#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২৮
.
ঘুম ভাঙতেই নীরদের গম্ভীর মুখখানা চোখে পড়ল অর্ঘমার। সে এখন সোফার সাথে হেলান দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই সোফাটা নীরদই আনিয়েছে নিজের থাকার জন্য। অর্ঘমা উঠে বসতে গেলে এক অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল তার সারা শরীর। তবুও এগিয়ে এলো না নীরদ। নিজের হাত-পায়ের অবস্থা দেখে বিকেলের কথা মনে পড়ে গেল অর্ঘমার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত বাজে প্রায় দেড়টা। নীরদ এসে বিছানার পাশের টেবিলের উপর থেকে খাবার, পানি আর ওষুধ রাখা ট্রে-টা নিয়ে অর্ঘমার সামনে বিছানায় রেখে মৌন অবস্থায় পুনরায় সোফায় গিয়ে বসল। অর্ঘমা বুঝল নীরদ রেগে আছে। সে চুপচাপ ট্রে-টা সরিয়ে রেখে হাত-পা গুটিয়ে, গায়ের কম্বলটা গলা অব্দি টেনে অপর পাশ ঘুরে শুয়ে পড়ল। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।
বিকেলে আয়নায় নিজেকে দেখে যেমন ঘৃণা হচ্ছিল তেমন অবাকও লাগছিল অর্ঘমার। তার চোখমুখ ভেঙে একাকার অবস্থা। শরীর একদম রোগা পাতলা হয়ে গেছে। চোখের নিচ দেবে গিয়ে কালি পড়ে গেছে। শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ফেটে চৌচির। মাসখানেক নিজের অযত্নের ফলে তার এই অবস্থা। তাকে দেখতে অসম্ভব কুৎসিত লাগছে। এমন চেহারা দেখার পরও নীরদ কীভাবে পারছে তার এত খেয়াল রাখতে? এখনো তাকে ভালোবাসতে কীভাবে পারছে?
অর্ঘমা টের পেল তার শরীর থেকে কম্বল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। চোখ মেলে তাকানোর সাথে সাথেই নীরদ তার বাহু ধরে একটানে তাকে উঠিয়ে বসিয়েছে। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল সে। নীরদের চোখমুখ শক্ত। যেন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা করছে। কোনো কথা না বলে ভাতের প্লেট নিয়ে এক লোকমা ভাত অর্ঘমার মুখের সামনে ধরল। নীরদকে একপলক দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল অর্ঘমা। অর্থাৎ সে খাবে না। নীরদ চুপচাপ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ অর্ঘমার দিকে। মিনিট দুয়েক পর হুট করে বা’হাত দ্বারা অর্ঘমার গাল চেপে ধরে ভাতের লোকমা মুখে পুরে দিতে গেলেই অর্ঘমা স্ব জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল হাতখানা। ফলে ভাতের লোকমা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। তৎক্ষনাৎ তার গাল চিনচিন করে উঠল। গালে হাত দিয়ে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকাল নীরদের দিকে। নীরদ তাকে থাপ্পড় মেরেছে? ব্যাপারটা যেন বিশ্বাস হতে চাইল না। পরক্ষণেই কাঁচের গ্লাসখানা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল নীরদ। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল গ্লাসটি। ভেসে এলো নীরদের রাগী গলার স্বর।
-“ফাজলামো করো আমার আমার সাথে তুমি? হ্যাঁ! আমাকে কী তোমার মানুষ বলে মনে হয় না? তুমি কী ভেবেছ, তুমি এমন করলে তোমার সাথে যা হয়েছে তা ঠিক হয়ে যাবে? নাকি যারা তোমার এই অবস্থা করেছে তারা শাস্তি পেয়ে যাবে? এসব কিচ্ছু হবে না। তোমার আশেপাশের মানুষগুলোর কথা একবারও ভেবেছ? যারা তোমাকে ভালোবাসে, তোমার ভালো চায় তাদের কথা ভেবেছ একবারও? তুমি এই যে নিজের অযত্ন করছ, নিজেকে আঘাত করছ এসবে সব থেকে বেশি কষ্ট তোমার আপনজনেরাই পাচ্ছে। কিন্তু সেসব তো তুমি ভাবছ না। নিজের জীবনটাকে শেষ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ তুমি। কেন করছ এসব? তোমার বাবা, অভ্র ভাই, নিধি এদের কথা ভেবেছ একবারও? আমার কথা ভেবেছ একবারও? আমাদের জন্য কেন স্বাভাবিক হতে পারছ না তুমি? অন্তত আমার জন্য হলেও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো অর্ঘমা। আমার ধৈর্যের বাঁধ দিনদিন ভেঙে যাচ্ছে। তোমার এই নির্লিপ্ততা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তোমার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী আমি জানি। তাই বলে এভাবে শাস্তি দিচ্ছ? এর থেকে নিজ হাতে আমায় মেরে ফেলো তা-ও কষ্ট কম হবে আমার। এভাবে আর বাঁচতে পারছি না আমি। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। আচ্ছা, আমি মরে গেলে শান্তি হবে তোমার? তখন কী একটু স্বাভাবিক হতে পারবে? তাহলে বলো, আমি তাই করছি। তবুও এভাবে থেকো না প্লিজ! আই বেগ অফ ইউ।”
