#কিশোরী_কন্যার_প্রেমে
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৩
.
অর্ঘমারা নতুন বাসায় উঠেছে প্রায় দু’মাস হতে চলল। বিল্ডিংয়ের দোতলার ভাড়াটিয়ার মেয়ের বিয়ের দাওয়াত পেয়েছে তারা। মূলত ওই আপুর আম্মুর সাথে অর্ঘমার আম্মুর বেশ খাতির হয়েছে গত দু’মাসে। সেই সুবাদেই তারা দাওয়াত পেয়েছে। পরশু বিকেলে বিয়ে। অর্ঘমা ভেবেছিল সে যাবে না। কিন্তু তার মায়ের কয়েকটা ঝারি খাওয়ার পর যেতে রাজি হয়েছে। বলতে গেলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই যেতে রাজি হয়েছে।
নীরদ ছাদে এসেই টের পেল তার ফুল গাছে ফুল ফুটেছে। সম্পূর্ণ ছাদ বেলী ফুলের ঘ্রাণে ম-ম করছে। ফুল গাছের দিকে এগিয়ে গিয়ে খুশি হলো সে। বেলী ফুল তার ভীষণ পছন্দের। গুনগুন শব্দ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। কাউকে দেখতে না পেয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে লাগল। ছাদের অপর পাশে এসে অর্ঘমাকে দেখতে পেল। এক কর্ণারে বসে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে খাতায় কিছু একটা করছিল সে। নীরদ এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। অর্ঘমা উপরে তাকিয়ে নীরদকে উঁকি দিতে দেখে হকচকিয়ে গিয়ে দ্রুত খাতা বন্ধ করল। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“উঁকি দিচ্ছিলেন কেন ওভাবে?”
-“কী করছিলে তুমি?”
-“আমি যা-ই করি না কেন, আপনি এভাবে উঁকি দিবেন কেন? জানেন না এটা ব্যাড ম্যানার্স!”
-“তুমি স্কেচ তৈরি করছিলে। আমি ডিস্টার্ব করতে চাই নি। তাই উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম। এখন যখন তুমি টের পেয়েই গিয়েছ তখন আর উঁকি দিব না। সরাসরি দেখব এবার।”
হাত থেকে খাতাটা টান দিয়ে নিয়ে নিতেই লাফিয়ে উঠল অর্ঘমা। সে কোনোমতেই নীরদকে খাতাটা দেখতে দিবে না। কিন্তু নীরদ তো নাছোড়বান্দা। সে দেখেই ছাড়বে কি এঁকেছে অর্ঘমা।
অর্ঘমার সাথে নীরদ পারলে সারাক্ষণ একে অপরের পেছনে লেগে থাকে। পান থেকে চুন খসলেই দু’জনের মাঝে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। দু’জন যেন পুরো টম এন্ড জেরী। মাঝে মাঝে অবশ্য অর্ঘমাকে লজ্জা দিতেও ছাড়ে না নীরদ। নীরদ, অর্ঘমা দু’জনই নিজেদের পরিবারের ছোট সদস্য হওয়ার সুবাদে আহ্লাদী আর খুব আদরের। নীরদ বয়সে, ক্লাসে অর্ঘমার থেকে বড় হলেও দু’জনের মাঝে সবসময় বাচ্চাদের মতো কথা কাটাকাটি লেগেই থাকে। তাদের পরিবারও এই ব্যাপারে বেশ ভালো মতোই অবগত হয়েছে গত দু’মাসে। কিন্তু তারা এগুলো স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছেন। অভ্রর কাছে বিষয়টা বেশ কিউট লাগে। নীরদকে তার পছন্দ। অর্ঘমার সাথে নীরদের সম্পর্ক হলে তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু দু’জনের দেখা হলেই যেভাবে বাচ্চাদের মতো একে অপরের পেছনে লেগে থাকে, তাতে বুঝা মুশকিল যে তাদের ভেতরে আদৌও কিছু হবে কিনা।
নীরদ খাতার প্রথম পেইজ উল্টাতেই অর্ঘমা নিজের জিনিসপত্র নিয়ে খাতা রেখেই দৌড়ে চলে গেল। নীরদ সেদিকে বেকুবের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারও খাতা দেখায় মনোযোগ দিল। খাতার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল নীরদ। স্কেচগুলো দেখে মনে হচ্ছে প্রফেশনাল কেউ করেছে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সবগুলো স্কেচ তার। তার বিভিন্ন রকম ভঙ্গিমার ছবিগুলো এঁকেছে অর্ঘমা। স্কেচগুলো ভীষণ পছন্দ হয়েছে নীরদের। তার ঠোঁট কোলে সুক্ষ্ম এক হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। মনে মনে অর্ঘমার আঁকার হাতের অনেক প্রশংসা করল।
গত আধঘন্টা যাবত একটার পর একটা টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে অর্ঘমা বিরক্ত। বিয়েতে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে বসে আছে সে। অথচ তার মায়ের খবর নেই। তিনি এখনো সাজগোজ করতে ব্যস্ত। অভ্র রুম থেকে বেরিয়ে এসে অর্ঘমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
-“বিয়ে কার? তোর নাকি ওই মেয়ের!”
