#কাজললতা
#লেখিকা_ইভা_আক্তার
#পর্ব_২৫ (শেষ পর্ব)
—————————————————————————-
৬ বছর পর
প্রিয় মানুষটার সঙ্গ নিজের পুরোটা জীবনকেও বদলে দিতে পারে। তেমনি ইফতির সঙ্গ আজ আমাকে ঠিক ওর মতোই একজন নামকরা হার্টের ডঃ হতে সাহায্য করেছে। আজ আমি একজন সফল হার্টের ডাক্তার। সেই কাজেই ইমারজেন্সিভাবে আমাকে তিন মাসের জন্য নিজের আপনজনদেরকে ছেড়ে লন্ডন যেতে হয়েছিলো।
নিজের একান্ত প্রাইভেট কার থেকে নেমেই সেই চিরচেনা বাড়িটির দিকে তাকালাম। আজ প্রায় তিন মাস পর আবারো নিজের আপনজনদের কাছে ফিরে আসা। তিন মাস পর বাড়িতে ফেরায় যতটুকু আনন্দ হওয়ার কথা ছিলো ঠিক ততটুকু আনন্দ আমার এই মনে হচ্ছিল না। এয়ারপোর্ট থেকে আমার আপনজন বলতে কেউই আমাকে রিসিভ করতে যায় নি। ধীর পায়ে হতাশা নিয়ে বাড়ির সামনে দুই-তিন বার কলিং বেল বাজানোর পরও যখন কেউ দরজা খুললো না তখন দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। ভেতরে গিয়ে দেখি সম্পূর্ণ বাড়ি অন্ধকার। লাইট জ্বালাতে যাবো হুট করে তখনই লাইট জ্বলে উঠলো। সামনে তাকাতেই সকলে বলে উঠলো,
-শুভ জন্মদিন ডঃ ইভা চৌধুরী।
সকলকে একসাথে আমার বাড়িতে দেখে আমার মনে খুশির বন্যা বয়ে গেলো। এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে রিসিভ করতে না যাওয়ার কারণই হচ্ছে আজকে আমার এই জন্মদিনের সারপ্রাইজ দেওয়া। বাড়ির সকলে আমার কাছে এগিয়ে সামনে কেক ধরতেই মআি মোমবাতিটা ফু দিয়ে নিভিয়ে কেকটা কেটে সর্বপ্রথম পিসটা মুখে দেওয়ার জন্য ইফতিকে খুঁজলাম। সকলের ভিরে খানিকটা পেছনে ইফতিকে খুঁজে তার মুখের সামনে কেক ধরতেই ইফতি কেকের পিসটা মুখে নিয়ে নিলো। কেকের পিসটা মুখে নিতেই ইফতির চোখ ছলছল করে উঠলো।
স্বাভাবিক এই প্রথম বিয়ের পর ইফতির থেকে তিনটা মাস দূরে থাকা।আমারো যে খুব কষ্ট হচ্ছিলো ওর থেকে দূরে থাকাটা।
– মাম্মি
“মাম্মি” ডাকটা শুনে পেছনে ফিরতেই বাবার কোলে থাকা আমার আর ইফতির ৫ বছরের ছোট্ট সোনামণি ইতি আমার কোলে লাফিয়ে উঠলো। আমি শক্ত করে ইতিকে জড়িয়ে ধরে ওর শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম। দীর্ঘ তিনটা মাস আমার কাছে আমার ইতি মামনিকে ছাড়া তিনটা বছর মনে হচ্ছিল। প্রতিদিন ভিডিও কলে ওর মাম্মি মাম্মি ডাক শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেঁদে উঠতো শুধুমাত্র ওকে একবার আদর করার জন্য।
– মাম্মি জানো আমি আর পাপা তোমাকে অনেক মিস করেছি। তুমিও কি আমাকে আর পাপাকে মিস করেছো?
– করেছি মামনি। অনেক অনেক মিস করেছি। তোমার মাম্মি তোমাকেও অনেক মিস করেছে।
ইতির কপালে চুমু দিতেই ইতি কোল থেকে নেমে নীলের হাত ধরলো। নীল হলো নওশিন আপুর ৮ বছরের ছেলে। দু বছর আগেই নওশিন আপু নীল এবং নীলের বাবাকে নিয়ে একেবারের জন্য দেশে ফিরেছে। ছোটো চাচ্চুর বিয়ের পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ইলমার বিয়ের কয় মাস পর হাজার চেষ্টায় অবশেষে সে মা হতে সক্ষম হয়। ছোটো চাচ্চুর ছেলের বয়স ৬ বছর নাম ইশান। একদমই চোটো চাচ্চুর বিপরীত অর্থাৎ ইফতির মতো গম্ভীর। ৬ বছরের বাচ্চারা যখন খেলাধুলা আর দুষ্টুমিতে মগ্ন থাকে তখন আমার পিচ্চি ভাই থাকে সম্পূর্ণ নীরব। ইলমা আর নাহিল ভাইয়ার একমাত্র মেয়ে হচ্ছে তোহা যার বয়স মাত্র তিন বছর। আর এটাই হচ্ছে আমাদের মিষ্টি এবং আদুরে একটা ফেমিলি। আর এই সম্পূর্ণ বাড়িটা হচ্ছে আমার আর ইফতি ভাইয়ার পারিশ্রমের তৈরি সংসার।
– না আমি ফুটবল খেলবো না। আমি পুতুল পুতুল খেলবো (ইতি)
ইতি চিৎকারে আমরা সকলেই তার দিকে তাকালাম।
– তোর সাহস কি করে হলো আমার কথার অবাধ্য হওয়ার?
