#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২৭
.
সেই মর্মান্তিক ঘটনার পর পার হয়েছে প্রায় একমাস। অর্ঘমাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে গতকাল। শারীরিক বা মানসিক কোনো দিক দিয়েই সে সুস্থ নয়। এই এতগুলো দিনে অর্ঘমার মুখ থেকে একটা টু শব্দও কেউ বের করতে পারেনি। নীরদ প্রতিদিন হসপিটালে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অর্ঘমার হাত ধরে তার পাশে বসে থেকেছে। বিভিন্ন মন ভুলানো কথা বলেছে। কিন্তু অর্ঘমা কী এত সহজে ভুলে এসব কথায়? অর্ঘমার মুখ থেকে কথা বের করার জন্য অভ্র আর নিধিও কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশ অফিসার দু’বার এসেছিলেন অর্ঘমার সাথে কথা বলতে। কিন্তু অর্ঘমার অবস্থা দেখে নীরদই তাকে আসতে বারণ করেছে। বলেছে অর্ঘমা যদি কিছু বলে তাহলে সে জানাবে। এর মধ্যে নীরদের বাসার সবাই বেশ কয়েকবার এসে দেখে গিয়েছে অর্ঘমাকে।
বর্তমানে অর্ঘমা ঘুমিয়ে আছে। তাকে জোর করে খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়েছে নীরদ। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে অর্ঘমা এখন গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। নীরদ বসে আছে তার পাশে। পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার মাথায়। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার মায়াময় মুখের দিকে। যে মায়াময় মুখটা ঢাকা পড়েছে অসংখ্য কামড় আর খামচির দাগের নিচে। কিন্তু তবুও নীরদের কাছে সেটা মায়াময় মুখ। তার ভালোবাসা এত ঠুনকো নয় যে এতটুকুতেই হারিয়ে যাবে। চেহারার কী? কয়েকদিন বাদে আবার ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েটার মনের ভেতরে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তার কী হবে? সেটা কীভাবে ঠিক হবে? অর্ঘমার এই নিস্তব্ধতা নীরদকে ঠিক কতটা পোড়াচ্ছে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই অর্ঘমার। ধারণা থাকলে হয়তো সে চুপ থাকতে পারত না।
অভ্র রুমে ঢুকে এমন একটা দৃশ্য দেখে মুচকি হাসল। কিন্তু পরক্ষণেই তার হাসিটা মিলিয়ে গেল। অন্য চিন্তায় তার মনের ভেতরটা ছটফট করছে। নিঃশব্দে নীরদের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখল। পেছন ঘুরে তাকাল নীরদ। অভ্র তাকে ইশারা করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। অর্ঘমার গায়ের কম্বলটা ঠিকঠাক করে দিয়ে নীরদও গিয়ে দাঁড়াল অভ্রর পাশে।
অন্ধকার আকাশ মেঘে ঢেকে আছে। তারার দেখা নেই বেশ কয়েকদিন যাবৎ। সেদিকে তাকিয়েই অভ্র বলল,
-“তারপর কী ভেবেছিস?”
-“কোন ব্যাপারে বলছ?”
-“তুই চাইলে এই বিয়েটা ভেঙে দিতে পারিস। কেউ কিচ্ছু বলবে না তোকে। পরিস্থিতিটা সবাই জানে।”
মৃদু হাসল নীরদ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-“তোমার কেন মনে হলো আমি বিয়েটা ভাঙতে চাই?”
-“এমন একটা ঘটনার পরও তুইও বিয়ে করতে চাস অর্ঘমাকে?”
-“না করার কী আছে? দোষ তো ওর না। দোষ আমার। আমার জন্যই আজ ওর এই অবস্থা।”
-“করুণা করতে চাইছিস ওকে?”
-“সেই সাধ্য আমার নেই ভাইয়া। অর্ঘমাকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি। ওকে ছাড়া থাকতে পারব না। আর ভালোবাসায় করুণা করা সাজে না।”
-“তোর পরিবার এখনো মেনে নিবে অর্ঘমাকে?”
-“নিবে। আমি যদি খুশি থাকি তাহলে তারা না করার কে?”
-“অথচ তোর মা এসে বিয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে আজ।”
বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল নীরদ। অভ্র সেই দৃষ্টি দেখে মলিন হাসল। সে-ও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
-“আন্টি বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন। আর বলে গেছেন তোকে যেন বুঝাই এসব পাগলামি ছাড়তে। আশেপাশের সবাই এখন জানে অর্ঘমা ধর্ষিতা। এমন একজনকে তোর বউ করলে তিনি সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। এখনই সবাই তাকে খোঁচা মেরে কথা বলে। তাই এই বিয়ে সম্ভব না।”
-“বিয়ে আমি অর্ঘমাকেই করব। যে যা-ই বলুক আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়ছি না। আমি ওকে ওর শারীরিক সৌন্দর্য দেখে তো ভালোবাসি নি। তাহলে ও ধর্ষিতা কিনা সেটা কেন দেখতে যাব?”
