কিশোরী কন্যার প্রেমে পর্ব ২৩

0
524

#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২৩
.
অর্ঘমা মাথানিচু করে বসে আছে। সে এসবের ব্যাপারে কিছুই জানে না। এখানে যা হচ্ছে সব তার মাথার তিন হাত ওপর দিয়ে যাচ্ছে। নীরদের বাবার এসব কথায় অর্ঘমার বিস্ময়ের পাহাড় যেন হিমালয় পর্বতের সমান হয়ে গেছে। তার রাগ হচ্ছে নীরদের ওপর। আজ যে ওরা এই ব্যাপারে কথা বলতে আসবে আগে থেকে জানাল না কেন? আগে থেকে জানালে একটু প্রস্তুতি নিয়ে থাকা যেত। এভাবে কিছু না বলে হুটহাট এসব কাজের মানে কী? এখন যে সে অপ্রস্তুত হয়ে বসে আছে! বাবা কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবে সে?

অর্ঘমাকে মাথানিচু করে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে অভ্রর বাবা আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলেন না। যা বুঝার বুঝে গেলেন তিনি। অভ্রর দিকে তাকাতেই অভ্র গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল,
-“আমি ওদের ব্যাপারটা জানতাম। নীরদ ভালো ছেলে তাই আমার আপত্তি ছিল না। মানে আপত্তি করার কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া আসল ব্যাপার হলো ওরা দু’জন দু’জনকে পছন্দ করে। তাহলে আমি কেন আপত্তি করব?”
বাবা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকলেন। মনে মনে চিন্তাভাবনা করছেন হয়তো। পরিবেশটা হুট করেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। এই ফাঁকে নিধি এসে সকলকে চা-নাস্তা দিয়ে হালকা কুশলাদি বিনিময় করে আবারও রুমে চলে গেল। অভ্রর বাবা গলা ঝেড়ে বললেন,
-“আমার তরফ থেকেও কোনো আপত্তি নেই।”
পরিবেশটা আবারও আগের মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠল। অর্ঘমা প্রথমে বিস্ময় নিয়ে বাবার দিকে তাকালেও পরক্ষণেই নীরদের দিকে তাকাল। নীরদ আড়চোখে আশেপাশে দেখে নিয়ে চোখ টিপ মারতেই লজ্জায় অন্য দিকে তাকাল। দুই পরিবারের সকলে একে অপরকে মিষ্টি মুখ করাল। নীরদের বাবা এবার আরেকটা আবদার রাখলেন।
-“আমি চাইছিলাম আজই আংটি পরানোর কার্যক্রমটা সেরে ফেলতে। আমরা দেরি করতে চাইছি না। সামনে অর্ঘমার পরীক্ষা আছে শুনলাম। পরীক্ষার পর বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছি।”
-“এত তাড়াতাড়ি?”
-“জি। ওরা দু’জন যখন দু’জনকে পছন্দই করে তখন আর দেরি করার দরকার কী?”
-“একটা মাত্র মেয়ে তো তাই আমি চাইছিলাম সময় নিয়ে সবকিছু করতে।”
-“চিন্তা করবেন না। এর মধ্যেই সব হয়ে যাবে। আমরা আছি তো।”
-“ঠিক আছে। আপনারা যখন এত করে বলছেন, আর ছেলেমেয়েরও কোনো আপত্তি নেই তখন আর না করব না।”
পরক্ষণেই আবার বললেন,
-“হাতে তো তাহলে একদমই সময় নেই।”
-“চিন্তা করবেন না। হয়ে যাবে সবকিছু। আপাতত নাহয় আংটি বদলটা হয়ে যাক।”
-“হ্যাঁ, অবশ্যই। দাঁড়ান আমি আসছি।”
অভ্রর বাবা ভেতরে রুমে গেলেন। ফিরে এলেন কিছুক্ষণ পর হাতে একটা ছোট বক্স নিয়ে। সোফায় বসে বললেন,
-“মেয়ে এখন বড় হয়েছে। এমন একটা দিন আসবে ভেবেই এই আংটিটা কিছুদিন আগে বানিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু দিনটা যে এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা ভাবিনি।”
অর্ঘমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তুমি কী চেঞ্জ করবে মামণি?”
নুসরাত বাঁধ সেধে বলল,
-“দরকার নেই আঙ্কেল। এভাবেই ভালো লাগছে। স্কার্ট আর শার্টে ওকে খারাপ লাগছে না।”
-“আচ্ছা, তাহলে শুরু করা যাক।”