– নীল ভাইয়া ফুটবল খেলে সেদিন আমার পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম একারণে আমি আর ফুটবল খেলবো না।
ইতি কথাটা বলেই মাথাটা নিচু করে ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদোকাদোঁ ভাব নিলো। সাথে সাথে নীল হাটু গেঁড়ে বসে ইতির হাঁটুতে ব্যথার দাগে হাত বুলিয়ে বললো,
– ঠিক আছে চল আমরা পুতুল পুতুল খেলবো। কিন্তু শর্ত আছে।
নীলের কথায় ইতির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠলো।
– বলো বলে কি শর্ত।
– আমাকে একটা ভালো চরিত্র দিতে হবে।
– ঠিক আছে। তুমি আমার বর হবে আর আমি হবো তোমার বউ কেমন?
– ঠিক আছে চল।
কথাগুলো বলেই ইতি আর ইলমা দুজন দুজনার হাত ধরে পুতুল পুতুল খেলতে বসলো। ওদের বর আর বউয়ের কাহিনী দেখে আমার ঠোঁটে এমনি এমনি হাসি ফুটে উঠলো। আচ্ছা? আমার আর ইফতির মতো ওদের জীবনেি যদি পরিবর্তন চলে আসে?
—————————————————————————-
আজ তিন মাস পর আমার ইতি মামনিকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে ব্যালকনিতে গেলাম। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি ইফতি বাইরের দিকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসার পর থেকে আমার সাথে একটুও কথা বললো না। ইফতির কাঁধে হাত রাখতেই পেছনে ঘুরে হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। ইফতি কাদঁলেও আমি নিজেকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইফতির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
-আর কেঁদো না প্লিজ। এই যে দেখো আমি চলে এসেছি।
– যানো তোমাকে ছাড়া আমরা বাবা মেয়ে কতটা কষ্টে ছিলাম। তিনটা মাস বিষের মতো করে পার হচ্ছিল।
– আমিও তো তোমাদের ছেড়ে অনেক কষ্টে ছিলাম। বারবার ইচ্ছে করছিলো সবকিছু ছেড়ে এক্ষনি তোমাদের কাছে চলে আসি। কিন্তু দেখো আমি আসার পর থেকে তুমি একবারও আমার সাথে কথা বললে না।
ইফতি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
– কি করে বলতাম বলো? তোমাকে দেখেই আমার চোখ ছলছল করে উঠছিলো। যদি তোমার সাথে কতা বলতে যেতাম তাহলে হয়তে তাদের সামনে কেঁদে দিতাম।
ইফতির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি। মানুষটা এতে বছর পরও বদলালো না। আজ সে যেমন একজন স্বামী যেমন একজন বাবা তেমনি একজন দায়িত্ববান ডাক্তার। এতো কাজের মাঝেও আমার প্রতি তার ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমলো না। আমার হাতে থাকা কাজলটা আমি ইফতির সামনে দিয়ে বললাম,
– যানো এই তিন মাসে তোমার দেওয়া এতো এতো কাজল আমার কাছে ছিলো বটে কিন্তু আমি একটুখানিও পড়ি নি। পড়িয়ে দেবে না? তোমার দেওয়া কাজলে আমাকে কাজললতা তৈরি করার জন্য।
ইফতি মুচকি হেসে আমার হাতের কাজল নিয়ে আমার দুচোখের আঁখিতে দিয়ে দিলো।
“কাজললতার আঁখি জোড়ার পলক হতে চাই,
যদি সে সম্মতি দেয় তার হূদয়ের আঙিনায়,
তার মনে কি রয়েছে আমার জন্য ভালোবাসা,
নাকি হারিয়ে যাবে আমার প্রিয় কাজললতা! ”
ইফতির চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রয়েছি। এই মানুষটাকে সত্যি অবেক ভালোবাসি। নিজের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসি।
– তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক পুরুষের মধ্যে একজন।
– উহম। কাজললতার হৃদয়ের গহিনে যদি নিজেকে পোড়াতে পারতাম, তাহলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারতাম।
আমি হাসিমুখে ইফতিকে জড়িয়ে ধরলাম। এই মুহুর্তটা যেনো আজীবন বিদ্যমান থাকে। আমার প্রেমিক পুরুষের হার্টের শব্দ যেনো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাকে মনে করিয়ে দেয় হ্যা আমিই তার কাজললতা। আমি আমার প্রেমিক পুরুষের সেই কাজললতা।
—————————-
🍂সমাপ্ত🍂
—————————