প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব ৩৯

0
1610

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব____৩৯

শীত শীত ভাবটা স্মরণিকা নিবাসের ইট-পাথর,আনাচে-কানাচে,ফুলে ফুলে মিশে গিয়ে বসে রইল চুপটি করে। নীরবে, নির্বিঘ্নে, এলোমেলো হয়ে শীত স্নিগ্ধ হাওয়ার সাথে মিলেঝুলে দোলা খেয়ে চলেছে হুটহাট মানবদেহে। ওলের সোয়েটারটা গায়ে জড়িয়ে শিমুল তারস্বরে পড়ছিল। আকস্মিক গলাটা আঁটকে গেল তার। কেমন মন খারাপের বাতাস শিহরণ জাগিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেল নিমিষেই। শিহরণ জাগাল সর্বাঙ্গে। বইটা ঠেলে চেয়ার ছাড়ে শিমুল। পড়ার মনটা হারিয়ে গিয়েছে। মনের অস্থিরতায় কি পড়া মগজে ঢুকে? ধুপধাপ, অগোছালো পদলি ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সকালেই সৌরভ ভাইয়ের সাথে একদফা কথা সেড়ে ফেলেছে মুঠোফোনে। তবুও মনটা এত এত আনচানের খেলায় ডুবেছে কেন? ক’দিন বাদেই পরীক্ষা। অপ্রকাশিত প্রেমিক পুরুষ আদেশ করেছেন ভালো রেজাল্ট করতে হবে। কি সুন্দর করে কথা বলেন এখন সৌরভ ভাই! একটুও বকেন না শিমুলকে। বরং আদুরে গলায় বলেন,

” তুই এক ফালি চাঁদের মতোই মায়াময় শিমুল, বরফের মতোই শক্ত মনের। অল্প প্রেম উত্তাপে গলে যাস তুই। যে কথার সৌন্দর্যের জাদুতে টানে, ধৈর্য্য ধরে পাথর মতোন কঠিন মনে প্রেম জাগায়, অনুরাগের প্রদীপ নিয়ে ভরসার আলো ছড়িয়ে বেড়ায়, বিশ্বাসের ঝুলি নিয়ে মজবুত সম্পর্কের নিমন্ত্রণ বিলি করে, তাকে চোখ বন্ধ করে হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী বানানো যায়। একদমই তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। ”

ব্যস, শিমুল বুঝে যায় তখন সৌরভের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দের মর্ম। ভালোবাসায় না কি মানুষ বোকা হয়ে যায়? জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পায়? কই! ওর পেল না তো। উল্টো ছোট বয়সে বুঝ বেড়েছে। শুধুই ভালোবাসা বুঝার বুঝ। সৌরভ ভাই যদি এক জনমেও ” ভালোবাসি,ভালোবাসি” না বলে, তবুও সে এই মধুর শব্দটা শোনা ব্যতীতই অনায়সে তার নিঃশ্বাসে,নিঃশ্বাসে মিশে থাকবে আকণ্ঠ। কেননা সেই কথাগুলোই ভালোবাসা হয়ে প্রবেশ করে শিমুলের রঙিন প্রেম মহলে।

হুট করে তার চোখের সূক্ষ্ম নজর গিয়ে পড়ে বাড়ির প্রধান ফটক পেরিয়ে রাস্তায়। পরিষ্কারভাবে দেখতে পেল ছোট মামা ওদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে ঘনঘন ইতস্ততভাব ফোটে ওঠছে। জড়তাটা পুরো চেহারা দখল করে রেখেছে, পায়ে বোধহয় শিকল হয়ে পেঁচিয়ে আছে। ছোট মামা একবার আগাচ্ছে, আরেকবার ভীষণ মলিনভাব প্রকাশ করে পিছিয়ে যাচ্ছেন। সুন্দর ভূমিতে আসার পর কোনোদিন তার কোনো মামাকে বাড়ির সামনে দেখেনি শিমুল। রবিন মামাকে দেখে বেশ চমকালো। ঘোরতর কোনো ব্যাপার না হলে তার অহংকারী, গাম্ভীর্যে ভরপুর মামাদের পায়ের ধূলি কখনোই স্মরণিকা নিবাসের মাটি ছুঁবে না৷ দৌড়ে মায়ের রুমের দরজায় দাঁড়াল সে। তপ্ত শ্বাসে,হাঁপানো স্বরে খবর দিল ছোট মামার আগমনের।

