প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব ৪০

0
2291

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪০

প্রহরের মুখ থেকে কবুল শব্দটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র নিশাতের অন্তরে ঢংঢং করে ডঙ্কা বাজল। চো**রা নজরে একবার দেখে নিল হৃদয় কাঁপানো মুখখানা। পরক্ষণেই আব্বার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকাল ও। অচিরেই মুখে ছেয়ে গেল ছাই রং। বাবার রক্তিম চাহনি তীক্ষ্ণ ফলার ন্যায় বিঁধল নরম মাংসপিণ্ডে। তেজের হল্কার কবলে নিশাত ভয়ার্ত, দুশ্চিন্তায় মগ্ন দৃষ্টিযুগল রাখল বিছানার সবুজের বুকে সাদা সাদা ফুল আঁকা চাদরে। আব্বার গম্ভীর কণ্ঠ শ্রবণপথ এড়ালো না। তিনি প্রহরকে লক্ষ্য করে বললেন,

” নিচে আসো। সেখানেই কথা বলব। ”
প্রহর নির্ভেজাল কণ্ঠে প্রতুত্তর করে,” জি। ”

নিশাত,রোকেয়া, রবিন চমকে গেল। এত শীতল,স্বাভাবিক কথা! প্রহরকে দেখলে যার চেহারায় অষ্ট প্রহর ক্রোধ,দাম্ভিকতা লেগে থাকে, সে কিনা অস্বাভাবিকভাবে বিয়ে হয়ে যাবার পরও এত শান্তভাবে কথা বলছে! ব্যাপারটা মোটেও বোধগম্য হচ্ছে না রোকেয়ার। স্বামীকে বেরিয়ে যেতে দেখেই প্রহরের কাছে এগিয়ে এসে ভীতসন্ত্রস্ত, অসহায় মুখে জিজ্ঞেস করলেন,

” তোর মামা আবার কিছু করবে না তো?”
” রিলেক্স মামী। কিছুই হবে না। আপনার মেয়ের জামাই খালি হাতে যুদ্ধের ময়দানে পা রাখে নি। অদৃশ্য অ**স্ত্র সমেতই এত দূর এসেছি। ”

প্রহরের কথার পৃষ্ঠে অল্প করে হাসলেন রোকেয়া। সবল চেহারার, তুখোড় বুদ্ধিপূর্ণ এই ছেলেটাকে অতিশয় ভালো লাগে উনার। মেয়ের জামাই বলে নয়। ছোট থেকেই প্রহরকে একটু বেশিই পছন্দ করেন। নিশাতকে যখন পদে পদে শাসন করত তখন মনে হতো চঞ্চল মেয়েটার জন্য এই রাগী, এলোমেলো স্বভাবের ছেলেটাই পারফেক্ট। কিন্তু মাঝে মাঝে বেঁকে যেতেন দুই বাড়ির পরিস্থিতি বিবেচনা করে। নিজের অতীব পরিচিত,চেনাজানা একটা সুপাত্রে মেয়ে দিলে নিশ্চিন্তে থাকা যায়। আর প্রহর তো ব্যকুল হয়ে ভালোবাসে নিশাতকে। তাই আজ থেকে রোকেয়া মেয়ের জন্য চিন্তা করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বস্তির শীতল বাতাসে মনের রাজ্য আনন্দে মেতে উঠল।

” আমিও নিচে যাই। বিয়ে হইল, একটু মিষ্টিমুখ হইব না? তুই নিশুরে নিয়ে আয়। ”

রোকেয়া চলে গেলে,রবিনও পিছু পিছু ছুটতে লাগলেন। প্রহর জোরেশোরে ডাকল,
” মামা!”
রবিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র মুখে। প্রহরের সুপুষ্ট দেহটা এগিয়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মামাকে। কৃতজ্ঞতার গলায় বলল,

