#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ২৪)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
চারিদিকে রং বেরঙের ছোট ছোট লাইট জ্বলছে। পুরো বাড়িটাই অর্কিড আর স্টারগেজার দিয়ে সাজানো হয়েছে। লোকজনের সমাগমে মুখর হয়ে উঠেছে পুরো পরিবেশ। স্টেজের উপর রাজকীয় চেয়ারে বসে আছে মারুফা আর আয়াত ভাইয়া। মাঝে মাঝে আয়াত ভাইয়া মারুফার কানে কানে কিছু বলছেন আর মারুফার গাল দুটো লাল, বেগুনি রং ধারণ করছে। দূর থেকে ওদের কার্যকলাপ দেখে মুখ টিপে হাসছি আমি। নির্ভীক মহাশয় নিজের কাজে ব্যাস্ত। ভাইয়ের বৌভাত এর অনুষ্ঠান বলে কথা কাজ তো থাকবেই। মামনি আর কাকিমনি রান্নাঘর সামলাচ্ছেন। আমি গিয়েছিলাম সাহায্য করতে কিন্তু ওনারা ঠেলে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনেক বলেও বোঝাতে পারিনি আমি। ওনাদের এক কথা, “আজ তোমাকে কোন কাজ করতে হবে না ভবিষ্যতে তো তোমাকেই এসব সামলাতে হবে আজ নাহয় থাক। তুমি বরং তোমার বন্ধুর সাথে থাকো।” কিন্তু আমি খুব ভালো করে জানি আমাকে কোনদিনই কাজ করতে দেবে না এনারা। ঠিক কোন না কোন বাহানা দিয়ে পাঠিয়ে দিবে। ভেবে অবাক লাগে এনারা কি আমার শশুর বাড়ির লোকজন! নাকি আমার বাবা মা! এতো ভালো কেন এই মানুষগুলো। এতো ভালো হওয়াটা কি ভালো কথা নাকি? এমন হলে তো আমি দিনদিন লাট সাহেব হয়ে যাবো। এমনিতেও অলস আরো বেশি অলস হয়ে যাবো। কিন্তু মামনি তো এই কথাটা মানতে নারাজ। মিউজিক এর আওয়াজ এ ঘোর কাটলো আমার। সামনে তাকিয়ে দেখি আয়াত ভাইয়া আর নির্ভীকের সব বন্ধুরা চলে এসেছে। হুট করে নজর গেল নির্ভীকের উপর। খয়েরী রংয়ের পাঞ্জাবী পড়েছেন উনি। ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের দিকে তাকালাম। আমার ল্যাহেঙ্গাটাও খয়েরী রঙের। ল্যাহেঙ্গাটা সকলে উনিই দিয়েছেন আমায়। মুচকি হেসে উনার দিকে তাকালাম। এবার একটা বিষয় আমার নজরে পড়লো। তাশা নির্ভীকের আশেপাশে ঘুরঘুর করে বেরাচ্ছে। একবার উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আবার পেছনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। কখনও নিজেকে চুল ঠিক করছে তো কখনও বা মেক আপ। ওর এমন অবস্থা দেখে আমার একরকম হাসি পাচ্ছে। আবার রাগ ও লাগছে। হাসি পাচ্ছে এই ভেবে যে, বেচারী নির্ভীকের অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য কত ডেসপারেট হয়ে আছে। আর রাগ লাগছে এই ভেবে যে, এই মেয়ে আবার বরের দিকে নজর দিচ্ছে! কত বড় সাহস। ও কিনা আমার বিয়ে করা বরের দিকে নজর দেয়। আমি গিয়ে নির্ভীকের পাশে দাঁড়ালাম। উনার দিকে আড়চোখে তাকালাম। উনি আমার দিকেই চেয়ে আছেন। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মারুফার দিকে তাকালাম। ও ঈশারায় আমাকে নিজের কাছে ডাকলো। আমিও ওর কাছে এসে দাঁড়ালাম। ও বলল,,
–“দোস্ত আর কতক্ষণ এইভাবে বসে থাকবো? আমার খুব অস্বস্তি লাগছে এতো লোকের মাঝে এমন শং সেজে বসে থাকতে একদম ভালো লাগছে না।”
আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম,,
–“একটু কষ্ট করে আজকের দিনটা ম্যানেজ করে নে বইন। কাল থেকে একটু রিলিফ পেলেও পেতে পারিস। এখন কিছুই করার নেই।”
ও দুঃখী দুঃখী ভাবে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল,,
–“হুদাই বিয়ের জন্য এতো অনুষ্ঠান করার কি আছে বলতো? আমার তো এবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সবাই তো নিজেদের মতো ব্যাস্ত আর এদিকে বর কনে দুজনের অবস্থাই শোচনীয়! বসে বসে পিঠের হার ও বাঁকা হয়ে গিয়েছে। কোথায় নিজের বিয়েতে আমি একটু আনন্দ করবো তা না এমন ভারী সাজে বসে থাকতে হচ্ছে।”
–“কথাটা ভুল বলিসনি! কিন্তু কিছু করার নেই রে..!!”
হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো। নির্ভীকের বন্ধুরা কাকে যেন বকাঝকা করছে। ব্যাপারটা কি হলো? সবাই কার সাথে এতো রাগারাগী করছে? কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আর যেতেই যা দেখলাম তাতে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো। এটা কিকরে হলো? নির্ভীক এর হাতের কনুই এর নিচ থেকে বেশ অনেকখানি কেটে গিয়েছে আর সেখান থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু উনি একদম ভাবলেশহীন ভাবে উনার হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন।মনে হচ্ছে ওনার কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমার তো যায় আসছে।
আমার মনে হচ্ছে আঘাত টা আমি পেয়েছি। এই মুহূর্তে কিছুই যেন আমার মাথায় ঢুকছে না। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। আশেপাশে কি হচ্ছে কোন খেয়াল নেই। বারবার একটা কথাই আসছে সেটা হলো, “উনার হাতে রক্ত! উনি ব্যাথা পেয়েছেন। কিছু কর! যেকোনো ভাবে উনার ব্যথাটা গায়েব করে দে!” আমি দৌড়ে গিয়ে ওনার হাত ধরে ফেললাম। তারপর উদ্বিগ্ন গলায় বললাম,,
–“কি করে হলো এটা? কিছুক্ষণ আগেও তো ঠিক ছিলেন তাহলে কি করে হলো? এতো খানি কাটলো কি করে? আমাকে বলছিলেন আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি না! এখন আপনিই তো নিজের খেয়াল রাখছেন না।”
আমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছি। ছলছল চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি আবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। আশেপাশের সবাই হয়তো কিছু বলছিল কিন্তু আমার সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। কারোর কোন কথা না শুনে ওনার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে এলাম। ফার্স্ট এইড বক্স এনে তুলো দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে করুন স্বরে বললাম,,
–“কেন করেন এমন? আশেপাশের জিনিসপত্র খেয়াল করতে পারেন না। কতখানি কেটে গিয়েছে আর আপনি কিনা ওখানে ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে ছিলেন। সেদিন আমি নাহয় বুঝতে পারিনি কিন্তু আজ আপনি তো বুঝেছিলেন। আপনি খুব খারাপ জানেন? জানেন আপনার হাতে রক্ত দেখে কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি? কোন ধারণা আছে আপনার?”
একনাগাড়ে এসব বলে থামলাম আমি। উনি উত্তর দিলাম না। চোখ বেঁয়ে পানি পরছে আমার। নিজের হাত কাটলেও মনে হয় এতোটা কষ্ট হয়নি। ব্যান্ডেজ করা শেষ করে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছেন! আজব তো উনি হাসছেন কেন? এভাবে হাসার মানে কি?
–“আপনি হাসছেন কেন? আজব মানুষ আপনি, এদিকে আমার জান যায় যায় অবস্থা আর আপনি হাসছেন! এটা কি করে হলো সেটা বলুনতো। একটু আগেও তো সব ঠিক ছিলো..!”
–“আরে তেমন কিছু হয়নি। ঐ রেহান ছুরি নিয়ে যাচ্ছিল। এদিকে আমরা সবাই গল্পে বিজি ছিলাম। গল্পের মাঝেই হঠাৎ ইমতি ধাক্কা দিয়ে দেয়। আমিও কাল সামলাতে না পেরে কিছুটা পিছিয়ে যাই তখনই কোনভাবে ঐ ছুরিটার সাথে লেগে গিয়েছে হয়তো!”
–“তো আপনি হাসছেন কেন?”
উনি আবার ও হাসলেন তারপর বললেন,,
–“কারণ তুমি কাঁদছো?”
–😒
উনার কথা শুনে চোখের পানি মুছে ফেললাম। আসলেই আমি কাঁদছি? এতোক্ষণে হুঁশ ফিরলো আমার। আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,
–“সত্যি বলতে তখন আমার কি হয়েছিল জানি না। মনে হচ্ছিল আঘাত আপনার না আমার লেগেছে। কষ্ট হচ্ছিল খুব। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন তো! যদি ছুরিটা হাতে না লেগে অন্য কোথাও লাগতো তখন?”
উনি কিছু বললেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে যেতে যেতে বললেন,,
–“তুমি নতুন প্রেমের জোয়ারে ভাসছো শর্মি! কিন্তু আমি তো সেই কবেই প্রেমের গহিন অতলে তলিয়ে গিয়েছি। মাত্র কয়দিনেই তোমার এই অবস্থা তাহলে আমার কথাটা ভাবো!”
