#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৬
.
ড্রয়িংরুমে থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শাকিল আর তার বাবা-মা অভ্রর পানে তাকিয়ে আছে। তাদের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখে অভ্র শীতল চাহনি নিক্ষেপ করল তাদের দিকে। অতঃপর বলল,
-“এখানে আসার আগে আপনাদের ভাবা উচিত ছিল, যে মেয়ের জন্য আপনারা প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন, আপনার ছেলে আদৌ সেই মেয়ের যোগ্য কিনা।”
-“আমার ছেলেকে কোন দিক দিয়ে তোমার অযোগ্য মনে হলো?”
-“একজন মানুষের যেদিকেটা সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আপনার আর আপনার ছেলের সেই দিকটাই ঠিক নেই আঙ্কেল।”
ভ্রু কুঁচকে তাকালেন শাকিলের বাবা। অভ্র মৃদু হেসে বলল,
-“আপনাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের খবর আমার জানা আছে। আপনাদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া শেষ। আশা করি এর থেকে বেশি কিছু আমাকে বলতে হবে না। আপনারা বুঝদার মানুষ।”
শাকিলের বাবা চুপ হয়ে গেলেন। লজ্জায়, অপমানে তিনি মাথা নিচু করে রইলেন। অথচ তার দৃষ্টিতে রাগ স্পষ্ট।
শাকিল হাত মুঠ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। সে শর্ট টেম্পার মানুষ। কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। অভ্রকে যেন নিজের চোখ দিয়েই সে ভস্ম করে দিবে। অভ্র চোখ গেল শাকিলের পাশে বসে থাকা রিয়ার দিকে। যে বর্তমানে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অভ্র মাথানিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রিয়ার দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে সে নিজের ভাইয়ের পক্ষেই আছে। অভ্র রিয়াকে উপেক্ষা করে শাকিলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“তোমাকে যেন আমার বোনের আশেপাশেও না দেখি। যদি দেখি তো ভাবতেও পারছো না তোমার কি হাল করব আমি। আজ ভদ্রভাবে বলছি। কিন্তু পরবর্তীতে এত ভদ্রতা আমি দেখাতে পারব না। আশা করছি তুমি বুঝতে পেরেছো আমার কথা। আমি আবারও বলছি। আমার বোনের আশেপাশে তোমার ছায়াও যেন না পড়ে।”
শাকিল রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে। অতিরিক্ত রাগে উঠে দাঁড়াল সে। সবাই ভাবল এখন হয়তো গণ্ডগোল শুরু করবে শাকিল। কিন্তু না! সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাকিল হেসে উঠল। হাসিমুখে দাঁতে দাঁত চেপে অভ্রকে বলল,
-“বোনকে সামলে রেখো। দিনকাল ভালো না। বলা তো যায় না কখন কি হয়ে যায়! দেখা গেল তোমার বোন একদিন স্কুলে গিয়েছে। অথচ স্কুল ছুটির পর সে আর বাড়িই ফিরল না। কোচিং-এ থেকে আসার পথেও হতে পারে। আজকাল কিন্তু রাস্তাঘাটের অবস্থা একদম ভালো না।”
অভ্র উঠে শাকিলের কলার চেপে ধরতেই নীরদ তাকে টেনে সরিয়ে নিল। তাদের একটা ভুল পদক্ষেপ অর্ঘমার জীবনে কাল ডেকে নিয়ে আসতে পারে। নীরদ মৃদু হেসে শাকিলকে বলল,
-“তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আসলেই আজকাল রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না। দেখা গেল রাস্তা দিয়ে বেখেয়ালি ভাবে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একটা গাড়ি এসে তোমাকে পিষে দিয়ে গেল। তোমার বাবা-মায়ের একটা মাত্র ছেলে তুমি। তোমাকে হারালে তাদের সামলাবে কে? তাই তুমি বরং নিজের খেয়াল রেখো!”
শাকিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীরদের দিকে তাকিয়ে রইল। নীরদ আবারও হাসিমুখে বলল,
-“বাসার দরজাটা ওইদিকে। আপনারা এবার আসতে পারেন।”
লজ্জায়, অপমানে থমথমে চেহারা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল সকলে। যাওয়ার আগে রিয়ার সাথে অভ্রর দৃষ্টি মিলন হলো। রিয়ার দৃষ্টিতে স্পষ্ট ছিল ক্ষোভ।
___
-“আগামীকাল থেকে তুই আর স্যারের বাসায় কোচিং করতে যাবি না।”
অভ্রর কথায় অবাক হলো না অর্ঘমা। এরকম কিছু একটাই সে আন্দাজ করেছিল। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তাহলে পড়া বুঝব কীভাবে?”
-“সেই ব্যবস্থা আমি করে দিব। বাসায় টিচার রেখে দিব।”
-“আচ্ছা। আর স্কুলে?”
-“এ মাসে আমি দিয়ে আসব আর আমিই নিয়ে আসব। আগামী মাস থেকে স্কুল বাসে যাতায়াত করবি।”
-“আচ্ছা।”
অভ্র অর্ঘমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বরাবরের মতো একটা কিটক্যাট সামনে রেখে চলে গেল। তবে আজ অর্ঘমা খুশি হলো না। তার ভীষণ মন খারাপ। নিজের ইচ্ছে মতো আর চলাফেরা করতে পারবে না। সবসময় কেউ না কেউ সাথে থাকবেই এখন থেকে। যদিও এসব ওর ভালোর জন্যই। তবুও!
