#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১৫
.
অর্ঘমা আর নিধিকে দিতে স্কুলে যাচ্ছে নীরদ। অনেকক্ষণ যাবৎ উশখুশ করছে অর্ঘমার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু অর্ঘমা কথা বলার মুডে নেই তা বুঝাই যাচ্ছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু তার উত্তর দিচ্ছে। এছাড়া নিজে থেকে কিছুই বলছে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল নীরদের। স্কুলের গেইটের সামনে পৌঁছাতেই নিধি অর্ঘমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“তুই ক্লাসে যা। আমার একটা খাতা লাগবে। আমি কিনে নিয়ে আসছি।”
-“একসাথেই যাই।”
-“তুই আগে যা। সিট পাব না পরে। ওই দেখ ক্লাসের সবচেয়ে বড় দলটা আসছে। জলদি গিয়ে সিট দখল কর আগে।”
-“আচ্ছা। তুই তাড়াতাড়ি আসিস।”
-“এখনই আসছি আমি।”
অর্ঘমা ভেতরে ঢুকে যেতেই নীরদ জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু বলেছে?”
-“হ্যাঁ, গতকাল রাতে ঘুমানোর সময় অনেক জোরাজোরির পর বলেছে।”
-“কী?”
-“আপনি গতকাল একটা মেয়ের সাথে ছিলেন সম্ভবত। স্কুল থেকে ফেরার পথে আপনাদের দেখেছে অর্ঘমা। এজন্যই মেয়েটার মন খারাপ হয়ে গেছে। ও ভেবেছে মেয়েটা হয়তো আপনার প্রেমিকা বা এই টাইপ কিছু হবে।”
-“আরে নাহ্! ওই মেয়ে তো আপুর ননদ ছিল। আমি স্কুলেই আসছিলাম তোমাদের নিতে। রাস্তায় ওর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল তাই ভদ্রতার খাতিরে কথা বলছিলাম। এর মাঝে দেখি তোমাদের স্কুল ছুটি হয়ে অনেকটা সময় পারও হয়ে গেছে। অভ্র ভাইয়ের বন্ধু তোমাদের নিয়ে এসেছে ভেবে আমি আর যাইনি। আপুর ননদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চলে গিয়েছিলাম।”
-“একটা কথা বলি ভাইয়া?”
-“হ্যাঁ, বলো।”
-“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলার কিছু নেই আপনার কাছে, তাই সরাসরিই বলছি। অর্ঘমার অনুভূতি সম্পর্কে আপনি নিশ্চয়ই অবগত? অবগত না হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখছি না। অর্ঘমা কিন্তু নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখেনি। ওর অনুভূতি খোলা বইয়ের মতো। নিজের প্রতিটা কথা বা কাজ দ্বারা কিন্তু ও আপনাকে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছে। আর আপনিও যথেষ্ট বুঝদার মানুষ। এসব আপনার না বুঝার কথা নয়। আপনি বুঝেছেন কিন্তু কিছুই বলেননি। এতেই বুঝা যাচ্ছে আপনি অর্ঘমাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আর আপনার কথাবার্তায় বুঝা যায় আপনিও অর্ঘমাকে পছন্দ করেন।”
-“হ্যাঁ, আমি অর্ঘমাকে প্রশ্রয় দিয়েছি। কারণ ওকে আমার ভালো লাগে। আমি ওর জন্য কিছু একটা অনুভব করি। এর বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না। আর আমারও মনে হয় না তোমার এর থেকে বেশি কিছু জানার আছে।”
হাসল নিধি। বলল,
-“আর কিছু জানার নেই ভাইয়া। শুধু বলব অর্ঘমা খুব ভালো মেয়ে। ওকে কখনো কষ্ট দিয়েন না। মেয়েটা আপনাকে অনেক ভালোবাসে।”
নীরদ কিছু না বলে শুধু হাসল। নিধি চলে যেতেই নীরদ উলটো ঘুরে বাসার দিকে রওয়ানা হলো। মুখে তার এক চিলতে হাসি। অর্ঘমার মন খারাপের কারণ জেনে তার আরও বেশি হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা যে আসলেই একটা বোকা আজ তার আবারও প্রমাণ পেল। নাহলে নিধি যেখানে বুঝে গিয়েছে সে অর্ঘমাকে পছন্দ করে, সেখানে অর্ঘমা নিজেই বুঝল না?
ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নীরদ তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল। বাসায় গিয়ে পড়তে বসতে হবে তাকে। আজ তার পরীক্ষা আছে। অর্ঘমার হয়তো মনেও নেই তার পরীক্ষার কথা। অভিমানে সব ভুলে গিয়েছে মেয়েটা। আবারও হাসি পেল নীরদের। পাশ দিয়ে দুটো মেয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ব্যাপারটা খেয়াল করে নিজেকে সংযত করল নীরদ। এভাবে একা একা হাসতে দেখলে যে কেউ তাকে পাগল ভাববে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। চুলে আঙুল চালিয়ে দ্রুত বাসার দিকে অগ্রসর হলো। বাসায় গিয়ে নাহয় একটু প্রাণ খুলে হেসে নেওয়া যাবে।
___
অভ্র আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে। অফিসের এক স্টাফ হঠাৎ মারা যাওয়ায় আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। পরে অবশ্য জানা গেছে যিনি মারা গিয়েছেন তিনি আসলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। তার বাড়ির লোকেরা জানিয়েছেন, বিগত কয়েকদিন যাবৎ নাকি তার বুকে ব্যথা ছিল। তারা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেও ভদ্রলোক যাননি। আর আজ তিনি পরলোকগমন করলেন।
অভ্র ফ্রেস হয়ে এসে মায়ের রুমে উঁকি দিল। রুমে কেউ নেই। ভ্রু কুঁচকে অর্ঘমার রুমের সামনে গিয়ে দরজায় দু’বার নক করে দাঁড়িয়ে রইল। আগে অর্ঘমার রুমে ঢোকার সময় অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করত না। নিধি আসার পর থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করে। দরজা খুলতেই সম্মুখে ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে থাকা নিধিকে দেখে গলা ঝেড়ে নিল। এই অসময়ে অভ্রকে দেখে নিধি চমকে গেল। জুবুথুবু হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কিছু বলবেন?”
-“মা কোথায়?”
-“আমি তো জানি না। রুমেই থাকার কথা।”
-“রুমে নেই, দেখেছি আমি। অর্ঘমা কোথায়?”
-“ঘুমাচ্ছে।”
-“তুমিও ঘুমাচ্ছিলে নাকি?”
-“হ্যাঁ, ওই একটু চোখ লেগে এসেছিল।”
অভ্র কতক্ষণ ইতস্তত করে বলল,
-“একটা কথা বলার ছিল।”
অবাক হলো নিধি। তাকে কিছু বলার ছিল অভ্রর? সে কী আদৌ ঠিক শুনল? এ বাসায় আসার পর অভ্রর সাথে তার কথা হয়েছে হাতেগোনা দুই থেকে তিনবার। তাও পড়া সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। অর্ঘমাকে যখন পড়া সংক্রান্ত বিষয় জিজ্ঞেস করত তখন তাকেও করত। অবাকতার রেশ টেনে সে বলল,
-“বলুন।”
-“মা অথবা অর্ঘমা থাকলে ওদেরই বলতাম। কিন্তু অর্ঘমা তো ঘুমে। আর মা বাসায় নেই। তাই তেমাকেই বলতে হচ্ছে।”
-“কী?”
-“এক কাপ চা দিতে পারবে? আসলে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। এক কাপ চায়ের খুব দরকার।”
-“আমি এখনই বানিয়ে দিচ্ছি।”
বলেই হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটল নিধি। অভ্র গিয়ে বসল সোফার রুমে। হঠাৎ তার মনে হলো নিধিকে চা বানাতে বলা ঠিক হয়নি। এর থেকে দোকানে গিয়ে চা খাওয়া উচিত ছিল। একবার ভাবল এখনই গিয়ে নিধিকে চা বানাতে না করে দিবে। পরক্ষণেই আবার ভাবল, নিজেই চা বানাতে বলে আবার নিজেই না করে দিলে বিষয়টা কেমন দেখাবে? অভ্রর কেন যেন প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছিল। অর্ঘমাটা জেগে থাকলে ভালো হতো।
নীরবতা কাটিয়ে সশব্দে ফোন বেজে উঠতেই চমকে উঠল অভ্র। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আননোউন নাম্বার। একবার ভাবল ধরবে না। আবার কি মনে করে যেন ধরল। ফোন কানের কাছে আনতেই বুঝতে পারল সে যা ভেবেছিল তাই। এটা রিয়ার নাম্বার। ব্রেকাপের পর থেকে রিয়া প্রতিদিন বিভিন্ন নাম্বার দিয়ে তাকে কল করে। এই পর্যন্ত রিয়ার কতগুলো নাম্বার যে সে ব্লক লিস্টে ফেলেছে তার হিসেব নেই। মেয়েটা এতগুলো নাম্বার পেল কোথায়? বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিতে গিয়েও ওপাশ থেকে রিয়ার আকুতি মিনতি শুনে আর কাটল না। যতই হোক সে রিয়াকে ভালোবাসে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আবার কেন ফোন করেছ? কতবার না বলেছি আমায় ফোন করবে না।”
-“এমন কেন করছ অভ্র? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তোমাকে ছাড়া। প্লিজ আমার সাথে এমন করো না।”
-“আমি কী করলাম?”
-“আমরা আবার আগের মতো এক হয়ে যেতে পারি না অভ্র? আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো। তাহলে বিচ্ছেদ কেন?”
-“কারণ তোমার ভাই।”
-“আমার ভাইয়ের দোষটা কোথায় একটু বলবে? সে তো শুধু অর্ঘমাকে পছন্দ করেছে।”
-“পছন্দ করলে কিছু বলতাম না। কিন্তু সে লিমিট পার করেছে আমার বোনকে হুমকি দিয়ে। বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল দেখেও আমি তেমন কিছু বলিনি। ভদ্রভাবে না করেছিলাম। কিন্তু তোমার ভাই এখানেও ঘাড়ত্যাড়ামি করে হুমকি দিয়ে গেল।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। মেনে নিলাম আমার ভাই ভুল করেছে। ওর জন্য আমাকে কেন শাস্তি দিচ্ছ তুমি?”
