#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২৫
সেদিনের পর থেকে কুসুম উচ্ছ্বাসের সামনে এলে লজ্জায় আলুথালু হয়ে থাকে। উচ্ছ্বাসের নিজেরও এখন কুসুমকে লজ্জা লাগে। দুজন যতবার মুখোমুখি হয়েছে ততবার কুসুম মৃদু হেসে সরে যায়, উচ্ছ্বাসও মাথা চুলকে হেসে উঠে। ব্যপারটা নতুন নতুন প্রেমে পরার মতই সুন্দর। আগামীকাল তারা দুজন কক্সবাজার যাবে। রাত থেকেই দুজনের প্যাকিং শেষ করে সবকিছু তৈরি করা হয়েছে।
চলে যাবে দেখে উচ্ছ্বাস আগের দিন রাতে সব কাজ শেষ করে বেশ দেরি করেই বাড়ি ফিরেছে। উত্তেজনায় কুসুম নিজেও ঘুমায় নি। দুজন সারারাত গল্প করছিল। দুজনের আগ্রহ, খুশী তাদেরকে ঘুমাতে দেয়নি। উচ্ছ্বাস অবশ্য কয়েকবার বলেছে ঘুমানোর কথা। তবে কুসুম ঘুমিয়ে গেলে তো? কথার ফুলঝুরি যেন উপচে পরেছিল তার। কুসুমকে এত খুশী দেখে উচ্ছ্বাসও বাঁধা দেয় নি আর। কুসুমের হাসিহাসি অন্যরকম উচ্ছল চেহারা দেখতে বেশ লাগছিল তার।
বিকেলের ফ্লাইট ধরে সন্ধ্যার দিকে তারা কক্সবাজার এসে পৌঁছে। হোটেলের সমস্ত ফর্মালিটিজ পূরণ করে সবে তারা রুমে ঢুকেছে।
হোটেল রুমে ঢোকার পরপরই দুজনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। সম্পূর্ণ বাসর ঘরের মত বিছানা সাজানো। রুমটাও মোমবাতি, বেলুন, লাল গোলাপ দিয়ে সজ্জিত করা। লাভ শেপের বিছানা, সম্পূর্ণ রুম সাদা এবং লাল রঙের আবরণে সাজানো। কুসুম পলক ঝাপটে ঝাপটে সম্পূর্ন রুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। উচ্ছ্বাস প্রথমে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিল। পরপরই তার মনে হল, টাফ হানিমুন প্যাকেজ নিয়েছে। তাই তাদের হানিমুন স্টাইলে ঘর সাজানো হয়েছে। উচ্ছ্বাস মাথা হালকা নিচু করে মৃদু হাসল। চোখ তুলে তাকাল কুসুমের দিকে। কুসুম এখনো এসব হজম করতে পারে নি। উচ্ছ্বাস বলল,
‘ আমরা হানিমুন প্যাকেজ নিয়েছি না? তাই হানিমুন প্যাকেজে এই রুম সাজানো হয়েছে। তুমি কি ডিসকমফোর্ট ফিল করছ কুসুম?রুম কি পরিষ্কার করিয়ে দেব? ”
কুসুম নিজেকে সামলে নিল। পরপরই লজ্জিত আভা কণ্ঠে ঢেলে বলল, ‘ না,থাক। ভালো লাগছে দেখতে। ‘
উচ্ছ্বাস ঘরটা আরো একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘ গোসল করে নাও। গোসল করে সমুদ্রে যাব। ‘
‘ এই রাতে? আর রাতের খাওয়া? ‘
‘ খাবার খেয়েই যাব। আর রাগের সমুদ্র দেখেছ কখনো? অসম্ভব সুন্দর হয়। গেলেই বুঝবে। সমুদ্র থেকে মধ্যরাতে হেঁটে হেঁটে ফিরব। তখন আরো বেশি ভালো লাগবে। ভেজা মাটি যখন পায়ে লাগে, উফ! জাস্ট মারাত্মক লাগে। কাদা ডিঙিয়ে চলা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। অনেকের কাছে ঘেন্না লাগে। তবে আমার কাছে ভালোই লাগে। মাটির খুব কাছের মনে হয় লাইক মাটির মানুষ। ‘
কুসুম এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে উচ্ছ্বাসের কথা শুনছিল। কুসুম প্রশ্ন করল,
‘ কবার এসেছেন এখানে? ‘