আলতার মনে হলো সে সদ্য আকাশ থেকে মাটিতে পড়ল। বিস্ময়ে নড়চড় ভোলে বসেছে। স্তব্ধ ভঙ্গিমায় মেয়ের দিকে চেয়ে মুহূর্তেই ছুটে গেল গেইটের দিক। বলা যায় না যদি রবিন চলে যায়! পায়ের গতি বাড়িয়ে এসে ছোট ভাইয়ের সমুখে দাঁড়ালো। রবিন চমকে গেলেও নিজেকে যথাসম্ভব সামলে বড় বোনের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” প্রহর কোথায় আলতাবু? ওর খোঁজে এসেছি আমি। ”

আলতা অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। চেষ্টা করলেন অশ্রুকণা চেপে রাখার। পারলেন না। মাঝে মাঝে রাস্তায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রবিনের সঙ্গে দেখা হলেও,কথা হলেও, ভাই এই বাড়ির চৌকাঠে আসে না বহু কাল,বছর। নিরু মা–রা যাবার পর তার লা–শটাও অন্তিম বার চোখের দেখা দেখতে আসে নি। রবিনের প্রতি কোনো ঘৃণা, কষ্ট কিছুই নেই আলতার। সে সম্পর্ক ভাঙতে নয়,গড়তে পছন্দ করে। অহংকার, হিংসার ধারেকাছে ভিড়েন না তিনি। ভাইয়ের হাতটা খপ করে ধরে বললেন,

” ভিতরে আয়। প্রহর ঢাকা গিয়েছে। ”
” কখন গিয়েছে? কখন ফিরবে? ”

রবিনের গলাটা অত্যধিক ভয়মিশ্রিত। আঁতকে ওঠেছে সে। আলতা ও শিমুল উভয়ে ঘাবড়ে গেল। শিমুল এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,
” কী হয়েছে মামা? ভাইয়ার সাথে কথা আছে? চলে আসবে সন্ধ্যার আগে। ”
” ও আসতে আসতে যে সব শেষ হয়ে যাবে রে। ”
আলতা ভাইয়ের বিমর্ষ কণ্ঠ শুনে আবারও কোনো অঘটনের অগ্রিম বার্তা অনুভব করলেন৷ ভাইকে টেনে নিয়ে আসলেন বাড়ির ভেতর। ব্যকুলভাবে বললেন,
” কী শেষ হয়ে যাবে? কী হয়েছে? ”
” নিশুর বিয়ে আজ বুবু। ”

আলতার সমস্ত শরীর ঝক্কি দিয়ে উঠল। শিমুল ব্যস্ত পায়ে মোবাইল আনতে গেল। ভাইকে ফোন করতে হবে,বিয়ে আঁটকাতে হবে।
” নিশুর বিয়ে মানে?”
” বড় ভাই সব জেনে গেছেন প্রহর নিশুর বিষয়ে। পাত্রপক্ষ এসে গেছে। এখনই বিয়ে। সবটার আয়োজন আমাদের লুকিয়ে করেছেন। যতক্ষণে আমরা টের পেলাম পাত্রপক্ষ হাজির, কাজীও চলে আসছে। প্রহর ছাড়া কেউ আটকাতে পারবে না বুবু। বিয়ে হয়ে গেলে কী হবে?”
” আমি যাব। বড় ভাইকে থামাব। আমার ছেলের রঙিন জীবন সাদা-কালো হয়ে যাবে,মা হয়ে আমি কেমনে সহ্য করব? তাকে ছাড়া বাঁচবে না আমার ছেলেটা। ”

শিমুল ক্রমাগত কল দিয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠ কান্নায় ভেজা ওর। চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে যাচ্ছে অবিরাম। ধরা গলায় বলল,

” ভাইয়া কল ধরছে না আম্মু। প্রত্যয় ভাইয়াও ধরছে না। ভাইয়া তো কখনো এমন করে না। এখন কী হবে? বড় মামা কখনোই আমাদের কথায় বিয়ে থামাবে না। ”

গন্ডগোলের খবর পেয়ে প্রহর ছুটে যাওয়ার আগে আলতার দুহাত আঁজলায় নিয়ে বলেছিল, ” নেতা হিসেবে আমার দলের লোকগুলোকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব মা। রেডি থেকো, এসেই নিশুকে বউ বানাতে যাব। ”

