#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২২
.
সোডিয়াম আলোয় আলোকিত রাস্তা। মোটামুটি নির্জন পরিবেশ। আকাশে থেমে থেমে মেঘের গর্জন ভেসে আসছে। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে নীরদ ও অর্ঘমা। কফিশপ থেকে তারা একা বেরিয়েছে। বাকিরা সবাই যার যার মতো চলে গেছে। নিধি অভ্রর সাথে বাসায় চলে গেছে। মূলত তাদের কিছুটা একান্ত সময় কাটাতে দেওয়ার জন্যই সকলের চলে যাওয়া। দু’জনই বেশ চুপচাপ। একে অপরের ভেতরে চলা অনুভূতি নীরবে অনুভব করার চেষ্টায় আছে দু’জনে। অর্ঘমার হাতের সাথে বারবার নীরদের হাতের ছোঁয়া লাগছে। মৃদু হাসি লেপ্টে আছে তার ঠোঁটে। নীরদ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে ধীর গতিতে অর্ঘমার হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের হাতের আঙুল গুঁজে দিল। চমকে হাতের দিকে একপলক তাকিয়ে নীরদের দিকে তাকাল অর্ঘমা। অপর হাতে কপালের সামনে আসা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে লাজুক হেসে রাস্তার দিকে তাকাল। প্রশ্রয় পেয়ে শক্ত হলো নীরদের হাতের ভাজ। অন্য হাতে মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে আবারও ঠিক করল।
মেঘের গর্জনের পাশাপাশি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। নীরদ আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা দূরে টং দোকান দেখে অর্ঘমার হাত ধরে সেদিকে দৌড় দিল। ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে নিজের জামা ঝেড়ে নিল অর্ঘমা। নীরদ পকেট থেকে রুমাল বের করে কিছু না বলে চুপচাপ অর্ঘমার চুলে লেগে থাকা পানি মুছে দিল। মুগ্ধ চোখে তাকে দেখল অর্ঘমা। নিজের জামাকাপড়ে লেগে থাকা পানি ঝাড়তে ঝাড়তে নীরদ দোকানের ভেতরে তাকিয়ে অর্ঘমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“চা খাবে?”
-“হ্যাঁ, খাওয়া যায়।”
-“বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা খাওয়ার মজাই আলাদা।”
দোকানিকে দু’কাপ চা দিতে বলে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে দাঁড়াতেই কিছু একটা মনে পড়ল নীরদের। পকেট হাতরে আড়চোখে অর্ঘমার দিকে তাকাল। অর্ঘমা তখন গলার স্কার্ফ ঠিক করতে ব্যস্ত।
-“অর্ঘ!”
নীরদের ডাকে থেমে গেল অর্ঘমার হাত। পাশে তাকিয়ে দেখল নীরদ দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
-“কিছু বলবেন?”
প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে অর্ঘমার সামনে এনে হাতের মুঠ খুলল। চেইনের খুব সুন্দর একটা ব্রেসলেট তার হাতে। অর্ঘমা এবার সরাসরি তাকাল নীরদের দিকে।
-“প্রথম বেতন পেয়ে সবার জন্যই কিছু না কিছু নিয়েছিলাম। এটা নিয়েছিলাম তোমার জন্য। কিন্তু দিতে সাহস পাইনি। কারণ এটা আলাদা। তোমার ফ্যামিলি স্বাভাবিকভাবে নিত না এই ব্যাপারটা। আর আসল কথা হলো আগে দিলে তুমিই নিতে না এটা। কিন্তু এখন তো নিতে সমস্যা নেই। আর তোমার বাবা-মা কিছু জিজ্ঞেস করলেও অভ্র ভাই সামলে নিতে পারবে।”
অর্ঘমা কিছু না বলে মৃদু হেসে নিজের হাত এগিয়ে দিল। নীরদের চোখজোড়া খুশিতে চকচক করে উঠল। ব্রেসলেটটা দ্রুত অর্ঘমার হাতে পরিয়ে দিল। ব্রেসলেটটা ভীষণ পছন্দ হলো অর্ঘমার।
-“আমার আসলে মেয়েদের জিনিসপত্রের ব্যাপারে তেমন কোনো আইডিয়া নেই। তাই কী নিব বুঝতে পারছিলাম না। অনেক খোঁজার পর এটা এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল বলে নিয়েছি। তোমার পছন্দ হয়েছে?”
