#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৭|
উচ্ছ্বাস সবেমাত্র হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরেছে। গায়ের সফেদ রঙা এপ্রোন ঘামে জুবজুব। টিশার্টটাও ঘেমে গায়ের সঙ্গে মিশে গেছে। দ্রুত গোসল করতে পারলে হয়ত ভালো লাগবে। উচ্ছ্বাস ঘরে ফিরে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ শিউলির ঘর থেকে কুসুমের হাসির শব্দ শুনে উচ্ছ্বাস কেমন ঝিম ধরে গেল। কুসুম এত শব্দ করে হাসতেও পারে? কই, তার সামনে তো কুসুমের বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না এই অবস্থা হয়ে যায়। পরপরই উচ্ছ্বাসের মনে হয়, কুসুমের সঙ্গে সবে বিয়ে হয়েছে তার। বয়সে ছোট একটা মেয়ে তার মত বড়সর এক ছেলের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্থি হতেই পারে। এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। উচ্ছ্বাস মাথা ঝাড়া দেয়। নিজের ঘরে যেতে যেতে ডাকে,
‘ শিউলি? আমার ঘরে আয় একটু। ‘
উচ্ছ্বাস ঘরে গিয়ে কাপড় ছাড়ছিল। এপ্রোন আর টিশার্ট খুলে বালতিতে ভিজিয়ে রাখল। নিজেও টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে যাবে তখন শিউলি ঘরে এল।
‘ ডেকেছিলে ভাইয়া? ‘
উচ্ছ্বাস উদোম ঘাড়ে টাওয়াল ঝুলিয়ে বলল,
‘ গোসলে যাচ্ছি। এক কাপ কফি দিয়ে যা। বড্ড মাথা ধরেছে। ‘
শিউলি মাথা দুলাল। কিছু একটা ভেবে মৃদু স্বরে বলল,
‘ আচ্ছা, দিচ্ছি। তুমি গোসল শেষ করে আসো। ‘
উচ্ছ্বাস গোসলে চলে যায়। উচ্ছ্বাস বাথরুমে যেতেই শিউলি দৌঁড়ে নিজের ঘরে আসে। কুসুম তখন বিছানায় গোল হয়ে বসে সায়মাদের সঙ্গে গল্পে মজে ছিল। তাদের যে কতরকম গল্প। কিশোরী বয়সের গল্প কার না শুনতে ভালো লাগে? সায়মার বয়ফ্রেন্ড আছে, মাত্র জানল কুসুম। সায়মা তার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ভয় পাচ্ছে ইদানিং। উচ্ছ্বাস শুনলে সায়মাকে প্রাণে মেরে ফেলতে দ্বিধা করবে না, এটা সায়মার মনে হয়। একটামাত্র ভাই তাদের পরিবারে। ভাইকে কষ্ট দিলে বোনদের সবার মন পুড়ে। তাই সায়মা চিন্তা করছে, সে ব্রেকআপ করে নিবে। অথচ অন্যান্য বোনরা তাকে বারবার মানা করছে। সায়মার বয়ফ্রেন্ড বেশ ভালো এবং ভদ্র একটা ছেলে। তাকে রিজেক্ট করা মানে, সায়মার কপাল পুড়বে। উচ্ছ্বাসের প্রেম ভালোবাসার বিরুদ্ধে এসব কঠোরতা শুনে কুসুম খানিক আশ্চর্য্য হল। উচ্ছ্বাস ভাই কি প্রেম সহ্য করতে পারে না? তার জীবনেও কি কখনো প্রেম আসে নি? কুসুম এসব অবাস্তব চিন্তা করতে মশগুল হয়ে গেল! শিউলি কুসুমের পাশে এসে বসল। কুসুমকে ডাক দিল,
‘ কুসুম আপা! ভাইয়া ডাকছে তোমায়। ‘
