কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব ২৫

0
565

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২৫
.
নিধি চুপচাপ বসে আছে অভ্রর সামনে। অভ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পুরো বাসা সুনশান। অভ্রর বাবা ব্যবসার কাজে বেরিয়েছে। অভ্রর মা গিয়েছেন হয়তো তার কোনো বান্ধবীর বাসায়। এখন সারা বাসায় শুধুমাত্র অভ্র আর নিধি উপস্থিত। মিনিট দশেক হয়েছে তারা বাসায় এসেছে। বাসায় ঢুকেই অভ্র নিধির হাত টেনে ধরে তাকে সোফায় বসিয়েছে। নিজেও চুপ করে বসে আছে সামনে। এখন নিধির মনে হচ্ছে সে বেশি বলে ফেলেছে তখন। ওদের পার্সোনাল কথার মাঝে তার ঢোকাটা উচিত হয়নি। কিন্তু তখন তার মাথাও তো ঠিক ছিল না। দু’জনের মাঝে দাঁড়িয়ে পিষতে হচ্ছিল তাকে। এত চেঁচামেচি একাধারে শুনতে শুনতে মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল তার। তাই তো মুখ ফসকে গিয়েছিল।
অভ্র সোফায় আরাম করে হেলান দিয়ে বসল। গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল,
-“আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।”
-“জি!”
-“পানি নিয়ে এসো।”
অভ্রকে এক পলক দেখে নিয়ে নিধি উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল পানি আনতে। মিনিটের মাঝেই গ্লাস ভরতি পানি নিয়ে হাজির হলো। গ্লাসটা অভ্রর দিকে বাড়িয়ে দিতেই নিয়ে নিল। তৃপ্তি সহকারে পানি খেয়ে গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বলল,
-“বসো।”
-“জি!”
-“কানে সমস্যা আছে? কথা বারবার রিপিট করা লাগছে কেন?”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে চুপচাপ অপর পাশের সোফায় বসল। অভ্র দু’হাত ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল। হাই তুলল। নিধির মাথায় ঢুকছে না অভ্রর কাজকর্ম।
-“কী বলছিলে তখন রিয়াকে?”
ভয়ে গলা শুঁকিয়ে এলো নিধির। এখন কী তাকে বকবে নাকি লোকটা? এমনিতেই তো অকারণে সবসময় এই ভয়েই থাকে সে। আজ কী তবে ভয়টা সত্যি হতে চলল? মিনমিনে গলায় সে বলল,
-“সরি। আসলে তখন আপনাদের কথা কাটাকাটি শুনে আমারই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই আরকি…! আপনি বললে আমি রিয়া আপুকে সরি বলে দিব।”
-“আর সেটা কীভাবে? ওকে পাবে কোথায় তুমি?”
-“আপনি বলবেন আসতে। তারপর নাহয় সরি বলব।”
-“আমি কেন আসতে বলব? আমার ঠ্যাকা পড়েছে নাকি? ওসব ফাতরা মেয়েদের নাম্বার আমি আমার ফোনে রাখি না।”
নিধি অবাক হয়ে বলল,
-“আপনি না আপুকে ভালোবাসেন?”
-“ঘটনাটা কয় বছর আগের সেই হিসাব আছে? তখন ভালোবাসতাম। কিন্তু এখন আর ওকে ভালোবাসি না আমি। ওর প্রতি থাকা অনুভূতিগুলো ও-ই নষ্ট করে দিয়েছে।”
-“মানে আমি আপুকে যে এত কথা বলে আসলাম, আপনি রাগ করেননি?”
-“উঁহু! একটু না। উল্টো আমার হাসি পেয়েছে। কিন্তু বিস্ময়ের চোটে হাসতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন তুমি আরেকবার কথাগুলো রিপিট করো। আমি একটু হেসে নিই।”
নিধি ভ্র কুঁচকে তাকাতেই হেসে উঠল অভ্র। প্রাণখোলা হাসি তার। সেই হাসি দেখে নিধির মুখেও সুক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা গেল। শরীর দুলিয়ে হাসছে অভ্র। এর আগে কখনো এত কাছ থেকে অভ্রকে এভাবে হাসতে দেখা হয়নি। হঠাৎ হাসি বন্ধ করে অভ্র বলে উঠল,
-“উইল ইউ ম্যারি মি?”
-“হুঁ!”
বিস্ময়ের চোটে হকচকিয়ে গেল নিধি। সে ঠিক শুনেছে না ভুল শুনেছে বুঝতে পারছে না। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে সে। অভ্র মৃদু হেসে বলল,
-“আমার কথাকে মজা ভেবে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ভুল করো না কিন্তু। আমি সিরিয়াস। এসব ব্যাপার নিয়ে মজা করার বয়স আমার নেই। বিয়ের বয়স অলমোস্ট পার হতে চলল।”
নিধি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তাকে দ্বিতীয় বারের মতো চমকে দিয়ে আবারও একই প্রশ্ন করল অভ্র।
-“সো, উইল ইউ ম্যারি মি?”
