#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৯
.
অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো তখন সময়টা সন্ধ্যা। ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলেমেয়ে বের হচ্ছে কলেজ থেকে। মাঠ ভরতি গিজগিজ করছে ছাত্র-ছাত্রীদের বৈঠক। অর্ঘমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এটা ঢাকার নিউমার্কেট। আর সে নিউমার্কেটের ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। নিধির হাত ধরে একপাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফোন বের করে নীরদকে কল দিল। একবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। অর্ঘমার মনে হলো নীরদ এতক্ষণ তার কলের জন্যই অপেক্ষা করে ফোন হাতে নিয়ে বসেছিল। নীরদকে কলেজে আসতে বলে কল কেটে দিল। নিধি বলল,
-“শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে কী করব? তার চেয়ে চল কলেজটা একটু ঘুরে দেখি।”
-“আর কী দেখবি? সবই তো দেখা শেষ।”
-“হাঁটাহাঁটি করতে তো আর সমস্যা নেই।”
-“এই ভীড়ের মাঝে? ভাই, তোর এত কারেন্ট থাকলে তুই একাই হাঁট। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এত ভীড়ে। ভীড়টা একটু কমলে বাঁচি আমি।”
-“তাহলে চল, ওপাশের বট গাছটার নিচে গিয়ে বসি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে ওখানে গিয়ে বসা ভালো।”
-“হ্যাঁ, এটা করা যায়।”
বট গাছটা একদম কলেজের গেইটের সামনে। সেখানে বসলে এক হিসেবে সুবিধা হবে। নীরদ আসলেই তাদের দেখতে পাবে। হাঁটতে হাঁটতে বট গাছের সামনে আসতেই দেখতে পেল সেখানে ভার্সিটির একটা দল জায়গা দখল করে বসে আছে। তাই আর সামনে এগিয়ে গেল না। নিধির হাত ধরে উল্টো ঘুরে ভেতরে যেতে গেলে পেছন থেকে কেউ একজন ডাকল। তবে তাদেরই ডাকল কিনা বোঝা গেল না। কারণ নাম ধরে ডাকেনি। অবশ্য নাম জানারও কথা না। তবুও পেছন ঘুরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করল না অর্ঘমা বা নিধি। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে পেছন থেকে সামনে এসে দাঁড়াল দু’জন ছেলে। অর্ঘমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে একটা ছেলে বলল,
-“তোমাদের ডাকা হলো উত্তর নিলে না কেন?”
-“আমাদের ডাকা হয়েছে বুঝতে পারিনি। আসলে এখানে তো অনেকেই আছে। তাছাড়া আপনারা নাম ধরে ডাকেননি তাই বুঝিনি।”
-“ওখানে চলো।”
-“কেন?”
-“সিনিয়ররা ডাকছে তাই।”
কথা বাড়াল না অর্ঘমা। তবে ভেতরে ভেতরে সে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। এরা আবার কেন ডাকছে? নীরদ কখন আসবে কে জানে। নিধির সাথে আবারও বট গাছের সামনে ফিরে গেল অর্ঘমা। সাথে আছে সেই দু’জন ছেলে। গাছের নিচে প্রায় দশ-বারোজন ছেলে-মেয়েদের একটা দল বসে আছে। সেখানে গিয়ে অর্ঘমা ভেতরে ভেতরে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও তা মুখে প্রকাশ করল না। স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করল,
-“ডেকেছিলেন আমাদের?”
-“হ্যাঁ। কলেজে নতুন?”
-“জি।”
-“নাম কী?”
-“অর্ঘমা।”
-“পাশের জনের?”
নিধি মিনমিন করে বলল,
-“নিধি।”
-“কী?”
আওয়াজটা এতটাই আস্তে ছিল যে নিধি নিজে শুনতে পেয়েছে কিনা সন্দেহ। নিধিটা প্রচন্ড ভীতু স্বভাবের। তাকে দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সে ভয়ে অর্ধেক মরে গেছে ইতোমধ্যে। অর্ঘমা এত বিরক্ত হলো যা বলার মতো না। নিধির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে একপলক তাকিয়ে আবারও সামনে তাকাল। সিনিয়রদের উদ্দেশ্যে বলল,
-“ওর নাম নিধি।”
-“ওর গলায় কী আওয়াজ নেই?”
-“আছে, কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করে।”
সিনিয়র এক মেয়ে কিছু একটা বলছিল কিন্তু সেটা কানে গেল না অর্ঘমার। তার দৃষ্টি ভার্সিটির গেইটের দিকে। অভ্র আর নীরদ ঢুকছে একসাথে। হাসি ফুটে উঠল অর্ঘমার মুখে। তার ভেতরে থাকা ভয়টা আর কাজ করছে না। অভ্র তার দিকে তাকিয়েই হাসল। অর্ঘমার হাসি আরও বিস্তৃত হলো। সে সিনিয়রদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমাদের অভিভাবক এসে গিয়েছে।”
কথাটা বলেই অর্ঘমা একগাল হেসে অভ্র আর নীরদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
-“ভাইয়া তুমি! আজ এত তাড়াতাড়ি?”