-“আমি সুন্দর আমি জানি। এত পেঁচিয়ে কথা বলতে হবে না তোমাকে।”
-“কে বলল তুই সুন্দর? তুই তো পেত্নী।”
-“তুমি নিজে কি! যেই না চেহারা, নাম রাখছে পেয়ারা।”
-“আমি জানি আমি অনেক হট এন্ড হ্যান্ডসাম। তাই তো আমার গার্লফ্রেন্ড আছে।”
-“তোমার ব্রেকআপ করাতে আমার জাস্ট এক মিনিট লাগবে। এখন বাকিটা তোমার উপর ডিপেন্ড করে।”
-“নিজে একটা বয়ফ্রেন্ড জুটাইতে পারোস না দেখে আমার গার্লফ্রেন্ডের দিকে নজর দিতিছিস!”
-“আমাকে কি তোমার লেসবিয়ান মনে হয় যে তোমার গার্লফ্রেন্ডের দিকে নজর দিব?”
অভ্র কিছু বলার আগেই তার মা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এসে তাড়া দিয়ে বলল,
-“জলদি চল। দেরি হয়ে গেছে অনেক। আপা ফোন দিয়ে পাগল করে ফেলছে।”
-“এত তাড়াতাড়ি কেউ তৈরি হয়? আরেকটু সময় নিতে!”
-“বেশি কথা বলবি না অর্ঘ। নিজে আজকে একটু তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েছিস বলে এত কথা বলছিস। এখন চল জলদি।”
গোমড়া মুখ করে জুতো পড়ে ভাইয়ের সাথে নিচে নামল অর্ঘমা। নিচে নামতেই চোখাচোখি হয়ে গেল নীরদের সাথে। তারাও বিয়েতে যাচ্ছে। বাসার বাড়িওয়ালা হওয়ার সুবাদে দাওয়াত পেয়েছে তারা। অভ্র এগিয়ে গিয়ে নীরদের সাথে কুশল বিনিময় করল। নীরদের চোখ মুগ্ধভাবে তাকিয়ে আছে অর্ঘমার দিকে। মেয়েটাকে ভারি মিষ্টি দেখাচ্ছে। লাল রঙের জামার উপরে সোনালি সুতোয় কাজ করা দারুণ একটা গাউন পরেছে অর্ঘমা। মুখে ভারি মেকাপ আর জামার সাথে মিলিয়ে ম্যাচিং জুয়েলারিতে খুব সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে। নীরদের দৃষ্টি কিছুটা বিব্রত করে তুলল অর্ঘমাকে। সে এদিক সেদিক তাকিয়ে অভ্রকে ডেকে নিল। তাদের সাবধানে আসতে বলে অভ্র অর্ঘমাকে নিয়ে রিকশায় উঠে গেল। তাদের বাবা-মা সামনের রিকশায় চলে গেছে ইতোমধ্যে।
