#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৬
.
গভীর মনোযোগ সহকারে অংক করছে অর্ঘমা। পড়তে বসলে অর্ঘমা একদম সিরিয়াস হয়ে যায়। যে পড়াটা ধরবে সেটা শেষ করে তবেই অন্য কোনো কথা বলবে বা দুষ্টুমি করবে। গত কয়েক মাসে নীরদ অর্ঘমার এই ব্যবহারের সাথে পরিচিত হয়ে গেছে। নিধি আগেভাগে অংক শেষ করে নীরদের দিকে খাতা এগিয়ে দিল। চোখ দিয়ে ইশারা করে অর্ঘমাকে দেখিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আমি চা করে আনছি। আপনি খাতা দেখুন। তাছাড়া আজকের মতো তো আমার পড়া শেষ।”
-“আচ্ছা।”
নিধি রুম থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিট পর অংক শেষ হলো অর্ঘমার। খাতা নীরদের দিকে এগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বই ঘাটতে লাগল। খাতা দেখার প্রয়োজন মনে করল না নীরদ। এই অংক এর আগেও বেশ কয়েকবার করেছে অর্ঘমা। তাই নীরদ নিশ্চিত এবারও অর্ঘমার অংক ঠিক আছে। উঠে দাঁড়াল নীরদ। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। অবশ্য এখন কারো আসার কথাও নয়। এই সময়টাতে মিনা বেগম শুয়ে থাকেন। আর নিধি রান্নাঘরে গিয়েছে চা বানাতে। অন্তত মিনিট বিশের আগে আর আসবে না। এছাড়া বাসায় আপাতত আর কেউ নেই।
অর্ঘমার চেয়ার নিজের দিকে ঘুরাতেই হকচকিয়ে গেল অর্ঘমা। সামনে তাকানো মাত্রই সে ভরকে গেল। কারণ নীরদ তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়ে চেয়ারের সাথে একদম মিশে গেল সে। দু’চোখে বিস্ময়, ভয়, আতঙ্কে ভরপুর। শুকনো ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল,
-“কী করছেন?”
-“তুমি কথাও বলতে পারো?”
-“মানে?”
-“ক’দিন যাবৎ তো পড়া সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া বাড়তি আর একটা কথাও বলছ না। তাই আমি ভাবলাম হয়তো তুমি বোবা হয়ে গেছ।”
-“ধুর! সরুন তো। অস্বস্তি হচ্ছে আমার।”
-“সরবো তো অবশ্যই। তার আগে এটা বলো, আমাকে ইগনোর করছ কেন?”
অর্ঘমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে অস্বস্তি নিয়ে আশেপাশে কয়েকবার নজর বুলালো। অতঃপর মিনমিন করে বলল,
-“আমি আপনাকে ইগনোর কেন করতে যাব?”
নীরদও সময় নিয়ে কিছুক্ষণ দেখল অর্ঘমাকে। মেয়েটা এমন কেন? নিজের খারাপ লাগার কথাটা তাকে বললে কী হয়? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-“সেদিন আমাকে যে মেয়েটার সাথে দেখেছ, সে আপুর ননদ ছিল। রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল বলে সৌজন্যতার খাতিরে কথা বলছিলাম শুধু। এর বেশি কিছু না। আর আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”
কথাটুকু একদমে শেষ করে নীরদ অর্ঘমার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। টেবিলের উপর থেকে নিজের ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। দরজা লাগানোর শব্দে নিধি হন্তদন্ত হয়ে রুমে এলো। অর্ঘমাকে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-“ভাইয়া চলে গেছে? আমি না বলে গেলাম চা বানিয়ে নিয়ে আসছি!”
-“জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল তাই চলে গেছে। চা অন্য দিন খাবে বলেছে।”
মিথ্যে কথা বলে হনহনিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল অর্ঘমা। বুকের ভেতরটা খুব জোরে জোরে ধুকপুক করছে। অস্থিরতা বিরাজ করছে সারা শরীর জুড়ে। এ কেমন অনুভূতি? একদম ভিন্ন। একদম নতুন। অর্ঘমা বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখল। একটু আগে নীরদ তার খুব কাছে ছিল। দৃশ্যটা মানসপটে ভেসে উঠতেই লাজে রাঙা হয়ে উঠল সম্পূর্ণ মুখশ্রী। নিজের সাথে নিজেরই চোখ মেলাতে বড্ড লজ্জা লাগছিল তার।
___
স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে অর্ঘমা আর নিধি। তারা অপেক্ষা করছে অভ্রর জন্য। আগামী মাস থেকে তাদের এসএসসি শুরু হবে। ক্লাস হবে আর মাত্র ৮ দিন। শেষের এই ক্লাসগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর যেহেতু এবার তাদের স্কুল জীবনের সমাপ্তি তাই ক্লাসের সবার সাথেই মোটামুটি মেশার চেষ্টা করছে তারা। এরপর কে কোথায় থাকে না থাকে তার তো ঠিক ঠিকানা নেই।
নিধি শুধু শুধু বসে থেকে সময় নষ্ট না করে কিছু এমসিকিউ দেখছে। আর অর্ঘমা গালে হাত দিয়ে নীরদের কথা ভাবছে। গতকালের ঘটনার রেশ এখনো তার মাঝে বিদ্যমান। তবে কিছুটা কম। আড়চোখে নিধিকে দেখে নিল অর্ঘমা। সে নিশ্চিত নিধিই নীরদকে জানিয়েছে তার জেলাসির ব্যাপারটা। বিষয়টা তার কাছে অবশ্যই লজ্জাজনক। নীরদ না জানি কী ভেবেছে। তবে একটা জিনিস ভালো লেগেছে অর্ঘমার। নীরদ তার কাছে যেভাবে বিষয়টা ক্লিয়ার করল তাতেই বোঝা যায় নীরদের লাইফে তার গুরুত্ব ঠিক কতটা।
চুলের বেণীতে টান পড়তেই মৃদু শব্দে চিৎকার করে উঠল অর্ঘমা। চোখমুখ কুঁচকে অভ্রর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-“সকাল সকাল আমার সাথে লাগছ কেন?”