-“কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গিয়েছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে নীরদকে কল করে জানলাম তুই কলেজে। আর নীরদও এখানেই আছে। তাই সোজা এখানে চলে এলাম।”
-“ভালোই হয়েছে। চলো সবাই মিলে ফুচকা খেয়ে আসি। সাথে আইসক্রিম।”
-“চল।”
অভ্র যেতে গিয়েও আবার পেছন ফিরে তাকাল। রিয়ার কয়েকজন বন্ধুদের এখানে দেখে বেশ অবাক হলো। তারা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অভ্র একবার ভাবল কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে ওরা এখানে কী করছে। পরক্ষণেই নিজের ভাবনা বদলে ফেলল। দরকার কী শুধু শুধু যেচে পড়ে কথা বলার। ওদের যা মন চায় করুক। তার কী? অর্ঘমার ডাকে হুঁশ ফিরল অভ্রর।
-“ভাইয়া! কোথায় হারালে?”
-“হুঁ! না, কোথাও না। চল।”
কলেজ থেকে বের হতে হতে অর্ঘমা মনে মনে বলল, ‘ভাগ্যিস ভাইয়ারা তাড়াতাড়ি চলে এসেছিল। নয়তো এই সিনিয়ররা যে আরও কী কী প্রশ্ন করত কে জানে?’
___
ফুচকা খাওয়ার মাঝে অভ্রর কল আসায় উঠে গেল সে। কথা বলার একফাঁকে অর্ঘমাদের দিকে তাকাল। অর্ঘমা আর নীরদ কথা বলার পাশাপাশি ফুচকা খাচ্ছে। পাশেই নিধি বসে আছে। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলছে সে। তার দৃষ্টি সামনে কি যেন দেখছে। অভ্র চোখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল। বছর সাতেকের এক মেয়েকে নিয়ে তার বাবা-মা এসেছে ফুচকা খেতে। বাচ্চা মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। একবার বাবার কোলে চড়ছে তো আরেকবার মায়ের কোলে চড়ছে। বাবা-মা দু’জনই প্রচন্ড ভালোবাসেন মেয়েটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অভ্র বুঝতে পারল নিধির মনের অবস্থাটা। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই। কল কেটে সবার সাথে গিয়ে বসল।
-“আরও এক প্লেট ফুচকা খাব আমি। এমন সুযোগ রোজ রোজ আসে নাকি?”
-“পরে পেট ব্যথা করবে অর্ঘ। আর খাওয়ার দরকার নেই।”
-“ভাইয়া প্লিজ, আর এক প্লেট খাব।”
অর্ঘমা ঠোঁট উল্টে তাকাতেই অভ্র, নীরদ দু’জনেই রাজি হয়ে গেল। অর্ঘমা হাসল। সে ভালো মতোই জানে কীভাবে এই দু’জনকে মানানো যায়। অভ্র নিধির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“তোমার জন্যও অর্ডার করি আরেক প্লেট?”
-“আমি আর খাব না।”
-“কেন?”
-“আমার একটুতেই পেট ব্যথা করে। বেশি খেলে অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়।”
মিথ্যে কথাটা বলে অর্ঘমার দিকে আড়চোখে তাকাল নিধি। অর্ঘমা বুঝল ব্যাপারটা। গতকাল থেকে নিধির পিরিয়ড শুরু হয়েছে। এই সময়ে বাইরের খাবার নিধির পেটে সয় না। তবুও আজ খেয়েছে। সবার সাথে এসেছে। কিছু না খেলে তো অভ্র আর নীরদ তাকে প্রশ্ন করে মেরে ফেলবে। রাগও করতে পারে। এই ভেবে খেয়েছে। এর বেশি খাওয়া তার পক্ষে আসলেও সম্ভব না। নীরদ এক প্লেট ফুচকার অর্ডার দিতে উঠে গেল।
অভ্র তাকাল নিধির দিকে। নিধি এখনো সেই ছোট্ট পরিবারের দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্র একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল নিধির গায়ে তার দেওয়া জামাটা। খুশি হলো এই ভেবে যে জামাটা নিধির পছন্দ হয়েছে। সে খুঁটিয়ে দেখল নিধিকে। অতি সাধারণ একটা মেয়ে। প্রথম যখন তাদের বাসায় আসলো তখন দেখতে এক রকম ছিল, এখন দেখতে আরেক রকম হয়েছে। তখনকার চেহারা ছিল ভেঙে যাওয়া ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। কাজের চাপে আর মার খেয়ে চেহারায় ভর করেছিল মলিনতা। কিন্তু এখন নিধির চেহারার লাবণ্য যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। একটু আদর-যত্ন মেয়েটাকে যেন একদম পালটে দিয়েছে। দেখে মোটামুটি পছন্দ হওয়ার মতো মেয়ে। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা কত প্রাণোচ্ছল থাকে। কিন্তু নিধির উচ্ছলতা সব ভাঁটা পড়ে গিয়েছে বাবা আর সৎ মায়ের অত্যাচারে। নীরদের ডাকে হুঁশ ফিরল অভ্রর। নিধির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নীরদের দিকে তাকাল। এরপরের পুরোটা সময় অভ্র একটু পর পর আড়চোখে নিধিকে দেখে গেল। এই বয়সটা হৈচৈ করে কাটানোর বয়স। সেখানে নিধিকে এত চুপচাপ দেখে কেন যেন মানাচ্ছে না বলে মনে হলো অভ্রর।