” ধন্যবাদ মামা। আপনি সঠিক সময়ে মা’কে না জানালে আমি নিশুকে হারিয়ে পাগ–ল হয়ে যেতাম। ভীষণ ভালোবাসি আপনার ভাইঝিকে। ”

তার পিঠে হাত চাপড়ে রবিন ন্যাতানো গলায় কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে উঠে,
” তোমার ফুপিকে হারানোর কষ্ট এখনো আমার হৃদয়ভূমি রক্তা**ক্ত করে। শান্তির ঘুম, ঘুমাই না অনেক বছর। প্রতিটা রাত নিজের মৃ**ত্যু কামনা করি। এ পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্য আর আমাকে আকৃষ্ট করতে পারে না। একজন আমার সব মুগ্ধতা কেড়ে নিয়েছে। তারপর পৃথিবীর কোনো কিছুই আর আমাকে কাছে টেনে ভালো থাকার মন্ত্র শিখাতে পারে নি। তোমরা সুখী হও। বিরহ সবার জন্য না। বিরহ সরিয়ে ভালোবাসার সফলতাই হোক তোমাদের উদ্দেশ্য। তাকে আমি পাব না, তাই বিবর্ণ আমার ধরণী। তুমি তোমার হৃদয়াক্ষীকে পেয়েছ, আজ থেকে রঙিন তুমি ও তোমার জীবন। ”

সবাই চলে গেলে প্রহর নিঃশব্দে দরজা লাগিয়ে আস্তে করে বলল,

” নিচে নেমে আয় নিশু। ওভাবে নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পেয়ে বসে আছিস কেন?

অস্বস্তি দানা বেঁধে আছে নিশাতের মনে,শরীরে। প্রহর ভাইয়ের কথা কর্ণধারে পৌঁছাতেই ঝপাং করে লাফিয়ে বিছানা ছাড়ল। বোকা বনে গেল। সে কি নতুন বউ না! সদ্যই বিয়ে হলো তার। অথচ তাকে বলা হচ্ছে সে কেন নতুন বউয়ের মতো বসে আছে? ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত তৈরি হলো হুট করে। প্রহর ভাই কেন এত রহস্যময় কথা বলছে? অবশ্যই নব বধূ সে, প্রহর ভাইয়ের বউ। শাড়িটা ঠিক করে লম্বা ঘোমটা টানল। চুড়ির রিমঝিম শব্দ দ্রুত গতিতে বদ্ধ কক্ষের নির্জনতায় চমৎকার মুহূর্ত সৃষ্ট করল। প্রহর নাক মুখ কুঁচকে ফেলে।
” চুড়িও পড়েছিস ওই সমীরণের জন্য? ওর জন্য যা যা পড়েছিস সব এক্ষুনি খুলবি,খোল। ”

নিশাতের চোয়াল ঝুলে গেল, ” হ্যাঁ? ”

প্রহর তড়িৎ বেগে কাছে এসে দাঁড়াল। নিশাত ওষ্ঠদ্বয় ফাঁক করে কিছু বলতে যাবে, প্রহর ওর ঠোঁটে তর্জনী চেপে বলে উঠল,” চুপ!”

রক্ত জমে নিশাতের শুভ্র মুখশ্রী ডালিমের ন্যায় লাল হয়ে গেল। বুক ভারী হয়ে উঠল নিঃশ্বাসে। শ্বাসরুদ্ধভাবে ঠোঁট নাড়াতে চাইলে আরও চাপ অনুভব করল নিটোল ওষ্ঠাধরে।
প্রহর বা হাতটা টেনে নিয়ে রুষ্টভাবে চুড়িগুলো খুলে ফেলে দিল বিছানায়। সমীরণের জন্য সেজেছে নিশাত এটা সে মানতে পারবে না। সুন্দর, মনোহারিণী কেবল তারই জন্য নিজেকে সাজাবে। আজ পূর্ণ অধিকার নিয়ে বলল,

” পানসে মুখে বিয়েটা হলো নিশু,তোর কি একটুও খারাপ লাগছে না?”