-“কী ভেবে এত মিটমিট করে হাসছিস?”
-“বলব কেন?”
-“ওমা! আমাকে বলবি না?”
-“না।”
-“বাহ্! এই ছিল তোর মনে? ঠিক আছে বলতে হবে না।”
অভ্র গম্ভীর মুখে টুলে বসে জুতা পরতে লাগল। অর্ঘমা সামনের ছোট চুলগুলো ঠিক করে বলল,
-“তোমাকে গম্ভীর মুখে একদম প্যাঁচার মতো লাগছে। মনে হচ্ছে জলজ্যান্ত একটা প্যাঁচা আমার সামনে বসে আছে।”
নিধি দুই ভাইবোনের কথা শুনে মুখ টিপে হেসে বলল,
-“আমার কাছে মনে হচ্ছে কেউ তাকে জোর করে নিমপাতার রস খাইয়ে দিয়েছে। তাই চেহারার হাল এমন।”
হো হো করে হেসে উঠল অর্ঘমা। সাথে তাল মেলালো নিধি নিজেও। অভ্র বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে নিধির দিকে। মেয়েটা বাড়তি কথাও বলতে পারে নাকি? কই আজ পর্যন্ত তো দেখেনি নিধিকে কথার পিঠে দু-একটা প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া বাড়তি কোনো কথা বলতে। অভ্রকে চোখ বড় বড় করে তাকাতে দেখে নিধির হাসি বন্ধ হয়ে গেল। শুকনো ঢোক গিলে অর্ঘমার পেছনে গিয়ে লুকালো সে। অভ্রর গাল টেনে দিয়ে অর্ঘমা বলল,
-“আরে ভাই শুধু শুধু গাল ফুলিয়ে রেখেছ তুমি। আমি মজা করছিলাম। আসলে নীরদ ভাইয়ের কথা ভাবছিলাম।”
-“তো কী ভাবলি?”
-“একটা ঘড়ি কিনব।”
-“হঠাৎ?”
-“তোমাদের নাকি গলায় গলায় ভাব জমে গিয়েছে? তো ভুলে গেলে কীভাবে যে ক’দিন বাদেই তার জন্মদিন?”
-“মনে করিয়ে ভালো করেছিস। আসলে ভুলিনি কিন্তু খেয়াল ছিল না। তারিখ শুনলে ঠিকই খেয়াল হয়ে যেত।”
-“তুমি বাসায় থাকবে সেদিন?”
-“না, তবে বিকালে তাড়াতাড়ি আসতে পারব অফিস থেকে।”
-“আমরা তাহলে সারপ্রাইজ দিব নীরদ ভাইকে।”
-“কেক অর্ডার করব?”
