#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ০৪)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
আম্মুউউ তোমার মেয়েটা আজ শহীদ হয়ে যাবে গো। এখন যে আমার সাথে ঠিক কি কি হবে সেটা খুব ভালো মতোই আন্দাজ করতে পারছি আমি। এরকম আগেও ঘটেছে কিনা!
ভয়ে ভয়ে ভাবতে লাগলাম সেই দিনের কথা তখন আমি কলেজে উঠেছি। মারুফার সাথে লাইব্রেরী থেকে বই হাতে বের হচ্ছিলাম আমি। ঠিক তখনই কোথা থেকে সান ভাইয়া এসে সামনে দাঁড়ালো। হঠাৎ এইভাবে সামনে চলে আসায় কিছুটা দূরে সরে গেলাম। আর একটু হলে ধাক্কা লেগে যেত। উনার দিকে তাকাতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। নির্ভীকের বেশিরভাগ বন্ধু কেই আমি চিনি। সবাইকে বেশ ভালো মেন্টালিটির ই মনে হয় ব্যাতিক্রম শুধু সান ভাইয়া। কেমন যেন গায়ে পড়া স্বভাবের। একে আমি যথা সম্ভব এড়িয়ে চলি কিন্তু কেউ যেতে সামনে আসলে তাকে তো আর এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সান ভাইয়া দাঁত কেলিয়ে বললেন,,
–“হেই পিচ্চি কেমন আছো?”
মুখে প্লাস্টিকের হাঁসি ঝুলিয়ে বললাম,
–“জ্বি ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কি কিছু বলবেন? না মানে এই সময়ে এখানে তাও আবার প্রায় দৌড়েই আসলেন তাই বলছিলাম এখানে কোন কাজ ছিলো কিনা?”
আমার উপর টা মনে হয় ওনার ঠিক পছন্দ হলো না!
–“না। কেন কাজ না থাকলে আসতে পারি না বুঝি?”
–“তা কেন হবে? এটা তো সরকারি কলেজ যখন তখন যে কেউ আসতে পারে হেহে! যাই হোক ভাইয়া আমার না ক্লাস আছে। আমি আসছি।”
ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে ক্লাসের দিকে যাচ্ছি আর ভাবছি ইনডাইরেক্টলি যে পিঞ্চ টা করেছি তাতে আর জীবনে আমার সাথে কথা বলবে না। কিন্তু মুহূর্তেই আমার ধারণা ভূল প্রমাণিত করে দিয়ে আবারও সামনে এসে দাঁড়ালেন সান ভাইয়া। আচ্ছা এই লোকটার আত্নসম্মান বোধ বলে কি কিছু নেই নাকি? যত্তসব!
–“জানি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো। কিন্তু বেশিদিন এটা পাড়বে না,,,,
আমি মাথা তুলে তাকাতেই দেখি নির্ভীক রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওরে সর্বনাশ! উনি এখানে কেন? উনার তো রাজশাহীতে থাকার কথা। এইভাবে রাগী লুকে কেন তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি আবার কি করলাম। আমি নির্ভীক এর দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছি। সান ভাইয়ার কোন কথাই কানে ঢুকছে না আমার। এর মাঝে কখন যে সান ভাইয়া আমার হাত ধরেছে বুঝতেই পারিনি। সান ভাইয়া হয়তো নিচে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন। কিন্তু আমার তো সেদিকে কোন খেয়াল ই নেই। হঠাৎ নিলা এসে আমাকে টেনে ক্লাসে নিয়ে এলো। ডেস্কে বসার পর বলল,,
–“ঐ তোর খেয়াল কোন জাইগায় আছিলো রে। ঐ পোলা তোর হাত ধরছিলো আর তুই চুপচাপ খারায় আছিলি!!
নিলার কথা শুনে আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। ঐ আহাম্মক আমার হাত ধরেছিলো!! কোন রকমে নিলাকে ম্যানেজ করলাম। কিন্তু আমার জন্য যে যমরাজ অপেক্ষা করছিলো সেটা তখনও জানতাম না। ক্লাস শেষে বের হতেই কেউ আমার হাত ধরে টেনে একটা ফাঁকা রুমে নিয়ে গেল। আচমকা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। রুমটা দেখে বুঝলাম এটা প্র্যাকটিস রুম আর এই রুমটা সাউন্ড প্রুফ যাতে ক্লাসে কোন অসুবিধা না হয়। হঠাৎ কারো শব্দে পেছনে ঘুরে তাকালাম। নির্ভীক দাঁড়িয়ে আছে। উনার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। হঠাৎ এমন রাগের কারণ বোধগম্য হচ্ছে না আমার। উনি একদম আমার মুখের সামনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,
–“তুই সানের সাথে এতো হেসে হেসে কথা বলছিলি কেন হ্যাঁ? খুব ভালো লাগে তাইনা? খুব ভালো লাগে ওর সাথে কথা বলতে, ওর হাত ধরতে! এই তোর সাহস কিভাবে হয় ওর সাথে কথা বলার। তোকে আমি বারণ করেছিলাম না সানের সামনে যেতে। বলেছিলাম না ওর থেকে দূরে থাকতে তাহলে কেন গিয়েছিলি? বল ”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,,
–“আমি কি ও,, ওনার সামনে গিয়েছিলাম নাকি,,! উ,,উনি নি,নিজেই তো আমার সামনে এসে,এসেছিলেন।”
এতটুকু বলতেই দিলেন এক ধমক!
