#অস্তিত্ব
#২৭_ও_শেষ_পর্ব
#বনলতা
বাতাসি বিনির খুব কাছের এবং আদরের ছিলো এশা।এশাকে খুব ভালোবাসতেন উনি।স্বভাবে চতুর ও কুটিল হলেও নাতি-নাতনীদের কাছে বাতাসি ভালোবাসাময় আস্থাশীল স্থান।তাদের সকল আবদার হাসিমুখে পুরন করেছে সে।তমালকেও ছোট থেকে খুব আদর,সোহাগ করে কোলেপিঠে মানুষ করেছে বাতাসি।তমালও খুবই ভালোবাসত কিন্তু শেষে এসে সব ওলট-পালট হয়ে গেলো।সকলের মধ্যে এশা ছিলো ছোট।বড়বাড়িতে প্রায় সবসময়ই মৌসুম ফসলের কাজ লেগেই থাকত।যার ফলে নাতি-নাতনীরা বাতাসির সংস্পর্শেই বড় হয়েছে। সবার চেয়ে এশা বাতাসিকে ভালোবাসত বেশি। এশার পড়াশোনা আর স্কুল-কলেজ বাদ দিয়ে সবসময় বাতাসির সাথে থাকত।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ করে বাতাসি মারা যাওয়ার সব এলোমেলো হয়ে যায়।এশা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে।প্রথম থেকেই সে ওর মায়ের থেকে বেশি বাতাসির কাছে থাকা পছন্দ করত।এশা নিজেকে একাকী মনে করতে থাকে।বারবার
হ্যালুসুলেশন হয়।চোখের সামনে বারবার বাতাসিকে দেখতে পেত।অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর ডিপ্রেশনে এশাকে দেড়মাসের মাথায় এ্যাসাইলামে পাঠানো হয়।কারন প্রথমদিকে মানসিক অবস্থা সামান্য খারাপ ছিলো।দেড়মাসে গিয়ে এশা একেবারে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।কাউকে চিনতে পারেনি।কেউ কাছে আসলেই চিৎকার চেঁচামেঁচি করত।এক প্রকার বাধ্য হয়ে এস্যাইলামে পাঠায়।পুরো দুমাস সেখানে রাখার পরে কিছুদিন আগেই বাড়ি নিয়ে আসা হয় এশাকে।আর এর মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে যায়।
_________
পুরো আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা।সাদা সাদা মেঘগুলোকে মনে হচ্ছে পেঁজা তুলা।নিচে দিয়ে কিছু মেঘ ভেসে বেরাচ্ছে আবার চোখের সামনে দিয়ে কিছু মেঘ ভেসে যাচ্ছে। কি অপরুপ দৃশ্য। হঠাৎই সাদা সাদা মেঘগুলো জমে গিয়ে কালো বর্ন ধারন করল।কালো মেঘের পাহাড় থেকে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে জমিনে।জানালা দিয়ে মাটির বসতিগুলো দেখা যাচ্ছে না।দুরে কোথাও একটা শহরকে মনে হচ্ছে শিল্পীর আকা ছবি।এখান থেকে নিচে মেঘ, তার নিচে মাটিতে বৃষ্টি পড়ছে।মেঘ থেকে জমিনে বৃষ্টি পড়ার এমন সরাসরি দৃশ্য কখনও দেখা হয়নি তুলির।তাইত খুব মনোযোগের সাথে এই মেঘ-বৃষ্টির খেলা অভূতনয়নে দেখছে সে।বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য দেশের সীমানায় চলে গেলো ওদের বিমান।তুলি ছোটবেলা ভাবত এক আর অন্য দেশের মাঝে যেমন বর্ডারে তারকাটার বেড়া দেওয়া থাকে ওই আকাশেও বোধহয় এমনই সীমানা নির্ধারণ করা থাকে।সময়ের সাথে সাথে সেই ভাবনাটা পরিবর্তন হলেও আজ আবারও মনে হচ্ছে কেনো নেই এমন তারকাটার বেড়া আকাশেও।ভাবতেই হাসি পাচ্ছে তার।মুখে হাত দিয়ে চাপা স্বরে হাসতে থাকে সে।
