#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১২
.
নিধির বাসায় পৌঁছেই দৌড়ে ওপরে গেল অর্ঘমা। নিধি নেই পানির ট্যাংকের পাশে। আসার সময় বহুবার নিধিকে কল দিয়েও পায়নি অর্ঘমা। চিন্তায় তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর কিছু না ভেবে অভ্র আর নীরদকে নিয়ের নিধির বাসায় ঢুকল। দরজা খোলাই ছিল। অর্ঘমাকে দেখে নিধির সৎ মা যেমন অবাক হলেন তেমন রেগেও গেলেন। কারণ অর্ঘমা শেষবার যখন এখানে এসেছিল সেদিন তিনি সাফ সাফ অর্ঘমাকে বারণ করে দিয়েছিলেন সে যেন এখানে আর না আসে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অর্ঘমা জিজ্ঞেস করল,
-“নিধি কোথায়?”
-“তোকে কেন বলব? তোকে বলছিলাম না তুই আর আমার বাসায় আসবি না! তো আসছিস কেন?”
-“খেতে আসিনি আপনার বাসায়। ভালোভাবে জিজ্ঞেস করছি, বলুন নিধি কোথায়?”
-“ও আছে ওর ঘরে। কিন্তু এখন দেখা করা যাবে না। তুই যা এখন। এত রাতে কারো বাসায় আসাটা কোন ধরনের সভ্যতা?”
অর্ঘমা পেছন ঘুরে নীরদ আর অভ্রর দিকে করুণ চোখে তাকাল। তার চোখ ছলছল করছে। যেন এখনই কেঁদে ফেলবে। অভ্রর ফোনে কল আসায় সে নীরদকে বলে বেরিয়ে গেল। ফিরে এলো মিনিট দুয়েকের মাঝে। সাথে আছে পুলিশ। নিধির মা পুলিশ দেখে চমকালেন, ভড়কালেন। অর্ঘমা বলল,
-“দেখুন স্যার, নিধি আমাকে ওনার ফোন থেকে কল করেছিল। মেয়েটা লুকিয়ে ছিল। এখন ওনার ফোন ওনার হাতে দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওনারা নিধিকে খুঁজে পেয়েছে। প্লিজ নিধিকে নিয়ে আসতে বলুন এখানে।”
অভ্র বোনের পেছনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখল। পুলিশকে পুরো ঘটনা জানানো হয়েছে ফোনেই। তাই তিনি সময় ব্যয় না করে কনস্টেবলকে বললেন,
-“পুরো বাসা সার্চ কর।”
-“আরে আরে যাচ্ছেন কোথায় আপনারা?”
নিধির সৎ মায়ের কথায় অফিসার বললেন,
-“আপনার নামে অভিযোগ আছে।”
আঁতকে উঠলেন নিধির সৎ মা। রাগী চোখে তাকালেন অর্ঘমার পানে। নিধির বাবা বাসায় ঢুকে পুলিশ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে পুলিশ তাকে নিধির ফোন করে জানানো ব্যাপারটা বললেন। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুহূর্তেই। অভ্র আর নীরদ বুঝতে পারল ভদ্রলোক নিজেও এই ঘটনার সাথে জড়িত।
কনস্টেবল ভেতর থেকে একটা ছেলেকে টেনে নিয়ে আসলেন। অর্ঘমা নিধির কথা তাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন ভেতরে মহিলা কনস্টেবলের সাথে আছে। দেরি করল না অর্ঘমা। দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। অভ্র আর নীরদ গেল না পেছনে। নিধি কী অবস্থায় আছে কে জানে! এই অবস্থায় ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না তাদের। তারা দাঁড়িয়ে রইল পুলিশের সাথে।
নিধির ঘরে ঢুকতেই অর্ঘমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল। মেয়েটার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সে নিজেই কেঁপে উঠল। নিধি অর্ঘমাকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কনস্টেবল মহিলা অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
-“আপনি কে?”
