#প্রেমাঙ্গন
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬।
মানুষ স্মৃতি হারিয়ে ফেললে বুঝি তার পছন্দ অপছন্দও ভুলে যায়?
অর্ণব এখনও হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। পৃথা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘জানি আপনার কাছে কথাটা শুনতে খুব অস্বাভাবিক লাগছে। আমার নিজের কাছেও লাগছে। কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না কেন এই সিগারেটের ঘ্রাণটা আমার ভালো লাগছে। হয়তো সিগারেটের নতুন ভ্যারিয়েশন বেরিয়েছে, যেটার ঘ্রাণ ভালো।’
অর্ণব বড়ো করে নিশ্বাস নিল। মেয়েটা আবার পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছে না তো? এবার তো তার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। সে ঠান্ডা গলায় বলল,
‘এখন শরীর ঠিক আছে আপনার?’
‘আমার শরীর খারাপের কথা আপনি কী করে জানলেন?’
‘কালকে রাতে আপনার বন্ধুদের সাথে দেখা হয়েছিল, তখন ওরাই বলল, আপনার শরীর নাকি ভালো না। এখন ঠিক আছেন?’
‘জি।’
‘খেয়েছেন কিছু?’
‘না, এত সকালে কে খায়?’
অর্ণব ইতস্তত স্বরে বলল,
‘এক কাপ চা খাওয়া যাবে?’
‘আপনার সঙ্গে? কখনোই না।’
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ঠিক আছে তাহলে, আপনি থাকুন; আমি আমার রুমে যাচ্ছি।’
অর্ণব চলে যেতে নিলেই পৃথা বলে উঠে,
‘আপনার সিগারেটের নামটা তো বললেন না।’
অর্ণব পেছন ফিরে চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলল,
‘কেন, খাবেন নাকি?’
‘আরেহ না, জাস্ট ঘ্রাণ নিব।’
অর্ণব কিছুক্ষন রাগি চোখে পৃথার দিকে চেয়ে থেকে ধপধপ করে পা ফেলে চলে গেল। পৃথা ভেংচি দিয়ে মনে মনে বলল,
‘হু ঢং, আবার আসছে আমার সাথে চা খেতে।’
,
সকালে নাস্তা খেতে গিয়ে পৃথার শরীর আবার খারাপ করতে শুরু করল। সেখানে অর্ণবরাও ছিল। দূরে একটা টেবিলে বসেছিল। পৃথা বুঝতে পারল না, তার শরীরের এমন কেন লাগছে। রেস্টুরেন্টের বিভিন্ন খাবারের ঘ্রাণে তার গা গুলাচ্ছে, ব’মি পাচ্ছে। আশ্চর্য, সে বুঝতেই পারছে কেন এমন হচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও ঠিক পারছে না। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলো, যখন তাদের সামনে তাদের খাবার নিয়ে আসা হলো। খাবারের তীব্র ঘ্রাণ নাকে যেতেই সে “ওয়াক” করে শব্দ করে মুখ চেপে ধরল। তার এমন কান্ডে সবাই হতভম্ব। নিলয় তো কিছু বুঝতেই পারল না। সারা আর রুহা ভয় পেয়ে গেল। দূর থেকে সব অর্ণবও দেখছে। পৃথার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছে। পৃথা মুখ থেকে হাত সরিয়ে হালকা হেসে বলল,
‘কেন যেন বমি বমি পাচ্ছে।’
সারা আর রুহা একজন অন্যজনের মুখের দিকে ভীত চোখে চাইল। নিলয় জিজ্ঞেস করল,
‘তোর শরীর এখনও ঠিক হয়নি? এক কাজ করি, আজ তাহলে আমরা ঢাকায় ব্যাক করি। তোর শরীরের এমন কন্ডিশনে এখানে থাকা ঠিক হবে না।’
পৃথা উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘আরে না, ঠিক আছি আমি। প্লিজ, আমার জন্য তোদের আনন্দটা নষ্ট করিস না। আমরা আরো দু’দিন থেকে তারপর যাব।’
রুহা বলল,
‘না, আমরা আর থাকব না এখানে। আর আমার বাসা থেকেও আম্মু বারবার কল করছে। বাসায় ফিরতে বলছে তাড়াতাড়ি। ঘোরাঘুরি তো কম হয়নি, এবার ফেরা প্রয়োজন।’
রুহার কথার সাথে তাল মিলিয়ে সারা বলল,
‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।’
পৃথার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে, তার জন্য তার বন্ধুরাও আনন্দ করতে পারছে না। রাগ হচ্ছে। এই শরীরটা খারাপ হওয়ার আর সময় পেল না।
পৃথার মন খারাপ দেখে নিলয় বলল,
‘আরে বোকা, মন খারাপ করছিস কেন? আমরা কিছু দিন পর না হয় আবার কোথাও একটা ট্রিপ দিব। এটা নিয়ে এত মন খারাপ করার কী আছে।’
পৃথা হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘আমার জন্য তোদের আনন্দেও বাঁধা পড়ল।’
‘আনন্দ অনেক করেছি। ভবিষ্যতেও আরো করতে পারব। এই নিয়ে তুই আর মন খারাপ করিস না। এবার নাস্তা করেনে। তারপর না হয় বিকেল পর্যন্ত ঘুরে রাতে রওনা দিব।’
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও পৃথা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। তারপর সবার সঙ্গে খাবার খাওয়ার জন্য উদ্যত হলেই আবার তার গা গুলাতে শুরু করে। রুটিটা তরকারিতে লাগিয়ে মুখে পুরলেও গিলতে সে কোনোভাবেই পারছে না। পেটের ভেতর কেমন যেন সব গুলাচ্ছে। যেন এক্ষণি সব বেরিয়ে আসবে। সেই রুটির টুকরো কোনোরকমে গিলে, সে রুহাকে বলল,
‘দোস্ত, আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি। তোরা খা।’
রুহা বলল,
‘দাঁড়া, আমিও আসি।’
‘না না, তুই খা। আমি একাই যেতে পারব।’
রুহাকে জোর করে বসিয়ে রেখে পৃথা ওয়াশরুমে চলে যায়। আর সেখানে গিয়েই টয়লেটে দ্রুত প্রবেশ করে সে বমি করতে আরম্ভ করে।
,
পৃথার অনুপস্থিতিতে তাদের টেবিলের কাছে অর্ণব আসে। এসে রুহাকে জিজ্ঞেস করে,
‘পৃথার কী হয়েছে, রুহা? ওর শরীর কি বেশি খারাপ?’
