|১|
‘ উচ্ছাস ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে? তুমি পাগল হয়ে গেছ আপা! আমি এখনো ছোট। এখন আমার বিয়ে করার বয়স নাকি? ‘
উষা কুসুমকে আগলে নিল দুই হাতে। কুসুমের গা ভীষন নরম। বেড়াল ছানার মত বুকের ভেতর রাখা যায়। গায়ের রঙ একটু শ্যামলা, তবে ভীষন আদর লাগে ওই শ্যামলা মুখে তাকালে। উষা বলল,
‘ বিয়ে হবে না, কাবিন হবে। উচ্ছাস তিন বছর পর লন্ডন থেকে ফিরলে তুলে দেবে। ততদিনে তুইও বড় হয়ে যাবি। ‘
বিয়ের কথা শুনে হুট করেই কুসুমের গা কাঁপিয়ে কান্না পাচ্ছে। বিয়ে মানেই বোধ হচ্ছে এক মস্ত বড় বোঝা। এই বোঝা বহন করলে কুসুম ম”রে যাবে যে। কুসুম উষার বুকের ভেতর ঢুকে ফেলার চেষ্টা করল। উষার কোমড়ের জামা আঙ্গুলের মুঠোয় পুড়ে হঠাৎ করেই কেঁদে উঠল। উষা হকচকিয়ে গেল। কুসুম কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘ আমার খুব ভয় করছে আপা। আমি বিয়ে করব না। মাকে না করো তুমি। ‘
উষা বোনের মাথায় হাত বুলাল। খুব আদর করে ডাকল,
‘ কুসুম, এই কুসুম। ‘
কুসুম মাথা তুলে চাইল। চোখের পানি উপচে পরছে। ভাসা ভাসা চোখে কি যে আদর লাগছে। ইচ্ছে করছে, মেয়েটাকে একদম নিজে কাছ থেকে হাতছাড়া না করতে। এই একটুতেই এই মেয়ের কান্নায় চোখ ভেসে যায়। কি হবে এই মেয়ের? ইশ! উষা কুসুমকে বুঝাল,
‘ পাগল! শুধু কাবিন হবে। তোর ১৮ বয়স পাড় হলে তারপর তুলে দেবে। এখন তো তুই আমাদের সাথেই থাকবি। আমাদের ঘরেই ঘুমাবি। তোর যখন ১৮ হবে, তখন উচ্ছাস লন্ডন থেকে ফিরলে তোকে তুলে দেবে। এখন তুলে দিচ্ছে কে তোকে? ‘
কুসুম শুনল। এবার আর কাঁদল না। তবে ফুঁপিয়ে যেতে লাগল। উষা একের পর এক আদর কণ্ঠ কুসুমের কানে ঢেলে দিল। কুসুম শুনল। মন খারাপ একসময় দূরদূর করে পালিয়ে গেল। মেয়েটা এত আদুরে কেন!
______________________
উচ্ছাসের সঙ্গে কুসুমের কোনো দিক থেকে মিলঝুল নেই। উচ্ছাসের সবকিছুই গোছালো, পরিচ্ছন্ন। কিন্তু কুসুমের স্কুলের ব্যাগটাও অব্দি মা গুছিয়ে দেন। উচ্ছাস একটুখানি গম্ভীর, তবে অনেক বুঝে। কুসুম কি বুঝে? শুধু ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতেই জানে। উচ্ছাস ভাইয়ের ন্যায় পারফেক্ট একজন মানুষের সঙ্গে কুসুমের বিয়ে, এ তো রীতিমত অবাস্তব। কুসুম বিশ্বাস করতে চায়না। উচ্ছাস নিজেও চায়নি, বয়সে ছোট কুসুমকে বিয়ে করতে। এখনো তার ক্যারিয়ারের ঝাপটা বাকি। সবে এমবিবিএস পাশ করেছে। এখনি বিয়ে? মায়ের মাথা পাগল হয়েছে।
উচ্ছাস এই বিয়ে নিয়ে ভীষন বিরক্ত। মায়ের সঙ্গে এই বিষয়ে আজই সে কথা বলবে বলে ঠিক করে রেখেছে। আপাতত রিডিং রুমে বসে পড়াশোনা করছে সে। উচ্ছাসের মা ছেলের জন্যে কফি করে নিয়ে এলেন। কফির কাপটা টেবিলের পাশে রেখে উচ্ছাসের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। উচ্ছাস বইয়ের দিকে চেয়ে বলল,
‘ কিছু বলবে, আম্মা? ‘
‘ কুসুমকে একবার দেখে আসি আমরা সবাই। তুই লন্ডন যাবার আগে বিয়ে কথা পাকা করে গেলে ভালো হয়না? ‘
উচ্ছাস চুপ করে শুনে যায়। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বুঝে, কফিতে চিনি কিঞ্চিৎ কম আছে। উচ্ছাস টেবিলে ছেড়ে উঠে। বুকসেল্ফের পাশে রাখা ড্রয়ার থেকে চিনির বোয়াম বের করে কফিতে চিনি মেশায়। লাইব্রেরিতে দিনের বেশিরভাগ সময় উচ্ছাস কাটায় বলে, এখানে প্রয়োজনীয় সবকিছুই সংগ্রহে রাখে উচ্ছাস। টুংটাং চামচ নাড়িয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
‘ কিসব পাগলামি শুরু করেছ, আম্মা! বলো তো। এখন বিদেশ যাব, পড়াশোনা করব। এখন বিয়ে করার সময়? ‘
উচ্ছাসের মায়ের মুখ এটুকু হয়ে গেল। তিনি চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর মুখটা গম্ভীর করে বললেন,