কুসুম উচ্ছ্বাসের নাম শুনেই কেমন ভরকে গেল। কেন যেন উচ্ছ্বাসের নাম তার কানে এলে কুসুমের সারা গা ঝিম ধরে যায়। পেটের মধ্যে অদ্ভুত জিনিস মোচড় দিয়ে উঠে। মনের মধ্যে সুড়সুড়ি অনুভব হয়।
উচ্ছ্বাসের সামনে গেলে কুসুম ভয়ে সিটিয়ে যায়। গায়ে কাপন ধরে। সে কাপনে অস্থির হয়ে যায় কুসুম। এসব কেন হয় তার সঙ্গে? অদ্ভুত অনুভূতি! কুসুম বলল,
‘ আমাকে কেন ডাকছেন? ‘
শিউলি কাধ ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ আমি কি জানি। বলল কফি দিতে তাকে। ‘
কুসুম কি আর করবে? সে বলেছে এখন কফি করে দিতেই হবে। নাহলে অন্য কথা উঠবে। তাই কুসুম গল্পের এই মজাদার আসর ছেড়ে উঠে পরল। শাড়ির আঁচল সামলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল খালা পেঁয়াজ কাটছেন। কুসুমকে দেখে কাজের খালা গদগদ হয়ে বললেন,
‘ আপা, আপনি এইখানে কি করেন? কি দরকার আমারে কন। বানাই দিতাসি। ‘
কি অমায়িক খালার কথা। খালাকে ভীষন ভালো লাগল কুসুমের। কুসুম মৃদু হেসে বললেন,
‘ কফি করব খালা। ‘
‘ কার লাইগা? আপনি খাইবেন? আমি বানাই দিতাসি। ‘
‘ না আমার জন্যে নয়। তার জন্যে। ‘
‘ তা…? ‘
কথা সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন হয়না খালার। তিনি বুঝে ফেলেন কুসুম কার কথা বলছে। বুঝতে পেরেই হেসে উঠে বললেন,
‘ ভাইজানের লাইগা? আচ্ছা আপনি বানান। ওই তাকে চিনি আর কপি পাউডার আছে। কিছু লাগলে কইয়েন। ‘
কুসুম লজ্জা পেয়ে গেল। বাড়িতে এত মানুষ থাকতে কফি বানানোর জন্যে তার কুসুমকে প্রয়োজন পরল? ইশ! কেমন লজ্জায় জড়িয়ে গেল কুসুম। কুসুম চুলোয় গরম পানি বসাল। খানিক পর কাপে কফি বানিয়ে চামচ নাড়ল। এক ফোঁটা খেয়ে দেখল সব ঠিক আছে কি না। চিনি ঠিক আছে দেখে কফির কাপ নিয়ে চলল উচ্ছ্বাসের ঘরের দিকে।
উচ্ছ্বাস তখন গোসল থেকে বেরিয়েছে। উদোম গায়ে শুধু ট্রাউজার পরা। মোবাইলে কথা বলছে। আগামীকালের ফ্লাইট সংক্রান্ত কথাবার্তা। কুসুম দরজার টোকা দিল। উচ্ছ্বাস ভেতর থেকে বলল,
‘ আয়। ‘
কুসুম গুটিগুটি পায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। উদোম গায়ে এই প্রথম উচ্ছ্বাসকে দেখেই কুসুম রীতিমত চমকে উঠল। সারা গা বেয়ে শীতল স্রোত বইয়ে গেল। কুসুম নত শিরে মৃদু স্বরে বলল,
‘ আপনার কফি। ‘
কুসুমের কন্ঠ শোনামাত্রই উচ্ছ্বাস চমকে উঠল। দ্রুত মোবাইল রেখে পেছনে ফিরে গেল। লজ্জায় আবৃত কুসুমকে দেখে উচ্ছ্বাস খানিক অপ্রস্তুত হল। বিছানা থেকে টিশার্ট নিয়ে দ্রুত গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল,
‘ তুমি কফি বানাতে গেলে কেন? আমি তো শিউলিকে বলেছিলাম। ‘
উচ্ছ্বাস ততক্ষণে টিশার্ট পরে নিয়েছে। কুসুম এবার মাথা তুলে চাইল। ডাগর ডাগর চোখে অবাক হয়ে বলল,