রুহা বুঝতে পারছে না উত্তরে কী বলবে। অর্ণবকে কি রুহার বমির হওয়ার কথাটা এখন বলবে? যদি অর্ণব খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে? উত্তেজনায় আবার যদি বেশি আবেগ দেখিয়ে ফেলে, তখন তো আরেক বিপদ লাগবে। রুহা খানিক ভেবে বলল,
‘না, ঐ একটু শরীর খারাপ নাকি লাগছে বলছিল। বেশি কিছু তো বলেনি।’
‘ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে?’
‘আমরা আজকে ফিরব, ভাইয়া। আমার মনে হচ্ছে ওকে নিয়ে একবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এমনিতেই অসুস্থ, তার উপর আজকাল ওর শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিলেই ভালো হবে।’
‘কখন যাবে?’
‘রাতে রওনা দিব।’
‘আচ্ছা, একসাথেই যাব তাহলে।’
‘ও যদি আপনাকে দেখে সন্দেহ করে?’
‘আসার সময় যখন দেখেনি, তখন যাওয়ার সময়ও দেখবে না। তোমরা শুধু ওর উপর খেয়াল রেখো, তাহলেই হবে।’
‘আচ্ছা, ভাইয়া।’
তাদের সাথে কথা বলা শেষ করে অর্ণব আবার গিয়ে তার টেবিলে বসে। এর মাঝে পৃথাও ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। ও এসে চেয়ারে বসতেই রুহা বলে,
‘কিরে, শরীর কি এখনও খারাপ লাগছে? চোখ মুখ এমন লাগছে কেন, আবার বমি করেছিস নাকি?’
‘না না। বমি করিনি।’
‘আচ্ছা, খা তাহলে।’
খাবার দিকে তাকাতেই তার চোখ মুখ শুকিয়ে আবার গেল। বিষন্ন সুরে বলল,
‘না খেলে হয় না?’
নিলয় ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘খাবি না কেন? আর বমি কি আগেও করেছিলি?’
রুহা বলে,
‘হ্যাঁ, ও কালকে রাতে বমি করেছিল।’
‘ওমা, আমাকে ডাকিসনি কেন? রাতে কি ওর শরীর বেশি খারাপ ছিল?’
রুহা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই পৃথা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘আরে না, তেমন কিছুই হয়নি। একটু শুধু বমি হয়েছে। এখানে এসে কত কিছু খেয়েছি কোনো হিসেব আছে? মনে হয় ফুড পয়জনিং হয়েছে। এত ভাবিস না তো, একটু পরেই দেখবি ঠিক হয়ে গেছি।’
নিলয় চিন্তিত সুরে বলল,
‘তাহলে এখন খেতে চাচ্ছিস না কেন?’
পৃথা আমতা আমতা করে বলল,
‘আমার না আসলে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।’
নিলয় অবাক হয়ে বলে,
‘তুই এখন ভাত খাবি?’
‘হ্যাঁ, তাও শুটকি ভর্তা দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে।’
নিলয় যেন কথা হারিয়ে ফেলল। যে মেয়ে কখনো শুটকির ঘ্রাণও সহ্য করতে পারত না, সে এখন শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে চাচ্ছে? নিলয় বোকা বোকা চোখে রুহার দিকে চাইল। রুহা তাকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলল। তারপর সে পৃথাকে বলল,
‘আর কিছু খাবি, নাকি শুধু শুটকি ভর্তাই?’
‘না, শুধু শুটকি ভর্তা হলেই হবে। শুটকি ভর্তা আর গরম গরম ভাত। আহ, ভেবেই মুখে পানি চলে আসছে।’
রুহা কথা মতো খাবারের অর্ডার দিয়ে দিল।
অপরদিকে অর্ণব পৃথাকে ভাত খেতে দেখে আশ্চর্য হয়ে বসে আছে। মেয়েটা সকাল থেকেই সব আজগুবি কাজ করছে। কেন করছে এসব? তার ঔষধের আবার কোনো রিয়েকশন দিচ্ছে না তো? অর্ণব মেলাতে পারছে না কিছু। পৃথার এই ব্যবহার অস্বাভাবিক, খুব অস্বাভাবিক। অর্ণবের মনেও এবার ভয় জাগছে, আবার তাদের জীবনে নতুন করে কোনো বিপদ আসছে না তো?
চলবে…