মা**রামারি, দ্বন্দ্ব এসব ভয় পান উনি। কিন্তু ছেলে দুটোই ছোট থেকেই বাবা ও জেঠার মতোই রাজনীতিবিদ হতে চায়। আর যাই হোক মানুষের ইচ্ছের ওপর লাগাম টানা খুবই অপছন্দ করেন তিনি। ইচ্ছেদের ওড়তে দিতে হয় প্রজাপতিদের মতোই। সেটা ভেবে প্রহর ও প্রত্যয় দুই ছেলেকে বাঁধা দেন নি। ভালো করেই জানেন, প্রহর সঠিক, ন্যায়ের জন্যই লড়াই করবে। কিন্তু ছেলেদের প্রাণ নিয়ে শঙ্কায় থাকেন প্রচন্ড। যেদিন থেকে প্রহরের নেতা হবার কথা চলল আলতা ঘুমাতে পারেন না। অজানা চিন্তা এসে বলে দেয় পথটা ভয়ংকর। আজও প্রহর বেরিয়ে যাওয়ার সময়টায় প্রবলভাবে ঝড় উঠেছিল অন্তরআত্মায়। সেই ঝড় বুঝি ছুঁয়ে দিল নিশাতকে। শিমুলকে বললেন ঊষাকে কল দিয়ে প্রহর, প্রত্যয়ের খোঁজ নিতে।

ঊষা কল্পনা করে নি এমন এক অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। শিমুলের কান্না জর্জরিত, অস্পষ্ট কথাগুলো তাকে আহত করেছে খুব। সে শত শত বার চেষ্টা করল প্রত্যয় ও প্রহরের সাথে ফোনে যোগাযোগ করার। তাকে বাড়িতে রেখেই ঝামেলার খবর পেয়ে ছুটে যায় প্রত্যয়। ঊষার হাত পা জমে বরফে পরিণত হবার উপক্রম। মাথাটা যন্ত্রণায় ভো ভো করছে। সূচালো একটা কিছু বুক চিরে দিয়ে লুকিয়ে পড়ল কোথাও। না আর বসে থাকতে পারবে না সে। দুটো ভালোবাসার মানুষ আলাদা হয়ে যাবে, কষ্ট নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে, এমনটা হতে দিবে না ও। রিস্ক নিয়েই হাজির হলো ঘটনাস্থলে। ততক্ষণে পরিবেশ কিছুটা শান্ত হয়েছে। সেখানে গিয়ে জানতে পারল প্রত্যয় হসপিটালে গিয়েছে। কু ডাক ছড়িয়ে পড়ে অন্তঃপুরে তৎক্ষণাত৷ তারপর গন্তব্য হয় হসপিটাল। গিয়ে এমন সময়ে একটা দুঃখের সংবাদ শুনতে হবে ভাবে নি ঊষা। তার ভিতরটা ভেঙে চুড়ে গুড়িয়ে গেল। যেই মানুষটা রক্তা–ক্ত হয়ে হসপিটালের বেডে পড়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে, তাকে কেমন করে তার প্রিয়তমার বিয়োগের খবর পৌঁছাবে ও?

বাবার পাশে গিয়ে বসল ঊষা। মোশতাক সাহেব ভাবনার জগতে নিমজ্জিত। প্রত্যয়কে এগিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল ও। চক্ষে বিঁধল, রোমশ হাতে সফেদ ব্যান্ডেজ গৌরবে লেপ্টে আছে। বুকটা হাহাকার করে উঠল নিমেষেই, কষ্ট চোখে বেয়ে ঝরল অশ্রু রূপে, নৈঃশব্দ জড়ো হলো কণ্ঠনালিতে। প্রত্যয় ওর কাছে এসে হালকা ধমকে প্রশ্ন করল,

” তুই এখানে এসেছিস কেন? এত রিস্ক কেন নিলি? বাহিরে সাংবাদিক আছে না? তোকে দেখেছে? ”

” আছে। ভাইয়ার আপডেট জানার অপেক্ষা করছেন সবাই। চারদিকে অনেক নিউজ ছড়িয়ে পড়েছে। আমায় কেউ দেখতে পায় নি। বাবার সেক্রেটারি নিয়ে এসেছে। ”

” তবুও তোর আসা উচিত হয় নি ঊষা। ইলেকশনের এই কয়েকটাদিন সবাইকে খুব সামলে থাকতে হবে। ”

গুরুতর পরিস্থিতিতে নিশাতের বিয়ের কথাটা কীভাবে বলবে ঠাহর করতে পারছে না ঊষা। কিন্তু বলতে হবেই। প্রথমে জেনে নিল,
” প্রহর ভাইয়ার কী অবস্থা এখন?”

প্রত্যয়ের নাসারন্ধ্র গলিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস উন্মুক্ত হলো। নিষ্প্রভ, পানসে মুখে প্রতুত্তর করে,

” জ্ঞান ফিরেছে। মাথায় আ–ঘাত পেয়েছে আর হাতে। মাথার আ–ঘাতের পরিমাণ একটু বেশি হওয়ায় ডাক্তার বলেছেন দুই দিন হসপিটালে থাকতে হবে। ”

” এসব কী করে হলো?”

” ভাইয়াকে আম্মু, আমি,বড় আব্বু সবাই নিষেধ করেছিলাম ঝামেলা এমনিতেই মিটে যাবে, তার যাওয়ার দরকার নেই। অপোজিট পার্টিকে লেলিয়ে দিয়েছে কেউ। হুট করেই নির্বাচনের পূর্বের অনুষ্ঠিত সম্মেলনে হাম–লা,তারপর এমন অবস্থা। পেছন থেকে ভাইয়ার মাথায় আ–ঘাত করেছে কেউ, সুযোগে ভাইয়াকে মে**রে ফেলতে চেয়েছিল। ”

ঊষা খুঁত খুঁত করছে। বাবার সামনে নিশাতের কথাটা বলবে কি-না? আর প্রহর ভাইয়ের শরীরের অবস্থা খারাপ। এমতাবস্থায় এসব বলা কি ঠিক হবে? কী করবে,কীভাবে বলবে, এ নিয়ে প্রচন্ড দ্বিধায় পড়ে গেল সে। সংশয়, হতাশা,
মনের উচাটন সবই বিশদভাবে ঊষার চোখে ফোটে ওঠছে। মানুষের চোখ না-কি কথা বলে? এই মুহূর্তে ওর চোখও কিছু বলতে চাইছে তা প্রত্যয়ের বুঝতে বেগ পেতে হয় নি। আলতো করে হাতটা চেপে ধরে বলল,
” একটু আমার সাথে আয়। ”
ও প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও প্রত্যয়ের হাঁটার তালে তালে পা ফেলল। আভিজাত্যপূর্ণ হসপিটালটায় মানুষের আনাগোনা খুবই ক্ষীণ। নির্জন করিডোরে প্রত্যয়ের চোখের সামনে এসে দাঁড়াল।

” তুই কি কিছু বলবি? কেমন যেন মুখ কালো করে আছিস। কিছু হয়েছে ঊষা?”
ঊষা দেরি না করে ভিজে আসা কণ্ঠে বলে উঠল,
” ভাইয়ার কাছে নিয়ে চলো। নিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়াকে জানাতে হবে। ”
প্রত্যয় বজ্রাহত দৃষ্টিতে চেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল,
” বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মানে? কখন?”
” আজই,এ মুহূর্তে। শিমুল ফোন করে জানিয়েছে। নিশাতের বাবা কাউকে আভাস পেতে দেয় নি। হুট করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। ”
প্রত্যয় আর বিলম্ব করল না। কারো দিকে না তাকিয়ে কেবিনে আসল সরাসরি প্রহরের কাছে। প্রহর বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছে৷ ওকে দেখেই নরম, দুর্বলভাবে বলল,

” ডাক্তারকে বল রিলিজ দিতে আমাকে সন্ধ্যার আগে। গ্রামে যাব। সাথে তোরাও যাবি। নিশুকে কথা দিয়ে রেখেছি আমি। নিশু আমার পথ চেয়ে অপেক্ষা করে থাকবে। ”

প্রত্যয় জানে নিশাতের বিয়ে হয়ে গেলে ধ্বংস হয়ে যাবে তার ভাই। মুখ নুইয়ে জানালো,

” নিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ভাই। মা গিয়েছে আটকাতে। কিন্তু বড় মামা মা’কে বাড়িতে ঢুকতে দেবে কি-না সন্দেহ আছে। ”

প্রহর তীক্ষ্ণ চক্ষে তাকাল। গর্জে উঠলো সে,

” বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মানে? কার সাথে? ”

বলতে বলতে বেড ছেড়ে নেমে এলো সে। কপালের শিরা উপশিরা টান টান হয়ে গেল৷ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল রগে রগে। খালি পায়েই দরজার দিকে এগোতে এগোতে আদেশ করল,

” গ্রামে ফোন দিয়ে মেম্বারকে ওদের বাড়িতে পাঠা, আমাদের লোক পাঠা। আমি দেখব আমার নিশুকে কে কেঁড়ে নেয় আমার থেকে। ”

মোশতাক সাহেব কেবিনের সামনেই ছিল। প্রহর ঠিকভাবে হাঁটতেও পারছে। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন,
” কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
” দেশের জন্য সবসময় ভেবেছি, কখনোই রাজনীতিতে নিজের কর্তব্যের হেলাফেলা করি নি আমি। আজ আমার ভালো থাকা হারিয়ে যাচ্ছে। আমি কীভাবে স্থির থাকতে পারি? গ্রামে যাচ্ছি আমি। ”

প্রত্যয়ও ভাইয়ের সাথে সাথে বেরিয়ে গেল। ঊষা বেরোতে নিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে বাবাকে একবার বলে গেল,

” তুমি বাড়িতে চলে যেয়ো বাবা। তোমার শরীর ভালো না। গ্রামে যাচ্ছি আমরা। জলদি ফিরে আসব। নিশুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ”

মোশতাক সাহেব মেয়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলেন নিষ্পলক। ক্রোধের অনলে জ্বলছেন তিনি। সর্বদা চেয়েছেন প্রহর যেন নিশাত থেকে দূরে থাকেন। বোনের মৃ–ত্যুর তীব্রদাহনে এখনও পুড়ছেন দিন-রাত। উজ্জ্বল সাহেব যতই ভুলে যাক, মজুমদার বাড়ির প্রতিটা সদস্যকে ক্ষমা করে দিক। তিনি সবটাই মনে যত্ন করে পুষে রেখেছেন, যা একটু একটু করে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে পুরো মজুমদার বাড়িকে।

প্রহর গাড়িতে ওঠেই প্রত্যয় থেকে মোবাইল নিয়ে নিশাতকে কল দিতে শুরু করল। কল রিসিভ হচ্ছে না। মানসপটে কালো মেঘ এসে জড়ো হলো, মেজাজটা লাগামছাড়া হয়ে গেল বড্ড। ইচ্ছে করছে নিশাতের গলা টি**পে ধরতে। সে কাউকে কবুল বলবে আর প্রহর ধৈর্য্য ধরে শান্ত হয়ে বসে থাকবে? কবুল বলার আগেই গলা টি**পে ধরে রেখে বলবে, “নে এবার কবুল বল।” ঊষাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল সন্দিগ্ধ কণ্ঠে,
” নিশু ওর বাপের ভয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে? ”
ঊষা তাড়াহুড়ো করে জবাব দিল,
” না ভাইয়া। নিশু রাজি হয় নি। জোর করেই দিচ্ছে তাকে। ”

প্রহরের রাগ কিছুটা দমল। নিশাতের ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ নেই তার। ভালোবাসা সে চোখের ভাষায় বুঝে নিতে পারে। নিশাতের চোখে ভালোবাসা আগে দেখতে পাইনি বলেই তো সে নিজেকে এতগুলো বছর দমিয়ে রেখেছিল। কেননা ভালোবাসা জোর করে হাসিলের জন্য নয়,বরং ভালোবাসাকে কোমলভাবে হৃদয়ের গোপনে আগলে রাখতে হয়। তার ভয়টা ছিল বাবার জন্য তার ভালোবাসা অস্বীকার করে বেঁকে না বসে নিশাত৷ ছোট বয়সের,ভীতু মেয়েগুলো পদক্ষেপ নিতে ভীষণ ভয় পায়। প্রহর গলা উঁচিয়ে বলে,

” শিমুলকে কল দিয়ে বল মা যেন ওই বাড়ির চৌকাঠে না যায়। আমি চাই না, মা কোনো ধরনের অপমানের কবলে পড়ুক। বিয়ে কীভাবে আঁটকাতে হবে আমি জানি। প্রহরের নিশুকে প্রহরের কাছেই সঁপে দিতে হবে মামুজানের। ”

প্রহর এবার সোজা কল দিল রফিক আজমের মোবাইলে। তিনি সমীরণকে বার বার আশ্বস্ত করছেন নিশাত একটু সুস্থ হলেই বিয়েটা হবে। বিয়ে হতে বেশি সময় লাগবে না। ৫ মিনিটের ব্যাপার। মেয়েটা একটু জ্ঞানে আসুক। সমীরণ দাঁতে দাঁত পিষে হজম করছে কথাগুলো। এত সহজে সে হাল ছেড়ে দেবে না। আগে ছিল প্রহরকে শেষ করার মনোবাসনা, এখন যোগ হয়েছে নিশাতকে প্রতিক্ষণে অল্প অল্প করে কষ্ট দেবার আকাঙ্ক্ষা। এই টুকুন বয়সের একটা মেয়ের কত বড় দুঃসাধ্য হলো ওর মুখে থুথু মা**রার। এমনকি ওর বুকে খামচি দিয়েও দূরে সরিয়ে দিয়েছে ওকে। হুম**কি দিয়েছে, ওর হাত কে–টে ফেলবে।

কাবিননামা বাড়িয়ে দিলে সাইন করবে না বলে কাঁদতে থাকে নিশাত। জোর করেও কেউ করাতে পারছিল না৷ এক সময় কাঁপতে কাঁপতে চেতনা হারিয়ে ঢলে পড়ে। পাড়ার ডাক্তার ডাকিয়ে এনেছে রফিক আজম। ডাক্তার চেইক করে জানালেন হুঁশে আসতে সময় লাগবে খানিকটা। আজ যা-ই হয়ে যাক না কেন এই বিয়ে তিনি দিয়ে ছাড়বেন। ফোনের শব্দে অচেনা নাম্বার দেখে একবার ধরবেন না ভাবলেন। তারপর আবার রিসিভ করলেন,

” হ্যালো…..”
” বিয়ে হয়ে গেছে? বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন?”
কণ্ঠ চিনতে ভুল করেননি তিনি। মৃদু ভরকালেন। গম্ভীর কণ্ঠস্বর,
” তাতে তোমার কী?”
প্রহর ভ্রুঁ কুঁচকালো। রাগত্ব স্বরে বলল,
” আমার কী মানে! আপনি আমার প্রেমিকাকে বিয়ে দিয়ে দেবেন, আবার প্রশ্ন করছেন আমার কী?”
” তোমার সাহস কি করে হলো আমার মেয়ে নিয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ কথা বলার? বেয়া–দব। ”
” জানেনই তো আমি বেয়া–দব। তাই এমন সাহস করতে আমার কষ্ট হয় না। সুন্দর করে বলছি, পাত্র যেখান থেকে ধরে এনেছেন সেখানে পাঠিয়ে দিন। ”
” তোমার কথায় পাঠাতে হবে? তুমি আমার বোকা মেয়েটাকে এভাবে ফাঁসাচ্ছো কেন? ”

প্রহরের চিবুকের উপরে ওষ্ঠাধর কোণে কালচে দাগ হয়ে আছে। স্মিত হাসিতে ঝলমল করতে লাগল সেটা। ঊষা ভাইয়ের মুখের কথা শুনতে পেল।

” ভালো কথা বললেন। ফাঁসিয়েছি তো। আপনার মেয়ে আমার ভালোবাসায় ফেঁসেছে মামুজান। যে একবার ভালোবাসার জালে আটকা পড়ে, তার আর মুক্তি মিলে না। আমিও তো সেই জ্বালে আটক। ”

” শুনো,ভালোই ভালোই আমার মেয়েকে ছাড়ো। তোমার মতো বেয়াদব চরিত্রের ছেলের কাছে আমি কখনো মেয়ে বিয়ে দেবো না। পুরো জাতই ত্যাড়া,অভদ্র। ”

প্রহরের মাথা রাগে দপদপ করতে লাগল। বি**শ্রী শব্দ বেরিয়ে আসতে হুটোপুটি করছে। ঘাড় দু’দিকে নেড়ে নিজেকে থামালো,শান্ত করল সে। বলল,

” আমার বুকের ভেতর যে ভালোবাসার বন্যা বয়ে চলেছে তাতে আমি কখনো বাঁধ দিতে পারি নি। প্রতিটি রক্ত কণিকায় মিশে থাকা ভালোবাসা নামক আসক্তি ছেড়ে দিয়ে আমি হতে পারি নি কভু নিরাসক্ত। যদি আপনি সেই আসক্তি দূর করতে পারেন, তবে আমি স্বেচ্ছায় আমার প্রাণভোমরাকে ছেড়ে দিয়ে আপনাকে জিতিয়ে দেবো। আমার প্রিয়তমার মায়াবী চেহারার দিকে ফিরেও তাকাবো না একবার। ”

রফিক আজম থমকে গেলেন। প্রবল নিস্তব্ধতা তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে আরম্ভ করল। বুঝলেন,এই ছেলে নিশাতের পিছু ছাড়বে না। একটু হুঁশ আসলেই কোনোরকমে বিয়েটা পড়িয়ে দিতে হবে। ফোন কাটতে নিলে আরও শুনলেন,

” ঝামেলা করবেন না। আমিও ঝামেলায় যেতে চাই না। আপনি মেয়ের বাবা। তাই সবিনয়ে বলছি,আমি নিশুকে ভালোবাসি। আমার হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দন নিশু,নিশু,নিশু উচ্চারণ করে। আমি কী করব? ওকে ছাড়া কীভাবে থাকব? কোথায় যাব? নিজেকে কীভাবে বাঁচাবো? আপনি ওকে আমায় দিয়ে দিন প্লিজ। ”

উনি চট করে কলটা কেটে দিলেন। এত এত ভালোবাসার কথা কোনোদিনও উনাকে হারাতে পারবেন না।
____________________

নিশাতের চেতনা ফিরতেই ফের বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়া হলো তাকে। এবার রফিক আজম নিজেই কাবিননামা নিয়ে রুমে আসল। চাপা স্বরে বললেন,

” সাইন করো, তারপর ধর্মীয় মতে বিয়ে হবে।”
নিশাত ছলছল চোখে তাকিয়ে পাষন্ড মনের লোকটার কাছে কাতর স্বরে আকুতিমিনতি করল,
” এখানে সাইন করলে আমি ম**রে যাব আব্বা। আমাকে মে**রে মাটিতে পুঁতে ফেলেন,তবুও সাইন করতে বলবেন না।”
হুংকার দিয়ে উঠলেন তিনি,
” আড়াই ঘন্টা ধরে নাটক করে যাচ্ছেন আপনি। সাইন করতেই হবে আপনার। ”
জোর করে নিশাতের হাতে কলম ধরিয়ে দিলেন তিনি। পিংকির মা পাশ থেকে মিনমিন করে বললেন,
” বড় ভাই, বিয়েটা না করতে চাইলে থাকুক। জোর করে বিয়ের মতো বন্ধনে বাইন্ধা দিয়েন না। আল্লাহ নারাজ হইব।”

রফিক আজম রক্তচক্ষু নিয়ে চাইলেন পিংকির মায়ের দিকে। পিংকির বাবাও কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু ভাইয়ের দৃষ্টি দেখে দমে গেলেন। তিনি আবারও গম্ভীর স্বরে বললেন,

” সাইন করেন আম্মা। আপনি আমাকে কঠোর হইতে বাধ্য করলেন। বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তানের কখনোই সুখ হয় না। আশা করি আমার এত বছরের কষ্টের দাম দিবেন আপনি। ”

নিশাত অসহায় চোখে আব্বার দিকে তাকাল। গলা কাঁপছে তার। আর পারছে না লড়াই করতে। বুকটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। কখন আসবে প্রহর ভাই? তার ছোট প্রানটা যে আর পারছে না। বাবা-মার সাথে কেইবা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে? কলমটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে নিল হাতটা। মনে মনে ভেঙে পড়ল ভীষণ। বলল,” আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন প্রহর ভাই। আপনার তিলবতী খুব ভালোবাসে আপনাকে। ” আব্বার দিকে তাকিয়ে জেদি গলায় বলে উঠল,
” এই সাইন আমাকে আর প্রহর ভাইকে মে**রে ফেলবে আব্বা। আপনি দায়ী থাকবেন আমাদের মৃ**ত্যুর। আমার কাছ থেকে আপনি ক্ষমা পেয়ে গেলেও, প্রহর ভাইয়ের কষ্টের জন্য আপনাকে কোনোদিন ফুপি, শিমুল, কেউ ক্ষমা করবে না। ”