‘ কিন্তু শিউলি তো বলল আপনি আমাকে বলেছেন কফি দিতে। ‘
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকাল। হয়ত শিউলির কারসাজি সে বুঝতে পেরেছে। ভাবনার ফলস্বরূপ উচ্ছ্বাসের ভ্রু দুটো আঁকাবাঁকা হয়ে সুন্দর এক খাঁজ তৈরি করল কপালে। কুসুম দেখল সেটা দুই চোখ ভরে। উচ্ছ্বাস অত্যন্ত সুন্দর একজন পুরুষ। গৌড় বর্নের এ পুরুষকে কুসুমের ন্যায় শ্যামলা রঙের মেয়ের সঙ্গে কি কখনো মানাবে? কখনোই না! কুসুমের ভয় হয়। এমন যদি হয়,কুসুমের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে উচ্ছ্বাসের আফসোস হয়। কুসুমকে ছেড়ে দিতে চায় না শুধুমাত্র এই গায়ের রঙের জন্যে? এমন কি কখনো হবে? কুসুম মনেপ্রাণে দোয়া করল, এমন যেন কখনো না হয়। যেই বিয়ে নিয়ে কুসুম ইতিমধ্যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, সেই বিয়ের বন্ধন যেন কখনো না ভাঙে।
উচ্ছ্বাস এগিয়ে এক কুসুমের দিকে। কুসুমের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘ শিউলি মজা করেছে তোমার সঙ্গে। কফি খাওয়া দরকার, একজন বানালেই হল। কফি দাও। ‘
কুসুম কফির কাপ এগিয়ে দিল। উচ্ছ্বাস কফির কাপে চুমুক দিয়ে বিছানায় এসে বসল। কুসুম এখনো দাড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস বুঝতে পারল না কুসুমের ভাবনা। কুসুম উৎসুক চোখে চেয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে। এবার উচ্ছ্বাস বুঝতে পারল, কুসুম কেন এখনও দাড়িয়ে আছে তার ঘরে। উচ্ছ্বাস মৃদু হাসল। কাপে আরেকবার চুমুক দিয়ে বলল,
‘ কফিটা ভালো হয়েছে। ‘
কুসুম যেন নেচে উঠল এ কথা শুনে। কুসুম সবসময়ই নিজের জন্যে কফি বানায়। কফি বানাতে বানাতে অভ্যস্ত হলেও আজ উচ্ছ্বাসের জন্যে কফি বানাতে গিয়ে কুসুমের হাত কেপেছে। বারবার মনে হয়েছে, কফিটা বাজে হবে। উচ্ছ্বাস পছন্দ করবে না। যাই হোক। কুসুমের বানানো কফি উচ্ছ্বাসের পছন্দ হয়েছে, সেই বিশাল ব্যাপার। কুসুমের যা শোনার ইচ্ছে ছিল, শোনা হয়ে গেছে। এবার কুসুম দ্রুত উচ্ছ্বাসের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
#চলবে
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৮|
উচ্ছ্বাসের বাড়ি থেকে কুসুমের যাবার সময় হয়ে এসেছে। রাত হুহু করে বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে নয়টায় এসে থেমেছে। কুসুমের মা এই নিয়ে অনেকবার কল করেছেন। কুসুম এখনো ফিরছে না কেন? মেয়ে আদরের কি না। খানিক চোখ ছাড়া হলেই, দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কুসুমের খালা বোনের এই চিন্তা যেন পাত্তাই দিলেন না। বরং বললেন,