-“খুব পছন্দ হয়েছে। থ্যাংক ইউ।”
ঠোঁট কামড়ে হাসল নীরদ। দোকানদারের ডাকে এগিয়ে গিয়ে চা নিয়ে এসে একটা কাপ অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিল। অর্ঘমা সেটা নিতেই নীরদ পকেট থেকে রুমাল বের করে অর্ঘমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“রুমাল দিয়ে কাপটা পেঁচিয়ে ধরো। তাহলে আর হাতে গরম লাগবে না।”
মুচকি হাসল অর্ঘমা। এতগুলো বছরে এসবে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ছেলেটা বড্ড কেয়ারিং। নুসরাতের কাছে শুনেছে, যে মেয়ে নীরদের লাইফ পার্টনার হবে সে নাকি ভীষণ ভাগ্যবতী হবে। তখন অর্ঘমা মনে মনে হাসত। কারণ ইতোমধ্যে সে নীরদের সকল কেয়ারিং উপভোগ করেছে। নীরদের লাইফ পার্টনার হিসেবে নিজেকে কল্পনা করত প্রায় সময়। আজ সে অফিশিয়ালি নীরদের গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। স্ত্রী হতেও সময় লাগবে না এখন।
নীরদের কথা মতো রুমাল দিয়ে কাপটা পেঁচিয়ে ধরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে চা পান করতে লাগল। এর মধ্যে অভ্রর কল এসেছিল। নীরদ তার সাথে কথা বলে নিয়েছে। বৃষ্টি কিছুটা কমতেই অর্ঘমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে রিকশা খুঁজতে গেল। রিকশা পেতেই দু’জনে রিকশায় উঠল। প্রত্যেকবারের মতো এবারও অর্ঘমা রিকশায় ওঠার পর তার জামা, ওড়না ঠিক করে দিয়ে তারপর রিকশায় উঠল নীরদ। রিকশা চলতে আরম্ভ করলে এবার অর্ঘমা নিজে থেকেই নীরদের হাত ধরল। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল নীরদ। অর্ঘমা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে দেখে মৃদু হাসল। হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে আশেপাশে ভালো করে দেখে নিয়ে অর্ঘমার হাতের উপর চুমু খেল। কেঁপে উঠে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল অর্ঘমা। এবার নীরদ অন্যদিকে তাকাল। অর্ঘমার বিস্ময় ভাব তখনো কাটেনি। রিকশার বেলের শব্দ শুনে বিস্ময়ের ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। লজ্জায় গাল গরম হয়ে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগল। কিন্তু অধর জুড়ে ছেয়ে গেল হাসির রেখা। বিরবির করে বলল,
-“আমিও আপনাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি নীরদ ভাই।”
___
বাসার সকল জিনিসপত্র গোছগাছ করা হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় অল্প কিছু জিনিস বাইরে আছে। চারদিন পর অর্ঘমারা এই বাসা ছেড়ে নিজেদের বাসায় উঠবে। এখান থেকে প্রায় দুই ঘন্টার পথ অতিক্রম করে তাদের বাসায় যেতে হয়। তবে একটা জিনিস ভালো হয়েছে। ভার্সিটি একদম কাছে তাদের বাসা থেকে। দশ মিনিটের মতো লাগে যেতে। এসবের মাঝেও নীরদের জন্য তার মন খারাপ করছে। এখন তো প্রতিদিন দেখা করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কী করবে? তখন তো আর প্রতিদিন দেখা হবে না। আর নীরদের পক্ষেও প্রতিদিন অফিস শেষে ক্লান্ত শরীরে উলটো ঘুরে এসে তার সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। অবশ্য যদি অর্ঘমা বলে তাহলে নীরদ প্রতিদিন অবশ্যই আসবে। কিন্তু এটা ঠিক হবে না ভেবে বলার কথা মাথাতেও আনেনি।
বিকালে অর্ঘমা বেলকনিতে বসে ফোন টিপছিল। বেলের আওয়াজ শুনে রুমের দিকে তাকাতেই দেখল নিধি ইতোমধ্যে রুম ছেড়ে বের হচ্ছে দরজা খোলার জন্য। তাই আর সেদিকে গেল না। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ফোনে ভিডিও দেখতে লাগল। নীরদের সাথে সকালে কথা হয়েছিল। আজ অভ্রর ছুটি থাকায় সে বাসায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ইয়ারফোনে টান লাগায় সামনে তাকিয়ে নিধিকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে?”
-“নীরদ ভাইয়ের বাবা-মা আর বোন এসেছে।”
-“হঠাৎ?”
-“তা তো জানি না। তুই ভাইয়াকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখ।”
নিধির বলতে দেরি অর্ঘমার কল লিস্টে ঢুকতে দেরি হয়নি। নীরদের নাম্বারে কল দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে নিরাশ হতে হলো। কারণ ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো না। পর পর বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পরও হদিস মিলল না নীরদের। বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজেকে কিছুটা পরিপাটি করে বের হলো রুম থেকে। অর্ঘমাদের পারিবারিক ব্যাপারে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে নিধি রুমেই রইল।
ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখল অভ্র আর তার বাবা কথা বলছে নীরদের বাবা-মা আর বোনের সাথে। অর্ঘমা গিয়ে তাদের সালাম দিল। নুসরাত তার পাশে জায়গা করে দিল বসার জন্য। অর্ঘমা মুচকি হেসে নুসরাতের পাশে বসে তার সাথে গল্প করা শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পর সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল নীরদ। তার দু’হাত ভরতি মিষ্টি ও ফল। অভ্রর সাহায্যে সেগুলো টেবিলে রেখে এসে সোফায় বসল সবার সাথে। চোখাচোখি হলো দু’জনার। অর্ঘমা চোখের ইশারায় এসবের মানে জিজ্ঞেস করলে নীরদ কিছু বলল না। শুধু রহস্যময় ভাবে হাসল। পাশ থেকে নুসরাত অর্ঘমাকে ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“তলে তলে তোমাদের কাহিনী এতদূর গড়িয়ে গেল। আর আমরা জানতেও পারলাম না?”