অর্ঘমাকে বসানো হলো তার বাবা আর ভাইয়ের মাঝে। মিনা বেগম এখানে অনুপস্থিত। তিনি ঘুরতে গিয়েছেন তার বান্ধবীদের সাথে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে মাকে ছাড়া শুভ কাজ সারতে একদমই ভালো লাগছিল না অর্ঘমার। কিন্তু কিছু করার নেই। মায়ের সাথে তার সম্পর্ক খুব জঘন্য ভাবে একেবারে শেষ হয়ে গেছে। মিনা বেগম এখন আর তাকে মেয়ে বলে পরিচয় দেয় না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে তার একটা মাত্র ছেলে। এসব শুনে খুব কষ্ট হয় অর্ঘমার। মিনা বেগমের এই দুর্ব্যবহার যে শুধু নিধিকে এই বাসায় নিয়ে আসার জন্য না তা অর্ঘমা অনেক আগেই টের পেয়েছে। নিধি তো শুধু নামমাত্র। কিন্তু আসল ঘটনা অন্য জায়গায়। এই নিয়ে বছরখানেক আগে ভীষণ বড় রকমের একটা ঝগড়া লেগেছিল বাসায়। সেদিন অর্ঘমা প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিল। সেদিনের কথা ভাবলে এখনো অর্ঘমার দু’চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়তে চায়।
দুরুদুরু বুকে বাবা, ভাইয়ের মাঝে বসে চোখ তুলে তাকাল নীরদের দিকে। নীরদের মুখে খুব সুক্ষ্ম এক হাসির রেখা। সেটা কেউ বুঝতে না পারলেও অর্ঘমার চোখ এড়ালো না। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে ঘাড় উঁচু করে আশেপাশে তাকাল। নিধি নেই কোথাও। অভ্রর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“নিধি কোথায়? ওকে ডেকে নিয়ে এসো ভাইয়া। আম্মু তো নেই। এখন আমার এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যদি নিধিও না থাকে তাহলে..”
-“মন খারাপ করিস না। আমি তোর বান্ধবীকে নিয়ে আসছি।”
অর্ঘমা মাথা নাড়িয়ে সায় জানাতেই অভ্র সোফা ছেড়ে উঠে গেল।