-“ওর বান্ধবী। ও আমাকেই কল করে জানিয়েছিল এখানের ঘটনা।”
নিধির সারা শরীরে মারের দাগ। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। ক্ষতগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে এগুলো তাজা। অর্ঘনা নিধির হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে পানি খুঁজল। নিধিকে পানি খাইয়ে তার পাশে বসে হাত ধরে জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছিল সবটা বল আমাকে।”
কান্নার দমকে বারবার কেঁপে উঠছে মেয়েটা। অর্ঘমার পানে তাকাতেই তাকে আশ্বাস দিল অর্ঘমা।
-“ফোন কেটে আমি ছাদেই লুকিয়ে ছিলাম চুপচাপ। ততক্ষণে নিচে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছিল খালা আর তার ভাগ্নে। বিল্ডিংয়ের সবার বাসায় গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। আমি ছাদে আসার সময় চারতলার এক মহিলা আমায় দেখে নিয়েছিলেন। তিনিই ওদের জানিয়েছেন আমার ছাদে আসার কথা। খালা আর তার ভাগ্নে ছাদে এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে দোতলা ছাদে আসে। আর আমাকে পানির ট্যাংকের পাশেই পেয়ে যায়। খালা আমাকে সেখানে দাঁড়িয়েই কতগুলো থাপ্পড় মারেন। তারপর আমার চুলের মুঠি ধরে বাসায় টেনে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটান আমাকে। খালার ভাগ্নেও মেরেছে। আমার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি ছিল না আর মার খাওয়ার। আমাকে সেই অবস্থাতেই এই ঘরে ফেলে রেখে চলে যায় ওরা। কিছুক্ষণ পরে খালার ভাগ্নে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। বাবাও এসবের সাথে জড়িত অর্ঘ।”
কেঁপে উঠল অর্ঘমা। ওর নিজের চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পরল। মেয়েটার সাথে কী তবে আরও বাজে কিছু ঘটেছে? কণ্ঠনালি কাঁপছে অর্ঘমার। তবুও সে বলল,
-“সে কী তোর সাথে বাজে কিছু…”
আর বলতে পারল না। নিধি জোরে কেঁদে উঠল। অর্ঘমা তাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। একসময় শান্ত হলো নিধি। মাথানিচু করে মিনমিনে গলায় বলল,
-“বেশি কিছু করতে পারে নি। তার আগেই পুলিশ এসে গিয়েছিল। তবুও যেখানে যেখানে ওই লোক আমায় স্পর্শ করেছে মনে হচ্ছে সেখানে সেখানে এসিড ঢেলে জ্বালিয়ে দেই। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে অর্ঘ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”
আবারও কেঁদে উঠল নিধি। কাঁদতে কাঁদতে এবার তার অবস্থা প্রায় অচেতনের মতো হয়ে গেল। মুখ থেকে হালকা গোঙানির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা গেল না আর। অর্ঘমা বুঝলো না কিছুই। ঘাবড়ে গিয়ে মহিলা কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি নিধির শ্বাসের গতিবিধি দেখে কপালে হাত ছোঁয়ালেন। আঁতকে উঠে বললেন,
-“শরীর তো প্রচন্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।”
নিধির জামা ঠিকঠাক করে সেভাবেই শুইয়ে রেখে ঘর ছেড়ে বের হলো অর্ঘমা আর মহিলা কনস্টেবল। বাইরের ঘর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। সেখানে গিয়ে মহিলা কনস্টেবল অফিসারকে জানালেন নিধির বলা কথাগুলো।
অর্ঘমা অভ্রর কাছে গিয়ে বলল,
-“নিধিকে নিয়ে হসপিটালে যেতে হবে ভাইয়া। ওর অবস্থা ভালো নয়। সারা শরীরে মারের দাগ আর প্রচন্ড জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।”
-“ঠিক আছে, নিয়ে যাব।”
নীরদ অফিসারের উদ্দেশ্যে বলল,
-“এনাদের কী শাস্তি দিবেন তা আপনি জানেন। তবে দেখবেন শাস্তি যেন কঠিন হয়।”
-“অবশ্যই।”
অর্ঘমা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“নিধি এই বাড়িতে থাকলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না ভাইয়া। আমি এই মহিলাকে এক বিন্দুও বিশ্বাস করি না। তাছাড়া এই মহিলা নিধির বিয়ে ঠিক করেছেন এক চরিত্রহীন পঞ্চাশোর্ধ বুড়ো লোকের সাথে। আজ বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বুড়ো কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে দেখে বিয়ের তারিখ পেছানো হয়েছে। ওই বুড়োর আবার আরও দুইটা বউ আছে। আমি নিধিকে এখানে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না।”
-“নিধিকে আমাদের সাথে আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।”
-“মা-বাবা!”