-“হ্যাঁ অবশ্যই। আর ডেকোরেশনের জন্য কিছু জিনিস লাগবে। তোমার রুম সাজাবো।”
-“অনলাইন অর্ডার করে দিস। আমি পেমেন্ট করে দিব।”
-“ডান। কিন্তু কেকটা তোমাকে গিয়ে অর্ডার করতে হবে। ভালো কেক আনবে কিন্তু।”
-“ঠিক আছে মা আমার। চল এবার, দেরি হয়ে যাচ্ছে। নীরদ সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে বাসার নিচে। ভালোই হলো এক হিসেবে। আমাকে কষ্ট করে উলটো ঘুরতে হবে না।”
কথাটা অর্ঘমার কানে যায়নি। নীরদের কথা শুনেই সে দৌড়ে নিচে চলে গিয়েছে। নিধি আগে আগে নামছে। পেছন পেছন অভ্র নামছে আস্তেধীরে। সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে অভ্র আস্তে করে বলল,
-“হাসলে কী তোমার মান খোয়া যাবে? নাকি হাসিটা একটু সুন্দর বলে ভাব দেখাও? শোনো মেয়ে, না হাসলে মানুষ ভাববে তুমি গোমড়ামুখো।”
কথাটা বলে অভ্র এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। পেছনে হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিধি। অভ্র তাকে বলে গেল এসব? চোখ পিটপিট করে অভ্রর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও আস্তেধীরে হাঁটা ধরল।
___
নীরদের আজ মেজাজ খারাপ। গত তিনদিন যাবৎ সে অপেক্ষায় আছে অর্ঘমা তাকে সরি বলবে। সরি না বলুক অন্তত তার সাথে কথা বলবে। কিন্তু কিসের কী? ম্যাডাম নিজের ভাবেই বাঁচে না। কথা বলা তো দূরে থাক তার দিকে তাকাচ্ছেও না ঠিক মতো। সেদিনই তো সব ক্লিয়ার করে দিল। তবুও এমন করছে কেন মেয়েটা? অর্ঘমা কী বিশ্বাস করেনি তার কথা? এই যে সে এখন অর্ঘমা, নিধিকে পড়াচ্ছে আর বারবার অর্ঘমার দিকে তাকাচ্ছে। তাতেও অর্ঘমার কোনো হেলদোল নেই। নীরদের যে আজ মেজাজ খারাপ তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার চেহারায়। কপালে ভাজ পড়ে আছে। চেহারায় কঠোর একটা ভাব এনে রেখেছে। পড়ানো শেষ হতেই উঠে যাবে এমন সময় অভ্র এলো ঘরে। তাকে দেখে নীরদ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। নিধি রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই তার পেছন পেছন অর্ঘমাও বেরিয়ে গেল। নীরদ আড়চোখে তাকিয়ে দেখেও কিছু বলল না।
-“কিরে কই হারালি?”
-“কোথাও না ভাই। এমনি মেজাজটা একটু খারাপ। ভার্সিটিতে একটু ঝামেলা হয়েছে।”
-“ওহ আচ্ছা। আমার রুমে চল। ওখানে বসে কথা বলি।”
-“আজ হবে না ভাই। কিছুদিনের মধ্যে একটা প্রেজেন্টেশন সাবমিট করতে হবে। সেটার কাজ এখনো বাকি আছে।”
-“তোকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কথা বলার ছিল। দশ মিনিট সময়ও কী হবে না?”
-“চলো তাহলে আগে তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথাটা শুনে নিই।”
অর্ঘমার রুম থেকে বেরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে অর্ঘমাকে খুঁজল নীরদ। কিন্তু পেল না। অভ্র এসে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতেই ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখল।
-“লাইটটা ছাড় নীরদ।”
নীরদ দ্বীরুক্তি করল না। সরল মনে লাইট জ্বালাতেই ভেতর থেকে নিধি, অর্ঘমা আর পেছন থেকে অভ্র ‘হ্যাপি বার্থডে’ বলে চিল্লিয়ে উঠল। প্রথমে ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই অবাক হয়ে তাকাল সবার দিকে। অর্ঘমার হাতে চকলেট আর ভ্যানিলা মিক্স কেক। রুমের একপাশে লেটার শেপ বেলুন দিয়ে ‘HAPPY BIRTHDAY NIROD’ লেখা। নীরদের মেজাজ এক মুহূর্তেই ফুরফুরে হয়ে গেল। তার যে একটু আগে মেজাজ খারাপ ছিল সেটাও ভুলে গেল। হেসে বলল,
-“জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে তো আমাকে হার্ট অ্যাটাকই দিয়ে ফেলেছিলে প্রায়। সবাই যেভাবে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলে আমি সত্যিই ভয় পেয়েছি। বাই দ্যা ওয়ে, থ্যাংক ইউ গাইজ।”
-“এবার কেকটা কেটে উদ্ধার করুন আমাদের।”
অর্ঘমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল নীরদ। এতদিন তাকে যন্ত্রণা দিয়ে আজ এসেছে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে? হুহ! লাগবে না তার অর্ঘমার শুভেচ্ছা। ভীষণ অভিমান হয়েছে তার। অভ্র তার কাঁধে ধাক্কা দিলে মৃদু হেসে সামনে এগিয়ে গেল। টেবিলের উপর কেক নামিয়ে রেখে সরে গেল অর্ঘমা। একটা ক্যাপ নিয়ে নীরদের মাথায় পরিয়ে দিয়ে অভ্র হেসে বলল,
-“নে বার্থডে বয়, এবার কেক কাট।”
নিধি পুরোটা সময় ভিডিও করছিল অর্ঘমার ফোন দিয়ে। কেক কেটে প্রথমে অভ্রকে খাওয়াল নীরদ। এরপর অর্ঘমা আর নিধিকে খাওয়াল। অভ্র আর নিধি নীরদকে কেক খাওয়ালেও অর্ঘমা খাওয়ায়নি। সে কেকের ক্রিম নিয়ে নীরদের দুই গালে মাখিয়েছে। তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না নীরদ। অর্ঘমা বুঝতে পারল নীরদ তার উপর রেগে আছে। বলা ভালো অভিমান করে আছে।
চলবে…