___
সময়টা গ্রীষ্মকাল। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে প্রচণ্ড দহনজ্বালা। মনে হচ্ছে যেন সূর্য মাথার উপরে অগ্নিরশ্মি ঢালছে। হাওয়ায় ভেসে আসছে আগুনের হলকা তাপ। চারদিকে নিস্তব্ধ নিঝুম ভাব। অর্ঘমা কপালের ঘাম মুছে আবারও রাস্তার দিকে তাকাল। জনমানবহীন শূন্য রাস্তা। কলেজ ছুটি হয়েছে আধঘন্টার কিছু সময় বেশি হয়েছে। সবাই যে যার মতো চলে গেছে। বাকি আছে শুধু সে আর নিধি। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মন। আজকে তাদের ক্লাস টেস্ট ছিল। অর্ঘমার টেস্ট তেমন একটা ভালো হয়নি। মন মেজাজ এমনিতেই খারাপ। আর এখন তো রাগে মাথার ভেতরটা দপদপ করে জ্বলছে। এমন ফাজলামোর কোনো মানে হয়? এই গরমে আধঘন্টার বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা কম কথা নয়। যেকোন সময় সে সানস্ট্রোক করতে পারে। হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে নিধিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না আমার পক্ষে। আমার সাথে গেলে চল। নাহলে দাঁড়িয়ে থাক তোর নীরদ ভাইয়ের জন্য।”
কথা শেষ করে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না অর্ঘমা। হনহন করে হাঁটা শুরু করল। নিধি কী করবে বুঝতে না পেরে একবার অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে আবার রাস্তার দিকে তাকাল। তারপর কোনো কিছু না ভেবেই দৌড় লাগাল অর্ঘমার পেছনে।
হাঁটতে হাঁটতেই অর্ঘমার মাথায় এলো একটু আগের ঘটনা। কলেজ ছুটির পর অর্ঘমা নিধির ব্যাগ নিয়ে করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নিধি ওয়াশরুমে গিয়েছে। ফ্লোর পুরোটা খালি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এমন সময় ছেলেমেয়েদের হাসাহাসির শব্দ শুনে পেছনে সিঁড়ির দিকে তাকাল। কলেজ বিল্ডিং আর ভার্সিটি বিল্ডিং একসাথে জয়েন্ট করা। তাই খুব সহজে ভার্সিটির স্টুডেন্টরা কলেজ বিল্ডিংয়ে আর কলেজের স্টুডেন্টরা ভার্সিটি বিল্ডিংয়ে যাতায়াত করতে পারে। সিঁড়িতে সেদিনের সিনিয়রদের দেখে অর্ঘমা সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে নিল। অর্ঘমার কেন যেন এদের চাহনি একদমই ভালো লাগে না। ছেলেগুলো কেমন করে যেন তাকায়। গা ঘিনঘিন করে উঠে অর্ঘমার। আর মেয়েগুলো তো কলেজ শুরুর প্রথম দিন থেকেই কেমন যেন খোঁচা মেরে মেরে কথা বলে। অর্ঘমা বুঝে না এদের সমস্যা কী? ভার্সিটি লেভেলের ছাত্র-ছাত্রীরা ইন্টারের এক ছাত্রীর পেছনে এভাবে হাত ধুয়ে কেন পড়ে আছে ভেবে পায় না অর্ঘমা। ছেলেমেয়েগুলো হয়তো তাকে দেখে ফেলেছিল তাই সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিজেদের মাঝে কথা বলে জোরে জোরে হাসাহাসি করছিল। এক পর্যায়ে কথার ধরন এমন নিম্নপর্যায়ে পৌঁছাল যে কান গরম হয়ে উঠল অর্ঘমার। এত বিশ্রী ভাষা এদের? বুঝতে বাকি থাকে না যে কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে। নিধি আসতেই এক মুহূর্ত সময়ও ব্যয় না করে নিধির হাত ধরে দ্রুত পা চালিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। নিধি কিছুই বুঝেনি অর্ঘমার এমন ব্যবহারের মানে। জিজ্ঞেস করলেও অর্ঘমা কোনো জবাব দেয়নি।
সারা রাস্তা অর্ঘমা এটা ভাবতে ভাবতেই এলো যে এই ছেলেমেয়ে গুলোর সাথে তার কীসের শত্রুতা? শত্রুতার কথা তো পরে আসছে, অর্ঘমা তো এদের চেনেই না। আর এত বিশ্রী ভাষা এদের মুখে এলোই বা কীভাবে একটা মেয়ের ক্ষেত্রে? ছিঃ! অর্ঘমার অন্যমনস্ক ভাব লক্ষ্য করেছে নিধি। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। জানে লাভ নেই। নিজে থেকে কিছু না বললে নিধি হাজার চেষ্টা করলেও কিছু জানতে পারবে না। মাঝরাস্তায় নীরদকে দেখা গেল। সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছিল। হয়তো কলেজেই যাচ্ছিল তাদের আনতে। কিন্তু তাদের রাস্তায় দেখে দাঁড়িয়ে গেল। অর্ঘমা তখনও অন্যমনস্ক। প্রথমত তার টেস্ট ভালো হয়নি। দ্বিতীয়ত সিনিয়রদের বাজে ভাষা। এসবই ভাবতে ভাবতে তার ধ্যান আশপাশ থেকে সরে গেছে।