বিয়ে বাড়ি মানেই অর্ঘমার কাছে মাথাব্যথার অপর নাম। আর সেই মাথাব্যথা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তো এখানকার আন্টিরা আছেই। একজনের বিয়ে খেতে এসে পারলে তারা নিজেদের ছেলেমেয়ের বিয়েও করিয়ে ফেলে। শুধু নিজেদের ছেলেমেয়ে না, পারলে এরা বাসার কাজের লোকের জন্যও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। অসহ্য! অর্ঘমা একপাশে চুপচাপ বসে থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে আশেপাশের লোকজনদের কার্যকলাপ দেখছে। অভ্র এখানে এসেই কিছু আন্টিদের কবলে পড়ে গিয়েছিল বলে আপাতত সে নিরুদ্দেশ। আন্টিরা যে কি পরিমাণ ভয়ংকর হয় সেই ধারণা হয়ে গেছে বেচারার। জেনেশুনে নিজেকে বলির পাঠা কে-ই বা বানাতে চাইবে! তাই ভেগে গেছে বেচারা।
পাশে কেউ বসায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে চমকে উঠল অর্ঘমা। নীরদ এসে বসেছে তার পাশে। বিব্রতবোধ করল সে। তার স্কেচবুক নীরদ দেখে ফেলেছে ভাবতেই শরীরে বারবার কাটা দিয়ে উঠছে। না জানে ছেলেটা কি ভাবছে তাকে। অন্য দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইল। নীরদ হালকা গলা ঝেড়ে বলল,
-“মাশাআল্লাহ্।”
অর্ঘমা চোখ বড় বড় করে তাকাল। নীরদ হেসে বলল,
-“তোমার আঁকার হাতের কথা বলছি।”
আবারও মুখ ঘুরিয়ে ফেলল অর্ঘমা। নীরদ কিছুটা এগিয়ে বসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,
-“তোমাকেও কিন্তু দেখতে মাশাআল্লাহ্ লাগছে।”
অর্ঘমা চমকে উঠে শক্ত হয়ে বসে থাকল। নীরদ তা দেখে হেসে বলল,
-“বি ইজি। এমন অদ্ভুত আচরণ করছ কেন? স্কেচই তো করেছ যাস্ট। সত্যি বলতে আমার খুব পছন্দ হয়েছে স্কেচগুলো। আমি তো ভাবছি ওগুলো পেইন্ট করে প্রিন্ট করিয়ে আমার ঘরে রাখবো।”
-“ভদ্রলোকের মতো আমার স্কেচবুক ফেরত দিয়ে দিবেন। কারো পারমিশন ছাড়া তার জিনিসপত্র দেখা ব্যাড ম্যানার্স।”
-“বাহ! আমি তোমার জিনিস হলাম কবে থেকে?”
থতমত খেয়ে গেল অর্ঘমা। আমতা আমতা করে বলল,
-“আমি স্কেচবুকের কথা বলেছি।”
-“ওর ভেতরে তো আমার ছবি ছিল। আর তুমিও কিন্তু আমার অনুমতি ব্যতীত আমার ছবি এঁকেছ।”
-“পৃথিবীতে একই চেহারার ৭ জন মানুষ হয়। আমি তাদের ভেতরে একজনেরটা এঁকেছি।”
-“আর সেই একজনটা আমি।”
-“এঁকেছি তো এঁকেছি। কী করবেন আপনি?”
-“তোমাকে একটা চকলেট দিব। কারণ স্কেচগুলো আমার পছন্দ হয়েছে। তোমার আঁকার হাত কিন্তু দারুণ!”
