কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ১৪

0
544

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_১৪
জাওয়াদ জামী

” এই অ’স’ভ্য মেয়ে এখানে সংয়ের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই পরিবারের সব বিষয়েই নিজেকে জড়াতে ইচ্ছে করে? আমরা চাইনা তুমি পরিবারের কোন বিষয়ের মধ্যেই থাক, সেটা কি তুমি বুঝতে পারনা? নি’র্ল’জ্জ, বে’হা’য়া মেয়ের এই সামান্য জ্ঞানটুকুও নেই! একে কিছু বলেও আবার শান্তি নেই। আরেকজন জানলে তো বাড়ি সরু মানুষকে অপমান করে ছাড়বে। ” রাজিয়া খানম হঠাৎই কান্তার ওপর খেঁকিয়ে উঠে।

” রিল্যাক্স, দাদি শ্বাশুড়ি। আমার কোন ইচ্ছেই নেই আপনার যতসব জ’ঘ’ন্য কথাবার্তা শোনার। বয়সতো আর কম হয়নি, এই বয়সে কোথায় আল্লাহ রসুলের নাম নিবেন। তা না করে মানুষের পেছনে আঙুল দিয়ে বেড়ানোয় আপনার সুখ। আপনার কথার ধারে ভদ্রলোক চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এত জোড় পান কই! গ্রামে দেখেছি আপনার বয়সী মহিলারা হয় ক’ব’রে গেছে নয়তো প্যা’রা’লা’ই’জ’ড হয়ে বিছানায় শুয়ে কা’ত’রা’য়। কিন্তু আপনি দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন। আপনার উচিত বেশি বেশি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা। এতে আল্লাহও খুশি হবেন আর আপনিও পাপ মুক্ত থাকবেন। ”

” তোমার এত বড় সাহস! তুমি আমার মৃ’ত্যু কামনা করছ? আজ শহিদ বাসায় আসুক। আমি একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। আমার সাথে এই আচরনের শোধ নিয়েই তবে ক্ষান্ত হব। ”

” আপনার ছেলেকে যা খুশি বলবেন। এতে আমার যায় আসেনা। আমিও তাকে বলব আপনি একজন ভদ্রলোকের সাথে কত খারাপ আচরণ করেছেন। ভদ্রলোক কাঁদতে কাঁদতে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আবার আমাকেও বিনা দোষে গালি দিয়েছেন। ”

” তুমি আমাকে থ্রে’ড দিচ্ছ? দুই দিনের মেয়ে। জীবনে কখনো শহরের মুখ দেখেছ? যেই ঢাকার পানি পেটে পরেছে সেই রং বদলাতে শুরু করেছ? ”

” বাহ্ দাদি শ্বাশুড়ি, আপনি দেখছি ইংরেজিও জানেন! আচ্ছা আপনি কোন শহরের মেয়ে ছিলেন বলুনতো? আমেরিকা না ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন? কাউকে কিছু বলার আগে নিজের শেকড়ের দিকে ভালোভাবে তাকাবেন। তারপর বলবেন। আমি চিন্তা করছি দাদা শ্বশুর আপনাকে সহ্য করেছেন কিভাবে! আপনার যা ঝাল। বেচারা বোধহয় দুনিয়ায় বেঁচে থেকেও মৃ’ত্যু’র স্বাদ পেয়েছে। দাদা শ্বশুরের জন্য কয়েক বালতি সমবেদনা জানাচ্ছি। ”

” বেয়াদব মেয়ে, তুমি আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হও। কোন কু’ক্ষ’নে যে শহিদ এই মেয়েকে ছেলের বউ করে এনেছে। ”

” যাচ্ছি, যাচ্ছি। আমারও শখ নেই আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আপনার ঝাল ঝাল কথাবার্তা শোনার। মুখ তো নয়, যেন মে’শি’নগা’ন। হা করলেই কথার আ’ঘা’তে মানুষের কলিজা ঝাঁ’ঝ’রা হয়ে যায়। ” কান্তাও কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেয়।

রাজিয়া খানম রা’গে থরথর করে কাঁপছে। আজ পর্যন্ত তাকে কেউ এভাবে বলেনি। দুইদিনের মেয়ের কতবড় সাহস তাকে এতগুলো কথা শোনায়!