নিধিকে পাওয়া গেল রুমের বারান্দায়। গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটাকে সে হাতে গোণা কয়েকবার মাত্র হাসতে দেখেছে। কথাও বলে খুব কম আর আস্তে। মেয়েটার চাপা স্বভাব দিন দিন যেন আরও বাড়ছে। বাইরে বের হলে রাস্তায় কোনো পরিবার দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ে। বাবা-মা যখন তাদের বাচ্চাদের আদর করে তখন নিধির চোখ দু’টো টলমল করে ওঠে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদে মেয়েটা। সবই খেয়াল করেছে অভ্র। তার খারাপ লাগে নিধির জন্য। এমন কপাল কেন হলো মেয়েটার? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অভ্র। এগিয়ে যায় সামনে। গলা ঝাড়তেই পেছনে তাকাল নিধি।
-“বাইরে চলো। অর্ঘমা তোমায় ডাকছে।”
-“কেন?”
-“ওর এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ও তোমাকে পাশে চায়। অ্যাজ আ বেস্টফ্রেন্ড, এটা তোমার দায়িত্ব।”
-“গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত মানে? কী হচ্ছে ওখানে?”
-“অর্ঘমাকে আংটি পরাতে এসেছে। সামনে তোমাদের এক্সাম আছে। সেটা শেষ হলেই বিয়ের আয়োজন শুরু হবে।”
নিধির মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। অভ্রর হাসি পেল নিধির অবস্থা দেখে। হাসি চেপে বলল,
-“জলদি চলো। তোমার জন্য আংটি পরানো স্থগিত রয়েছে।”
-“সত্যি সত্যি আজ অর্ঘমার এনগেজমেন্ট?”
-“হ্যাঁ।”
-“কিন্তু এভাবে হঠাৎ?”
-“মূলত ওদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে এসেছিল। এখন নীরদের বাবা চাচ্ছেন আংটি পরিয়ে যেতে। বাবাও রাজি।”
-“যাক, ভালোই হলো। অর্ঘমা তো আজ হাতে ইদের চাঁদ পেয়েছে।”
হাসল অভ্র। নিধি মৃদু হেসে বলল,
-“চলুন।”
নিধি আগে আগে যেতেই অভ্র হাসিমুখে তার পেছন পেছন গেল।
___
নীরদরা চলে যেতেই অর্ঘমা রুমে এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মনের ভেতর এক অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। একটু আগে তার বাগদান সম্পূর্ণ হয়েছে। কথাটা যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না। প্রথমে নীরদের ওপর রাগ লাগলেও এখন তার ভীষণ ভালো লাগছে। আজকের এই সারপ্রাইজের জন্য নীরদকে একটা টাইট হাগ করতে মন চাচ্ছে। ফোন হাতে নিতেই স্ক্রিনে নীরদের ম্যাসেজ দেখতে পেল।
-“সারপ্রাইজ কেমন লাগল?”
অর্ঘমা মৃদু হেসে রিপ্লাই করল,
-“ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালো।”
তৎক্ষনাৎ নীরদের থেকে আবারও ম্যাসেজ এলো।
-“এত ভালো একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আমাকেও তো তোমার কিছু দেওয়া উচিত।”
কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে অর্ঘমা রিপ্লাই করল,
-“রাতে ছাদে আসবেন। দেখা করে ভাববো কী দেয়া যায় আপনাকে।”
-“ওকে। এখন তাহলে বিশ্রাম নাও। আমাকে একটু বের হতে হবে। কাজ আছে।”
-“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
একটা লাভ ইমোজি পাঠিয়ে নীরদ অফলাইন হয়ে গেল। তা দেখে অর্ঘমাও ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে নিল। ঠোঁটে মৃদু হাসি। আংটি বদলের মুহূর্তটা কল্পনা করতে করতে সেভাবেই ঘুমিয়ে গেল একসময়।
___
চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সামনের নিম গাছের ডালে দুটো চড়ুইপাখি বসে আছে। একজন আরেকজনের মাথা চুলকিয়ে দিচ্ছে। হাসি ফুটে উঠল নিধির মুখে। পাখিরাও ভালোবাসা বোঝে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। তার জীবনে কেউ নেই কেন? অর্ঘমা যেমন সহজেই নীরদকে পেয়ে গেল, ঠিক তেমন করেই সে-ও তো কাউকে পেতে পারত। কিন্তু তার জীবনে কখনো কেউ আসতেই চায়নি। তার জীবনে শূন্যতার অভাব নেই। সবচেয়ে বড় শূন্যতা হলো বাবা-মায়ের শূন্যতা। নিধি নিজ ভাবনায় এতটাই মগ্ন ছিল যে রান্নাঘরে অভ্রর উপস্থিতি একদমই টের পায়নি।
-“তুমি কী চা বানাচ্ছ?”
হঠাৎ প্রশ্নে ভীষণভাবে চমকে উঠল নিধি। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। অভ্র বুঝতে পারল না এর কারণ। সে তো এমন কিছু বলেনি যে চমকে উঠতে হবে। নিধি পেছন ঘুরে অভ্রকে দেখে বলল,
-“কিছু বলেছেন?”
-“তুমি কী কিছু ভাবছিলে? চমকে উঠলে যে হঠাৎ?”
-“না, তেমন কিছু না। আপনি কী বলছিলেন?”
-“চা বানাচ্ছ কিনা জিজ্ঞেস করছিলাম।”
-“হ্যাঁ। আপনার জন্যও বানাব?”
-“বানালে ভালো হয়। আসলে অফিসে প্রতিদিন এই সময়ে চা খাওয়া হয়। অভ্যাস হয়ে গেছে।”
-“আচ্ছা, দিচ্ছি। আপনি বসুন গিয়ে।”
অভ্র চলে যেতেই চায়ের পাতিলের দিকে তাকাল। পানি শুকিয়ে অল্প হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আবারও পাতিলে পানি দিয়ে পানি বলক আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল।