উচ্ছ্বাস আঙ্গুলে গুনে নিয়ে বলল, ‘ আব…পাঁচবার। দুবার কলেজ ট্যুরে। আরো দু বার ফ্রেন্ডের সঙ্গে। আর একবার একা একা। ‘
‘ একা একা? একা একা এরকম জায়গায় এসে ভালো লেগেছিল? ‘
‘ লাগবে না কেন? আর তাছাড়া আমি তখন রেগে ছিলাম। তাই একা থাকতেই এখানে এসেছি। ‘
‘ কিসের জন্যে রাগ? ‘
‘ ডাক্তারি পড়ব না তাই। ‘
‘ কিহ? ‘
উচ্ছ্বাসের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। চোখ বুজে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ ছোটবেলা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব ইচ্ছে ছিল। সে অনুযায়ী প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম উচ্চ মাধ্যমিক শেষ। মেডিকেল এক্সাম এলো। বন্ধুরা অনেকেই এক্সপেরিয়েন্সের জন্যে এক্সাম দিয়েছে। তাই আমিও দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত ঢাকা মেডিকেলে চান্স হয়ে যায়। তারপর পুরো ব্যাপারটি বদলে যায়। আমি মেডিকেল পড়ব না, আম্মু রীতিমত যুদ্ধ করা শুরু করল আমার সঙ্গে। বাসার কেউই আমাকে বুঝে নি। তাই রাগে কক্সবাজার চলে এসেছিলাম। ‘
‘ পরে? মেডিকেলে ভর্তি হলেন কিভাবে? ‘
উচ্ছ্বাস আঙুল দিয়ে নিজের কপাল দেখিয়ে বলল,
‘ অল অ্যাবাউট লাক। এখানে এসে সবার কথা ভাবার চেষ্টা করেছিলাম। পরে মনে হল, ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আর ডাক্তারি পড়া ইজ নট দ্যাট ব্যাড। তাই আর ভাবিনি। দুদিন পর বাসায় গিয়ে মেডিক্যালে পড়ব জানিয়ে দিলাম সবাইকে। তুমি ভাবতেও পারবে না, সবাই কি খুশি হয়েছিল সেদিন। এখন মনে হয়, ওই খুশি দেখার জন্যে হলেও আমি শ’বার মেডিকেলে পড়তে রাজি। কি অদ্ভুত ব্যাপার। ‘
কুসুম হেসে ফেলল। উচ্ছ্বাসও হালকা হাসল। পরপরই উচ্ছ্বাস তাড়া দেখিয়ে বলল,
‘ দ্রুত গোসলে যাও তো। তুমি এলে আমি যাব। তুমি গোসল করার সময়টায় আমি চা অর্ডার করে রাখি? চা তো? নাকি কফি? ‘
‘ চা, দু চামচ চিনি দিয়ে। ‘
‘ ওকে। যাও এখন। দেরি হচ্ছে আমাদের।’
কুসুম তাড়াহুড়ো করে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে যাবে, তবে পেছন থেকে উচ্ছ্বাস মোবাইলে ওয়াইফাই কানেক্ট করতে করতে বলল,
‘ শাড়ি আর সেলোয়ারের কামিজ পড়ার দরকার নেই। ওয়ান পিস, বা কুর্তি এনেছ না? সেসব পরো। সমুদ্রে কেউ শাড়ি পরে যায় না। ‘
কুসুম নিজের বোকামিতে দাত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে ধরল। লং কুর্তি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
দুজন গোসল করে পরিপাটি হয়ে চা খেয়ে খানিক গল্প করল। ডিনারের সময় একবারে সমুদ্রে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো।
হোটেলে সি ফুড পাওয়া যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস দেখে দেখে খাবার টেবিলে সব সি ফুড অর্ডার করল। কুসুম প্রথম প্রথম ইতস্তত করল সি ফুড খেতে। পরে উচ্ছ্বাস অনেক বুঝিয়ে দু একটা আইটেম ট্রাই করাল। তাতেই কাজ হল। কুসুম পরের খাবারগুলো স্বতঃস্ফূর্ত খেতে লাগল। উচ্ছ্বাস বুঝতে পারল, কুসুমের খাবার মজা লেগেছে।