-“এক্সকিউজ মি! কে শাস্তি দিচ্ছে তোমায়? তুমি নিজেই না বলেছিলে তোমার ভাইয়ের সাথে আমার বোনের বিয়ে না দিলে আমার তোমার সাথেও প্রেম করার দরকার নেই?”
-“সরি অভ্র। ভুল হয়ে গেছে আমার। প্লিজ মাফ করে দাও।”
অভ্র ফোনের এপাশে নিশ্চুপ রইল। রিয়ার কান্না তাকে পীড়া দিচ্ছে। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়?
-“সব পুরুষ মানুষের ক্যারেক্টার ঢিলা হয় না রিয়া। কিছু পুরুষ মানুষ এক নারীতেই আসক্ত থাকে। আমি আমার বোনের জন্য এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকা পুরুষই চাই। যে শুধু আমার বোনের প্রতিই আসক্ত থাকবে। এবং আমি নিজের ক্ষেত্রেও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যে আমার জীবনসঙ্গী হবে আমি তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। তাকে ব্যতীত অন্য কারও দিকে নজর দিব না। এখন সেই মানুষটা তুমিই হও বা অন্য কেউ।”
-“এভাবে বোলো না অভ্র। কষ্ট হয় আমার। আমি ব্যতীত তুমি অন্য কারও কথা ভাবার চিন্তা করলেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”
-“কেঁদো না।”
কথাটা শুনে যেন রিয়ার চোখের পানি আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল। অভ্র অসহায়বোধ করতে লাগল। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। তার কী উচিত হবে রিয়াকে নিজের জীবনে ফিরিয়ে নেয়া? মন কেন যেন সায় দিচ্ছে না। কিছু একটা বাঁধা দিচ্ছে তার মনকে। সেটা কী? রিয়া নিজেই আবারও বলল,
-“ভাইয়া অর্ঘমাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে অভ্র। অর্ঘমার জন্য সে ভীষণ পাগলামি করছে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছে একসপ্তাহ হলো। বাসায় গিয়েই নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। কারও সাথে কথা বলছে না। শুধু অর্ঘমা অর্ঘমা করে যাচ্ছে। বারবার বলছে অর্ঘমাকে এনে দিতে।”
অভ্র দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-“যা বলতে চাইছ সাফ সাফ বলো।”
-“আমি বলতে চাইছি ভাইয়ার এসব পাগলামিতেই কী প্রমাণ হচ্ছে না যে ভাইয়া অর্ঘমাকে ভালোবাসে? আর একবার কাউকে ভালোবাসলে তার মন কখনো দ্বিতীয় নারীর প্রতি আসক্ত হয় না অভ্র।”
ফোনের এপাশ থেকে হেসে ফেলল অভ্র। রিয়া কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। অভ্র হাসি থামিয়ে বলল,
-“আর একটু হলেই তোমাকে দ্বিতীয় বারের মতো আমার জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি কনভিন্স হয়ে যেতাম। ভাগ্যিস তুমি তোমার ভাইয়ের হয়ে উকালতি করে আমাকে কনভিন্স হওয়া থেকে আটকালে।”
-“অভ্র!”
-“তুমি আর তোমার ভাই জাহান্নামে যাও। আল্লাহ’র ওয়াস্তে আমার আর আমার বোনের পেছন ছেড়ে দাও।”
-“আপনার চা। কড়া লিকার দিয়ে বানিয়েছি। আশা করি মাথা ঝিমঝিম ছেড়ে যাবে।”
অভ্র চোখ উঠিয়ে সামনে তাকাতেই নিধিকে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-“টেবিলে রাখো।”
ওপাশ থেকে রিয়া বলল,
-“মেয়েটা কে অভ্র? তোমার জন্য চা নিয়ে এসেছে কেন? আবার তুমিও বলছ চা-টা টেবিলে রাখতে। এটা অর্ঘমা না তা আমি শতভাগ নিশ্চিত। তুমি কেন অন্য মেয়ের হাতের বানানো চা খাবে? কে মেয়েটা?”
-“আমার বউ। হ্যাপি? আর কখনো ফোন দিলে খুন করে ফেলব একেবারে।”
কল কেটে নাম্বার ব্লক করে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেল অভ্র। নিধি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী থেকে কী হলো কিছুই বুঝল না সে। অভ্রর চেহারার হাল দেখেই মনে হচ্ছিল সে এই মুহূর্তে ভীষণ রেগে আছে। তাই আর তার রুমে যাওয়ার সাহস করল না। অর্ঘমার রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল।
অর্ঘমা এখনো ঘুমাচ্ছে। ঘড়িতে সময় দেখে নিল নিধি। নীরদের আসতে আরও ঘন্টা দুই সময় বাকি। এই ফাঁকে আরেকটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না ভেবে অর্ঘমার পাশে শুয়ে পড়ল। ঘুম আগে থেকেই তার চোখে ছিল। তাই শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
চলবে…