‘ কুসুম কি শুধু তোর মেয়ে, সাহেদা? আমার কিছু না? মনে রাখবি, তোর মেয়ে আমার হাতে বড় হয়েছে। তুই মেয়েকে আমার কাছে রেখে স্কুলে মাস্টারি করতে চলে যেতি। কুসুমকে খাওয়া থেকে শুরু করে ডায়পার অব্দি আমি বদলে দিয়েছি। এখন কুসুমের জীবনে আমার অবদানের কথা ভুলবি, তো আমার সাথে তোর কথা শেষ! ‘
সাহেদা এবার খানিক নিভেন। লম্বা করে বুকে শ্বাস টেনে নিয়ে অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললেন,
‘ আপা, রাগছ কেন? মেয়ে এই প্রথম বাড়ির বাইরে গেছে। মন তো একটু টানবেই। কখন আসবে, একটু জেনে রাখলে শান্তি পাব। ওকে ছাড়া খালি খালি লাগছে ঘর, আপা। ‘
কুসুমের খালা পারুল বোধহয় আজ একটু বেশি উড়ে বেড়াচ্ছেন। তার কারণও আছে বৈকি। কুসুমকে ছেলের বউ করে ঘরে আনবেন তার জন্যেই বোনের কাছে এতদিন তেল মালিশ বিক্রি করেছেন। এটা সেটা বলে বোনকে খুশি করার চেষ্টাও করা হয়েছে অনেক। কিন্তু এখন তো কুসুমকে তিনি নিজের বাড়ির সদস্য করে নিয়েছেন। এখন আর বোনকে পাত্তা দেবার প্রয়োজন বোধ করছেন না। বোনের কাছে এতদিন ভিজে বেড়াল হয়ে থাকলেও, এখন হয়ে গেছেন বাঘ। কুসুমকে পেয়ে তিনি চোখে আর কাউকে দেখছেন না। বোনকে তো একেবারেই নয়। অনেক জ্বালাতন করেছে সাহেদা তাকে। কুসুমকে বিয়ে দেবে না দেবে না করে সারাক্ষণ ঝগড়া করেছে তার সঙ্গে। এখন তিনি বোনকে বুঝাবেন ঝগড়া কাকে বলে!
পারুল কথা বললেন। বেশ ভাব নিয়ে দেমাগ দেখিয়ে,
‘ আসবে, আসবে। উচ্ছ্বাস আজ লাগেজ টাগেজ নিয়ে ঢাকা চলে যাবে। সেখান থেকে সোজা বিদেশ। যাবার আগে তোর মেয়ে তোর ঘরে রেখে যাবে। এবার আর আমার মাথা খাস না। ফোন রাখ। আর ফোন দিবি না। তোর মেয়েকে আমরা মা-ছেলে মিলে খেয়ে ফেলছি না। ‘
সাহেদা বোনের কথা শুনে বেশ বুঝতে পারছেন, পারুল আপা তাকে জব্দ করতে চাইছে। করুক। তিনিও দেখতে চান, বোন আর কি কি করতে পারে। সাহেদা ফোন কাটার আগেই পারুল ফোন কেটে দিলেন। সাহেদা কি করবেন আর। অগ্যতা ফোন হাতে নিয়েই থম হয়ে রইলেন।
______________________
পারুল উচ্ছ্বাসের লাগেজ তৈরি করছেন। ছেলে সেই যে খেয়েদেয়ে বের হয়েছে, আর ঘরে আসেনি। হতচ্ছাড়া হয়েছে। কাল যাবার কথা ছিল। সেখানে আজ চলে যাচ্ছে। একদিন ছেলের কাছে সময় চেয়েছিলেন। সেটাও মিলেনি। পিঠে দুই ঘা দিতে পারলে শান্তি লাগত। কিন্তু বড় হয়েছে ছেলে। এখন বললেই তো আর ছোটবেলার ন্যায় উদোম করে পিঠে পরপর কিল বসাতে পারেন না। আর না পারেন ধরে বাসায় বেধে রাখতে। পারুল লাগেজে একে একে উচ্ছ্বাসের প্রয়োজনীয় কাপড় ঢুকাচ্ছেন। কুসুম পাশেই বসে আছে। পারুল আলমারি থেকে কাপড় বের করছেন আর উচ্ছ্বাসের নামে কুসুমের কানে এত এত অভিযোগ ঢেলে দিচ্ছেন। কুসুম বোকার মত মায়ের মুখে ছেলের অভিযোগ শুনেই যাচ্ছে। মৃদু হাসছে বারবার। পারুল বললেন,