-“তুই বুঝতে পারছিস না নীরদ।”
-“আমি সবই বুঝতে পারছি ভাইয়া। এই ব্যাপারে আর কোনো কথা হবে না। তুমি ভালো মতোই জানো আমি ওর জন্য ঠিক কতটা পাগল। তবুও তুমি কীভাবে আমাকে চলে যেতে বলছ ওর জীবন থেকে?”
-“পরিস্থিতি বিবেচনা করেই বলেছি।”
-“পরিস্থিতি আগে না তোমার বোন আগে? তোমার কী মনে হয় আমি চলে গেলে অর্ঘমা ভালো থাকবে? একদমই না। বরং এর থেকেও বেশি ভেঙে পড়বে। তাই বলছি এই ব্যাপারে আর কোনো কথা হবে না। অর্ঘমা একটু ঠিক হলেই আমি বিয়েটা সেরে ফেলব। কোনো অনুষ্ঠানের দরকার নেই। সংসার আমি করব, বাইরের মানুষজনরা করবে না যে তাদের কথা আমার শুনতে হবে।”
নিজের কথা শেষ করে হনহনিয়ে রুমে ঢুকে গেল নীরদ। গিয়ে বসল অর্ঘমার পাশে। ঘুমের মাঝে অর্ঘমার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ছে। তা দেখে আলতো হাতে সেই অশ্রু মুছে দিল নীরদ। আজকাল বেশিরভাগ সময়ই সে এখানে থাকে। তার চাকরিটাও সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছে। এভাবে রোজ রোজ ছুটি কাটালে তার চাকরি এমনিতেও টিকত না। অর্ঘমা আগে সুস্থ হোক তারপর নাহয় আবার চাকরি খোঁজা যাবে।
___
সময়টা তখন বিকেল। অর্ঘমা হাত-পা গুটিয়ে বিছানায় বসে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। ওখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের মনোরম পরিবেশ। ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে তার। বিগত প্রায় মাসখানেক যাবৎ সে ঘরে বসে আছে। নিজের রুম থেকেও বের হয়নি। মুখের সকল দাগ মিলিয়ে গেলেও হালকা দাগ রয়ে গেছে। শরীরের দাগগুলো এখনো আছে। আজ নীরদ আসেনি বাসায়। অর্ঘমারও সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। নিধি ভার্সিটি থেকে আসেনি। অভ্রও অফিসে। তার বাবা ব্যবসার কাজে বাইরে আছেন। মিনা বেগম পাশের রুমে আছেন হয়তো। অর্ঘমার এত বড় একটা দূর্ঘটনার কথা শোনার পরও একটি বারের জন্য তাকে দেখতে আসেননি মিনা বেগম। মানুষ এতটাও নির্দয় হয়?
বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল অর্ঘমা। নিজেকে দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এতগুলো বছর যেই শরীরে অন্য কোনো পুরুষের স্পর্শ লাগতে দেয়নি, সেই শরীরটাকেই খুবলে খুবলে খেয়েছে ওই নর্দমার কীটগুলো। নোংরা করে দিয়েছে তার শরীরটাকে। কলঙ্কিত করেছে তাকে। এই মুখ নিয়ে বাইরে যাওয়ার সাহস তার নেই। পাছে পাড়া-প্রতিবেশিরা যদি কটুক্তি করে কিছু বলে ফেলল তখন? সইতে পারবে না অর্ঘমা। অতো শক্ত মনমানসিকতা তার কোনো কালেই ছিল না। এই ঘটনার পর তো একদমই ভেঙে পড়েছে। নিজের চেহারা দেখতে নিজেরই ঘেন্না লাগছে। তার চোখ ফেটে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
চোখের পানি মুছে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মনে পড়ে গেল গতকাল রাতের কথা। নীরদ তাকে গতকাল অনেক বুঝিয়েছে। তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে পর্যন্ত! অর্ঘমার নীরবতা সে সহ্য করতে পারছে না। এসব বলার পরও অর্ঘমা নীরব ছিল। সেই রাগে নীরদ বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। আজ এখনো পর্যন্ত আসেনি ছেলেটা। ভীষণ অভিমান করেছে হয়তো। অর্ঘমা জানে নীরদ আসবে। সে শতভাগ নিশ্চিত।
নতুন ফোনটা অবহেলায় পড়ে আছে বিছানার একপাশে। এটা অভ্র এনে দিয়েছে। নতুন সিমও লাগিয়ে দিয়েছে। কিছু একটা ভেবে অর্ঘমা কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিল। ইতোমধ্যে সকল আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি সবাই জেনে গেছে তার সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার কথা। অনেকে এসেও ছিল তাকে স্বান্তনা দিতে কিন্তু তাদের রুমে আসতে দেয়নি অভ্র বা নীরদ। এদের কাজই অন্যকে খোঁচানো। অর্ঘমার মনের অবস্থা এমনিতেই শোচনীয়। এদের কথা শুনে মেয়েটা পরে আরও বেশি ভেঙে পড়বে।