সোফার ওপর থেকে ফোন নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল নীরদ। অভ্র আর নিধি কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনে ছুটে এসেছিল অর্ঘমার রুমের দিকে। কিন্তু নীরদের কথা শুনে তারা আর ভেতরে ঢোকেনি। দরজার বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ নীরদ একটা কথাও ভুল বলছে না। নীরদ বেরিয়ে যেতেই তারা রুমে ঢুকল। অর্ঘমা ফ্যালফ্যাল করে নীরদের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কিছু মুহূর্ত পর ডুকরে কেঁদে উঠল সে। নিধি কিছু না বলে জড়িয়ে ধরল তাকে। ইশারায় অভ্রকে বলল নীরদকে দেখতে। অভ্রও বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে নিধির কথা মতো নীরদ কোথায় গেছে তা দেখার জন্য গেল। নিধির মনে হলো এখন অর্ঘমাকে একটু বুঝালে হয়তো বুঝবে মেয়েটা। তাই সে-ও অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকে বুঝাতে লাগল। এতে যদি একটু স্বাভাবিক হয় মেয়েটা।
___
রাত পেড়িয়ে ভোর হলো। ঘড়িতে বাজে ছয়টা। অর্ঘমা কিছুক্ষণ হলো ঘুমিয়ে পড়েছে নিধির কোলে। এতক্ষণ যাবৎ ছটফট করছিল মেয়েটা নীরদের জন্য। রাতে নীরদের বলা কথা আর নিধির বুঝানো কাজে দিয়েছে বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল নিধি। কিন্তু মেয়েটা নীরদের সাথে কথা বলার জন্য পাগল হয়ে আছে। নিধি কল করেছিল বেশ কয়েকবার নীরদের ফোনে। কল তো নীরদ রিসিভ করেই নি উল্টো ফোনই সুইচ অফ করে দিয়েছে। তাই দেখে অর্ঘমার কান্নার বেগ দ্বিগুণ হারে বেড়ে গিয়েছিল। অভ্রও সারারাত বাসায় ফেরেনি। তার ফোনও বন্ধ বলছে। নীরদের বলে যাওয়া কথা শুনে নীরদের জন্য চিন্তায় মেয়েটার ঘাম ছুটে গেছে। নীরদ আবার সত্যি সত্যি নিজের ক্ষতি করে না বসে! এসব ভেবে সারারাত কান্নাকাটি করে একটু আগে অবশেষে ঘুমিয়েছে। অর্ঘমার মাথার নিচে বালিশ দিয়ে ঝটপট পুরো রুমটা গুছিয়ে ফেলল নিধি। এখন প্রায় সময় নীরদ এখানে থাকে বলে সে অন্য রুমে থাকে।
___
পার হয়েছে দু’টো দিন। নীরদের দেখা নেই। বেহাল দশা অর্ঘমার। নীরদ নীরদ করে পাগল হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। নীরদের খোঁজ খবর না পেয়ে শেষে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তার বাসায় ফোন দিয়েছিল। নীরদের খবর তো সে পায়ই নি, উল্টো নীরদের মায়ের কথায় তার ভারাক্রান্ত মন আরো ভারাক্রান্ত হয়েছে। ভদ্রমহিলা নিজের কথা দ্বারা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন অর্ঘমা এখন তার ছেলের যোগ্য নয়। এমন একজন মেয়েকে তিনি কখনো তার ছেলের বউ করবেন না। নীরদ অনেক ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করে। সে যেন নীরদের থেকে দূরে থাকে। এরপর থেকে আর কাঁদছে না অর্ঘমা। শুধু মনে মনে প্রার্থনা করছে নীরদ যেখানেই থাকুক না কেন, সে যেন ভালো থাকে, সুস্থ থাকে।
নীরদ সেদিন সন্ধ্যার পর পরই এসে হাজির হলো অর্ঘমাদের বাসায়। সরাসরি এসে ঢুকল অর্ঘমার রুমে। অভ্র মৃদু হেসে রুমের দরজা চাপিয়ে চলে গেল। তার বোন স্বাভাবিক হচ্ছে দেখে তার খুশির অন্ত নেই। এখন নীরদের সাথে মান-অভিমানটা শেষ হলেই তার শান্তি। অবশ্য তার মাথায় আরও একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। নীরদের পরিবার! সেই ব্যাপারে নীরদের সাথে কথা হয়েছে তার। এখন দেখা যাক কী হয়।
___
অর্ঘমা নীরদকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়াল। জলে টলমল করে উঠল তার চোখজোড়া। দৌড়ে গিয়ে জাপ্টে জড়িয়ে ধরল তাকে। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল নীরদের মায়ের বলা সকল কথা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। কান্নার বেগ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। সাথে জড়িয়ে ধরার বাঁধনও আরও শক্ত হলো। চোখ বন্ধ করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল নীরদ। কি যে শান্তি লাগছে তার, বলার মতো না। কতগুলো দিন পর তার অর্ঘ তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মেয়েটা স্বাভাবিক হচ্ছে বুঝতে পেরে নীরদের বন্ধ চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। দু’হাতে শক্ত করে অর্ঘমাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় চুমু খেল। অর্ঘমা কান্নারত অবস্থায় নীরদের বুকে কিল মেরে বলল,
-“কোথায় ছিলেন আপনি এতদিন? কত চিন্তা হচ্ছিল আমার জানেন? আরেকটু হলে আমি মর….”