-“কিসের কাহিনী? কিসের কথা বলছ আপু?”
-“তোমার আর আমার ভাইয়ের প্রেম কাহিনীর কথা।”
চোখ বড় বড় করে বিস্ময় নিয়ে তাকাল অর্ঘমা। নুসরাত কীভাবে জানল? অর্ঘমার অবস্থা দেখে নুসরাত হেসে বলল,
-“নীরদ জানিয়েছে কালকে রাতে। বাবা-মা তো তোমার কথা শুনে এক পায়ে রাজি। তবে আমরা সবাই এই ভেবে বিস্মিত হয়েছি যে এতগুলো বছরে আমাদের কারও চোখে পড়েনি বিষয়টা।”
-“কী বলেছেন নীরদ ভাই?”
-“ভাই? তুমি নীরদকে ওর সামনেও ভাই বলে ডাকো নাকি?”
থতমত খেয়ে গেল অর্ঘমা। আমতা আমতা করে বলল,
-“হ্যাঁ, ওই আরকি!”
-“নীরদ তোমায় কিছু বলে না এই নিয়ে?”
-“না। আসলে অভ্যাস হয়ে গেছে।”
-“তোমরা রিলেশনে আছ কবে থেকে? কয় বছর হলো? আগে কে কনফেস করেছে?”
-“রিলেশনে আছি সপ্তাহ তিনেক হলো। কনফেস আগে নীরদ ভাই করেছে।”
-“তুমি রাজি হলে কীভাবে?”
-“আমিও পছন্দ করতাম তাকে। তাই না করার কোনো অপশন ছিল না।”
লাজুক হেসে আড়চোখে নীরদকে একবার দেখে নিল। অভ্রর সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে ছেলেটা। নুসরাত তা খেয়াল করে বলল,
-“ভাই আমার একেবারে ডুবে গেছে প্রেমের সাগরে।”
অর্ঘমার গাল দু’টো লাজে রাঙা হয়ে উঠল।
___
নীরদের বাবা কথা বলার এক পর্যায়ে বললেন,
-“এতক্ষণ তো অনেক কথাবার্তা হলো। তাহলে এখন আসল কথায় আসি।”
অর্ঘমার বাবা সিরিয়াস হয়ে বসলেন। বললেন,
-“জি, বলুন।”
-“নীরদকে তো চিনেনই। অভ্রর সাথে বেশ ভালো খাতির আছে ওর। আমার ছেলে বলে বলছি না। নীরদ আসলেই ছেলে হিসেবে খুব ভালো।”
-“হ্যাঁ, আমরাও জানি ও খুব ভালো ছেলে। তাই তো অল্প সময়ে আমাদের এত প্রিয় হয়ে উঠেছে।”
-“নীরদের জীবনসঙ্গী যে হবে তাকে সে মাথায় তুলে রাখবে।”
-“যে মেয়ে আপনার ছেলের বউ হবে, সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী।”
-“বলছেন?”
-“জি।”
-“আপনার কী মনে হয়, যেকোন মেয়ে চাইলেই পাবো আমার ছেলের জন্য?”
-“যদি মেয়ের পরিবার বিচক্ষণ হয়, খাঁটি হীরে চিনতে পারে তাহলে অবশ্যই রাজি হবে।”
ছেলের দিকে তাকিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে হাসলেন নীরদের বাবা। নীরদও মৃদু হাসল। নীরদের বাবা অর্ঘমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তাহলে আপনার মেয়েটাকে আমাদের দিয়ে দিন।”
-“জি!”
বিস্ময় সুরে প্রশ্ন করলেন। নীরদের বাবা সহাস্যে হেসে বললেন,
-“আমরা নীরদের জীবনসঙ্গী হিসেবে আপনার মেয়েকে চাই। অর্ঘমার মতো লক্ষ্মী আর আদুরে মেয়ে থাকতে আমরা আর অন্য কোনো মেয়েকে দেখতে চাচ্ছি না। আমাদের অর্ঘমাকে পছন্দ। তাছাড়া নীরদ, অর্ঘমাও একে অপরকে পছন্দ করে।”
অভ্রর বাবা নিজেকে স্বাভাবিক করে একবার নীরদের দিকে তাকিয়ে পরে অর্ঘমার দিকে তাকালেন।
চলবে…
নোটঃ খুব শীঘ্রই গল্পটা শেষ হতে চলেছে।