এতটুকু বলেই উনি চলে গেলেন। বাইরে সবাই হৈচৈ করছে। অনুষ্ঠানে ব্যাস্ত সবাই। আর আমি! আমি তো উনার বলে যাওয়া কথাগুলো ভাবছি আর বিশ্লেষণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। কোন কিছু বিশ্লেষণ করতে না পেরে উঠে দড়জার কাছে আসতেই ঠাস করে কিছু পড়ে গেল। ঘুরে তাকিয়ে দেখি একটা ডায়রি পরে আছে। সেটা দেখেই ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। ডাইরি টা হাতে তুলে নিলাম। বেশ সুন্দর ডায়রি, উপরে খুব সুন্দর করে লেখা, “অনুভূতি”। এটি দেখে কৌতুহল হলো ডায়রিটা পড়ার। কিন্তু অন্যের ডায়রি বিনা অনুমতিতে পড়াটা কি ঠিক হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই ডায়রিটা খুলেই ফেললাম। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,,
“ডায়রি লেখার কোন অভ্যাস নেই আমার। কোনদিন লিখিও নি আর লেখার ইচ্ছাও হয়নি কখনো। আমার মতে ডায়রি লেখা এক ধরনের বোকামি বৈ আর কিছু নয়। কিন্তু আজ সেই বোকামিটাই করতে ইচ্ছে করছে। জীবনের কিছু সুন্দর অনুভূতি গুলো কাগজে বন্দি করে রাখতে মন চাইছে। কারণ আমি এই অনুভূতি গুলো ভূলতে চাই না কখনও। আর যদি কখনো ভূলেও যাই তাহলে এই ডায়রিটা আমায় মনে করিয়ে দিবে।”
প্রথম পৃষ্ঠায় এটুকু পড়েই বেশ অবাক হলাম আমি। নির্ভীক আর ডায়রি! কৌতুহল টা আরো বেরে গেলো। উনার মতো ছেলে ডায়রি তে কি লিখে রাখতে পারে। এই ভেবে পাতা উল্টালাম আমি।
“আমি যে এতো বাজে ভাবে কারোর মায়ায় জরিয়ে যাবো কখনো ভাবিনি। কিন্তু আমার ভাবনার অপেক্ষা না করেই এই বেহায়া মনটা তার পানেই ছুটে যায় বারবার। কালো শাড়ি পরে আম্মুর সাথে কথা বলছিল সে। কালো রঙে যে কাউকে এতো কিউট লাগতে পারে সেটা কল্পনাতেও ছিল না আমার। ফর্সাও না আবার কালোও না সত্যি এমন মেয়ে কখনো দেখিনি আমি! মনে হয়েছিলো নিজের কাছে বসিয়ে সারাজীবন শুধু দেখতেই থাকি ঐ মুখখানি! সেদিন ই ভেবে নিয়েছিলাম আমার ওকে চাই! চাই মানে চাই! ওর কনফিউজড হয়ে যাওয়া চেহারা দেখেই হয়েছিলো আমার সর্বনাশ! আমি ফেসে গিয়েছি, আর বেরোতে পারবো না এই জাল থেকে। ওর হুটহাট রেগে যাওয়া আবার একটু পরেই ভয়ে সিটিয়ে যাওয়া! কি মারাত্মক ওর সে চাহুনী! তাই তো ইচ্ছে করেই রাগিয়ে দিই মেয়েটাকে। যখন ও হাসে তখন ঐ হাসির ঝংকার আমার মনে ঝড় তোলে। মনে হয় হাসিতেই আছে আমার সাফল্য! মাঝে মাঝেই রাতে ছুটে যাই ওর বাড়ির পাশের রাস্তায়! ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর ও যখন জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় ওকে একনজর দেখেই ফিরে আসি আমি। তারপর ই নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। আজ প্রায় ২ বছর ৬ মাস হতে চললো। অথচ এ সম্পর্কে ও কিছুই জানে না। আমি জানাইনি। কারণ আমি ওকে নিজের প্রেমিকা হিসেবে নয় নিজের বউ হিসেবে দেখতে চাই। কি দরকার এখনকার ঐ সো কল্ড রিলেশনশিপে যাওয়ার। তার থেকে বিয়ে করে নিজের বউ বানিয়ে নেওয়াটাই ভালো নয়কি? ততদিন আমি ওকে চুপিচুপি ভালোবেসে যাবো। তখন এমনি ভেবেছিলাম আমি। আর ভাগ্যের কি খেলা দেখ, আজ সেই আমার বউ। জানি সেও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি এখনো তাকে সরাসরি বলিনি আমি তাকে ভালোবাসি। সেও বলেনি। তবুও আমরা দুজনেই জানি যে অপরপাশের মানুষটি আমাদের অনেক বেশি ভালোবাসে! আচ্ছা ভালোবাসি ভালোবাসি বললেই কি ভালোবাসা প্রকাশ পায় তাছাড়া পায়না? ছোট ছোট আচরণেও ভালোবাসা প্রকাশ পায়! অনুভূতি গুলো কে তো আর বলে প্রকাশ করা যায় না। এই যে বউ! যদি কখনো এই ডায়রিটা তোমার হাতে পরে তাহলে চুপিচুপি পড়ে নিও আর যেনে নিও তোমার বরটা তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”
মুচকি হেসে ডায়রিটা টেবিলের উপর রেখে দিলাম। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আমি ভাষাহারা! কেউ এমনও ভাবতে পারে! ভাবতে ভাবতেই বেড়িয়ে এলাম ঘর থেকে। নির্ভীক তাঁর বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে আছে। আমি দূর থেকে উনাকে দেখছি। ভাবছি এই সুন্দর মনের মানুষ টা আমার! শুধুই আমার!
·
·
·
চলবে………………………..