” আম্মা, আমি আপনাকে বারবার বলেছি, ঐ অ’স’ভ্য, গাঁইয়া মেয়েকে কিছু বলতে যাবেননা। ভালো আচরণ ওর কাছে আশা করেন কিভাবে? আপনি ভেতরে যান। আপনার ছেলেকে কিছুই বলার দরকার নেই। শেষে দেখবেন হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। ”

ছেলের বউয়ের কথা মেনে নিয়ে রাজিয়া খানম নিজ রুমে চলে যায়।

রাত এগারোটা বাজে অথচ আরমানের বাসায় আসার নাম নেই। কান্তা অনেকক্ষণ ইতিউতি করে আরমানের নম্বরে ফোন দেয়। ওর বুক দুরুদুরু করছে। না জানি ওর নম্বর দেখে লোকটা কোন খোঁ’চা মা’রে। তিনবার রিং হতেই আরমান ফোন কে’টে দেয়। কান্তা ফোন হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে। যেন ও ফোনকে বলছে, কি রে রিং হতে না হতে নিতাই মাষ্টার কে’টে দিল কেন?
কিন্তু বেচারা বাকশক্তিহীন ফোন কোন জবাব না দিয়ে নিরুত্তর থাকে।

এগারোটা দশে আরমান বাসায় আসে।
ঘামে ওর শরীর জুবুথুবু। চিবুক বেয়ে কয়েক ফোঁটা নামতে নামতে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

আরমান ওর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ড্রেসিংটেবিলে রেখে আলমিরা থেকে কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢোকে। কান্তার সাথে কোন কথা বলেনা।
কান্তা এতক্ষণ তার কাজকর্ম কপাল কুঁচকে দেখছিল।

” ব্যাটার ভাব দেখ! আমার সাথে কথা বলতে তার সম্মানে বাঁধে। এমন ভাব করছে, যেন সে হাতি আর আমি পিঁপড়া! ”

নিজে নিজেই বকবক করতে করতে কান্তা রান্নাঘরে আসে। খাবার গরম করে রুমে নিয়ে আসে।
ততক্ষণে আরমান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।

কান্তা বারান্দা থেকে টি টেবিল এনে তাতে খাবার রাখে।

” তারাতারি আসুন। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। ”

” তুমি প্লেটে ভাত দাও, আমি আসছি। ”

কান্তা চুপচাপ আরমানের নির্দেশ মেনে প্লেটে খাবার তুলে দেয়।
এরপর দু’জন নিরবে খাবার খায়।

আজ ফজরের নামাজ আদায়ের পর কান্তা বই নিয়ে বসেনি। ওর শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, তাই ঘাপটি মে’রে শুয়ে আছে। সকাল সাড়ে ছয়টা বাজলেও উঠার কোন নাম নেই কান্তার। ওর বাম পাশে সটান হয়ে শুয়ে আছে আরমান। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। মাথার ওপর ফ্যান শা শা শব্দে ঘুরে চলেছে।

একটু শীত শীত বোধ হওয়ায় কান্তা শরীরে ওড়না পেঁচিয়ে শোয়। কিন্তু এতেও ওর শীত কমেছেনা। অগত্যা পায়ের নিচ থেকে কাঁথা নিয়ে শরীরে জড়ায়।

হঠাৎই বালিশের তলায় থাকা বাটন ফোনটা বেজে ওঠে। এই সকালে আবার কে ফোন করল!
কান্তা বিছানা হাতড়ে খুঁজতে থাকে তার ফোন।

এদিকে ফোনের শব্দে আরমানের ঘুম হালকা হয়ে গেছে। তবুও চুপটি করে শুয়ে থাকে।

ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে কান্তা। বড় ভাইয়া ফোন দিয়েছে!
বিয়ের একমাস পর ওর বাড়ি থেকে কেউ ফোন দিয়েছে!

” আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া। তুমি হঠাৎ ফোন দিলে যে? কারও, কিছু হয়েছে? ”

” কেউ ফোন করলে তাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে হয়, তা কি ভুলে গেছিস? এত বছরেও তুই এসব শিখলিনা? অ’স’ভ্য’ই থেকে গেলি! ”

” যে এত বছরেও কিছু শিখেনি, তার কাছ থেকে এখন ফর্মালিটি আশা করা বৃথা তা কি তুমি জানোনা? আর তাছাড়া বিয়ের একমাসের মধ্যে যে ভাইরা তার বোনের কোন খোঁজ নেয়নি, সেই বোনের কাছ থেকে তুমি সহবৎ আশা করো কোন লজ্জায়? তোমাদের কি একবারও মনে হয়নি, যে বোঝা টাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলেছ, তাকে তোমাদের জন্য কটুকথা শুনতে হতে পারে? চিরকাল তুমি অন্ধই থেকে গেলে ভাইয়া। যাকে বলে চোখ থেকেও অন্ধ। ” কান্তা ইচ্ছে করেই শুয়ে থাকা অবস্থায় কথা বলছে। আরমান যে ওর পাশে আছে তা নিয়ে ও বিন্দুমাত্র লজ্জাও পাচ্ছেনা। কারন দুইদিন আগে আর দুইদিন পরে, আরমান একদিন ঠিকই সবকিছু জানতে পারবে।