নিশাত কসরৎ করে চোখ তুলে চাইল। হতভম্ব স্বরে প্রশ্ন করল,

” পানসে মুখে! আপনার মুখ পানসে লাগছে? আর আপনার মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কীভাবে ব্যথা পেলেন? ”

কাঁপা কাঁপা হাতে ঠোঁটের পাশের ক্ষত স্থানে হাত ছোঁয়াল নিশাত। কোমল হাতের স্পর্শে প্রহরের চোখ বুঁজে এলো। গাঢ় কণ্ঠস্বর,

” তুই আবার আপনি বলছিস? তুই কি আপনি,তুমিতে আটকে গেছিস নিশু? আপনি,তুমিই সম্বোধন করবি আমাকে? আচ্ছা, মেনে নিলাম। আমার তিলবতীর জন্য সাতখু***ন মাফ। ”

কপালের কাছে সফেদ ব্যান্ডেজের ওপর রক্ত জমেছে গোল হয়ে। নিশাত সেখানেও ছুঁয়ে দিল। বুকভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ল ও,

” কীভাবে ব্যথা পেলেন আপনি কিন্তু বলেন নি। ”

প্রহর চট করে হাতটা নামিয়ে আঁকড়ে ধরে চোখ রাঙাল। ফিসফিস করে একটুখানি রাগত্ব স্বরে বলল,

” কাঁদছিস কেন? হু? কেউ শুনলে কি বলবে? একটু আগে বিয়ে করেই আমি তোকে কাঁদাচ্ছি এটা মোটেও ভালো চোখে দেখবে না কেউ। তোর বুদ্ধি, জ্ঞান কম। তুই হলি গাধী আর মাথামোটা। কেঁদেকেটে তোর বুদ্ধিমান জামাইয়ের বদনাম করিস না। ”

নিশাত সরব করে চোখ নামিয়ে নিল। এই লোক যে তাকে ব্যথা পাওয়ার কারণ বলবে না এতে একফোঁটাও সন্দেহ নেই।

প্রহর নিশাতের নখ হতে শুরু করে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে বলল পুনরায়,

” আমি কিন্তু বলেছি আমার মুখ পানসে হয়ে আছে। ”

নিশাত মিইয়ে গলায় জবাব দিল,” নিচে চলেন। আমি আম্মুকে ঝাল করে কিছু রান্না করে দিতে বলব। ”

” আমি ঝাল খাব না। মিষ্টি খাব,বিয়ের মিষ্টি। ”

নিস্তরঙ্গ, দ্বিধাহীন, শক্ত কণ্ঠ শুনে নিশাতের শরীরের রক্ত ছলকে উঠল। নেত্রযুগলের সম্মুখে নেশাক্ত, অন্যরকম দুষ্ট চাহনি দেখে বিস্ময়ে গুটিয়ে নিতে চাইল নিজেকে৷

” আম্মু বলে গেল নিচে গিয়ে মিষ্টিমুখ করে নিতে। ”

প্রহর হতাশামিশ্রিত শ্বাস ছাড়ল। নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মিলন ঘটিয়ে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,

” একটুও বড় হবি না? আরেকটু বড় কেন হলি না তুই? প্রেম বুঝিস, মন বুঝিস, কী চাইছি সেটা বুঝতে পারছিস না?”

নিশাত অবাক হলো। হকচকালো সে,

” কী চাইছেন?”

