#চুপিচুপি_ভালোবাসি (পর্ব ০৩)
#আয়েশা_আক্তার
·
·
·
ছাদ থেকে নেমে এসে আন্টির কে ফুলের ঝুড়িটি দিয়ে নূপুরের সাথে ওদের বাড়ি ঘুরে দেখছি। ওদের বাড়িটা অনেক সুন্দর। আঙ্কেলের রুচির প্রশংসা না করে পারছি না। আমি যখন নূপুরের সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত ঠিক তখনই কেউ নূপুর কে ডাকলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম নির্ভীক ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। উনি কোনরকম ভনিতা না করে বললেন,,
–“নূপুর!! তোকে ছোট চাচ্চু অনেক্ষণ ধরে স্বরণ করছে। তুই এখানে কি করছিস? যা তাড়াতাড়ি।”
–“ঠিক আছে যাচ্ছি। আপু (আমার দিকে তাকিয়ে) তুমি এখানে একটু দাঁড়াও আমি একটু পরে আসছি।”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। নূপুর চলে যেতেই নির্ভীক ভাইয়া আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওনাকে দেখে কেমন জানি লাগছে আমার। খুব একটা সুবিধার লাগছে না। উনি চোখের ইশারায় আমাকে উনার সাথে হাঁটতে বললেন। আমি চুপচাপ ওনার সাথে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,,
–“কোন ক্লাসে পড়িস তুই?? ৬ এ নাকি ৭ এ? নাকি প্রাইমারি তে?”
উনার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। আমাকে কি এতোটাই ছোট বলে মনে হচ্ছ ওনার? উফ বিরক্তিকর একটা লোক! আমি শক্ত গলায় জাবাব দিলাম,,
–“এবার এসএসসি দিয়েছি। কিছুদিন পর কলেজে উঠবো।”
আমার কথা শুনে অবাক চোখে তাকালেন উনি। আরে এতো আবাক হওয়ার কি আছে? উনি কিছুক্ষণ কিছু একটা ভেবে বিড়বিড় করে বললেন,,
–“পারফেক্ট!!”
–“কিছু বললেন?”
–“কই কি বললাম। আমি তো কিছু বলিনি। যাই হোক আরেকবার আপনি করে বলতো! তোর মুখ থেকে শুনতে জোশ লাগে।”
আমি কিছু বলবো তার আগেই নূপুর রাগী গলায় নির্ভীক ভাইয়া কে বলল,,
–“ভাই!! তুই তো বললি চাচ্চু নাকি আমাকে ডাকছে কিন্তু চাচ্চু তো বলল আমাকে ডাকেনি! আমাকে শুধু শুধু ঘোড়ালি কেন?”
–“আমি কি বলেছি যে চাচ্চু তোকে ডাকছে? আমি তো বলেছিলাম চাচ্চু তোকে স্বরণ করেছে ডাফ্ফার।”
নূপুর কিছুক্ষণ ভেবে তারপর চোখ বড়বড় করে তাকালো। তারপর বলল,,
–“ভাইয়াআআ!! তুই আমাকে 3 idiots মুভির সেই লাইব্রেরীয়ান এর মতো বোকা বানালি? তোকে তো আমি,,,,
নির্ভীক ভাইয়া এতোক্ষণ এ হাওয়া। ওনাকে আর পায় কে। নূপুর ও ওনার পেছন পেছন ছুটছে। আর আমি ওদের দুষ্টুমি দেখে হাসছি। সত্যি এই ভাই বোনের সম্পর্ক গুলো এমনি হয়। ঝগড়া, দুষ্টু-মিষ্টি খুনশুটি এসব নিয়েই ভাই বোনের সম্পর্ক তৈরি হয়। সেদিনের পর থেকেই আমার লাইফটা তেজপাতা! এ পর্যন্ত নির্ভীকের কাছ থেকে যতগুলো ঝাড়ি খেয়েছি আজ পর্যন্ত আমার আব্বুও আমায় এতো ঝাড়ি দেয় নি। এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।
হঠাৎ কারোর ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো আমার। আমি পেছনে ঘুরে দেখলাম আন্টি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি নিজের চোখের পানি মুছে ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাঁসি ঝুলিয়ে আন্টির দিকে এগিয়ে যেতেই আন্টি বললেন,,
–“কিরে মা এখনও ঘুমাস নি! আমি তো ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছিস হয়তো!”