তুলির পাশের সিটেই বসে আছে তমাল।চোখদুটো বন্ধ করে গা টা এলিয়ে দিয়েছে সিটের ওপর।ডানহাত দিয়ে চেপে ধরে আছে কপালের শিরা।দপদপ করে জ্বলে যাচ্ছে তারা।একনাগাড়ে কয়েকদিন বিভিন্ন ঝামেলার জন্য না হয়েছে ভালো ঘুম আর না হয়েছে একটু বিশ্রাম নেওয়া।মুখে হাত দিয়ে চাপা স্বরে হাসির শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় তুলির দিকে।আবারও কপালের দুপাশের রগটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে সে।ডুব দেয় কল্পনায়।মাত্র দুইদিন আগের ঘটনা।
এশা মারা যাওয়ার তখন সাতদিন।আসলামকে সেদিনই পুলিশ নিয়ে চলে যায়।কুলখানির দিন বিকেলবেলা আমিনা তুলিকে একেবারে সাথে নিয়ে যেতে চায়।বাধ সাধে তমালের বাপসহ বাড়ির সবাই।আমিনা নাছোড়বান্দা। মেয়ের সুখ ছাড়া সে কোনো কিছুতেই ছাড় দেবে না। অনেক হয়েছে একলা ঘর পাহারা দেওয়া।তমালের যেখানে খুশি যাওয়ার আছে সেখানে যাক।শুধু যাওয়ার আগে যেন ডিভোর্স পেপার এ সাইন দিয়ে যায়।কলির ওপর হয়ে চলে এই মানসিক অশান্তির স্বাক্ষী এই বড়বাড়ির সবাই।আমিনার যুক্তির কাছে সবাই চুপ হয়ে যায়।বৈঠকে সবাই উপস্থিত থাকলেও তমাল নেই।কলি ঘরে ঢুকে দরজায় সিটকিনি লাগিয়েছে। সে যেতে চায়না।কিছুতেই না।নদীর পাড়ের তেতুল তলায় বসে আছে তমাল।ওর পাশেই বসে আছে শামীম।বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে ওরা জেনেছে মাত্র।তমালের এতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।কাল পরশু ওর ফ্লাইট। ওখানে গেলে আবার কর্মব্যাস্তময় জীবন।একঘেয়েমীর জীবনের শুরু।
নদীর উত্তাল স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা।সময় ও নদীর স্রোত কখনও অপেক্ষা করেনা।এইতো সেইদিন আমরা প্রথম স্কুলে গেলাম।প্রাইমারী পাশ করলাম। হাইস্কুলে গেলাম।কলেজে গেলাম।তারপর ভার্সিটি। সময় কত দ্রুত বেয়ে যায় তার খেয়াল কে রাখে। তমাল তেঁতুলের ছোট্ট একটা ডাল হালকা হাতে ঢিল ছুড়ল নদীতে।মুহুর্তেই তা স্রোতের টানে চলে গেলো বহুদুর।একহাত তমালের কাঁধে দিয়ে বলে ওঠে শামীম,
“ভাই জীবন আমাদের সবসময় দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয় না।আমরা তার মুল্যায়ন করিনা যা আমাদের পাশে থাকে।সময়ের স্রোতে যখন তা দুরে চলে যায়,একেবারে ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে।ঠিক তখনই আমরা তার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি।অতীত আঁকড়ে কখনও চলা যায়না। অস্তিত্বহীন অতীত আঁকড়ে ধরে থাকলে বর্তমানের সাথে ভবিষ্যৎ ও নষ্ট হয়।জীবন তোমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে।ওটাকে হেলায় হারিয়ে ফেলোনা।সবাই বারবার সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধান পায়না।কিন্তু তুমি পেয়েছে।এক মায়াময়ীর ভালোবাসা হারিয়ে তুমি দ্বিতীয় বার আরো এক মায়াময়ীর দেখা পেয়েছো।আমি তাকে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়না কলি খারাপ একটা মেয়ে।ভুলে যাও সবকিছু। শুরু করো নতুন করে আবারও সবকিছু। ভুলে যাও ঘুনেধরা অতীত,যা তোমার বর্তমানের সাথে গ্রাস করছে ভবিষ্যৎ, কারো জীবন।জীবনের সব ইচ্ছেই কেনো পুরন হতে হবে।হাজারও প্রাপ্তির মাঝে থাকুক না কি অপ্রাপ্তির শিঁখা, যা মাঝে মাঝে দহন সৃষ্টি করবে।এই দহনেও যে শান্তি আছে।বরই তৃপ্তির দহন এটা।”