দ্বিধান্বিত নিধির গলার আওয়াজ যেন হারিয়ে গেছে। বহু কষ্টে মিনমিনে আওয়াজে সে বলল,
-“মা..মানে আম..আমি! আহ..আসলে…”
-“আমাকে কী কোনো কারণে অপছন্দ তোমার?”
-“না তা নয়।”
-“আমি কী ছেলে হিসেবে খারাপ বা তোমার অযোগ্য?”
-“একদমই না। আপনার মতো ছেলে সব মেয়েই চায়। আর আপনি আমার অযোগ্য হতে যাবেন কেন? বরং আমি আপনার অযোগ্য।”
-“তুমি অযোগ্য হলে নিশ্চয়ই তোমাকে বিয়ের প্রপোজাল দিতাম না?”
-“কিন্তু আপনার মা?”
-“তার মানে মায়ের কথা বাদ দিলে তোমার কোনো আপত্তি নেই তাই তো?”
পুনরায় হকচকিয়ে গেল নিধি।
-“না মানে… আসলে…”
-“আসল নকলের কথা পরে হবে। এখন সিরিয়াস মোমেন্ট চলছে। সো, জলদি জলদি বলো। এই অফার কিন্তু সীমিত সময়ের জন্য।”
-“আপনি কী সিম কার্ড নাকি?”
-“সিম কার্ডের চেয়েও সীমিত এই অভ্রকে বিয়ে করার অফার।”
অস্বস্তি এবং চিন্তায় হাত ঘামতে লাগল নিধির। দু’হাত সমানে কচলে যাচ্ছে সে। কী বলবে না বলবে তা নিয়ে দ্বিধান্বিত তার মন। গলা খাদে নামিয়ে বলল,
-“আপনি কেন আমায় বিয়ে করতে চাইছেন?”
-“বিয়ে মানুষ কেন করে? বিয়ে করে বাসর করব। তারপর বছরখানেক বাদে দু’একটা বাচ্চা ফুটিয়ে বাবা ডাক শুনব। হ্যাঁ, তুমি চাইলে ওরা তোমাকেই মা বলে ডাকবে। তার জন্য তোমাকে এই বিয়েতে রাজি হতে হবে। নাহলে তো মা ডাক শুনতে পারবে না।”
নিধি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভ্রর দিকে। তার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। লজ্জায় গাল দু’টো গরম হয়ে গেছে। অভ্রর মুখ থেকে এমন লাগামহীন কথা সে আগে কখনো শোনেনি। তাই তার মানতে কষ্ট হচ্ছে। অভ্র তাকে বিস্ময়ের আরও এক ধাপ ওপরে পৌঁছে দিতে বলল,
-“আচ্ছা বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলতে হবে না। অন্য একটা প্রপোজাল দিই তোমায়। আমার বাবুর আম্মু হবে?”
এবার নিধির মন চাইছে নিজের মাথা দেয়ালে গিয়ে ঠুকতে। একটু ভালোভাবে বললে হয়টা কী? আজব লোক তো!
-“অফার কিন্তু শেষ হতে চলল। এত বড় একটা অফার হাতছাড়া করতে চাইছ নাকি তুমি? সেম অফারটা তুমি যদি আমায় দিতে তাহলে আমি সাথে সাথে লুফে নিতাম।”
-“আম..আমি আসলে বুঝতে পারছি না।”
-“তুমি যদি মা’কে নিয়ে চিন্তায় থাকে তাহলে বলব সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি ম্যানেজ করে নিব।”
-“হুম।”
-“হুম কী? রাজি?”
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে আছে নিধি। কী বলবে বুঝতে পারছে না। মন একবার বলছে রাজি হয়ে যেতে। আবার আশেপাশের লোকজনের কথার ভয়ে না করে দিতে ইচ্ছে করছে। তার চিন্তা-ভাবনার মাঝেই অভ্র উঠে এসে তার পাশে বসল। একদম গা ঘেঁষে। চমকে উঠল নিধি। মুহূর্তেই তার গাল জ্বলে উঠল। গলা শুঁকিয়ে আসতে লাগল। শুঁকনো ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে বলল,
-“আপ..আপনি এখানে কেন? দূদ..দূরে স..রে বসুন।”
-“কেন?”
-“পিপ..প্লিজ!”
-“অফার টাইম কিন্তু শেষ হতে চলল।”
-“আপনি..”
বুকের ভেতরটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে নিধির। ভয়, অস্বস্তি, উত্তেজনা সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা তার। শরীরের লোম সব দাঁড়িয়ে গেছে। কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। তার আবার জ্বর আসছে না তো?
-“আমি কী তাহলে তোমার উত্তর ‘না’ ধরে নিব?”
-“নাহ্!”
মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে উঠল নিধি। হেসে ফেলল অভ্র। দুষ্টু সুরে বলল,
-“তাহলে ‘হ্যাঁ’ ধরে নিব?”
অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল নিধি। এমন কেন করছে লোকটা? এভাবে মজা নিচ্ছে তার নার্ভাসনেসের? অভ্র আলতো ভাবে নিধির হাত ধরে জোরে হেসে ফেলল।
-“হাত-পা তো পুরো ঠান্ডা হয়ে গেছে তোমার। দেখো আবার স্ট্রোক করে বসো না যেন।”
অভ্র মাথা ঝুঁকিয়ে টুপ করে নিধির গালে চুমু খেয়ে বসল। নিধির মাথায় যেন এবার পুরো বিস্ময়ের পাহাড়টাই ভেঙে পড়ল। হা করে গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সে। তার চুল ঠিক করে কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে অভ্র বলল,
-“উত্তরটা তাহলে আমি ‘হ্যাঁ’ হিসেবেই ধরে নিলাম। পরে কিন্তু এর নড়চড় করা যাবে না। আর নিজেকে প্রস্তুত করো জলদি।”
নিধি ভয়ার্ত চোখে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই অভ্র হেসে বলল,
-“বিয়ের জন্য। মায়ের জন্য হয়তো অতো ধুমধাম করে বিয়ে করতে পারব না। কিন্তু বিয়ে আমরা করছি খুব শীঘ্রই।”
-“কিন্তু…”
-“আর কোনো কিন্তু নয়। এতদিন আমার চোখের সামনে অনেক ঘুরঘুর করেছ। এবার থেকে নাহয় আমার মনের ভেতরে ঢুকে ঘুরঘুর করবে।”
পরপর নিধির আরেক গালে চুমু খেয়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেল অভ্র। নিধি তখনো বিস্ময়ের ঘোরে রয়েছে। সে ওখানেই গালে হাত রেখে বসে রইল। বারবার চোখের পলক ফেলে একটু আগের সম্পূর্ণ ঘটনাটা পুনরায় ভাবার চেষ্টা করছে। ঘটনা পুরোটা মস্তিষ্ক ধারণ করতেই তার অধর কোণে স্মিত হাসি দেখা গেল। তার জীবনেও বুঝি অবশেষে একজন নিজের মানুষের আগমন ঘটল, যাকে সে একান্তই নিজের বলে দাবি করতে পারবে?
___
ঘরের দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল অভ্র। তার মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে সে আজ কতটা খুশি। তার এই খুশির কারণটাও স্পষ্ট। নিধি! এত বছর মেয়েটাকে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখে কবে আর কখন যে মেয়েটাকে মনে ধরে গেল বুঝতেই পারল না। নিধির প্রতি সে দূর্বল বিষয়টা বুঝেছে খুব বেশিদিন হয়নি। এইত মাস দুয়েক আগে তার অফিস ছুটি থাকায় অর্ঘমা আর নিধিকে ভার্সিটি থেকে তাদের নিয়ে আসতে গিয়েছিল। ভার্সিটির সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় খেয়াল করেছিল নিধি একটা ছেলের সাথে খুব হেসে কথা বলছে। পাশেই অর্ঘমা ফোনে কারও সাথে কথা বলছে। নীরদ হবে হয়তো। কিন্তু নিধি ছেলেটার সাথে এত হেসে কথা বলতে দেখে তার সারা শরীর যেন মুহূর্তেই জ্বলে উঠল। এক অদৃশ্য হিংসে এসে দানা বাঁধল তার মনে। কিন্তু কেন? এই কেন এর উত্তর সেদিন সারাদিন ভাবার পর গিয়ে পেল। নিধির সাথে তার খুব একটা কথা হয় না। বাসায় প্রায় প্রায়ই তাকে চা বানিয়ে দেওয়ার অথবা এটা-সেটা বানিয়ে খাওয়ানোর দায়িত্বটা নিধির ঘাড়েই পড়ে। কারণ তার রান্নার হাত চমৎকার। দায়িত্বটা অবশ্য অভ্র নিজেই দেয়। এই এতটুকুতেই সে ফেঁসে গেছে নিধি নামক মায়াজালে। সামান্য একটা কারণ, তবুও ভালোবাসার জন্য যথেষ্ট অভ্রর কাছে। এটা ঠিক যে অভ্র রিয়াকে ভালোবাসত। কিন্তু রিয়া নিজেই অভ্রর মনে নিজের প্রতি থাকা অনুভূতিগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। এরপর নিশ্চয়ই অন্য কারও প্রতি নতুন করে অনুভূতি জন্মানো অন্যায় কিছু নয়?

নিধিকে আজ বারবার বিস্মিত হতে দেখে বেশ মজা লাগছিল অভ্রর। ও এভাবে নিজের মনের কথা জানাতে চায়নি। আবার সরাসরি বলতেও ভয় পাচ্ছিল পাছে যদি তাকে আবার প্রত্যাখ্যান করে বসে নিধি তখন? তাই একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলে দেখল নিধি কী বলে। কিন্তু নিধির কনফিউশান দেখে তার সকল কনফিউশান দূর হয়ে গেছে। নিধি তাকে অপছন্দ তো করে না এটাই যথেষ্ট। যেভাবে নিধিকে ঘোল খাইয়ে এসেছে এরপর নিধি তাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য। তার প্রতি অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করতেও বাধ্য। নিধির বিস্ময়কর চেহারাটা মনে করে নিঃশব্দে হেসে উঠল অভ্র।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here