” আমি তোর হালচাল জানার জন্য ফোন দিলাম, আর তুই কিনা আমাকেই কথা শোনাচ্ছিস? এখন তো মনে হচ্ছে, তোকে বিয়ে দিয়ে খুব একটা ভুল করিনি। তোর এই ত্যা’ড়া স্বভাবের জন্যই শিখা তোকে নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে ও ঠিক কাজটাই করেছে। একটা উপদেশ দেই শোন, নিজের মুখটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখ। তাছাড়া দেখবি সারাজীবন মানুষের কটুকথা নিয়েই বাঁচতে হবে। ”

” অনেক ধন্যবাদ তোমার উপদেশের জন্য। যে মানুষ তার বউয়ের কথার বাইরে কখনও যায়না। বউয়ের কথাই তার কাছে হাদিসের ন্যায়, আর যাইহোক সেই মানুষের মুখে উপদেশ মানায়না। যে মানুষ তার বউয়ের কথা শুনে বোনের গায়ে হাত তুলতে দুইবার ভাবেনা, সে আজ তার বোনকে উপদেশ দিচ্ছে! এটাও আমাকে মানতে হবে! যে ভাই তার বোনের বিয়ের একমাস পর ফোন দিয়ে বোনের খোঁজ নিচ্ছে, সেই ভাইই আজ বোনকে উপদেশ দেয়! একটুতো লজ্জা কর ভাইয়া। ”

” তোর মত বেয়াদব মেয়েকে ফোন দেয়াই আমার ভুল হয়েছে। আজ থেকে ভুলে গেলাম, আমার কোন বোন আছে। ”

” আমার অনেক উপকার করলে ভাইয়া। তোমাদের মত ভাইদের জন্য আমার লজ্জা হয়। তোমরা যদি আমার সাথে সম্পর্ক না রাখ, তবে সেটা আমার জন্যই ভালো। তোমাদের নিয়ে অন্যকে ইনিয়েবিনিয়ে মিথ্যা বলতে হবেনা। তবে জানো তোমরা আমাকে পর করে দিলেও আমার কষ্ট হবেনা। কষ্ট হবে আরাফের জন্য। তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিতো। তোমাদের দুই ভাইয়ের মত বেইমান আমি নই। ছোটবেলা থেকে বাবা হারা বোনটাকে আপন করতে পারনি। মাথার ওপর মায়ের ছায়া ছিল তাই বড় হয়েছি। কিন্তু মা যখন মা’রা গেল তখন তোমাদের কাজের মেয়ে হয়ে রইলাম। শুধু ভাইদের জন্য দ্বায়িত্বই পালন করে গেছি। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে পেয়েছি অবহেলা, অনাদর, লাঞ্ছনা। তাদের বউদের কথা বাদই দিলাম। তারা অন্য বাড়ির মেয়ে। তাদের দূর্ব্যবহার মানাই যায়। ”

” তুই আসলেই একটা বেইমান। তোর মত বোন যেন আর কারও ঘরে না জন্মায়। আজকের পর থেকে তোর সাথে আমাদের আর কোনও সম্পর্ক থাকবেনা। ভুল করেও আমাদের ফোন দেয়ার চেষ্টা করবিনা। ”

আরমান নিজের বালিশে মাথা রাখা অবস্থায়ই অপরপক্ষের বলা কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে। ওর ভেতরটা রা’গে ফে’টে যাচ্ছে। কোন ভাই তার বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে পারে!

” বাঁচালে ভাইয়া। এই নামমাত্র ভাই-বোনের সম্পর্কের পাঠ আজ নিজের হাতে শেষ করে দিয়ে। তোমার আজকের বলা কথাগুলো আমার আজীবন মনে থাকবে। তোমার সাথে কোন সম্পর্কই আমার থাকবেনা। কিন্তু আমার বাবার রেখে যাওয়া বাড়িটার সাথে আমার নাড়ির সম্পর্ক কখনও ভোলার নয়। আমি বাবার একজন ওয়ারিশ হিসেবে, বাবার বাড়িতে যাব। কারন তার সকল কিছুতে আমার তোমাদের মত সমান অধিকার আছে। এই কথাটাও মাথায় ভালোভাবে ঢুকিয়ে নাও। সব শেষে একটা কথা বলি, তোমার নিজেরও একটা ছেলে আছে। তাকে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলো। দাবার চাল কখন উল্টে যায়, তা বলা যায়না। আর যাইহোক আমার মত কষ্ট সহ্য তোমরা কখনোই করতে পারবেনা। এবার রাখছি। ” কান্তা ফোনের লাইন কে’টে দিয়ে নিরব কান্নায় ভেঙে পড়ে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here