ফেসবুকে লগ ইন করা মাত্রই শত শত ম্যাসেজের ভিড় এসে জমা হলো ফোনে। অনেকে তাকে ট্যাগ দিয়ে বিভিন্ন পোস্ট করেছে। সবই বসে বসে দেখল অর্ঘমা। স্বান্তনার নাম করে সবার সামনে তাকে একজন ধর্ষিতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সকলে। বড্ড হাসি পেল অর্ঘমার। সব দেখতে দেখতে একসময় জোরে জোরে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই একসময় চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তার চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে মিনা বেগম ছুটে এলেন। রুমের সামনে এসে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভেতরে ঢুকলেন না। সেই ঘটনার পর আজ প্রথম অর্ঘমার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলেন তিনি। তাই কিছুটা অবাক হয়েই ছুটে এসেছেন। মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে আবারও নিজের রুমে চলে গেলেন।
অর্ঘমা কান্না করতে করতে হাতের ফোনটা ছুঁড়ে মারল ড্রেসিং টেবিলের দিকে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা ভেঙে কাচগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল চারপাশে। জোরে চিৎকার করে হাঁটু মুড়ে ফ্লোরে বসে পড়ল সে। নখ দিয়ে নিজের সারা শরীরে পাগলের মতো আঁচড় কাটতে লাগল। যেন কোনো বিষাক্ত কিছু তার শরীরে ছেড়ে দিয়েছে কেউ।
কিছুক্ষণ পর ঝড়ের বেগে নীরদ এসে ঢুকল তার রুমে। ফ্লোরে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল। তবুও থামল না অর্ঘমা। তাকে থামাতে না পেরে তার দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে তাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। অর্ঘমা ছোটার জন্য অনেক চেষ্টা করেও পারল না। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সেভাবেই ঢলে পড়ল সে নীরদের বুকে। নীরদ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিল। তার বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুবিন্দু।
এখনো শরীর কাঁপছে নীরদের। হাত-পা কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব করছে। একটু আগে মিনা বেগমের কল পেয়ে সে ছুটে এসেছে। ভাগ্যিস বাসার কাছেই ছিল। নাহলে আজ অর্ঘমা নিশ্চিত কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলত। অর্ঘমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় তার বুকের মধ্যে চেপে বসেছে কিছুদিন যাবৎ। তার বাসা থেকে তার মা-বাবা চাপ দিচ্ছে অর্ঘমার থেকে দূরে থাকার জন্য। অর্ঘমার ব্যাপারে এখন তার সামনে নুসরাত হ্যাঁ-ও বলছে না আবার না-ও বলছে না। কিন্তু তবুও বোনের ভাবসাব দেখে নীরদ বুঝতে পারে তার বোনও তার বাবা-মায়ের পক্ষকেই সমর্থন করছে। ইদানিং নীরদ খেয়াল করেছে নুসরাত তার সামনে সবসময় নিজের ননদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে। এতে নুসরাতের মনোভাব বুঝতে সমস্যা হয় না নীরদের। নুসরাত চাচ্ছে নিজের ননদকে নীরদের গলায় ঝুলাতে। কিন্তু সব বুঝেও নীরদ নির্লিপ্ত থাকে।
অর্ঘমাকে কোলে তুলে বিছানায় ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়ে তার গায়ে কম্বল টেনে দিল। অর্ঘমার মুখের দাগ গুলো প্রায় মিলিয়েই গিয়েছিল কিন্তু আজ নিজেকে আঘাত করে পুনরায় দাগ বসিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। নীরদ অসন্তোষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অর্ঘমার শুঁকনো মুখের দিকে। ক্ষত স্থানগুলো থেকে হালকা হালকা রক্ত ঝরছে। স্যাভলন নিয়ে এসে অর্ঘমার পাশে বসল নীরদ। ক্ষতস্থান গুলোতে স্যাভলন লাগিয়ে দিল। অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অর্ঘমার একটা হাত নিজের এক হাতের মাঝে তুলে নিয়ে চোখ বন্ধ করে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
-“তুমি আমায় একটুও ভালোবাসো না অর্ঘ। যদি বাসতে তাহলে বুঝতে তোমার নির্লিপ্ততা আমায় কতটা কষ্ট দেয়। আজ তোমার সাথে যা হয়েছে এর জন্য তুমি যতটা না কষ্ট পাচ্ছ, তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি কষ্ট আমি পাচ্ছি। নিজের ভালোবাসার মানুষের এই অবস্থা ক’জনই বা মেনে নিতে পারে? আমিও পারছি না। তোমার এই অবস্থার জন্য দায়ী আমি। তুমি আমায় শাস্তি দাও। তবুও নিজেকে এভাবে কষ্ট দিয়ো না, আঘাত করো না। তোমার শরীরের প্রতিটা আঘাত আমার মনকে বারংবার ক্ষত-বিক্ষত করে। এসব যদি তুমি জানতে তাহলে কখনো নিজেকে কষ্ট দিতে না। তুমি কী তবে এভাবেই আমাকে শাস্তি দিচ্ছ? এতটা কঠিন? এর থেকে যদি আমায় মৃত্যুদন্ড দিতে তা-ও বোধহয় কষ্ট কম হতো।”
চলবে…