_______________________
রাতের সমুদ্রের তীর নীরব, নিস্তব্ধ। হাতে গোনা কয়েকজন দেখা যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস দেখে দেখে বেশ দূরের এক জায়গায় এলো। এখানে মানুষের শোরগোল একদম নেই। শুনশান জায়গা। তুমুল বাতাস, সেই সঙ্গে সমুদ্রের উত্তাল পাত্তাল গর্জন। কুসুম মুগ্ধ দৃষ্টিত চেয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। একটু এগিয়ে গিয়ে কুসুম সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাল। উচ্ছ্বাসও কুসুমের পেছনে পেছন আসছে। কুসুম ভয়ে বিয়ে আরো একটু এগিয়ে এল। আরো একটু গভীর পানিতে পা নামাল। উচ্ছ্বাস এসব দেখে হাসল। হুট করে এগিয়ে এসে কুসুমকে কোলে তুলে যতটা গভীরে যাওয়া যায় গেল। কুসুম ভয়ে দুবার চিৎকার দিল। উচ্ছ্বাস আঙুল দিয়ে কুসুমের ঠোঁট বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল,
‘ সাইলেন্ট অ্যান্ড ইনজয় দিস ম্যাজিকাল মোমেন্ট। ‘
কুসুম চুপ হয়ে গেল। উচ্ছ্বাসের বুক বরাবর পানি। উচ্ছ্বাস সেখানে কুসুমকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। কুসুম পানিতে নেমে পায়ে কোনো ঠায় পেল না। এতেই ভয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘ আমি নামব না, ডুবে যাব,ডুবে যাব। ধরেন আমাকে। ‘
‘ শান্ত হও। আমি থাকতে তুমি ডুববে না। আমার কাঁধে ধরে রাখো। আমি তোমার ঠায় হচ্ছি। ‘
উচ্ছ্বাস কুসুমের কোমর দুহাতে জড়িয়ে ধরে ওকে উচু করে ধরল। সমুদ্রের পানি কুসুমের বুক বরাবর এসে ঠেকল। কুসুম শান্ত হল এবার কিছুটা। চারপাশ দেখল। যেদিকে চোখ যায় পানি আর পানি। এত এত পানি দেখে খুশিতে কুসুমের দম বন্ধ হয়ে আসছে। কুসুম হারিয়ে যাচ্ছে অতল মুগ্ধতায়। উচ্ছ্বাস মৃদু স্বরে বলল,
‘ ক্লোজ ইউর আইজ। ‘
কুসুম চোখ বন্ধ করল। উচ্ছ্বাস নিজেও চোখ বন্ধ করল। কুসুমের কানে এখন শুধু সমুদ্রের তীব্র গর্জন ভেসে আসছে। পানির শব্দ, সামনে গা ঘেঁষে থাকা উচ্ছ্বাসের নিঃশ্বাসের শব্দ, আকাশের নিচে রাতের নিস্তব্ধতার শব্দ, সব মিলিয়ে কুসুম সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস বলল,
‘ এবার আমার কাঁধ থেকে হাত সরাও। দুহাত দুদিকে স্বাধীনভাবে ছড়িয়ে দাও। এমনভাবে নিজেকে ছেড়ে দাও সমুদ্রে, যেন তুমি উড়ছ। পানিতে পাখির ন্যায় উড়ার চেষ্টা করো। ‘
কুসুম তাই করল। আস্তে আস্তে উচ্ছ্বাসের কাধের উপর থেকে নিজের হাত সরাল। এবার যেন কুসুম একটুও ভয় পেল না। সমুদ্রের গভীরতা আপাতত কুসুম ডুবে। নির্দ্বিধায় দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে দিল। পানির ঝাপটা এসে দোল খেল কুসুমের দুহাতে। ভিজিয়ে দিয়ে গেল শরীরের সঙ্গে কুসুমের মন। উচ্ছ্বাস বলল,
‘ এবার মাথা আকাশের দিকে তুলো। ‘
কুসুম মাথা আকাশের দিকে তুলে ধরল।
উচ্ছ্বাস নিজেও আকাশের দিকে তাকাল। সম্মোহনের ন্যায় বলল,
‘ এবার চোখ ধীরে ধীরে খুলে তাকাও। ‘