তমাল আপন ভাবে আপন ভাবনায় ডুবে আছে।মাঝে মাঝে নিজেই সে আশ্চর্য হয় তুলির কথা ভেবে।মেয়েটা এভাবে কিরে দিন অতিবাহিত করেছে।তবে কি সে তমালকে ভালোবেসে এতদিন অপেক্ষা করেছে।
তমালের কাঁধে মৃদু ঝাঁকুনি দেয় শামীম।স্তম্ভিত ফেরে তমালের।সময় অতিবাহিত হয়ে যায় আরো কিছুক্ষণ। শামীমের প্রতিটা কথা তার কানে বাজছে।এই মুহুর্তে তার ভীষন একা লাগছে।চরম দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে আছে সে।
তমালকে চুপ দেখে আবারও বলা শুরু করে শামীম,
“দেখো আজ যদি মায়া বেঁচে থাকত তাহলে তুমি কি এমনটা করতে।কখনওই নয়।আজ মায়া নেই।পরোক্ষ হোক বা প্রত্যক্ষ ভাবে তুমিই তার জন্য দায়ী।হাজারও মানুষের সামনে চিৎকার মেরে সহস্র যুক্তি দেখালেও আপন মনে নিজের কাছে তুমি নিজেই অপরাধী। পৃথিবীর সবাই চুপ থাকলেও তোমার ওই অবচেতন মনটা বারবার জানান দিয়ে যাবে তুমিই দোষী,তুমিই অপরাধী। আজ আবারও নতুন করে সেই মনের কাছে দ্বিগুন অপরাধী হয়োনা।আজ যদি তুলি চলে যায়।নষ্ট হয়ে যাবে তুলির জীবন।ও তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসে।অন্য কোথাও নতুন জীবন শুরু করলেও তার মনে তুমিই থাকবে।হাজারও চেষ্টায় তা মুছতে পারবে না।যেমনটা তুমি পারোনি আজ অবদি মায়াকে মন থেকে মুছে ফেলতে।প্রথম ভালোবাসা এমনি হয়।কখনও ভোলা যায়না।”
মাথাটা নিচু করে থাকে তমাল।বাড়ির বড় ছেলে ও।ছোট থেকেই যা ইচ্ছে তাই করেছে।কেউ শাসন-বারণ করেনি।কিন্তু আজ সে বুঝতে পারছে মাথায় ওপরে এমন করে বোঝানোর জন্য বড় ভাই নামক শক্ত এক ছায়া মানবের দরকার ছিলো তার।
ছলছল নয়নে শামীম চেয়ে থাকে তমালের মুখপানে।আচ্ছা এই পৃথিবী কি জানে একটা ভাইয়ের কাছে তার বোনের মৃত্যুর খরব কতটা যন্ত্রণাদায়ক।যদি জানত তাহলে তমাল,শাহীন-শামীমের মতো হাজারও ভাইদের কাছে এই নিষ্ঠুর সত্য জানাতো না।
লুকিয়ে রাখতো হাজারও মিথ্যের আড়ালে।
___
তমাল যখন বাড়ি ফিরল সুর্য তখন অস্ত যাওয়ার পথে।পশ্চিমাকাশে লালটে আভা।বাড়ি ঢুকে সরাসরি চলে যায় কলির কাছে।কলি তখন বিছানায় বসা।কাঁদতে কাঁদতে চোখদুটো লাল বর্ন ধারন করেছে।তমালকে দেখে কলি মাথাটা নিচু করে রাখে।তমাল সরাসরি গিয়ে কলির পাশে বসে।তমালকে পাশে বসতে দেখে ভীষণ অস্বস্তি হয় কলির।হবেই বা না কেনো।কখনও তো তাদের এভাবে পাশে বসা হয়নি।চোখে চোখ রাখা হয়নি।আহ্লাদী সুরে আবদার করা হয়নি।
নিশ্চয়ই এখন তমাল কলিকে ওর মায়ের সাথে চলে যেতে বলবে।কথাটা ভাবতেই হু হু করে কান্না পাচ্ছে কলির।কলিকে অবাক করে দিয়ে তমাল এমন কিছুই বলল না।কলির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।কলি মাথা তুলে তাকায় তমালের দিকে।চোখদুটোতে ছলছল করছে অশ্রুমালা।চোখে মুখে হাজারও আকুতি।এই আকুতিভরা ছলছল মুখপানে তাকাতে পারে না তমাল।