–“ও সামনে আসলেই কথা বলতে হবে? হাত ধরতে হবে? নাহ তোকে এইভাবে ছাড়া যাবে না। কোন হাত ধরেছিল ও, এই হাত? (আমার ডান হাত ধরে) বল (জড়ে চিল্লিয়ে)
উত্তরে আমি শুধু মাথা নাড়ালাম। আমার হাতটা উনি যথেষ্ট জোরে চেপে ধরেছেন। ব্যাথা লাগছে আমার কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। সব কথাগুলো গলার মধ্যে এসে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। এর ই মাঝে আমার হাতটা কামরে ধরেছেন।
এইটুকু মনে পড়তেই কয়েকটি শুকনো ঢোঁক গিললাম। আমার বাম হাতটা ডান হাতের উপর চলে আসল। সেইদিন আমার হাতের কি হালটাই না করেছিলেন উনি। হাত কেটে রক্ত বের হয়ে গিয়েছিলো। এখনও জায়গাটায় হালকা চিহ্ন আছে। আজ আবার সেরকম কিছু করবেন না তো! উনি শয়তানি হাসি দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমার তো ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমি যেন ফ্রিজড হয়ে গিয়েছি। আচ্ছা আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি! উনার কাছ থেকে এইরকম ব্যবহার একদম ই অপ্রত্যাশিত। উনি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,,
–“তুই কি ভেবেছিলি আমি ঐদিনের মতো তোর হাতে কামড়ে দিবো? আমি চাইলেও আর সেরকম কিছু করতে পারবো না। কারণ তোর কিছু হলে আমাকেই ভুগতে হবে আমার প্রিয় আম্মাজান আমায় জীবন্ত সমাধি দিয়ে দিবে।”
আমি মাথাটা ডান দিকে ঘোড়াতেই দেখলাম মামনি মুচকি হেসে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছেন। তো মামানির কথা ভেবে উনি এইরকম করলেন। আর আমি কিনা ভাবলাম,,ধুর আচ্ছা ধরিবাজ ছেলে তো। মামনি চলে যেতেই আমি উনাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলাম। মেজাজ চরম বিগ্রে গিয়েছে। আমি রাগি চোখে উনার দিকে তাকালাম। কিন্তু এতে উনার কোন ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। উনি নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছেন। মন তো চাইছে এই মুহূর্তে একে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দি। উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি এবার উল্টো দিকে ফিরে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলাম, উদ্দেশ্য নিচে গিয়ে মামনির কোলে মাথা দিয়ে ঘুমানো। কিন্তু সেটা আর হলো কই? কিছুদুর এগোতেই হাতে টান পরলো। আমি আমার হাত মোচড়ামোচড়ি করছি। কিন্তু হাত ছুটাতে পারছি না। হঠাৎ উনি হ্যাঁচকা টানে আমার হাত দুটো পেছন দিকে মুরিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলেন। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ছোটার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। উনার মতো হাতির হাত থেকে ছোটার আশা আমার মতো বাচ্চা মেয়ের পক্ষে যে নেহাতই দুরাশা সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলাম। তাই নড়াচড়া বন্ধ করে চুপ করে রইলাম। গতবারের মতো এবারও উনার রাগ এসে আমার হাতের উপর ই পরলো। উনি একটু জোরেই বললেন,,
–“একদম নড়াচড়া করবি না বলে দিলাম। এতো জোড় পাচ্ছিস কোথা থেকে? কাল সন্ধ্যা থেকে এখনও পর্যন্ত কিছু কি মুখে তুলেছিস বলে তো মনে হয় না! তাহলে এতো জোড় আসছে কোথা থেকে? আমি একটু নিচে যাচ্ছি। ফিরে না আসা পর্যন্ত এখান থেকে এক পা ও নড়বি তো খুন হয়ে যাবি বলে দিলাম। একদম চুপচাপ লক্ষি মেয়ের মতোন এখানেই থাকবি।”
বলেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। আর আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। হাত দুটো সামনে এনে দেখলাম পুরো লাল হয়ে আছে। এতো খারাপ কেন এই মানুষটা? খালি আমার সাথেই এমন কেন করেন উনি? কই নূপুর যখন সান ভাইয়ার সাথে কথা বলে তখন তো উনি কিছু বলেন না তাহলে আমার সাথেই কেন? আব্বু! প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও না এখান থেকে। তোমাকে বড্ডো বেশি মিস করছি আমি। এর মাঝেই উনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ছাদের রেলিংয়ের পাশে বসিয়ে দিলেন। উনার হাতে একটা খাবারের প্লেট। উনি সুন্দর করে ভাত মাখিয়ে হাতে নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরলেন। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম যার অর্থ আমি খাবো না। কিন্তু পরমুহূর্তেই উনার ধমক শুনে খেতেই হলো। উনি খুব যত্নসহকারে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিজেও খাচ্ছেন। হুহ এখন ঢং করে খাওয়ানো হচ্ছে আর কিছুক্ষণ আগেই তো। খাওয়া শেষে প্লেটটা সাইডে রেখে হাত মুখ মছে সোজা আমার মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন উনি। আমি হকচকিয়ে গেলাম। বললাম,,
–“আরে আরে! কি করছেন কি আপনি?”