কুসুম ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। এ কেমন অনুভূতি? উপরে আকাশ, নিচে সমুদ্রে, সমুদ্রে পাখির ন্যায় উড়ে বেড়ানো ওরা দুজন। আশপাশে কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু না। পুরো পৃথিবী এই মুহূর্তে কুসুমের কাছে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চোখের সামনে ভাসছে রাতের তারাময় বিশাল কালো আকাশ, কানে আসছে সমুদ্রের গান। কুসুমের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
‘ ই-ইটস ম-ম্যাজিকাল। ‘ ‘
#চলবে
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – ২৬
কুসুম ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল। এ কেমন অনুভূতি? উপরে আকাশ, নিচে সমুদ্রে, সমুদ্রে পাখির ন্যায় উড়ে বেড়ানো ওরা দুজন। আশপাশে কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু না। পুরো পৃথিবী এই মুহূর্তে কুসুমের কাছে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চোখের সামনে ভাসছে রাতের তারাময় বিশাল কালো আকাশ, কানে আসছে সমুদ্রের গান। কুসুমের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,
‘ ই-ইটস ম-ম্যাজিকাল। ‘ ‘
উচ্ছ্বাসের ঠোঁটে মৃদু হাস। কুসুমের এইটুকু খুশি উচ্ছ্বাসের বড্ড পাওয়ার ছিল। উচ্ছ্বাস কুসুমের কোমরে রাখা হাতের বাঁধন শক্ত করল। ভেজা গায়ে উচ্ছ্বাসের অনুভুতিপ্রবণ হাতের স্পর্শে কেমন নেতিয়ে গেল। থরথর কাপুনি স্পষ্ট লক্ষ্য করল উচ্ছ্বাস। হাতের বাঁধন আরো একটু শক্ত করতেই কুসুম মাথা নিচু করে তাকাল। কুসুমের চোখ-ঠোঁট বেয়ে পানি গড়িয়ে পরল উচ্ছ্বাসের মুখের উপর।
উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ রাখে কুসুম। একটু একটু করে এগিয়ে আসে উচ্ছ্বাসের মুখের দিকে। কুসুমের এইটুকু এগিয়ে আসা উচ্ছ্বাসকে তাক লাগানোর জন্যে যথেষ্ট ছিল। কুসুম হাত বাড়িয়ে উচ্ছ্বাসের দু গাল আলতো করে ধরল। উচ্ছ্বাস বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌছে গেছে যেন। কুসুম আরো একটু নত হল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
‘ ভ-ভালোসেন আ-আমায়? ‘
কুসুমের ভাঙা স্বর। উচ্ছ্বাস মোহনীয় চোখে কুসুমের চোখের দিকে চেয়ে আছে। কুসুম ঠান্ডায় কাপছে। ঠোঁট তিরতির করছে তার। কুসুম আবার জিজ্ঞেস করল,
‘ উ-উত্তরটা? ‘
উচ্ছ্বাস কুসুমের এমন আবেদনময়ী দৃশ্য এই প্রথম দেখল। আবেগে তার গলায় কথা আটকে আসছে। সে কুসুমের ভেজা মুখের দিকে চেয়ে থাকল। খানিক পর সম্মোহনের ন্যায় উত্তর দিল,
‘ হু, বাসি। ‘
কুসুম হাসল। উচ্ছ্বাস তখনো সম্মোহনের ন্যায় কুসুমের দিকে চেয়ে আছে। কুসুম হাসি ঠোঁটে রেখেই আবার প্রশ্ন করল,
‘ কতুটুকু? ‘
‘ অ-অনেক। ‘
‘ কখনও ছেড়ে দিবেন? ‘
‘ নে-নেভার। ‘
‘ আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি? ‘
‘ আ-আমি তোমাকে প্রচন্ড ব-বিশ্বাস করি। ‘
