#কাজললতা
পর্ব:৪
লেখিকা: ইভা আক্তার
🍁🍁🍁
কাজল দেওয়া শেষেই অতীতের ভাবনা থেকে ফিরে আসলাম। যখনই আমার সেই অচেনা প্রেমিক পুরুষের কথা মনে পড়ে, তখনই সেই প্রেমিক পুরুষের দেওয়া রঙ বেরঙের চিরকুট আর কাজল আমার আখিঁজোড়ায় দিয়ে নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করি। সেদিনের পর থেকে আরো কয়েকবার সেই অচেনা পুরুষ বিভিন্ন ধরণের চিরকুট পাঠিয়েছিলো। অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেই চিরকুটে মাঝেমধ্যে থাকতো অসাধারণ কবিতা আবার মাঝমধ্যে থাকতো কাজললতা নিয়ে বিভিন্ন বাক্য। আর প্রতিবার চিরকুটের সাথে থাকতো একটি করে কাজল। হয়তো লোকটা কাজলের প্রতি আসক্ত, না হলে কাজল দেওয়া আখিঁর উপর। মাঝেমধ্যে ভাবতেই অবাক লাগে, বর্তমান যুগেও যে ৯০ দশকের প্রেমিকদের মতো প্রেমিক আজও আছে যারা নাকি প্রেমিকাদের প্রতি তাদের মনের ভাব চিঠির মাধ্যমে প্রকাশ করে। সত্যি বলতে তার চিঠিগুলো এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কবে পাবো প্রেমিক পুরুষের লেখা চিঠি? সেই চিঠিতে কি কবিতা থাকবে? নাকি থাকবে কাজললতা নিয়ে কোনো গল্প কাহিনী?
আজও জমা রয়েছে তার চিঠি লেখা খামগুলো। চিঠির শুরুতে রয়েছে কাজললতা সম্বোধন। আর শেষে রয়েছে “কাজললতার অচেনা প্রেমিক পুরুষ “। তার প্রতিটি চিঠিতে রয়েছে একটা আলাদা সুগন্ধি মাখা ঘ্রাণ। একবার এক চিঠিতে সে বলেছিলো ” কাজললতা,যানো কেনো আমি প্রতিটি চিঠিতে একই সুগন্ধি ব্যবহার করি? যাতে করে তুমি তোমার এই অচেনা প্রেমিক পুরুষকে চিনতে পারো। যার মাধ্যমে চিঠি খুললেই তুমি পেতে পারো এক ফুলের গন্ধ মাখা সুগন্ধিযুক্ত ঘ্রাণ। খুঁজে নিবে তো আমায়? ”
সেদিনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তার ওই নীল রঙের শাড়ি আর পড়ি নি। কেনো পরবো সেই শাড়ি? ওই শাড়ি পড়ে কি হবে যদি না প্রেমিক পুরুষ তা নাই দেখতে পাবে? তাই ঠিক করে নিয়েছিলাম যেদিন ওই অচেনা প্রেমিক পুরুষের সাথে দেখা হবার সুযোগ হবে সেদিনই তার স্বপ্নের সেই নীল কাজললতা সাজবো। আজও অপেক্ষায় আছি। কবে পাবো প্রেমিক পুরুষের দেখা? কবে পাবো তার সুগন্ধিমাখা চিঠিগুলো?
🍁🍁🍁
সকালে কলেজে এসে গেটের সামনে দাড়িয়ে ইলমার অপেক্ষা করছি। কলেজে উঠার পরই আমি আর ইফতি ভাইয়ার বোন ইলমা একসাথে একই কলেজে এডমিশন নিয়েছি। কিন্তু ইলমার এডমিশন রেজাল্ট কিছুটা খারাপ হওয়ায় ওকে আলাদা ব্যাচে প্রাইভেট পড়তে হয় । কিছুক্ষণ পর দেখলাম ইলমা আসছে ইফতি ভাইয়ার বাইকের পিছনে বসে। ইফতি ভাইয়াকে দেখেই আমার কালকের রাতের সেই মেসেজের কথা মনে পড়ে গেলো যেখানে ইফতি ভাইয়া বলেছিলো, আমি দেখতে নাকি কুৎসিত আর গাইয়া। রাগে-দুঃখে ইফতি ভাইয়ার সামনে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ঠিক করেছিলাম যতই বড় হোক না কেনো আজ আর ইফতি ভাইয়ার সাথে কথা তো দূরের কথা তাকাবোই না।
“কেমন আছিস তুই?”