অর্ঘমা যখন নীরদকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল তখন নীরদের মুখটা হা হয়ে গেল। সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিল। ভাবল হয়তো দেরি করার জন্য অর্ঘমা রাগ করেছে। তাই সে সামনে এগিয়ে যেতে গেলেই পেছন থেকে নিধির ডাক শুনে থেমে গেল।
-“আজ এত দেরি হলো কেন ভাইয়া?”
-“আমি ভার্সিটি গিয়েছিলাম প্রজেক্ট জমা দিতে। তাই আসতে দেরি হয়ে গিয়েছে।”
-“ওহ আচ্ছা।”
-“অর্ঘমা নিশ্চয়ই রাগ করেছে?”
-“রাগ করেছে এটা জানি। কিন্তু কেন রাগ করেছে সেটা বুঝতে পারছি না। আসলে আমি ছুটির পর একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। ও বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আমার হাত ধরে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল। তখন থেকেই ওর মুখটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আমি বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘কী হয়েছে?’ কিন্তু কিছুই বলল না।”
নীরদ কিছু না বলে অর্ঘমার দিকে তাকাল। মেয়েটার মন খারাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। নীরদ চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে অর্ঘমার পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।
বাসার সামনে পৌঁছাতেই অর্ঘমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশে তাকাল। নিধিকে এই পাশে না দেখে অপর পাশে তাকাতেই নীরদকে দেখে চমকে উঠল। পেছন থেকে নিধি এসে হেসে টাটা দিয়ে উপরে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে অর্ঘমা প্রশ্ন করল,
-“আপনি কখন থেকে আছেন আমার পাশে?”
-“অনেকক্ষণ; তুমি কলেজ থেকে বের হওয়ার পর পরই আমি এসেছি।”
-“ওহ!”
অর্ঘমা চলে যেতে গেলে নীরদ তার হাত ধরে ফেলল। ভড়কাল অর্ঘমা। পেছন ঘুরে তাকাতেই নীরদ জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে তোমার? এমন অন্যমনস্ক হয়ে আছ কেন? এত কী ভাবছিলে যে আশেপাশের কোনো দিকে তোমার ধ্যানই ছিল না?”
-“কিছু হয়নি। এমনি একটু ক্লান্ত তাই।”
-“মিথ্যে কেন বলছ? আমি এতদিনে তোমাকে ভালো মতোই চিনেছি অর্ঘ। কিছু না হলে তুমি এমন করার মেয়ে না।”
-“আমি শুধু ক্লান্ত, তাই হয়তো এমন লাগছে।”
নীরদ কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইল অর্ঘমার দিকে। অর্ঘমা মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীরদ বলল,
-“ঠিক আছে, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। আর যদি কখনো কথাটা শেয়ার করতে মন চায় তবে ডেকে নিয়ো আমায়।”
নীরদ চলে যেতে গিয়েও দাঁড়াল। কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
-“আর কখনো একা একা বের হবে না কলেজ থেকে। এরপর থেকে আর কখনো তোমায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমি তাড়াতাড়ি না আসতে পারলে ভাইয়াকে বলে দিব। তার বন্ধু তোমাকে নিয়ে আসবে।”
চলে গেল নীরদ। ছেলেটা মন খারাপ করেছে বুঝতে পারছে অর্ঘমা। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে পা চালিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে গেল। শুধু শুধু এসব বলে নীরদকে রাগিয়ে দেওয়ার মানে হয় না। পরে কলেজে গিয়ে যদি ওই ছেলেমেয়েদের সাথে ঝামেলা করে তখন! ছেলেমেয়ে গুলো গোল্লায় যাক। যদি ঝামেলার মাঝে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায় আর যদি নীরদ ব্যথা পায়! এই ভেবেই সে বলেনি কথাটা।
চলবে…।
#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_২০
.
থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে অভ্র। তার পাশে রয়েছে নীরদ আর অর্ঘমা। অপর পাশের বেঞ্চের এক কোণায় দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে নিধি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে কাঁদছে। অভ্রর মাথায় বর্তমানে আশেপাশের কিছুই ঢুকছে না। তার মাথাটা ভনভন করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখ তুলে এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছুটা সামনেই একটা দোকান দেখতে পেল। এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে এক প্রকার দৌড়েই গেল সেদিকে। পেছন থেকে অর্ঘমা, নীরদ হতভম্ব হয়ে দেখল। পরক্ষণেই নীরদও ছুটল অভ্রর পেছনে।
অভ্র দোকান থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি কিনে কিছুটা আগে গলায় ঢেলে তৃষ্ণা মিটিয়ে নিল। বাকিটা মাথায় ঢালল আর চোখে-মুখে ছিটাল। পানি পড়ে শার্ট ভিজে একাকার অবস্থা। প্যান্টেও পানি লেগেছে কিছুটা। চোখ বন্ধ করে মাথার চুল ধরে টানতে লাগল। কাঁধে কেউ হাত রাখতেই চোখ মেলল। নীরদকে দেখে পেছন ঘুরে তাকাল। অর্ঘমা আর নিধিকে দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে এসব বাস্তব, কোনো কল্পনা নয়। একটু আগে যা ঘটেছে তা আসলেও সত্যি। নীরদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল অভ্র।
-“পাশের ক্যাফেতে চলো। একটু বসা দরকার সবার। মাথা ঠান্ডা করে কথা বলা উচিত।”
-“বলার আর কিছু বাকি আছে?”
অভ্রর কণ্ঠে বিষাদ স্পষ্ট। নীরদ তাকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারল না। তাকে ধরে পাশের ক্যাফের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। যাওয়ার আগে অর্ঘমাকে ইশারা করে বলল নিধিকে নিয়ে আসতে।
টেবিলে বসে কিছু একটা বলার জন্য উশখুশ করছিল অর্ঘমা। অভ্রর দিকে তাকিয়ে দেখে সে চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত দিয়ে রেখেছে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-“আ’ম স্যরি ভাইয়া।”
-“স্যরি বললে সব ঠিক হয়ে যাবে?”
অর্ঘমা চুপ হয়ে গেল।
-“কেন করলি এটা?”
-“নিধির ভবিষ্যৎ সিকিউর করার জন্য বিয়েটার খুব দরকার ছিল।”
-“তুই শুধু তোর বান্ধবীর কথাটাই ভাবলি। আমার কথা ভেবেছিস একবারও?”
-“ভেবেছি। অনেক চিন্তাভাবনা করেই এই কাজটা করেছি আমি। এতে ভবিষ্যতে তুমিও ভালো থাকবে আর নিধিও ভালো থাকবে।”
অভ্র রাগে টেবিলে জোরে ঘুষি মারল। আশেপাশের সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে। ব্যাপারটা খেয়াল করে নীরদ বলল,
-“আশেপাশের সবাই দেখছে। প্লিজ কোনো সিন ক্রিয়েট করো না বাইরের মানুষের সামনে।”
অভ্র তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আরে সিন ক্রিয়েট তো আমার জীবনের সাথে হয়ে গেল।”
অর্ঘমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“তোর কাছ থেকে এটা কখনোই আশা করিনি আমি। তুই আজকে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছিস। আমি তোকে কক্ষনো ক্ষমা করব না এর জন্য।”
হনহন করে চলে গেল অভ্র। অর্ঘমার চোখে ততক্ষণে জল জমে গিয়েছে। অভ্র এর আগে কখনো তার সাথে এতটা রুড বিহেভ করেনি। অভ্র যেতেই নিধিও উঠে দাঁড়াল। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-“এবার শান্তি পেয়েছিস তুই? আমার জীবনের পাশাপাশি নিজের ভাইয়ের জীবন নিয়েও জুয়া খেলে ফেললি। এর পরিণাম কী হবে বা কী হতে পারে তা জানা স্বত্বেও তুই এই কাজটা করলি। এর জন্য তোকে আমি কখনো মাফ করব না অর্ঘ।”
নিধিও চলে গেল। এবার কেঁদেই ফেলল অর্ঘমা। নীরদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-“খামোখা দুটো জীবনকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিলে। এর পরিণাম কী হবে ভেবেছ? তোমার বাবা-মা কেমন রিয়্যাক্ট করবে ভেবেছ একবারও? যদি তারা মেনে না নেয় তাহলে নিধির জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। রাগের মাথায় হুঁশ হারিয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে ওদের দু’জনের উপর। অথচ ওদের কথাটা একবারও ভাবলে না। তোমার জেদটা তোমার কাছে বড় হয়ে গেল?”
