলবে…