কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ১৫

0
611

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী

আরমান কোন নড়াচড়া না করে শুয়ে থাকে। ও বুঝতে পারছে কান্তা কাঁদছে। তবুও ইচ্ছে করেই ওকে শান্তনা দেয়না। এই মুহূর্তে ওকে কাঁদতে দেয়াই আরমানের কাছে উচিত বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া ওর ঘাপটি মে’রে শুয়ে থাকার আরেকটা কারন হলো, ও চায়না আরমান ওদের ভাইবোনের কথা শুনতে পেয়েছে ভেবে অস্বস্তিতে পরুক।

কান্তা কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে হালকা করে। ততক্ষণে ওর শরীরে জ্বর জাঁকিয়ে বসেছে। এদিকে আরমানের ভার্সিটি যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে।
কান্তা অনেক কষ্টে উঠে বসে। ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

আরমানের চোখের ঘুম সেই কখন গায়েব হয়ে গেছে। কান্তা বেরিয়ে যেতেই ও উঠে বসে। তখনও ওর মাথায় আ’গু’ন জ্ব’ল’ছে। ভাই হয়ে ছোট বোনের সাথে এত খারাপ আচরণ কি করে করতে পারে! ঘুরেফিরে এই কথাই ওর মাথায় এই কথাই ঘুরছে। আর যাই করুক না কেন এই লোকটাকে আরমান কখনোই ক্ষমা করবেনা।

” আপনার খাবার এনেছি। খেয়ে নিন। আজকে পরোটা করতে পারিনি। আপনার জন্য লাঞ্চবক্সে শুধু একটা তরকারি আর ভাত দিয়েছি। একটু কষ্ট করে খেয়ে নিয়েন। ” টি টেবিলে রুটি আর ডিম ভাজা রেখে কান্তা বলল।
আরমান গোসল সেরে সবেমাত্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।

” রুমে আনলে কেন? আমি ডাইনিং রুমে যেয়েই খেতাম। এই, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? ” আরমান কথা বলতে গিয়ে কান্তার দিকে তাকালে বুঝে যায়, কান্তার কিছু একটা হয়েছে।

” মনে হয় জ্বর এসেছে। ”

আরমান তড়িঘড়ি করে আসে কান্তার কাছে। ওর কপালে হাত রেখে চমকে উঠে।

” শরীর জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে, আর তুমি বলছ, মনে হয় জ্বর এসেছে! আমার খাওয়ার চিন্তা বাদ। আগে তুমি রুটি খেয়ে মেডিসিন নাও। ” আরমান জোর করে কান্তাকে দুইটা রুটি খাইয়ে দেয়। এরপর একটা প্যারাসিটামল দেয় কান্তার হাতে।
এরপর নিজেও দুইটা রুটি খায়।

” এখানে মেডিসিন রইল। জ্বর না কমলে আরেকটা খাবে। এই অসুস্থ শরীরে কেন রান্না করতে গেলে? আমার না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে। তাই কখনও যদি শরীর খারাপ হয়, রান্নার চিন্তা না করে আগে আমাকে বলবে। ঠিক আছে? আজ আর রান্নাঘরে যেওনা। আমি খালাকে বলে যাব, সে তোমার খাবার রুমে নিয়ে আসবে। ”

কান্তা কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ায়।

আরমান প্রয়োজনীয় সব কিছু ব্যাগে তুলে নিয়ে কান্তার কাছে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা খাটের একপাশে বসে আছে।
হুট করেই আরমান কান্তার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরে। এরপর কান্তার মাথায়, কপালে পরপর কয়েকটা চুমু দেয়।

” চুপচাপ শুয়ে থাকবে কেমন? বেশি খারাপ লাগলে খালাকে ডাকবে। আর আমাকে ফোন দিবে। আমি ফোন দিলে রিসিভ করবে। কারও সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবেনা। আজ আর কোচিং-এ যাওয়ার দরকার নেই। আজকে জ্বর না কমলে কাল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব। ”
কান্তা বাধ্য মেয়ের মত আরমানের সকল কথায় সায় দেয়।

আরমান বেরিয়ে যেতেই কান্তা হু হু করে কেঁদে উঠে। আজ আরমান ওকে জড়িয়ে ধরেছে, চুমু দিয়েছে। এত সুখও কি ওর কপালে ছিল! মানুষটা কত খেয়াল রাখে ওর। এখনও যেন আরমানের ছোঁয়া ওর শরীরে লেগে আছে। কান্তা দুপুর পর্যন্ত থেকে থেকেই কেঁদে উঠে।

আরমান সারাদিনে বেশ কয়েকবার ফোন করে কান্তার খোঁজ নিয়েছে। ওর জ্বর এখনও আছে।
খালা এসে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিয়েছে। আরমান ভার্সিটি যাওয়ার আগে তাকে বলে গেছিল।

সারাদিন একবারের জন্যও আকলিমা খানম কিংবা রাজিয়া খানম দুজনের কেউই কান্তার খোঁজ নেয়নি। শ্রীজা যতক্ষণ বাসায় ছিল ততক্ষণ কান্তার পাশে ছিল। সন্ধ্যায় শহিদ আহমেদ বাসায় এসে খালার কাছে কান্তার কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন কান্তার রুমে। তিনি কিছুক্ষণ কান্তার মাথায় হাত রেখে ওর পাশে বসে থাকেন।

আরমান আজ একটু তারাতারি বাসায় ফিরেছে। সে যখন রুমে এসেছে তখন কান্তা জ্বরে কাতরাচ্ছে। খালা ওর মাথায় পানি ঢালছে।
আরমান ভেতরে আসার কিছুক্ষণ পর খালা কান্তার মাথা মুছিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আরমান ফ্রেশ হয়ে এসে কান্তার পাশে বসে। হাত রাখে ওর মাথায়।

” আপনি আজ এত তারাতারি আসলেন যে? দুপুরে ঠিকমত খেতে পেরেছিলেন তো? ” ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে কান্তা।

” কি আশ্চর্য মেয়ে তুমি! নিজে জ্বরে কাতর অথচ নিজের চিন্তা না করে আমার চিন্তা করছ! তোমার জন্য তারাতারি বাসায় এসেছি। আর দুপুরের খাবারও পেট পুরে খেয়েছি। এখন একটু উঠে বস। আমি কিছু খাবার এনেছি। সেসব খেয়ে ঔষধ খাবে। আজ রাতটুকু দেখব। সকালের মধ্যে জ্বর না কমলে কাল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব। ”

” ডক্টরের কাছে নিতে হবেনা। এমনিতেই সেরে যাব। এরকম জ্বর জীবনে কত হয়েছে। এমন অস্থির কেউ হয়নি। আর না করেছে এত সেবা। আপনি মিছেমিছি ঘাবড়াচ্ছেন। দেখবেন কাল সকালেই জ্বর পালাবে। ”

” অতীতে কেউ তোমার জন্য চিন্তা করেনি জন্য ভবিষ্যতেও কেউ চিন্তা করবেনা, এমনটা ভাবার কোন কারন নেই। অতীতে যতটা অবহেলিত ছিলে, ভবিষ্যতে তারচেয়েও বেশি কারও ভালোবাসার নাম হবে তুমি। অতীতের যে দুঃসহ স্মৃতি তোমার মনে দাগ কে’টে’ছে। শীঘ্রই সেই দাগে কেউ প্রলেপ লাগাবে ভালোবাসার। তোমার চারপাশে থাকবে ভালোবাসায় ঘেরা সুখস্মৃতি। সেই ভালোবাসার দেয়াল ডিঙিয়ে অতীতের কালো স্মৃতি ভবিষ্যতে তোমার আশেপাশে পৌঁছাতে পারবেনা। একটা কথা মনে রেখ, তুমি কারও রাজ্যের রানী। না থাকুক সে রাজ্যে কোন প্রজা, অর্থ কিংবা কোন প্রতিপত্তি। সেই রাজ্য তুমি নামক রানীতেই পূর্ণ। সেই ভালোবাসায় ভরা রাজ্যে প্রজা, বিত্ত-বৈভব কিংবা প্রতিপত্তি সবকিছুরই স্থান তুমি দখল করে আছ। যে রাজ্যের প্রতিটি কোনা তুমিময়। ”

কান্তা মুগ্ধ হয়ে আরমানের কথা শুনছে।

” আপনি এভাবেও কথা বলতে পারেন! যে মানুষের মুখে একমাসেও হাসি দেখিনি, আজ তার মুখে এসব শুনে আমার মাথা ঘুরছে। আমার হাতে একটা চি’ম’টি কা’টু’ন তো। তাহলেই বুঝব আপনি সত্যিই এখন আমার পাশে বসে আছেন। ”

” শরীরটা যে এত খারাপ, তবুও ফাজলামো যাচ্ছেনা? এবার উঠ। খেয়ে ঔষধ খেতে হবে। ” আরমান কান্তাকে উঠে বসতে সাহায্য করে।

রাত দুইটা। তবুও আরমানের চোখে ঘুম নেই। কান্তার জ্বর বেড়েই চলেছে। আরমান একবার ওর কপালে পানিপট্টি দিচ্ছে তো আরেকবার বালতি ভর্তি পানি এনে মাথায় ঢালছে। কান্তাও বুঝতে পারছে মানুষটাকে ওর জন্য খুব ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

” কান্তা, এই কান্তা। একটু কষ্ট করে উঠে বস তো। আমি তোমার শরীর মুছে দেই। তোমার শরীরে অনেক তাপ। ঠান্ডা পানিতে শরীর মুছলে তোমার ভালো লাগবে। ” আরমানের গলায় উদ্বেগ খেলে যায়। ক্রমাগত কান্তার জ্বর বেড়েই চলেছে। আরমান আল্লাহকে ডাকছে। রাতটুকু কোনমতে কাটলেই সকালে ওকে ডক্টরের কাছে নিবে।

” এসব কি বলছেন! আপনি আমার শরীর মুছে দিবেন কেন! আমার বুঝি লজ্জা করবেনা? আপনি দিনদিন কেমন অ’স’ভ্য হয়ে যাচ্ছেন। ” কান্তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। জ্বরের প্রচন্ডতায় চোখ খুলতে পারছেনা।

” তোমার এখন যে অবস্থা, তাতে যে কোন সময় জ্ঞান হারাতে পার। তবুও তোমার কথা বন্ধ হচ্ছেনা। তুমি কি এখন নিজ নিজে শরীর মোছার অবস্থায় আছ? দেখি একা উঠে বস তো, কেমন পার। ”

” খুব পারব। ” বলেই কান্তা বসতে গেলেই মাথা চক্কর দেয়। সাথে সাথে ধপ করে শুয়ে পরে।

” বাহ্ একা একা খুব বসতে পেরেছ। এজন্য তোমাকে পুরস্কৃত করা উচিত। বেশি কথা না বলে চুপচাপ থাক। ”

এরপর আরমান কান্তাকে তুলে বসায়। কিন্তু সে শরীর মুছে দেয়ার কথা বললেই, কান্তা আঁইগুঁই করতে থাকে। ও কিছুতেই আরমানকে দিয়ে শরীর মুছিয়ে নিবেনা। এদিকে আরমানও নাছোড়বান্দা। সে কান্তাকে হু’ম’কি’ধা’ম’কি দিয়ে ওর শরীর মুছিয়ে দেয়। পুরোটা সময় কান্তা ঠোঁট কা’ম’ড়ে, চোখ বন্ধ করে থাকে। লজ্জায় ওর শরীর মিইয়ে যাচ্ছে। ও স্বপ্নেও ভাবেনি কখনও এমন দিন কখনও আসবে। আরমানের সামনে কখনও এই অসুস্থ অবস্থায়, এভাবে নিজেকে মেলে ধরতে হবে

” লজ্জাবতীর লজ্জার পর্ব শেষ হলে চোখ খুলতে পারেন। ঝগড়া করার সময় তো লজ্জার বালাই থাকেনা। ঠাসঠাস করে কথা বলতে পারলেই তখন বাঁচেন। তখন অপ্রয়োজনে হাজার কথা বলেন, তবুও লজ্জার ল – ও দেখিনা। কিন্তু এই মুহূর্তে এত লজ্জার কি আছে! ” আরমান চেষ্টা করছে কান্তার লজ্জা ভাঙানোর।

কান্তা তবুও নিরুত্তর থাকে। ওর আরমানের দিকে তাকানোর সাহসই নেই।
আরমানও কান্তার অবস্থা বুঝতে পেরে মিটমিটিয়ে হাসছে।

পরদিন সকালে আরমান কান্তাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হতে গেলেই রাজিয়া খানমের সামনে পরে।

” এই সাত সকালে ঐ বেয়াদব মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? হয়েছে তো সামান্য জ্বর, তাতেই এমন এলিয়ে পরছে, যেন কি না কি হয়েছে! এমন ভাব করছে যেন আমাদের কখনও জ্বর হয়নি। আর তার সাথ দেয়ার জন্য তুমিও একপায়ে খাড়া হয়ে থাক! স্বামী আমারও ছিল। কই আমার অসুখ করলে সে তো এমন উদগ্রীব হয়নি। যতসব আদিখ্যেতা। যেন বাংলাদেশে আর কেউ বিয়ে করেনি, আর কারও বউ নেই। তা-ও যদি সেই বউ আবার রূপসী হত। ” মুখ ঝামটা দিয়ে বলে রাজিয়া খানম।

সারারাত ঘুম না হওয়ায় মাথা ঝিমঝিম করছিল। তারউপর এমন কথা শোনায় আরমানের মেজাজ হারায়। কড়া চোখে তাকায় রাজিয়া খানমের দিকে।

” শফিকুল ইসলাম যত্ন করেছে কি না, সেটাতো আপনাকে দেখেই বোঝা যায়। বেচারা আপনার সেবাযত্ন করতে গিয়ে অকালেই দুনিয়ার মায়া কাটিয়েছে। সে যদি আপনার সেবা না-ই করত, তবে আজ আপনি দুনিয়ায় থাকতেননা। কিন্তু দেখেন সব শত্রুদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে আপনি দিব্যি বেঁচে আছেন। আর আমার কলিজায় পেরেক মা’র’ছে’ন। আর ঐদিকে আপনার নির্বোধ স্বামী আপনার সেবা তো পায়নিই উল্টো আপনাকে হুজুর হুজুর করে গেছে। আপনি নাকি তাকে সবসময়ই দৌঁড়ের ওপর রাখতেন? আপনার জ্বালায় সবাই অতিষ্ট থাকত! এসব কিন্তু আমি আপনার শ্বশুর বাড়ির মানুষের মুখেই শুনেছি। আর সেই আপনি আজকে নিজের গুণগান গাইছেন! এত কষ্ট করে নিজেকে চেনানোর কোনও প্রয়োজন নেই। আপনাকে চিনতে কারও বাকি নেই। ” আরমান কথাগুলো বলে পৈ’শা’চি’ক আনন্দ পায়।
এরপর সে কান্তাকে ধরে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।

রাজিয়া খানমের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেছে। তিক্ত সত্যি কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে।
পাশ থেকে শ্রীজা মুখ টিপে হাসছে। ভাইয়া আজ বেশ জব্দ করেছে বুড়িকে।

” বলছি কি দাদিমা, অযথা ভাইয়ার পেছনে লাগতে যাও কেন? এতে তোমার কোন লাভ হল? শুধু শুধু তোমার অতীতের সত্যিকারের কথাগুলো সামনে চলে আসল। এরপর থেকে ভাইয়াকে এমন কিছু বলোনা যাতে তোমার অতীত আবারও সামনে আসে। এসব কিন্তু ভিষণ লজ্জার। ” শ্রীজাও একটু খোঁ’চা দেয়া৷ সুযোগ ছাড়েনা।

” শ্রীজা এসব কি বেয়াদবি? দাদিমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন? আরমানের সাথে মিশে ওর মতই বেয়াদব হচ্ছিস তুই। আর একদিন যদি তোকে এভাবে কথা বলতে শুনেছি তবে সেদিন তুই আমার হাতে থা’প্প’ড় খাবি। ” আকলিমা খানম রেগে গেছে।

” কেন মা, আমাকে থা’প্প’ড় মারবে কেন! দাদিমার আচরণ তোমার চোখে পড়লনা! সে অযথাই ভাইয়, ভাবিকে অপমান করে। নিজের সম্মান নিজেকেই রাখতে হয়। কেউ কাউকে এমনি এমনিই সম্মান করেনা। দাদিমা নিজের সম্মান নিজেই হারাচ্ছে। ” শ্রীজা আর সেখানে দাঁড়ায়না। সোজা নিজের রুমে চলে যায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here