চায়ের কাপ নিয়ে অভ্রর সামনের টেবিলের উপর রেখে বলল,
-“আপনার চা।”
-“তোমারটা কই?”
-“রান্নাঘরে রাখা আছে।”
-“চা নিয়ে এসে এখানে বসো। সঙ্গ দাও আমাকে।”
অবাক হয়ে গেল নিধি। অভ্র এই ধরনের কথা আগে কখনো বলেনি। নিধিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভ্র বলল,
-“কী হলো? যাও গিয়ে তোমার চা নিয়ে এসো।”
কোনো প্রতিত্তোর না করে মূর্তির মতন রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল নিধি। সে সবসময় অভ্রকে কিছুটা এড়িয়ে চলেছে। আশেপাশের লোকজনের কানাঘুষা আর অভ্রর মায়ের ভয়ে সবসময় তটস্থ থেকেছে। কখনো চায়নি তার জন্য অভ্রর সম্মানহানি হোক। এছাড়াও অভ্রকে দেখলে তার কেন যেন একটু ভয় ভয় করে। মনে হয় এক্ষুনি বুঝি তাকে বকবে। যদিও তার এসব ভাবনা অযৌক্তিক। কারণ অভ্র খুব শান্ত আর বড্ড প্রাণোচ্ছল ছেলে। সবসময় হাসিখুশি থাকাই এই ছেলের স্বভাব। অর্ঘমা আর অভ্র যখন দুষ্টুমি করে তখন মাঝে মাঝে নিধির বড্ড আফসোস হয় তার একটা ভাই নেই বলে।

চায়ের কাপ নিয়ে অভ্রর সামনের সোফায় বসল নিধি। অভ্রর একহাতে চায়ের কাপ, অন্য হাতে রিমোট নিয়ে এক এক করে টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছে। গরম চায়ে ফুঁ দিতে দিতে সেদিকে তাকাল নিধি। অভ্র চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“পড়াশোনা কেমন চলছে?”
-“ভালো।”
-“কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
-“না। সমস্যা হলে ক্লাসে টিচারকে জিজ্ঞেস করে নিই।”
-“হুম। ভবিষ্যতে কী হওয়ার ইচ্ছা আছে?”
-“এখনো ঠিক করিনি। এই ব্যাপারে আমি বরাবরই কনফিউজড।”
-“ব্যাপার না। সময় আছে অনেক। পড়াশোনার পাশাপাশি ভাববে এই ব্যাপারে।”
সম্মতি জানিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে টিভির দিকে তাকাতেই বিষম খেল নিধি। টিভির চ্যানেল পাল্টানোর সময় বলিউড মুভির নায়ক-নায়িকার আপত্তিকর দৃশ্য দেখে তার গলায় চা আটকে গিয়েছে। অভ্র নিজেও থতমত খেয়ে গেছে। দ্রুত হাতে চ্যানেল পাল্টাতে গিয়ে টিভিই বন্ধ করে দিল। নিধি খুকখুক করে কেশে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। ভীষণ লজ্জা পেয়েছে সে। অভ্র নিজেও লজ্জা পেয়েছে। এরপরে কেউ আর কোনো কথা বলল না। অস্বস্তি কাজ করছে দু’জনের ভেতরে। চা খেয়ে কাপ টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে অভ্র চুপচাপ চলে গেল সেখান থেকে। নিধি তৎক্ষনাৎ নিজের গালে হাত দিল। গাল গরম হয়ে গেছে তার। তখনকার দৃশ্যটা মনে পড়তেই এবার নিঃশব্দে হেসে উঠল। নিজের চা শেষ করে কাপ দুটো নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here