সাইন করতে নিয়ে হাতটা কাঁপতে লাগল নিশাতের। রোকেয়া মেয়েকে ঝাপটে ধরলেন,
” সাইন করতে হবে না তোর। আমরা দুজনে চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে। ”
রবিন এসে কলমটা নিয়ে বলল,
” উঠে আয়। নিচে বিয়ে হবে তোর,প্রহর এসেছে। ”

সমীরণ স্তব্ধ, নির্বাক প্রহরকে দেখে। তার মা প্রহর কেন এখানে এসেছে জিজ্ঞেস করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। প্রহর সমীরণের সামনের সোফায় বসে ঠান্ডা মাথায় এক বাক্যে উত্তর দেয়,

” মামুর বাড়িতে মামুর মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি আন্টি। ”

তনুজার বাবা-মা হকচকালেন। স্পষ্ট স্বরে চেঁচালেন,
” মানে?”
প্রহর আগের মতোই বলল,” বিয়ে করতে এসেছি। ”
প্রত্যয় আর ঊষাকে রেখে উপরে গেল সে। সমীরণ উঠতে নিলে প্রত্যয় বাঁধা দেয়,
” বোস এখানে,বিয়ের দাওয়াত খেয়ে যাস। ”

প্রহর সাথে কাজী নিয়ে এসেছে। নিশাত কারো তোয়াক্কা না করে ডেকে উঠল,” প্রহর ভাই!”
প্রহর চোখ বুঁজে ফেলল। বিড়বিড় করল নিজ মনে, ” নিশু রে,দেখ আমার কলিজা কাঁপছে, তুই কেন এত সুন্দর করে সাজলি?”
শ্যামবরণ, ধারালো চেহারায় ছোপ ছোপ কালো দাগ,মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ। নিশাতের বুক ভেসে যাচ্ছে কান্নায়। প্রহরের সাথে আনা কাজী কাবিননামা বের করে নিশাতের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। প্রহর নির্ভয় হয়ে বলল,

” তোর এটাই সাইন করতে আপত্তি নেই তো মেহরিন মজুমদার নিশাত?”

নিশাত আব্বার দিকে এক পল চাইল। রক্তাভ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন। প্রহর ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে,

” তুই সাইন কর। বাড়ির সবাই আমাকে জামাই হিসেবে চায়,মামুজানও চাইবেন। ”

রফিক আজম দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
” আমি তোমাকে পুলিশে দেবো। ”
প্রহর তার মামুজানের দিকে গাঢ় চোখে চেয়ে বলল,
” পুলিশ বাড়ির বাহিরে আছে। সাথে নিয়ে এসেছি। নিশুকে বিয়ে করে চলে যাব জে**লে। ”
রফিক আজমের মুখে থমথমে ভাব।
” তুমি মজা করছো আমার সাথে!”
রোকেয়া মেয়ের কানে ফিসফিস করলেন,
” এবার তো পালিয়ে যাওয়া লাগবে না তোর। প্রহর হীরের টুকরো। তোর বাবা একদিন ঠিকি মানবে। সবার সামনেই তোকে বিয়ে করতে বীরের মতো আসল ছেলেটা। এমন বীরকে না মেনে যাবে কই?”

নিশাত গুটি গুটি হাতে নিজের নামটা লিখে দিল ভিতরের ধুকপুকানি সমেত। আইনত হয়ে গেল সে তার প্রহর ভাইয়ের বউ। যা হবে হোক, প্রহর ভাই ঠিক সামলে নেবে। পৃথিবীতে সে বোধহয় প্রথম বউ, যার বিয়ে হয়েছে তর্কাতর্কির মাঝে। কাজী সহাস্যে বললেন কবুল বলতে।

নিশাত মায়ের দিকে একবার তাকালো, আব্বাকে কয়েক সেকেন্ড দেখল,প্রহর ভাইয়ের চোখের মাদকে আসক্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কবুল,কবুল,কবুল। ”

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সমীরণের পাশাপাশি আপনারা সবাইও অবশ্যই বিয়ের দাওয়াত খেয়ে যাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here