মনে মনে অনেক কিছু ভেবে রেখেছে তমাল।কিন্তু বলতে পারছেনা।এত সময় নিয়ে গুছিয়ে রাখা কথাগুলোও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গলার কাছে এসে সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।হঠাৎই এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটায় কলি।তমালকে অবাক করে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কলি।আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায় তমাল।কলির সম্মতিসূচক আলিঙ্গনে বুকের ভেতরের ভারী বোঝাটা হালকা হয়ে যায় তার।
সুন্দরী এক বিমানবালার ডাকে অতীতের ভাবনা থেকে বাস্তবে আসে তমাল।সাদা ট্রে’তে করে কিছু ফ্রুটস আর কোল্ডড্রিংস।
“নো থ্যাকংস” ( তমাল)
মুচকি হেসে চলে যায় মেয়েটি।
___
গায়ের শালটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে ভিডিও অন করে রোজা।লোডশেডিং এ বড্ড বিরক্ত করছে।একে তো ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম।তার ওপর গ্রাম।নতুন ওয়াইফাই এসেছে এখানে।গ্রামে ওয়াইফাই, কথাটা যেনো রুপকথা শোনায়।মুহিন,ইমরান,আশা,শান্তা,রোজা সবাই ভিডিও কলে কথা বলছিলো একসাথে।অনেক দিন পরে তারা আবার ভার্চুয়ালি এক পর্দায়।একটু সময় নিয়ে আবারও নেটওয়ার্ক ঠিক ভাবে পায়।ইমরান বুয়েটে চান্স পেয়েছে। এই একটা দিনের জন্য কতই পরিশ্রম করেছে সে।মুহিন তার মামার সাথে এক্সপোর্ট -ইমপোর্ট বিজনেস এ কাজ করে।ব্যাবসা সম্পর্কে মুহিনের ধারনা কম থাকায় ওর মামা সাথে নিয়ে কাজ শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছে। রোজা ওর জেলাতেই কলেজের প্রফেসর। আশা ওর স্বামীর সহায়তায় নারায়নগঞ্জেই একটা বুটিক হাউজ দাড় করিয়েছে।প্রথম কয়েক দফা লোকসান হলেও শেষ তিন বছরে তড়তড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওর বুটিক হাউজ।সবাই মোটামুটি সাবলম্বী এখন।
“আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস তো সবাই?”(রোজা)
” হুম পাচ্ছি, “(ইমরান)
” শুধু তোকে না কেতুর মা,তোর আন্ডা বাচ্চাকেও দেখতে পাচ্ছি,কথা শুনতে পাচ্ছি”(মুহিন)
” সো সুইট নেম,কেতুর মা?”(শান্তা)
মুহিনের কথায় সবাই হেসে ওঠে।রোজা রাগে ফেটে পড়ে।অনেক দিন পরে সবাই আবার হাসি আনন্দে মেতে ওঠে।এতদিনের বন্ধুত্ব সহজে ভোলা যায়না।দুরত্ব, যোগাযোগ বন্ধেও নষ্ট হয়না বন্ধুত্ব।শুধু ক্ষণিকের ব্যাস্ততায় তার রং ফিকে হয়ে যায়।যা চাইলেই পুরোটুকু না হলেও কিছুটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এই আড্ডায় মায়াকে মিস করে তারা।আড্ডার প্রতিটা কথায় জড়িয়ে থাকে মায়া।বন্ধু মহলের একেকটা বন্ধু একেকটা প্রাণ। এই একজনকে ছাড়া বন্ধুমহলের ভীত অসম্পূর্ণ। হাসি,কান্না,আবেগ-অনুভূতির খেয়ালিপনায় কেটে যায় অনেকটা সময়।হাতের ফোনটা স্ট্যান্ড করে হাতে গিটার নেয় মুহিন।বহু দিন পরে বুকের ভেতরের কষ্টগুলোকে আবারও প্রকাশ করে।আজ বহুদিন পর আবারও কয়েকটা চোখ নয় প্রাণ কাঁদুক।মুহিনের গিটারে সুর তুলে নেয়।পৃথিবীর পাঁচ জায়গায় থেকে পাঁচটি প্রাণ একসাথে গেয়ে ওঠে,