–“ঘুম আসছে না আন্টি!”
–“কেন? এই তোর কি মন খারাপ? আমার ছেলেটার উপর খুব রাগ হয়েছে বুঝি? আর আমাকে আন্টি কি বলছিস? এখন থেকে আমায় মামনি বলে ডাকবি। আমিও তো তোর মা ই হই তাইনা?”
উনার এরকম আদর মাখা কথা শুনে নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। এতোক্ষণ ধরে জমিয়ে রাখা রাগ, অভিমান, খারাপ লাগা সব অশ্রু হয়ে ঝরে পরতে লাগলো। মামনি মুচকি হেসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিলেন। তারপর উনিও আমার পাশে বসে চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি কন্নারত অবস্থায় ই বললাম,,
–“তোমার ছেলে খুব খারাপ জানো। সবসময় আমাকে কষ্ট দেয়।” (মুখ ফুলিয়ে)
–“ওরে বাবা আমার মেয়েটার দেখছি নির্ভীকের উপর খুব অভিমান হয়েছে! কিন্তু ওর উপর রাগ করে নিজের ঘুম কেন নষ্ট করছিস। নে শুয়ে পর তো আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আর শোন একদম কাঁদবি না। তোর এই কাঁদো কাঁদো মুখটা আমি আর দেখতে চাই না। এখন ঘুমিয়ে পর কাল সকাল সকাল উঠতে হবে তো। কাল আমরা সবাই বাড়ি ফিরে যাব। আর তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। অনেক দিন হলো আমাদের বাড়িতে যাস না তুই।”
আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ মামনির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। আর মামানি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর রাজ্যের ঘুম এসে ঘিরে ধরলো আমায়। চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম।
🍁
সন্ধ্যা ৭ টা। নূপুরের ঘরে বসে টিভি দেখছি আমি আর নূপুর। ঢাকা থেকে ফিরেছি ২/৩ ঘন্টা আগে। আর মামনি নিজের কথা অনুযায়ী ওনাদের বাড়িতেই নিয়ে এসেছেন আমায়। এখানে এসেই নূপুরের ঘরে ঢুকেছি এখনও পর্যন্ত একবার ও বাইরে যাই নি। খাটের এক কোনায় চুপচাপ বসে আছি। এই মুহূর্তে টিভিটাও বোরিং মনে হচ্ছে। নূপুর একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে কিন্তু আমি কোনটারি ঠিক ঠাক উত্তর দিচ্ছি না। শুধু হু-হা করছি। ঠিক তখনই এখানে এসে উপস্থিত হলেন আয়াত ভাইয়া। উনি নির্ভীক এর মেঝো চাচ্চুর ছেলে। উনিও ডাক্তার। নির্ভীক আর আয়াত ভাইয়া সমবয়সী। নির্ভীক উনার থেকে ১ মাসের বড়। আয়াত ভাইয়া আসার কিছুক্ষণ পরেই কোথা থেকে নির্ভীক এসে উদয় হলেন। নির্ভীক এসে আমার সামনাসামনি অন্য পাশে বসলেন। আর আয়াত ভাইয়া বসলেন নূপুরের পাশে। নির্ভীক আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর আয়াত ভাইয়া একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার নির্ভীকে দিকে তাকাচ্ছে। আয়াত ভাইয়ার এরকম তাকিতুকি করার মাঝেই নির্ভীক বলে উঠলেন,,
–“কিচ্চে আয়াত!! এইরাম ভাবে এদিক ওদিক তাকাইতাসোস ক্যান? এ্যাম্নে তাকিতুকি করলে তো তর ঘারে ব্যাথা করবো?”
আয়াত ভাইয়া অসহায় ফেস করে তাকালেন উনার দিকে। তারপর হুট করেই বললেন,,
–“চুপ থাক শালা! নিজে তো ঠুস কইরা চুপিচুপি বিয়া কইরালাইলি,, আমার কথাও তো একটু ভাবলিও না! যাওয়ার আগে তো একবার কইতে পারতি যে তোর বিয়া করার প্ল্যান আছে। তাইলে আমিও যাইতাম। যাইগ্গা তুই তো বিয়ে করে ফেলি আমার টা কবে হবে? আমি কবে পামু তারে?” (আবেগে আপ্লুত হয়ে)
উনি আয়াত ভাইয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তারপর চোখ ছোট ছোট করে বললেন,,
–“কার কথা বলছিস রে তুই!”