(আমি)
“আলহামদুলিল্লাহ তুই কেমন আছিস? অনেকক্ষন ধরে দাড়িয়ে আছিস তাই না? সরি রে আসলে রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো তাই আসতে লেট হয়ে গিয়েছিল। ” (ইলমা)
“আরে ধুর না। আমিও মাত্রই আসলাম ” (আমি)
“ওহ আচ্ছা তাহলে চল ক্লাসে যাই” (ইলমা)
ইলমার সাথে কলেজের ভিতরে হাঁটা দিতেই পেছন থেকে ইফতি ভাইয়া বলে উঠলো,
-কেমন আছিস ইভা? (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার নিজ থেকে বলা কথা আর এত নরম কন্ঠ আমি আমার জীবনে আজ পর্যন্ত শুনি নি। সাধারণত ইফতি ভাইয়া ছোট থেকে বড় পর্যন্ত শুরু করে সবার সাথে মুখে একটা গম্ভীরতা নিয়ে কথা বলতো। ইফতি ভাইয়ার এমন স্বরে কথা শুনে আমি আর ইলমা একবার একে অপরের দিকে আরেক ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছিলাম।
-কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেনো? (ইফতি ভাইয়া)
এক মুহূর্তের জন্য আমি ইফতি ভাইয়ার বলা কালকের অপমান গুলো প্রায় ভুলেই গেলাম। ইফতি ভাইয়ার কথায় কাঁপাকাপাঁ কন্ঠে উত্তর দিলাম,
“এই তো ইফতি ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ।”
“আজ তো রবিবার। তোর তো তাহলে কোচিং নেই। ইলমার যেহুতু কোচিং আছে তাই ওকে কোচিং দিয়ে এসে আমার সাথে রেস্টুরেন্টে যাবি? ” (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে যেনো আমার শ্বাসনালী বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। এসব কি সত্যি নাকি সব আমার কল্পনা। নাকি ইফতি ভাইয়া গাজা-টাজা খেয়ে এসেছে। আমি আর ইলমা দুজনেই বড় বড় চোখ করে ইফতি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর ফিসফিস করে ইলমার কানে গিয়ে বললাম,
“তোর ভাই কি সুস্থ আছে নাকি আসার সময় মদ্য পান করে এসেছে? ”
আমার কথা শুনে ইলমা আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। ছোটো চাচ্চু থাকলে নির্ঘাত আজ হয়তো হার্ট আ্যটাক করতো।
“কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেনো? ” (ইফতি ভাইয়া)
ইফতি ভাইয়ার ধমকে আমার হুশ ফিরে আসলো। এবার বেশ গম্ভীরভাব নিয়েই ইফতি ভাইয়া ধমক টা দিলো।
“আচ্ছা যাবো যাবো। ” (আমি)
“বেশ। ছুটির সময় আমি দাঁড়িয়ে থাকবো এখানে। ছুটি হওয়ার সাথে সাথে যেনো তোকে এখানে পাই নয়তো গাড়ির নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো। কথা কানে গেছে? “(ইফতি ভাইয়া)
আমি উপর নিচ মাথা নাড়ালাম মানে কথা আমার খুব ভালো মতোই কানে গেছে। ইফতি ভাইয়া চলে যেতেই আমরাও ক্লাসে চলে এলাম। আজকের সারা ক্লাসে ইফতি ভাইয়ার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ কি হলো যে ইফতি ভাইয়া এতো নরম আর হাসিমুখে কথা বলছে। জ্বীনে ধরেছে নাকি আবার। নাকি কালকে ইলমাকে ননদিনী বলেছিলাম বলে সব রাগ আর শাস্তি ঝাড়বে। কথাটা মনে হতেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। কারণ ইফতি ভাইয়ার শাস্তি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জানা আছে আমার। যতই ইফতি ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করি না কেনো, ইফতি ভাইয়ার রাগী চোখ গুলোই সবাইকে চুপ থাকতে বাধ্য করে। হয়তো বা আজ আমার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিনতম শাস্তি। তাই ঠিক করলাম ক্লাস শেষ হলেই দৌড়ে একটা রিক্সায় উঠে বাড়ি চলে যাবো। যাই হয়ে যাক না কেনো ইফতি ভাইয়ার সাথে আজ রেস্টুরেন্টে কোনোমতেই যাওয়া যাবে না।
🍁🍁🍁
ক্লাস শেষে ইলমাকে না বলেই আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য হাঁটা দিলাম। ক্লাস থেকে বের হয়েই দেখলাম সামনে ফাহিম দাঁড়িয়ে একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। এই ফাহিম সেই ফাহিম যে কিনা পুরো কলেজের সামনে ফুল নিয়ে আমাকে প্রপোজ করেছিলো। আজব ব্যাপার হচ্ছে সেদিনের পর থেকে ফাহিমকে আর কখনো কোথাও দেখতে পাই নি।
🍁🍁🍁
সেদিন সময়টা ছিলো বসন্তকাল। ফাল্গুনের জন্য কলেজে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। কলেজের ভিতরে শুধু একটাই গান বাজছিল,
“বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিলো নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে,
বসন্ত এসে গেছে
মধুর অমৃতবানী বেলা গেল সহজেই
মরমে উঠিল বাজি বসন্ত এসে গেছে
থাক তব ভুবনের ধুলি মাখা চরনে
মাথা নত করে রব ..
বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে।”
একে একে সব মেয়েরা হলুদ শাড়ি আর ফুলের গয়না পড়েছিলো। আমি আর ইলমাও হলুদ শাড়ি আর সাথে হলুদ রঙের ফুলের গয়না পড়েছিলাম। হাত ভর্তি ছিলো হলুদ রঙের চুড়ি। সেদিন ফাল্গুন অনুষ্ঠান শেষে আমরা বন্ধু আর বান্ধবীরা মিলে কলেজের ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই কে যেনো পিছন থেকে আমায় ‘ হলুদ পরি’ বলে ডাক দিলো। হলুদ পরি নামটা শুনে পিছনে ফিরে দেখতে চেয়েছিলাম আসলেই কি নামটা আমায় সম্বোধন করে ডেকেছে নাকি অন্য কাউকে। পিছনে ঘুরতে একটা ছেলে গোলাপ ফুলের গুচ্ছ দিয়ে হাটু গেঁড়ে বললো,
“I Love You প্রেয়সী। আজ ফাল্গুন অর্থাৎ ভালোবাসা দিবসে আমার এক আকাশ ভালোবাসা শুধুই তোমার জন্য প্রিয়তমা। ভালোবাসা দিবসে তোমার জন্য এক গুচ্ছ গোলাপ। আই লাভ ইউ হলুদ পরি। ”
আমি হতভম্ব হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কলেজের অনেকেই আমাদের দেখছিলো। কিন্তু আমার সমস্যা ছিলো যদি কলেজের কোনো স্যার বা মেডাম দেখে তাহলে কি হবে? যদি ওনারা বাবার কাছে কমপ্লেইন করে তাহলে তো বাবা আমার কলেজে যাওয়াই বন্ধ করে দিবে। হটাৎ করেই ছেলেটা দাড়িয়ে আমার হাতে গোলাপের গুচ্ছ ধরিয়ে দিলো। ছেলেটার দিকে তাকানোর আগেই আমার চোখ পড়লো সামনে থাকা ইফতি ভাইয়ার দিকে। সাথে সাথে গোলাপ গুলো নিচে ফেলে দিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম যে আজ ইফতি ভাইয়াই আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আসবে তাই ইফতি ভাইয়াকে ৬ টায় আসতে বলেছিলাম আমি আর ইলমা। ইফতি ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তেই আমার মনে প্রচন্ড রকমের ভয় হতে শুরু করলো। আমি জানি ইফতি ভাইয়া বাসায় গিয়ে সবাইকে আমার নামে উল্টা পাল্টা নালিশ করবে। হয়তো বলবে কলেজে আমার বিএফ আজকে ভালোবাসা দিবসে গোলাপ দিয়েছে। ইফতি ভাইয়ার দিক থেকে চোখ নামিয়ে আমি আমার দৃষ্টি নিচের দিকে নিলাম।একটু পর ইলমা এসে আমার হাত ধরে নিয়ে গেলো। পেছন থেকে ছেলেটি বললো “তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো হলুদ পরি।”
ছেলেটার কথা শুনে আমার আরও ভয় লাগলো। এবার হয়তো ইফতি ভাইয়া ভাববে এখন থেকে কলেজে এসে এই ছেলের সাথে ঘুরাঘুরি করবো। এসব ভাবতে ভাবতেই ভয়ে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরতে লাগলো। ইলমা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ইফতি ভাইয়ার সামনে গিয়ে বললো,
“ভাইয়া তুমি যা ভাবছো সেটা ভুল। ইভা ওই ছেলেটাকে চিনেও,,,”
ইলমাকে কথা বলতে না দিয়ে ইফতি ভাইয়া বললো,
-তোকে কি কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি? যা গিয়ে গাড়িতে বস তোরা। (রেগে)
ইলমা চুপ করে আমার হাত ধরে গাড়িতে গিয়ে বসলো। ইলমার পাশে আমিও বসলাম। আমার চোখ দিয়ে এখনে অশ্রু পড়ছে। ইফতি ভাইয়া আমায় বাসায় পৌঁছে না দিয়ে ইলমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বললো,
“তুই যা। আমি ইভাকে দিয়ে আসছি। “,,,,,
চলবে,,,🍁