“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা
আজ আর নেই,
আজ আর নেই,
কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালি বিকেলগুলো সেই,আজ আর নেই,
আজ আর নেই……
_______
বর্ষাকালের কোনো এক পড়ন্ত বিকেল।সকাল থেকে এই পর্যন্ত লাগাতার কয়েক দফা বৃষ্টি হয়ে আধঘন্টা যাবদ আকাশটা খালি হয়ে আছে।পুরো আকাশ সাদা হয়ে আছে।সুর্যের লেশমাত্র কোথাও দেখা যাচ্ছে না।চারদিকে কার্দামাক্ত বিশ্রি অবস্থা। উঠোনের পশ্চিম কোনে এক সজনে গাছ।ফুলে ফুলে ভরে আছে পুরো গাছটা।গাছের তলায় সাদা সজনে ফুলে ছেয়ে আছে।ছোট ছোট হাত দিয়ে সেই ফুলগুলো তুলে ছোট্ট এক ডালায় রাখছে মিহু।কাদামাখা ফুলগুলো বাদে সদ্য মাটিতে পড়া ফুলগুলো নিচ্ছে মিহু।সজনেফুল আলু দিয়ে ভাজি খেতে আহ্ কি মজা।মায়ের থেকে অনুমতি নিয়েই ফুলগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে মিহু।মিহু বাড়ির সেজো ছেলে আতিকের মেয়ে।হঠাৎ কই থেকে যেনো এশার মা এসে কাদামাখা ময়লা ফুল এনে মিহুর ডালায় রেখে দেয়।
পাতিলে ডাল সেদ্ধ দিয়েছে তমালের মা।হঠাৎই বাহিরে থেকে মিহুর কান্নার আওয়াজ আসে।তারপরই মিহুর মার গলা ভেসে আসল।চিৎকার মেরে সারা পাড়া এক করে বকাবকি করছে এশার মাকে।পাতিলের ঢাকনাটা সরিয়ে ডালে কয়েকটা কাঁচামরিচ আর খানিকটা নুন ফেলে দিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠোনে আসে সে।মুখটা কাচুমাচু করে এককোণে দাড়িয়ে আছে এশার মা।বিরক্তিমুখে মেয়েকে নিয়ে চলে যায় আতিকের বউ মিশি।এশার মাকে টেনে নিয়ে আসে তমালের মা। রান্নাঘরের ঠায় দাড়িয়ে থাকে সে।ডাইনিং টেবিলে ভাত দিলেও ভাতের থালা নিয়ে মেঝেতে বসে বাচ্চাদের মতো খেতে থাকে এশার মা।তার খাওয়ার দিকে একপলকে চেয়ে তমালের মা।বুকের ভেতরে উথাল-পাতাল করে কষ্টরা।আজ বড়বাড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে।সবার আলাদা আলাদা সবকিছু। রান্নাঘর একটাই তবে প্রত্যেকের আলাদা চুলো, আলাদা সেল্ফ।শুধু অনাদারে পরে আছে এশাদের ভাগ।এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই নিজের আলাদা সংসার,আলাদা রান্নাঘর নিয়ে কতই না শখ ছিলো এশার মায়ের।আজ সবই হয়েছে।কিন্তু ভালো নেই সে।পরপর পাওয়া মানসিক আঘাতে আজ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে এশার মা।
___
চারদিকে মাগরিবের আজান দিয়েছে।মিষ্টি অযু করে এসে নামায পড়ে নিলো।আবারও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কাঁথা মুড়িয়ে পা ঢেকে বিছানায় বসে আছে জাহানারা।নামায শেষে বসে থেকে তজবি পড়ছেন তিনি।এই বৃষ্টির মধ্যেও ছাতাটা নিয়ে দোকানে গেলো মোরশেদ।গরুর গোয়ালে কয়েল দিতে হয় প্রতিদিন।কয়েল নেই। ফুরিয়ে গেছে।মশারি সত্ত্বেও কেমন করে জানি মশা যায় ভেতরে।অবলা প্রাণী মুখফুটে তো বলতেও পারেনা