প্রহর তার ঠোঁটের দিকে চেয়ে মাদকময় কণ্ঠে আবদার করল,

” আমি সুপুরুষ নিশু। জোরাজোরির বিপক্ষে। সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি। একটা দীর্ঘ স্পর্শ চাই আমার ঠোঁট দু’টোতে। মিষ্টি ছোঁয়া পেলে আমি আর তোর সাথে করল্লার মতো তেঁতো কথা বলব না। এটা তোর জামাইয়ের প্রমিস। ”

নিশাত চট করে ঠোঁটগুলো উল্টে মুখের ভেতর নিয়ে নিল। শিরা উপশিরায় রক্তচ্ছাস। একদিনে দুবার চুমু! সকালের চুমুতে জ্বরে অবস্থা কাহিল,এখন আবার! শরীরের উত্তাপে চোখও জ্বলছে। প্রহর মাদক হেসে ললাটে উষ্ণ ছোঁয়া মাখল। বলল,

” তুই এখন আমার। তোর যখন মন হবে মিষ্টি মুখ করব। তার আগে আমি কিন্তু একটা মিষ্টিও খাব না নিশু। তোর শরীর গরম। আর কোমরে আচরের দাগ কেন?”

নিশাতের গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। কলিজা কেঁপে উঠল। বক্ষস্থলে অস্থির ভাব এসে জড়ো হলো। প্রহর ভাইকে কীভাবে বলবে সমীরণের রুক্ষ আচরণের ফলপ্রসূ এই হাল? অধোমুখী হয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইলে প্রহর ঝাপটে ধরল। রাগান্বিত কণ্ঠে প্রশ্নাত্মক বাক্য ছুড়ে দিল ঝটপট,

” তোর আচরণ অন্য কিছু বলছে। খুলে বল আমায়। ”

নিশাত নিভন্ত স্বরে, ভয়ে ভয়ে জানালো,

” সমীরণ,,,উনি বাজেভাবে স্পর্শ করেছে। ”

” কীভাবে স্পর্শ করেছে?”

নিশাত এবার ফুপিয়ে উঠল। তার কিশোরী মন অপবিত্র ছোঁয়ায় মুষড়ে পড়েছে। পৃথিবীর সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য,শান্তির স্থানে মাথা রেখে বলল,

” বাজে,,,বাজেভাবে। ”

নিশাতকে বুক থেকে সরিয়ে আদেশ করল প্রহর,

” শাড়িটা পাল্টিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। ”

রোষের তোড়ে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে তার। অ্যাডামস অ্যাপল ক্রমাগত উঠানামা করছে। নিশাতের মন কু ডাকল। হতচকিত হয়ে উচ্চারণ করল,

” প্রহর ভাই! ”

দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে প্রহর ততক্ষণে। নিচে এসে সোজা প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে বলে,

” বন্দুকটা দে। ”

সমীরণসহ সকলে চমকে উঠল। ভয়ের একটা সূক্ষ্ম রেখার দেখা মিলল সবার মাঝে। প্রত্যয় আপত্তিকর গলায় না করল। দেবে না সে। রেগেমেগে বহ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠল প্রহর।

” ওটা আমার লাইসেন্স করা। তুই দিতে বাধ্য। ”
ঊষা তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করে,” কী হয়েছে ভাইয়া?”

সবাইকে উপেক্ষা করে প্রহর প্রত্যয়ের কাছ থেকে বন্দুক নিয়ে সমীরণের বাহুতে তাক করল। নিশাত উপর থেকে এসব দেখে কুঁকড়ে গেল ভয়ে। এত নির্দয়, পাষাণ কেন তার প্রহর ভাই! কাউকে এত সহজে আ**ঘাত করা যায়!

সমীরণ চোখ নাচালো। ভয়কে লুকিয়ে রেখেছে সে। প্রহরের সামনে কোনোভাবেই হারবে না। প্রহর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,” শিয়াল হয়ে সিংহ সাজার ব্যর্থ চেষ্টা। ”
রফিক আজম গর্জে উঠলেন। বললেন,” তুমি আবার বেয়াদবি শুরু করেছ! ছাড়ো ওকে। ”
প্রহর না শোনার ভান করে ট্রিগার চেপে বলল,

” আমার ছোট ছোট স্বার্থে আঘাত লাগলে আমি হিংস্র হয়ে যাই। আর সে তো আমার তিলবতী ছিল। ”

#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here