___
পর পর চারটে সিগারেট শেষ করে ফেলেছে অভ্র। তার চেহারায় রাগ ছাপ স্পষ্ট। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে কপাল জুড়ে। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। সম্পূর্ণ ছাদ জুড়ে সমানে পায়চারি করে চলেছে। হাতে ফোন। স্ক্রিন ফেটে আছে ফোনের। রাগের বশে কিছু সময় আগে ফোনটাকে আছাড় মেরেছিল। তারই ফল বশত স্ক্রিন ফেটে গেছে। টাচে কাজও করছে না ঠিকঠাক মতো। প্রায় মিনিট দশেক পর কল এলো তার ফোনে। ফাটা স্ক্রিনে ‘লাভ’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর কল রিসিভ করতে সক্ষম হলো অভ্র। সাথে সাথেই গর্জে উঠল সে।
-“কখন থেকে কল দিচ্ছি? কই যেয়ে মরেছিলে এতক্ষণ? ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করছিলে না তাই না?”
-“ঠিক ধরেছ। কেন রিসিভ করব তোমার ফোন? আমার পরিবারকে অপমান করে মন ভরেনি? আরও অপমান করতে চাও?”
-“মেজাজ খারাপ করবি না। তোর ওই বখাটে ভাই কোন সাহসে আমার বোনের দিকে নজর দেয়, হ্যাঁ? আর তোর পরিবার যা, আমি তাই বলেছি।”
-“ভুলে যেয়ো না আমার পরিবারের মধ্যে আমিও পড়ি। আর আমার পরিবার যেমনই হোক এটা আমার পরিবার। অতএব তুমি তাদের ব্যাপারে কোনো কটু কথা বললে আমি বরদাস্ত করব না।”
নিজের রাগটাকে গিলে ফেলে অভ্র শান্ত কণ্ঠে বলল,
-“আমি কিন্তু তোমার পরিবারকে কোনো কটু কথা বলিনি। আমি শুধু তোমাদের পরিবারের নিয়ে আসা প্রস্তাবটা নাকচ করেছি। কারণ আমার বোনের জন্য তোমার ভাইকে আমার সঠিক মনে হয়নি।”
-“বেশ তো! থাকো তুমি তোমার বোনকে নিয়ে। তবে একটা কথা আমি জানিয়ে রাখছি। যদি অর্ঘমার সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ে না হয় তাহলে তোমার সাথেও আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আমার কাছে আগে আমার ভাই।”
-“রিয়া!”
-“একদম চেঁচাবে না। যে ছেলের সাথে তোমার বোনের বিয়ে দিতে পারবে না সেই ছেলের বোনের সাথেও তোমার প্রেম করার দরকার নেই।”
-“তুমি নিজেও তোমার ভাইয়ের ক্যারেক্টার সম্পর্কে ভালো ভাবেই জানো। তবুও তুমি এই কথা বলছো?”
-“হ্যাঁ, বলছি। কারণ অর্ঘমাকে আমার ভাই পছন্দ করেছে। আমার ভাই যেমনই হোক না কেন আমি চাইবো অর্ঘমার সাথে যেন তার বিয়ে হয়। তাছাড়া পুরুষ মানুষের অমন একটু আধটু লুজ ক্যারেক্টার হয়েই থাকে। এটা কোনো বড় ব্যাপার না।”
অভ্র যেন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। রিয়াকে আজ তার বড্ড অচেনা লাগছে। এই রিয়ার কথার ধরনেই একদিন মুগ্ধ হয়েছিল অভ্র। কিন্তু আজ রিয়ার কথার ধরন শুনে সে যেন পাথর হয়ে গেছে। একটা মানুষ এত জলদি কীভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়? নাকি রিয়া এতদিন তার সামনে মুখোশ পড়ে চলাফেরা করত বলে সে ধরতে পারেনি এই রিয়াকে!
অভ্র অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। ওপাশ থেকে রিয়া হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। অভ্র স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-“তাহলে তোমার কথাই রাখলাম।”
রিয়া খুশি হয়ে বলল,
-“তার মানে তুমি অর্ঘমা আর ভাইয়ার বিয়ের জন্য রাজি!”
-“না।”
মুহূর্তেই খুশিটা উবে গেল। রিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“তাহলে?”
-“তোমার সাথে আমার সম্পর্ক এখানেই সমাপ্ত।”
থমকে গেল রিয়া। সে ভেবেছিল অভ্রকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করলে অভ্র রাজি হয়ে যাবে অর্ঘমার বিয়ের জন্য। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
-“কী বলছো অভ্র? তুমি না আমাকে ভালোবাসো?”
-“তার থেকেও হাজার গুণ বেশি আমি আমার বোনকে ভালোবাসি।”
-“অভ্র!”
-“এখন চেঁচাচ্ছ কেন? তুমিই না একটু আগে বললে, যে ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দিতে পারব না, সেই ছেলের বোনের সাথেও আমার প্রেম করার দরকার নেই।”
-“তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে রাজি। অথচ আমার ভাইয়ের সাথে তোমার বোনের বিয়ে দিতে রাজি না!”
-“না। তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ। অতএব আমাদের যোগাযোগও এখানেই শেষ। রাখছি আমি। আর কখনো ফোন দিবে না।”
লাইন কেটে দিয়ে থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল অভ্র। তার চোখের কার্ণিশে জল জমেছে। ফোনটাকে আরও একটা আছাড় মেরে ধপ করে বসে পড়ল ছাদের মাঝে। চুলগুলো টানতে টানতে পাশের দেয়ালে জোরে জোরে দু’বার ঘুষি মারল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। তারপর হুট করেই সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরলো। তার ভেতরে বয়ে যাওয়া ঝড় আপাতত এই নিকোটিনের মাধ্যমেই শান্ত করতে হবে।
চলবে…