কুসুমের হাসির রেখা আরো বড় হল। উচ্ছ্বাসের গালে রাখা দুহাতের বাধন আরো একটু দৃঢ় হল। উচ্ছ্বাসের এবার দম বন্ধ বোধ হল। সেও কুসুমকে আরো শক্ত করে ধরল। কুসুম মাথা নামিয়ে আনল। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেবার আগে শেষবারের মত বলল,
‘ আমি আপনাকে প্রচন্ড বিশ্বাস করি। বিশ্বাস থেকেই ভালোবাসার উদয়। ‘
উচ্ছ্বাস মৃদু হাসল। অতঃপর এক গভীর ঠোঁট চুম্বন। দুজনের কাছে আসার প্রথম ধাপ। উচ্ছ্বাসের বোধ হল, সে নিজে এগিয়ে করা চুম্বনে এতোটা সুখ পেত না, যতটা সুখ কুসুমের এগিয়ে এসে করা ঠোঁট চুম্বনে অনুভব হচ্ছে। সেদিনের চুম্বন এতটা গভীর ছিল না। উচ্ছ্বাস শুধুমাত্র ঠোঁট ছুঁইয়ে সরে এসেছিল। তবে আজ সকল অনুভূতি ছাপিয়ে এই ভালোবাসার চুম্বনটাই সত্য মনে হচ্ছে। বাকী সব মিথ্যা, একমাত্র কুসুম-উচ্ছ্বাস সত্য, তাদের প্রগাঢ় ভালোবাসা সত্য, আর শেষ সত্য তাদের এই ঠোঁট চুম্বন।
_________________________
হোটেলে আসার পর থেকেই কুসুমের আগের রূপ আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সরে সরে আছে উচ্ছ্বাসের থেকে। মেয়েটাকে খুবই অদ্ভুত লাগে উচ্ছ্বাসের কাছে। একসময় ভালোবাসার এক পরিপক্ব রাজকুমারী মনে হয়, আরেকবার মনে হয় ঘন জঙ্গলের নীল রঙা হৃদ এর পাশে গজে উঠা সবুজ রঙের লজ্জাবতী পাতা। উচ্ছ্বাস দুজনের জন্যে হোটেল রুমেই ভাত অর্ডার করল। সমুদ্রে এত সময় ভেজার ফলে দুজনের শক্তিই শেষ। এই মুহূর্তে ভাত না খেলে জীবন উদ্ধার হয়ে যাবে। খাবার রুমে এলে উচ্ছ্বাস টেবিলে খাবার বাড়ল। কুসুম এখনও জানালার দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে আড়চোখে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাচ্ছে। উচ্ছ্বাস দিব্যি সেটা বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে দেখেই মাঝেমধ্যে হেসে হেসে উঠছে। উচ্ছ্বাসের হঠাৎ হঠাৎ হাসির শব্দে কুসুম আরো যেন লজ্জায় জমে যাচ্ছে। উচ্ছ্বাস চেয়ারে বসল। পাশের চেয়ার টেনে কুসুমের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ কিস করল যদি পেট ভরত তাহলে ট্রাস্ট মি কুসুম, আমি তোমাকে খেতে বলতাম না। কিন্তু এখন বাস্তব ধর্ম মেনে দুজনেরই পেট খালি। দ্রুত আসো। খেয়েদেয়ে তারপর আবার লজ্জা পেও। ভাত ঠাণ্ডা হচ্ছে। ‘
কুসুম কি করবে বুঝতে পারছে না। উচ্ছ্বাসের চোখের দিকে তাকানো বোধহয় এই জনমে আর সম্ভব হবে না কুসুমের পক্ষে। কুসুম কি করে বসল সেটা? নিজে নিজে…. উফ! ভাবতে পারছে না কুসুম। কি হয়ে গিয়েছিল তার তখন? উচ্ছ্বাসের একটুখানি স্পর্শে নিজেকে এভাবে হারিয়ে ফেললো? লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে কুসুমের। উচ্ছ্বাস আরেকবার ডাকলে কুসুম না চাইতেও পাদুটো টেনে চেয়ারে গিয়ে বসল। মাথা নত করে খেতে মশগুল হল। এখন পর্যন্ত উচ্ছ্বাসের দিকে একবারও তাকাল না। উচ্ছ্বাস খেতে খেতে বারবার কুসুমকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। কুসুম এসব দেখে লজ্জায় খাবার ছেড়ে উঠে যেতে মন চাইছে। একটা মানুষ জেনেবুঝে কি করে কুসুমকে এতটা লজ্জায় ফেলতে পারে?