‘ দেখ তো কুসুম, এই ম্যারুন রঙের শার্ট দেব ভরে? উচ্ছ্বাসের জন্যে নতুন কিনেছি কাল। পছন্দ হবে কি না বুঝতে পারছি না। পছন্দ না হলে পরবেও না। অযথা শার্ট ফেলে রাখবে আলমারির কোণায়। কি বলিস তুই, এটা কি লাগেজে ভরব? ‘
কুসুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল শার্টটি। ম্যারুণ রঙের শার্টটা বেশ সুন্দর, চোখে পরার মত। কুসুম বলল,
‘ দিয়ে দাও। সুন্দর কিন্তু শার্টটা। ‘
পারুল এ কথা শুনে একদম গদগদ হয়ে গেলেন। চোখে হেসে শার্ট ভাঁজ করে লাগেজে ভরে দিলেন। কুসুমকে বলেন,
‘ এদিকে আয় তো। তুই নিজে দেখে দেখে শার্ট প্যান্ট লাগেজে ঢুকা। আমি আসছি একটু। চুলোয় পায়েস চড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সন্ধ্যার নাস্তায় দেব। হতচ্ছাড়া ছেলে, এলোই না এখনো ঘরে? তুই দেখ না মা এদিকটা। আমি রান্নাঘর থেকে ঘুরে আসছি। ‘
কুসুমকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পারুল বেরিয়ে গেলেন উচ্ছ্বাসের ঘর থেকে। কুসুম পরল মহা ফ্যাসাদে। সে কি ছেলেদের কাপড় চোপড় ভালো করে চেনে? তার পছন্দ করা কাপড় উচ্ছ্বাসের পছন্দ না হলে? পরবে না একটাও। কুসুম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল খালার আসার জন্যে। কিন্তু খালামনি এলেন না। অগ্যতা কুসুম আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারি ভর্তি এত্ত এত্ত কাপড় দেখে কুসুমের টাশকি খাবার জোগাড়। ছেলে মানুষ হয়ে এত কাপড় পরেন? কুসুম মেয়ে হয়েও তার এত কাপড় চোপড় নেই। কুসুম আলমারি বেছে বেছে শার্ট প্যান্ট আর টিশার্ট বের করল। কয়েকটা জ্যাকেট আর শীতের কাপড়ও লাগেজে ভরল। আলমারির এক কোণায় একটা ব্যাগ রাখা। কাপড়ের দোকান থেকে আনা হয়েছে। বোধহয় উচ্ছ্বাস ভাই কিনে এনেছেন বিদেশ নিয়ে যাবার জন্য। কুসুম ব্যাগ খুলে দেখল। সঙ্গেসঙ্গে দু কদম পিছিয়ে গেল সে। ব্যাগে কয়েকটা আন্ডারওয়্যার আর সেন্ডো গেঞ্জি রাখা। কুসুমের লজ্জায় মরিমরি অবস্থা। এসব কি হচ্ছে তার সঙ্গে? এসব গুছাবে সে? উফ। খালামনির উপর রাগ লাগছে কুসুমের। তাকেই পেল উচ্ছ্বাস ভাইয়ের লাগেজ গুছানোর জন্য? কুসুম কি আর করবে। চোখ বন্ধ করে আলগোছে সেসব জিনিস রেখে দিল লাগেজে। সব রেখে দিয়ে মনে করে দেখল, আর কিছু বাকি আছে কি না। না, নেই। কিছু বাকি নেই দেখে কুসুম লাগেজের চেইন বন্ধ করে লাগেজ কষ্ট করে টেনে নিয়ে মাটিতে এক কোণায় রেখে দিল। হাত ঝাড়া দিয়ে ব্যথায় মুখ কুঁচকে নিল। ইশ, এত ভারি লাগেজ!