–“বুঝো না কার কথা কইতাচি? আমার মন তো ঐ একজনের উপরই আটকে আছে আর তাকে তো তুই ভালো করেই চিনিস। কিন্তু,,”
–“আহারে! বেচারা! আবার ঝগড়া হইসে নাকি রে? ফিকার নট লেগে থাক আবার ঠিক হয়ে যাবে।”
আয়াত ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বুঝলাম ভাইয়া কার কথা বলছেন। হাহ্ মারুফা রে!! তুই কই বোইন? এইখানে আইসা দ্যাখ তোর আশিক তোর লাইগা মজনু হইয়া গেছে রে! আয়াত ভাইয়ার ফ্যাকাশে মুখটা দেখে এখন সেই লেভেলের হাঁসি পাচ্ছে আমার। বেচারা আমার বেস্টুর জন্যে পাগল না হয়ে যায়! আমি নিজের কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বললাম,,
–“কয়দিন ধরে কথা বলে না ভাইয়া?”
–“২ দিন!”
নির্ভীক কিছু বলবেন তার আগেই কারোর গলার আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজ শুনেই নির্ভীক এর ফেস রিয়্যাকশন পাল্টে গিয়েছে। আমার ও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এটা নির্ভীকের বন্ধু ঐ সানের গলার আওয়াজ। নির্ভীক তো বলেই বসলেন,,
–“এই আহাম্মক টা এখন আমাদের বাড়িতে কেন আসছে আবার।”
–“সেটা বাইরে গেলেই বুঝতে পারবো। চল যাই।”
সবাই আমাকে রেখে বাইরে চলে গেল। যাওয়ার আগে নির্ভীক বলে গেলেন, “ভূল করেও ঐ সানের সামনে যাবি না।” আমিও ভাবছিলাম সান ভাইয়ার সামনে যাবো না কিন্তু নির্ভীক এর কথায় জেদ চেপে বসলো। আমি তো এখন বাইরে যাবোই। উনি কেন আমায় যেতে বারণ করলেন? যেই ভাবা সেই কাজ। গুটি গুটি পায়ে বাইরে চলে এলাম। বাইরে আসতেই সান ভাইয়া অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,,,
–“হেই শুর্মি! তুমি নির্ভীক দের বাড়িতে কি করে? তোমরা কি রিলেটিভ?”
সান ভাইয়ার কথা শুনে নির্ভীক আমার দিকে তাকালেন। আমাকে দেখেই উনি রাগে আগুন হয়ে গেলেন। তাতে আমার কি হুহ! আমি কি ওনাকে ভয় পাই নাকি? আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। সান ভাইয়া এখনও আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এবার আয়াত ভাইয়া বললেন,,
–“ইয়াহ ইউ আর রাইট সান! ও আমাদের আত্নীয়। অনেক গভীর আত্নীয়তা আমাদের তাইনা ভাবি!!” (আমার দিকে তাকিয়ে)
–“কিহ ভাবি মানে? মানে কি হ্যাঁ? শর্মি!!”
সান ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এদিকে নির্ভীক বারবার ইশারা করে আমাকে ভেতরে জেতে বলছেন। আমি ভেংচি কেটেঅন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রইলাম। উনি যে আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছেন সেটা ওনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম। হঠাৎ মনে হলো আমি হাওয়ায় ভাসছি! আশ্চর্য! কিছুক্ষণ পর বুঝলাম নির্ভীক আমাকে কোলে তুলে নিয়েছেন। আচমকা টাল সামলাতে না পেরে ওনার গলা জরিয়ে ধরলাম। আমি অবাক!! কিন্তু উনার চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম আমি। উনি সোজা আমকে নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালেন। আমি কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম। উনি ছাদে নিয়ে গিয়ে ধপ করে নামিয়ে দিলেন আমাকে। তারপর জোরে চিৎকার করে বললেন,,,
–“তোকে বলেছিলাম না! সানের সামনে যাবি না! বলিনি আমি? আজ তো তুই শেষ!!”
আল্লাহ এবার আমার কি হবে? যেভাবে রেগে আছে তাতে তো মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিবে আমায়। আমি কয়েকটা ঢোক গিলে পেছন দিকে পিছোতে লাগলাম। আম্মু গো আজ তোমার মেয়েটা শহীদ হয়ে যাবে গো!!
·
·
·
চলবে……………………..