অর্ঘমার ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিল নীরদ। দু’হাতে তার মুখ ধরে বলল,
-“এমন কথা আর কখনো যেন না শুনি। আমি তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি অর্ঘ। তুমি ভাবতেও পারবে না আমার ভালোবাসার পরিমাণ ঠিক কতটা। তোমার কষ্ট দেখলে আমার তার থেকে দ্বিগুণ কষ্ট হয়। মনে হয় নিজেকে শেষ করে ফেলতে। তাই প্লিজ, আর কখনো এমন কিছু করো না। এত সহজে ভেঙে পড়লে হবে, বলো? এখানে তো তোমার কোনো দোষ নেই। তবে তুমি কেন এভাবে ভেঙে পড়বে? দোষ যারা করেছে তারা মুখ লুকিয়ে চলবে। তুমি কেন মুখ লুকিয়ে ঘরে বসে থাকবে? ভয় পেয়ে লুকিয়ে না থেকে মানুষের কথার কঠোর জবাব আর অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করে দেখো অনেক হালকা লাগবে। আমি সবসময়, সারাজীবন তোমার পাশে আছি।”
নীরদের বুকের কাছের শার্টের অংশ খামচে ধরে ফোপাঁতে লাগল অর্ঘমা। হাসল নীরদ। অনেকদিন পর তার হাসির দেখা মিলল। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সময় নিয়ে অর্ঘমার কপালে চুমু খেল। চুমু খেল তার দু’চোখের পাতায়ও। চোখ মেলে তাকাল অর্ঘমা। তার গাল দু’টো ভিজে গেছে চোখের জলে।
-“আমাকে ক্ষমা করবেন নীরদ। আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি শুধু মেনে নিতে পারছিলাম না সেই দূর্ঘটনাটা। ওসব মনে পড়লেই আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় কতগুলো নোংরা বিষাক্ত পোকা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আমার ওপর। আম..আমি….”
ডুকরে কেঁদে উঠল অর্ঘমা। জল এলো নীরদের চোখেও। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অর্ঘমার বলা কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল নীরদের। চোখজোড়া যেন ক্রমশই রক্তিম বর্ণ ধারণ করতে লাগল।
-“আমি এখনো এসব মেনে নিতে পারছি না। আমার কী দোষ ছিল? ওরা কেন করল আমার সাথে এমন? ওই শা..শাকিল আর ওর বন্ধুরা….”
কান্নার বেগ বাড়ল অর্ঘমার। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল তার সাথে ঘটে যাওয়া কয়েকদিনের নরক যন্ত্রণা। সব পুনরায় মনে পড়তেই ভয়ে ঘেমে উঠল তার সারা শরীর। হুট করেই সে কেমন যেন করতে লাগল। নীরদ প্রথমে বুঝল না কিছু। পরক্ষণেই ডাক্তারের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই বুঝতে পারল সেই ঘটনা মনে পড়ায় অর্ঘমা ভয়ের কারণে এমন করছে। সে কী করবে বুঝতে পারল না। অর্ঘমার গালে হাত রেখে কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকল। স্বাভাবিক হতে বলল তাকে। অভয় দিল। আস্তে আস্তে শান্ত হতে লাগল অর্ঘমা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল সে। নীরদ তার গালে হাত রেখে বলল,
-“কিচ্ছু হয়নি। ওকে? সব ঠিক আছে। শান্ত হও। ওরা কেউ আর কখনো আসতে পারবে না তোমার কাছে। আর ওদের প্রাপ্য শাস্তি ওরা পাবে। ভয়ের কিচ্ছু নেই অর্ঘ। দেখো, তাকাও আমার দিকে।”
অর্ঘমা চোখ মেলল। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল নীরদের দিকে। নীরদ তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,
-“সব ঠিক আছে। কিচ্ছু হয়নি। হুম?”
মাথা নেড়ে সায় দিল অর্ঘমা। নীরদের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে রইল নীরবে।
চলবে…