খাবার কোনরকম শেষ করে কুসুম উঠে দাঁড়াল। উচ্ছ্বাস হোটেল বয়কে ফোন করে টেবিল পরিষ্কার করিয়ে ফেলল। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিবে দুজনেই। উচ্ছ্বাস নিজে বিছানায় এসে শুয়েছে। অথচ কুসুম এখনো বাথরুমে আছে। অনেক সময় হয়ে গেল কুসুম আসছে না। উচ্ছ্বাস উঠল। বাথরুমের সামনে গিয়ে বলল,
‘ বাথরুমে বিছানা বালিশ পাঠাব কুসুম? ঘুমিয়ে যাও সেখানে। ‘
কুসুম কি করবে আর? এই ছেলে আর এমন করছে কেন? উফ! অবশেষে কুসুম বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। উচ্ছ্বাস কুসুমকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভান করে বলল,
‘ সত্যি বের হয়েছ? আমি তো ভেবেছিলাম আজকে তুমি বাথরুমেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছ। ঘুমাও নি? হায় হায়। ‘
কুসুম চোখ রাঙানি দিল। উচ্ছ্বাস শব্দ করে হেসে ফেলল। কুসুম ধীর পায়ে বিছানায় এসে বসল। উচ্ছ্বাসের থেকে বেশ দূরত্ব নিয়ে শুবে তার আগেই উচ্ছ্বাস কুসুমের কোমরে হাত রেখে হেচকা টান দিয়ে নিজের পাশে নিয়ে এল। কুসুম চমকে গেল। কুসুমের পিঠ উচ্ছ্বাসের বুকের সঙ্গে লেগে। কুসুম শরীর শক্ত করে শুয়ে আছে। উচ্ছ্বাস কুসুমের ঘাড়ে মুখ এনে ফিসফিস করল,
‘ আমি কিন্তু এগিয়ে যাইনি কুসুম। তুমি কাছে এসেছ। শুরুটা তুমি করেছ, সারাজীবনের চালিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ত্ব আমার। ‘
কুসুম কি বলবে! চুপ করে লেগে আছে উচ্ছ্বাসের গায়ের সঙ্গে। উচ্ছ্বাস কুসুমের শক্ত করে শুয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘ শরীর ছাড়ো। সারারাত আমার সঙ্গেই লেগে ঘুমাবে। এভাবে শক্ত গায়ে শুয়ে থাকলে সকালে শরীর ব্যথা করবে। ‘
কুসুম বড়বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে শরীর ছেড়ে দিল। উচ্ছ্বাস কুসুমের পেটে হাত জড়িয়ে আরো গভীর ভাবে তাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। খানিক পর উচ্ছ্বাস কৌতুক স্বরে বলল,
‘ কি ছলচাতুরী করে আমার মুখ থেকে ভালোবাসি কথা বের করলে কুসুম? আ’ম ইমপ্রেসড। ভেবেছিলাম ভালো মুহূর্ত দেখে কথাটা জানাব তোমাকে। অথচ তুমি…তর সয় না মেয়ে? এত অস্থির তুমি, উফ। ‘
কুসুম হেসে ফেলল এবার। কুসুমকে হাসতে দেখে উচ্ছ্বাসও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে কুসুম সহজ হয়ে এসেছে। উচ্ছ্বাস বলল,
‘ হাসবে না কুসুম। তুমি জানো, তুমি খুবই ধূর্তবাজ একটি মেয়ে। উপরে উপরে সরল দেখলেও ভেতর ভেতর তুমি খুব প্যাচ জানো। ‘
কুসুম হালকা রাগ দেখানোর ভান করে বলল,
‘ মিথ্যা কথা। আমি কোনো প্যাচ জানি না। আমি উপরে যেমন ভেতরেও তেমন। ‘
‘ মিথ্যা না, সত্য কথাই। প্যাচ না জানলে, আমাকে কিভাবে প্যাঁচে ফেলে বুকের চাপা কথা মুহূর্তেই বের করে ফেললে। আমি হলে সেটা কখনোই পারতাম না। আমার ভেতর কোনো প্যাঁচ নেই। খোলা বইয়ের মত আমি। ‘
কুসুম কি বলবে। আসলেই সে ইচ্ছে করে এটা করেছে। উচ্ছ্বাসের মুখ থেকে ভালোবাসি কথা শোনার সত্যি তর সয় নি তার। তাই সমুদ্রে ওমন ম্যাজিকাল মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে উচ্ছ্বাসের মুখ থেকে বহু প্রতীক্ষিত কথাটা বের করেছে। কিন্তু কুসুম কি কখনো তা স্বীকার করবে? উহু! নাহলে দেখা যাবে, দিনরাত উচ্ছ্বাস কুসুমকে এই কথা বলে বলেই লজ্জায় মেরে দিবে। আসলেই। কুসুমের ভেতর বড্ড প্যাচ। ভালোবাসা অর্জন করার প্যাচ।
#চলবে