-“তাদের আমি বুঝিয়ে বলব।”
নিধির সৎ মা চিল্লিয়ে উঠলেন ওদের কথা শুনে। মহিলা প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়লেন।
-“নিধিকে নিয়ে যাবি মানে! ওকে তোদের সাথে কেন নিবি? তোর ভাইয়ের রক্ষিতা করে রাখার জন্য!”
মহিলার কথা শুনে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল অভ্র, নীরদ আর অর্ঘমা। অভ্র রেগে বলল,
-“মুখ সামলে কথা বলবেন।”
মহিলার সাথে অভ্রর বাকবিতণ্ডতা লেগে গেল। তার কথা হলো তিনি কোনোভাবেই নিধিকে নিয়ে যেতে দিবেন না। তার সাথে সহমত প্রকাশ করছে নিধির বাবা। নীরদ এসব দেখে পুলিশের সাথে কথা বলে ঠিক করল নিধি তাদের সাথেই যাবে। অন্তত পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথেই থাকবে মেয়েটা। কথা শেষ করে নীরদ অভ্রকে শান্ত হতে বলল।
-“নিধিকে নিয়ে এসো অর্ঘমা।”
নীরদের কথায় অর্ঘমা বলল,
-“ওকে হাঁটিয়ে নেওয়া যাবে না। সেন্স নেই ওর।”
-“কোলে নিতে হবে?”
-“হ্যাঁ, এছাড়া উপায় নেই।”
-“ঠিক আছে, চলো।”
নীরদ অন্য মেয়েকে কোলে নিবে শুনতেই অর্ঘমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। রেগে নীরদের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেল নীরদ। এভাবে তাকানোর মানে কী? অর্ঘমা দাঁতে দাঁত চেপে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ভাইয়া, তুমি নিধিকে উঠাবে। এসো আমার সাথে।”
অভ্র গিয়ে নিধিকে কোলে তুলে বের হলো। পুলিশ ততক্ষণে বাকিদের নিয়ে চলে গেছে।
___
রাতের খাবার নিয়ে অর্ঘমা ঘরে প্রবেশ করল। নিধি বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। চেহারায় অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। গত তিনদিন কঠিন জ্বরে আক্রান্ত ছিল মেয়েটা। গতকালই হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না বলেই ভর্তি করতে হয়েছিল। এখন একটু সুস্থ আছে বলে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।
খাবারের প্লেট নিধির সামনে রেখে তাকে ধরে ঠিক করে বসতে সাহায্য করল। অর্ঘমা নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিল নিধিকে। খাবার শেষে যত্ন করে মুখ মুছে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিল। প্লেট রান্নাঘরে রেখে এসে নিজেও খেয়ে নিল। হাত ধুয়ে রুমে এসে দেখল নিধি চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। তার পাশে বসে অর্ঘমা জিজ্ঞেস করল,
-“খারাপ লাগছে?”
-“আমার ভাগ্যটা এমন কেন হলো বলতে পারিস? কী পাপ করেছিলাম আমি?”
-“যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আমরা তো কিছুই বদলাতে পারব না তাই না! এসব আর ভাবিস না। এখন একটু ঘুমা তো। সপ্তাহখানেক পরে টেস্ট পরীক্ষা। আগামীকাল থেকে পড়তে বসবি। আমি তোদের বাসা থেকে আসার সময় তোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছি।”
কিছু বলল না নিধি। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। তার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।
___
নিধিকে বাসায় নিয়ে আসায় কিছুটা নারাজ হয়েছেন অভ্রর মা। এর কারণ হলো তিনি সেদিনের ঘটনা অর্ঘমার কাছ থেকে শোনার পর ভেবেছেন নিধিকে তার সৎ মায়ের ভাগ্নে রেপ করেছে। নিধি ভয় পেয়ে সত্যিটা বলছে না। এর ওপর আবার নিধিকে অভ্রর কোলে দেখে তার মাথা ঘুরে উঠেছেন। তিনি ভয়ে আছেন অভ্রকে নিয়ে। তার এত ভালো ছেলেটা আবার নিধির জালে ফেঁসে না যায়। তার ছেলে অনেক ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করে। তাছাড়া নিধির রেপ না হলেও তিনি এই মেয়েকে তেমন একটা পছন্দ করতেন না। একে তো মা নেই। থাকে সৎ মায়ের অত্যাচারে। বাপ তো থেকেও না থাকার মতো। এমন একটা পরিবারের মেয়েকে কীভাবে পছন্দ করবেন তিনি!
চলবে…