অর্ঘমা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকাল। তার কান্না থেমে গেছে। নীরদ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দু’হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে অর্ঘমা বলল,
-“এত বড় একটা সিদ্ধান্ত আমি কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়া নিব ভাবলেন কী করে আপনি? আমার আপন ভাই হয় অভ্র। আমি ওর জন্য যা করব তা অবশ্যই ভেবে চিন্তেই করব। ঠিক তেমনই নিধি আমার বেস্টফ্রেন্ড। আমার বোনের মতোই। ওর জন্যও যা করব ভেবে চিন্তেই করব। নিধি আর ভাইয়ার ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই আমি তাদের একে অপরের জীবনের সাথে জুড়ে দিয়েছি। ওদের ভালোর জন্যই করেছি। আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া আর নিধি আমার সিদ্ধান্তে কিছু সময়ের জন্য কষ্ট পেলেও অন্তত আপনি আমায় বুঝবেন। কিন্তু ভাবিনি আপনিও আমাকে ভুল বুঝবেন।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অর্ঘমা। তার ভেতর থেকে স্পষ্ট ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে। কান্না আটকানোর যে খুব করে চেষ্টা করছে তা বুঝাই যাচ্ছে।
-“নিজের জেদ আমি নিজের উপরেই দেখাই। আমার জেদের জন্য অন্য কারও ক্ষতি আমি ভুল করেও করি না। আর কখনো করবও না।”
অর্ঘমা চলে যেতে গেলে তার হাত ধরে ফেলল নীরদ। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অর্ঘমা হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।
___
ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠল অর্ঘমা। তার সারা শরীর দরদর করে ঘামছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মৃদু কাঁপছে তার শরীর। বালিশের পাশ হাতড়ে ফোন খুঁজে টর্চ জ্বালাল। পাশের টেবিলেই পানির বোতল রাখা। বোতলটা তাড়াতাড়ি নিয়ে অর্ধেক বোতল পানি এক নিমিষেই শেষ করে ফেলল। স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লাগল তার। কী ধরনের স্বপ্ন ছিল এটা? নিধির কথা মাথায় আসতেই তৎক্ষনাৎ বিছানার অপর পাশে তাকাল। নিধি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল অর্ঘমা। আজকাল সে অভ্র আর নিধিকে নিয়ে বেশি ভাবছে। হয়তো এই স্বপ্নটা সেই জন্যই দেখা। পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে একা পেলেই অভ্র আর নিধিকে জড়িয়ে কথা বলা শুরু করে দেয়। তার মন বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। অর্ঘমা এসবে কান দেয় না। কিন্তু তার মাথায় একটা ভাবনা এসেছে। রিয়া নেই অভ্রর জীবনে। নিধির জীবনেও কেউ নেই। বেচারি একদম একা। তার একটা ভরসাযোগ্য আশ্রয়স্থল দরকার। দরকার একজন নিজের মানুষের। যার সাথে দিন শেষে মনের সকল কথা শেয়ার করতে পারবে। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে পারবে। নির্দ্বিধায় সবরকম আবদার করতে পারবে। সেই মানুষটা তো অভ্র হতেই পারে। বেশ কিছুদিন ধরে সে এই কথা ভাবছে যার কারণে আজকে এমন একটা স্বপ্ন দেখা। তা-ও এমন একটা স্বপ্ন দেখল, যেখানে কিনা তাকে সবাই ভুল বুঝল? অভ্র, নিধি এমন কি নীরদ পর্যন্ত তাকে ভুল বুঝে বসে আছে স্বপ্নে। অর্ঘমা তৎক্ষনাৎ ভেবে ফেলল এমন কিছুই সে করবে না। যার ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবে। খামোখা সবার কাছে বিনা দোষে দোষী সে হতে পারবে না। এর চেয়ে যেভাবে যা চলছে চলুক। টর্চ অফ করে আবারও শুয়ে পড়ল অর্ঘমা।
___
সময় যেন চোখের পলকে চলে যায়। মনে হচ্ছে এইত সেদিন এই বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া হিসেবে আসলো অর্ঘমারা। অথচ চলতি মাসে পুরোপুরি সাড়ে চার বছর হতে চলল তারা এসেছে। অর্ঘমা আর নিধি বর্তমানে ভার্সিটিতে পড়ছে। নীরদ গত মাসেই চাকরিতে যোগদান করেছে। পাশাপাশি মাস্টার্সেও ভর্তি হয়েছে।
নীরদের সাথে অর্ঘমার সম্পর্কটা এখনো আগের মতোই আছে। শুধু আগের মতো আছে বললে ভুল হবে। তাদের সম্পর্কটা আরও মজবুত আর গাঢ় হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কেউ কাউকে একে অপরের মনের কথা বলেনি। এতে অবশ্য সমস্যা হচ্ছে না কারও। মুখে না বলেও একে অপরের মনের খবর বুঝে নিচ্ছে তারা প্রতিনিয়ত। সময় পেলেই একে অপরের সাথে ঘুরাঘুরি করা, আড্ডা দেওয়া, ঝগড়া করা সবই হচ্ছে।
অভ্র এখনো আগের গতিতেই থেমে আছে। অফিস, বাসা, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা নিয়েই বেশ আছে সে। রিয়া অনেকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল এর মাঝে। অভ্র তাকে কোনো প্রকার সুযোগ দেয় নি। কারণ রিয়া এর মাঝে অনেকগুলো ভুল করেছে। অভ্রকে না পেয়ে অর্ঘমার ওপর রেগে নিজের বন্ধুবান্ধব, যারা অর্ঘমার কলেজেই পড়ত তাদের দ্বারা বহুবার অর্ঘমাকে বিভিন্ন ভাবে অপদস্ত করার চেষ্টা করেছে। এমন কি নিজে গিয়েও একবার হুমকি দিয়ে এসেছিল। ফলস্বরূপ অর্ঘমার কাছ থেকে সব শুনে অভ্র নিজে রিয়ার সাথে দেখা করে তাকে দুটো থাপ্পড় সমেত হুমকি ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিল। কলেজে গিয়ে রিয়ার বন্ধুবান্ধবদেরও শাসিয়ে এসেছিল। এরপর থেকে না রিয়াকে দেখা গেছে অর্ঘমার কলেজের আশেপাশে আর না রিয়ার বন্ধুবান্ধবদের দেখা গেছে অর্ঘমার আশেপাশে।
নিধি শুধুমাত্র নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবারের লোকগুলোর উপরে নিধি কৃতজ্ঞ। তার কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। হাজারো কটু কথা, অপমানসূচক কথা শোনার পরও এই পরিবারের লোকগুলো তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। বিশেষ করে অভ্র আর অর্ঘমা তাকে সব কিছুতে খুব সাপোর্ট দিয়েছে। এরা দু’জন একবারের জন্যও তাকে এটা ভাবতে দেয়নি যে সে একজন বাইরের মানুষ। সব সময় তাকে এই পরিবারের একজন সদস্য মনে করেই ট্রিট করেছে। এত ভালো মানুষও যে হয় তা অভ্র আর অর্ঘমাকে না দেখলে নিধি জানতই না। এমন কি নীরদ পর্যন্ত তাকে যথেষ্ট স্নেহ করে। শুধু অর্ঘমার মা একটু ব্যতিক্রম এই যা।
___
অফিস শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরেই অবাক হয়ে গেল নীরদ। তাদের বসার ঘরে অর্ঘমার বাবা বসে আছে। নীরদের বাবা-মায়ের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে। অর্ঘমার বাবা এর আগে কখনো আসেনি তাদের বাসায়। আজ হঠাৎ দেখে নীরদ কিছুটা বিস্মিতই হয়েছে। অর্ঘমার বাবাকে সালাম দিয়ে টুকটাক কুশলাদি বিনিময় করে নিজের রুমের দিকে যেতে গেলে নুসরাতের রুম থেকে পরিচিত গলার আওয়াজ শুনে সেদিকে গেল। রুমের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল অর্ঘমা আর নুসরাত গল্প করছে। দু’জনকেই ভীষণ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। নীরদ হালকা করে কাশল। নুসরাত, অর্ঘমা দু’জনেই তাকাল সেদিকে। নুসরাত হেসে বলল,
-“চলে এসেছিস? আজকে দিন কেমন কাটল অফিসে?”
-“ভালো। তুই আজ এত তাড়াতাড়ি বাসায় যে?”
লাজুক হাসল নুসরাত। নীরদের হাত ধরে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে আসলো। বোনের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারল না নীরদ। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“লজ্জা পাওয়ার মতো কী বললাম?”
-“একটা খবর আছে।”
-“তোর জামাই তোর জন্য সতীন নিয়ে এসেছে?”
নুসরাত রেগে কান মলে দিল ভাইয়ের। নীরদ হাসতে লাগল কানে হাত দিয়ে। নাক ফুলিয়ে নুসরাত বলল,
-“ভালো মুডে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম তোকে। তুই তা হতে দিলি কই? গরু একটা! তুই মামা হবি।”
কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নীরদ বিস্ময় নিয়ে বলল,
-“মিষ্টি ছাড়া এমন সংবাদ দিতে তোর লজ্জা করল না? নাকি এজন্যই লজ্জা পাচ্ছিলি?”
-“এই গরু, তুই বের হ আমার রুম থেকে। তোকে জানানোই উচিত হয়নি।”
অর্ঘমা নিঃশব্দে হাসছে দুই ভাইবোনের খুনসুটি দেখে। নীরদ হাসতে হাসতে বোনের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-“আলহামদুলিল্লাহ্। আমি অনেক খুশি হয়েছি।”
নুসরাতও হেসে তার ভাইয়ের চুলগুলো এলোমেলো করে দিল। নীরদ তার রুমে চলে গেল ফ্রেস হতে। মিনিট দশেক পর ফিরে এলো হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে। সেটা নুসরাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“চাকরির প্রথম স্যালারি পেয়েছি গতকাল। এটা তোর জন্য নিয়েছিলাম। কাল তো বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে অনেক রাত করে বাসায় ফিরেছিলাম। তাই দিতে পারিনি। এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। মামা হওয়ার উপলক্ষে এটা তোর।”
-“কী এটা?”
-“খুলে দেখ।”
নুসরাত তৎক্ষনাৎ ব্যাগটা খুলল। শাড়ি দেখেই খুশিতে ঝলমল করে উঠল তার চেহারা। শত হোক একমাত্র ভাইয়ের প্রথম উপার্জনের টাকায় কেনা তার এই শাড়ি। পছন্দ না হয়ে যাবে কই?
-“ভীষণ পছন্দ হয়েছে ভাই। দেখো অর্ঘমা, শাড়িটা সুন্দর না?”
-“হ্যাঁ আপু। খুব সুন্দর। তোমায় খুব মানাবে এটা পরলে।”
নুসরাত ব্যস্ত হয়ে পড়ল শাড়ি নিয়ে। আয়নার সামনে গিয়ে শাড়িটা গায়ে রেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল নিজেকে।
নীরদ হেসে বোনের থেকে চোখ ফিরিয়ে অর্ঘমার দিকে তাকাল। অর্ঘমাও তাকাল তার দিকে। তাদের ভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্ন ছিল। তখনই কল এলো নুসরাতের হাজবেন্ডের। নুসরাত ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। নীরদ পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ভ্রু কুঁচকে ইশারা করল অর্ঘমাকে। গলার স্বর খাদে নামিয়ে অর্ঘমা জিনিস করল,
-“কী?”
-“তোমার বাবা হঠাৎ এখানে আসলেন যে?”
কথাটা শুনেই অর্ঘমার মুখ মলিন হয়ে গেল। তা খেয়াল করে নীরদ বলল,
-“কিছু হয়েছে?”
-“আগামী মাসে আমরা বাসা ছাড়ছি।”
বিস্ময়ে কপাল কুঁচকে গেল নীরদের। সে বলল,
-“আমি মনে হয় কানে কম শুনছি। কী বললে তুমি?”
-“ঠিকই শুনেছেন।”
-“কিন্তু কেন? হঠাৎ এভাবে বাসা ছাড়ার মানে কী? আর অভ্র ভাই তো আমায় কিছু জানাল না। তুমিও তো আগে কিছু বলোনি।”
-“আমরা কেউই জানতাম না। আমাদের বাড়ির কাজ শেষ হয়ে গেছে। আজকে বাবা গিয়ে দেখে এসেছেন। এখন বাবা চাইছেন আমাদের বাসায় উঠে যেতে। ভাইয়াকেও বিকালে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন বাবা।”
নীরদ কিছুক্ষণ চুপ করে পায়চারি করল ঘরজুড়ে। তাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে বারবার কিছু একটা বলতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে। মাথার চুল ধরে কয়েকবার টেনে সরাসরি অর্ঘমার দিকে তাকাল। অর্ঘমাও তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। নীরদের চোখ দু’টো লাল হয়ে আসছে। কীভাবে থাকবে সে এই মেয়েটাকে ছাড়া? রোজ যাকে একপলক না দেখলে তার দিন ভালো যায় না, তাকে দিনের পর দিন না দেখে কী করে থাকবে? সাড়ে তিনটা বছর এই মেয়েটাকে সে আগলে রেখেছে সকল বিপদ-আপদ থেকে। এরপর থেকে কে দেখে রাখবে? নীরদ কিছুক্ষণ উশখুশ করে প্রশ্ন করল,
-“তুমি আমাকে ভুলে যাবে?”
অর্ঘমা জবাব দিতে পারল না। তার আগেই নুসরাত চলে এলো ঘরে। নীরদ তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। অর্ঘমা শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। এছাড়া আপাতত তার আর কিছুই করার নেই।
চলবে…