উচ্ছ্বাস এসেছে রাত তখন সাড়ে দশটা। এসেই তাড়াহুড়ো করা শুরু করে দিয়েছে। এদিকে গিয়ে এটা ব্যাগে রাখে তো ওদিকে গিয়ে ওটা ঠিক করে। সে এক ঝড়! এসেই মাকে ডেকে উঠে,
‘ আম্মা, আমার লাগেজ গুছিয়েছ? দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। ‘
পারুল হাতে করে পায়েসের বাটি নিয়ে ছেলেকে দেন। পায়েস দেখে উচ্ছ্বাস অসহায় কণ্ঠে বলে,
‘ সময় নেই, আম্মা। এখনি বেরুতে হবে। ‘
পারুল রাগ দেখিয়ে পায়েসের বাটি টেবিলের উপর রেখে দেন। যেতে যেতে বলেন,
‘ সবগুলো পারে না আমাকে খাটিয়ে মারতে। একটা দিন চাইলাম তার কাছে, এই এক দিন আমায় দিতে পারল না? এমন হতচ্ছাড়া ছেলে জন্ম দিয়ে কি লাভ হল। জ্বা*লিয়ে মারল সবকটা। ‘
উচ্ছ্বাস ঘর থেকে মায়ের গাঁদা গাঁদা অভিযোগ শুনে। মা রাগ করবে দেখে কোনো উপায় না পেয়ে দ্রুত পায়েস নিয়ে খেতে শুরু করে। ঝড়ের গতিতে সবটুকু পায়েস খেয়ে এক গ্লাস পানি খায়। লাগেজ টেনে নিজের ঘরের দিকে একবার চেয়েই বেরিয়ে পরে। নিচে যেতে যেতে ডাক দেয়,
‘ কুসুম, দ্রুত আসো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘
দেখা গেল, কুসুম শিউলির ঘর থেকে পার্স নিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে আসছে। খালামনির থেকে বিদায় নেয়। পারুল ছেলের কাছে যান। এতক্ষণ কান্না আটকে রাখলেও এবার আর পারেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন ছেলেকে জড়িয়ে। মায়ের কান্না দেখে উচ্ছ্বাসের চোখেও কিছুটা জল জমে। কিন্তু সে বরাবরই শক্ত মনের মানুষ। তাই নিজের কান্না সংবরণ করে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝায়,
‘ আমি তো একেবারেই যাচ্ছি না আম্মা। এইতো বছর পরেই চলে আসব। কেঁদো না আম্মা। দেখো, তুমি কাদলে তো আমায় বাংলাদেশেই থেকে যেতে হবে। তোমাকে কান্না করিয়ে আমি বিদেশ গিয়ে শান্তি পাব? আমার ডিগ্রির কি হবে তখন? কান্না বন্ধ করো আম্মা। ‘
ছেলের অনেক বুঝানোর পর পারুল কান্না থামান। পারুল কান্না থামালেও উচ্ছ্বাসের বোনরা এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। কান্না থামার নামগন্ধ নেই। মানহাকে কোলে নিয়ে আদর করে উচ্ছ্বাস। অতঃপর বাবা, ফুপু, বোন, আম্মা, মানহা সবার থেকে বিদায় নিয়ে কুসুমকে নিয়ে বেরিয়ে যায় উচ্ছ্বাস। কুসুমের চোখ ছলছল করছে। এদের কান্নার মাতম দেখে যেকোনো মুহূর্তেই সে কেঁদে দেবে। উচ্ছ্বাস কুসুমের ছলছল চোখ দেখে কাতর কণ্ঠে বলল,
‘ এবার তুমিও শুরু করে দিও না প্লিজ। একবারেই যাচ্ছি না। তোমরা এমন ভান করছ, যেন কখনোই দেশে ফিরে আসব না। ‘
কুসুম কি আর বলবে? কান্না আসলে কি কান্না থামানো যায়? উহু। কুসুম চিন্তা করল, সে আর উচ্ছ্বাস ভাইকে তার কান্না দেখাবে না। দূর্বল হবে না তার সামনে। তাই কুসুম গাড়ির জানালার দিকে চেয়ে বসে থাকল সারাটাপথ।
#চলবে