অর্ঘমা মনে মনে খুশি হওয়ার পাশাপাশি প্রসংশা শুনে কিছুটা লজ্জাও পেল। অনুভব করতে পারল তার গাল গরম হয়ে আসছে। হয়তো লজ্জার লালিমা ছেয়ে গেছে এতক্ষণে গাল জুড়ে। আড়চোখে নীরদের দিকে তাকিয়েই থতমত খেয়ে গেল। নীরদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অর্ঘমা অধর কামড়ে ধরে মিনমিন করে বলল,
-“পানি খাবো।”
নীরদ উঠে গেল পানির খোঁজে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল অর্ঘমা। ছেলেটা যেভাবে তাকিয়ে ছিল তার দিকে, মনে হচ্ছিল চোখ দিয়েই তাকে গিলে খাচ্ছে।
নীরদ পানির বোতল হাতে নিয়ে অর্ঘমার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ অর্ঘমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অকারণে হঠাৎই সে হেসে ফেলল। আর দাঁড়িয়ে না থেকে পানির বোতল নিয়ে এগিয়ে গেল। পাঁচ-সাত হাত দূর থেকেই খেয়াল করল একজন মহিলা এসে পাশে বসলো অর্ঘমার। নীরদ আবারও দাঁড়িয়ে গেল। তার কপালে ভাজ পরলো। মহিলাটির উদ্দেশ্য কিছুটা আন্দাজ করে আর সামনে গেল না। উল্টো ঘুরে অর্ঘমার চেয়ারের পেছনের চেয়ারে গিয়ে বসলো তাদের কথা শোনার জন্য।
পাশে বিয়ে বাড়ির এক আন্টিকে বসতে দেখে অর্ঘমা যারপরনাই বিরক্ত হলো। এখন এই মহিলা হয়তো তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিবে। কিছুক্ষণ পর অর্ঘমার ভাবনাকে সত্যি প্রমাণিত করে মহিলাটি হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
-“তুমি কোন পক্ষ?”
-“মেয়েপক্ষ।”
ছোট জবাব অর্ঘমার। মহিলাটি আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
-“তুমি কী হও কনের?”
-“আমরা একই বিল্ডিংয়ে থাকি।”
-“ওহ আচ্ছা। কিসে পড়?”
-“আপনার ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে?”
থতমত খেয়ে গেলেন মহিলাটি। হালকা বিব্রত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-“হ্যাঁ, কেন?”
-“আমার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজছি তাই।”
মহিলাটি চমকালেন সাথে ভরকালেন। অবাক হয়ে অর্ঘমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“তোমার মেয়েও আছে?”
-“হ্যাঁ। মেয়েটা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।”
-“বলো কি! বয়স কত তোমার? তোমাকে দেখেই তো মনে হচ্ছে না তুমি অনার্সে পড়। তাহলে তোমার মেয়ে অনার্সে পড়ে কীভাবে?”
-“চেহারা দেখে তো সঠিক বয়স সহজে বিচার করা যায় না।”
মহিলাটির ফ্যাকাসে চেহারা দেখে মনে মনে খুব হাসল অর্ঘমা। আচ্ছা শিক্ষা দেওয়া গেছে মহিলাকে। বিয়ে বাড়িতে বিয়ে খেতে এসেছিস। তাহলে বিয়ে খেয়েই বিদায় হ! তা না করে আরেকজনের মেয়েকে নিয়ে টানাটানি করবি কেন তুই? অসহ্য সব লোকজন। মহিলাটি কিছুক্ষণ ইতিউতি করে বললেন,
-“তোমার মেয়েকে দেখা যাবে?”
-“আমার মেয়ে তো বিয়েতে আসেনি। আসলে ওর বিয়ে বাড়ি পছন্দ নয়। এখানের আন্টিদের ও একদম পছন্দ করে না। একজনের বিয়ে খেতে এসে আরেকজনের ছেলেমেয়েকে নিয়ে যখন বিয়ে বাড়ির আন্টিগুলো টানাটানি করে তখন ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তাই ও আসেনি।”
মহিলাটি এবার চুপসানো চেহারা নিয়ে আমতা আমতা করে বললেন,
-“আচ্ছা, তাহলে আমি উঠি। একটু স্টেজের দিকে যাই।”
-“আচ্ছা।”
মহিলাটি তড়িঘড়ি করে সরে পড়লেন অর্ঘমার সামনে থেকে। মহিলাটি চলে যেতেই অর্ঘমা হো হো করে হেসে ফেলল। পেছন থেকে হাসির আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নীরদ বসে পেটে হাত চেপে হাসছে। অর্ঘমা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে নিজেও হেসে ফেলল।
চলবে….
নোটঃ গল্প যাদের কাছে পৌঁছাবে, তারা সবাই রেসপন্স করবেন প্লিজ। পেইজের রিচ অনেক কমে গিয়েছে।