‘ পাগলামি নয়। ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এগুচ্ছি আমি। আজকালের বিদেশের পরিবেশ ভালো নাকি? কখন কোন পাপ করে ফেলিস, বলা যায় না। এরচেয়ে বিয়ে করে হালাল ভাবে সবকিছু কর। তোকে তো সংসার করতে বলছি না এখনি। শুধু কাবিন করিয়ে রাখলে কি সমস্যা? ‘
উচ্ছাস কফিতে চুমুক দিয়ে বুঝে, চিনি এবার ঠিক আছে। উচ্ছাস কাপে একের পর এক চুমুক দিয়ে চেয়ারে এসে বসে। বইয়ের পাতা উল্টে চশমা ঠিক করে বলে,
‘ আমি বিদেশ পড়তে যাচ্ছি, আম্মা। তোমার ভাষ্যমতে পাপ কাজ করতে না। বিয়ে বিদেশ থেকে এসেও করা যাবে। ‘
‘ তুই কি আমার মুখের কথার কোনো দাম দিবি না? সাহেদাকে আমি কথা দিয়েছি। ‘
‘ আমাকে না জিজ্ঞেস করে তুমি কিভাবে আমার জীবনের ব্যাপারে কাউকে কথা দিয়ে ফেলো? আমার বিয়ে ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করা জরুরি ছিল। ‘
‘ এতসব মাথায় থাকেনি। কুসুম ভালো মেয়ে, পরিবার ভালো, আমার বোন তোকে ছোটবেলায় কত আদর করেছে। জানিস তো তুই তোর খালামণিকে। এখন অযথা কথা বাড়াস না তো। ডেইট ফেল। আমরা তোর খালামনির বাড়িতে যাচ্ছি। একেবারে কাবিন পড়িয়েই ফিরবো সেখান থেকে। ‘
উচ্ছাস বই বন্ধ করে মায়ের দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘ সবই তো ঠিক করে রেখেছ। তাহলে আমার তারিখ দেওয়া নিয়ে কেন অপেক্ষা করে আছো? তারিখ নিজের সুবিধা মত রাখো। আমি থাকব, চিন্তা করতে হবে না। ‘
উচ্ছাসের মায়ের আর কিছু শোনার প্রয়োজন নেই। তিনি ভীষন খুশী। ছেলের ঘর থেকে ভীষন হাসিখুশি বের হলেন তিনি। বোনকে কল করে বললেন,
‘ এই সাহেদা, আমরা কাল আসছি রে তোর মেয়েকে দেখতে। যা, আয়োজন কর। উচ্ছাস রাজি হয়েছে। মায়ের কথা কখনো ফেলেছে নাকি যে আজ ফেলবে? ‘
_______________________
উচ্ছাসরা যৌথ পরিবারে থাকে। তাদের ঘরে, উচ্ছাস, তার বোন শিউলি, তার মা আর বাবা। আরো থাকেন, দুই চাচার পরিবার, এক ফুপু তার মেয়ে, আর চারজন চাচাতো ভাইবোন।
মেডিকেল থেকে উচ্ছাস সবে বাসায় ফিরেছে। গায়ে এখনো ঘামে ভেজা এপ্রোন। উচ্ছাস বাড়ি ফিরতেই সবাই ঝেকে ধরলো তাকে। আজ এক্ষুণি কুসুমকে দেখতে যাবে তারা। উচ্ছাস কোনোরকমে বলল,
‘ আরে, ফ্রেশ হয়ে আসতে দাও। গায়ে ঘামের গন্ধ। ‘
উচ্ছাসের ভাইবোন সরে দাঁড়ালো। উচ্ছাসকে পাঁচ মিনিটের জন্যে ছেড়ে দিল ফ্রেশ হবার জন্যে। উচ্ছাস নিজের ঘরে এল। এপ্রোন খুলে চেয়ারে ছুঁড়ে ফেলল। রাগ তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে তার। বিয়ের জন্যে বাসার সবাই এত উতলা হয়ে যাচ্ছে কেন? তার কি বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, নাকি সে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে? সবে চব্বিশ বয়স। এখনি বিয়ে? বাড়ির সবার যন্ত্রনায় দেখা যাবে একদিন উচ্ছাস পাগলা গারদে আশ্রয় নিয়েছে। নিউরোলজি নিয়ে পড়া ডাক্তার, পাগলা গারদে! অদ্ভূত!
উচ্ছাস ফ্রেশ হয়ে নিল। গায়ে জড়াল, কালো রঙের শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। চুল এলোমেলো নিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছিল সে। কিন্তু তার বোনরা আটকালো। ধরেবেধে চুল আঁচড়ে দিল। জেলও লাগাল চুলে। উচ্ছাস এসব দেখেই গেল। একবার শুধু বলেছে,
‘ মেয়ে দেখতে যাচ্ছি আমরা। ফ্যাশন শো তে না। ‘
উচ্ছাসের বোনরাও বেশ বিচ্ছু। তারা উচ্ছাসের গায়ে পারফিউম স্প্রে করে বলল,
‘ মেয়ে দেখতে গেলে তোমার এই এলোমেলো চেহারা দেখেই তোমাকে রিজেক্ট করে দেবে, ভাই। তাই এসব ওল্ড ফ্যাশন চেহারা চেম্বারে দেখিও। নিজের বিয়েতে না। ‘
#চলবে
গল্পের নাম – #বৌপ্রিয়া – সূচনা পর্ব
লেখনীতে – #আভা_ইসলাম_রাত্রি