–“চুপ! একদম চুপ! ঘুম পাচ্ছে আমার। ঘুমোতে দে একটাও কথা বলবি না।”
–“ঘুম পেয়েছে তো নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমোন। এখানে কেন?”
উনি চোখ বন্ধ করেই বললেন,
–“দেখ! এখন কোন কথা বলবি না তুই। কাল রাতে ঘুম হয়নি আমার। এখন সেই লেভেলের ঘুম আসছে।তাই বলছি একদম চুপ করে বসে থাক। আর এতো নড়াচড়া করছিস কেন তুই? একদম নড়াচড়া করবি না। এইভাবেই বসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দে। নাহলে আমি যে কি করবো (এক চোখ খুলে দুই হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে) বুঝতেই পারছিস!!” (বাঁকা হেসে)
উনার কথার ঠিক কি রিয়্যাকশন দিবো ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। কি অদ্ভুত হুটহাট কি করে বসে নিজেও জানে না। আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। উনি আবার ও চোখ বন্ধ করেই বললেন,,
–“তুই নিশ্চয়ই এমন কিছু চাস না। তাই চুপচাপ যা বলছি কর। চুলগুলো টেনে দে প্লিজ। ভালো লাগছে না। নাহলে,,,
–“এই নানা!! দিচ্ছি তো মানে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি তো!”😅
আমি চুপচাপ ওনার মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। আর উনি বললেন,
–“গুড”
গুড মাই ফুট। উনি আরামসে এখানে ঘুমোবে আর আমি কি করবো? কিনা এই উগান্ডার প্রেসিডেন্টের চুল টেনে দিবো। ইচ্ছে তো করছে এর সবগুলো চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলি। ব্যাটা ইবলিশ। এর মধ্যে উনি ঘুমিয়েও পড়েছে। বাব্বাহ সো ফাস্ট হা। হঠাৎ উনার ঘুমন্ত মুখটার দিকে চোখ পড়লো আমার। কি নিষ্পাপ লাগছে ছেলেটাকে। ঘুমোলেও বুঝি কাউকে এতো বেশী সুন্দর লাগতে পারে? নাকি আমার কাছেই এরকম লাগছে। মাঝে মাঝে হিংস্বে হয়। খুব বেশি হিঃস্বা হয়। ছেলেরা কেন এতো সুন্দর হবে হ্যাঁ। এটা কিন্তু ঠিক নয় আল্লাহ। হঠাৎ টের পেলাম উনি কাঁপছেন। ঠান্ডা বাতাস বইছে। কাঁপা টাই স্বাভাবিক। আমি নূপুর কে ফোন করে একটা চাদর আনতে বললাম। কিছুক্ষণ পর নূপুর এলো। উনাকে এইভাবে দেখে মনে হয় একটু বেশিই অবাক হয়েছে নূপুর। পুরো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,,
–“কিছু বলবে নূপুর?”😒
–“না ভাবী কিছু না।”😁
নূপুর হাসতে হাসতে চলে গেল। এবার আমার লজ্জা লাগছে। নূপুর কি ভাবলো? এই ছেলের জন্য আর কত কিছু যে হবে কে জানে। সেই প্রথম দিন থেকে কোন না কোনভাবে আমাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলাই যেন এর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। ধুরর ভাল্লাগে না।☹️
·
·
·
চলবে………………………