।মিষ্টি গায়ে ফুলস্লিভ কালো জামাটা পড়ল।বৃষ্টির জন্য হালকা শীত লাগছে।মোবাইল স্কীনটা জ্বলে উঠল সাথে টুং করে শব্দ হয়ে ম্যাসেজ আসল ফোনে।গায়ে জামাটা জড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলো মিষ্টি। নাম্বারটা সেভ করা না হলেও মিষ্টি জানে এটা কার নম্বর।প্রেম-ভালোবাসার কোনো ঠাঁই নেই তার জীবনে।কাউকে ভালোবেসে না পাওয়ার কষ্টে মরার চেয়ে একলা থাকা ঢের ভালো।বিষয়টাকে পাত্তা না দিয়ে এই বৃষ্টির মাঝেও জানালাটা খুলে দিলো মিষ্টি।জামগাছটার গা গড়িয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে।গাছে থোকায় থোকায় জাম ধরে আছে।রাতের অন্ধকারেও নজর কাড়ছে কালো কিষকিষে জামগুলো।তপ্ত এক দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে মিলিয়ে গেলো বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে। বইয়ের সারি থেকে সন্তপর্ণে বের করে মায়ার ডায়রিখানা।এতদিনেও ডায়রিটা নষ্ট হতে দেয়নি সে।বহু কষ্টে আগলে রেখেছে নিজের কাছে।
বাহিরে বৃষ্টির পরিমান বেড়ে চলেছে ক্রমাগত।বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় যেন টিন ছিদ্র হয়ে যাওয়ার উপক্রম। খোলা জানালা দিয়ে শো শো করে প্রবেশ করছে ঠান্ডা বাতাস।এই হীমশীতল বাতাসে খাড়া হয়ে উঠছে শরীরের লোমকুপগুলো।বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে।খোলা জানালার কাছে হীমধরা এই বাতাসের মধ্যে ডায়েরির ওপর মাথা রেখে কাঁদছে মিষ্টি। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। যখন মিষ্টি ছোট ছিলো জাম খাওয়া নিয়ে কতই না মারামারি হতো দুজনের।জাম খাওয়া,ভাজা ডিমের ভাগ,মাছের মাথা এগুলো নিয়ে কতই না বিরোধ ছিলো দুজনের।মায়া বড় হওয়া সত্ত্বেও বিবাদটা তাদের বাধত।কখনও ওদের বাবা ঝামেলা মিটাতো তো কখনও ওদের মা।
আজ বাড়িতে মাছ রান্না হলেও মাথা নিয়ে হয়না কোনো গন্ডগোল। ভাজা ডিমটা আর দুভাগ হয়না।একটা ভাজা ডিম পুরোটাই ঠাঁই পায় মিষ্টির পাতে।কিন্তু এই পুরো ডিমের মধ্যে কোনো স্বাদ খুঁজে পায়না মিষ্টি।কেমন তিক্ত লাগে। সময়ের সবকিছু জাল ছিন্ন করে ইতিহাস পাল্টে যদি মায়া আবার আসত,যদি আবারও মাছের মাথা নিয়ে,ভাজা ডিম নিয়ে ঝগড়া বাঁধত।
ডায়রির প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে মায়ার স্মৃতি, মায়ার গন্ধ খুঁজে পায় মিষ্টি। এই জগৎটা তার একান্ত আপন।এই ডায়রি,এই ঘর,আলমারি সবকিছুতে মায়ার অস্তিত্ব মিশে আছে।মায়াকে একেবারে হারিয়ে যেতে দেয়নি মিষ্টি। মায়া আছে মিষ্টির মনের সবটা জুড়ে আছে সে।মিষ্টি প্রতিটি মুহুর্তে মায়াকে মনে করে।তার যে ওই বোনটাকে বড় প্রয়োজন। ছোটোবেলায় যখন কোনো কিছুতে সে শাসন করত,মিষ্টির রাগ হতো প্রচুর।কিন্তু আজ মিষ্টি মনেপ্রাণে সেই শাসন গুলোকে স্মরন করে অশ্রুমালা বিসর্জন দেয়।
ডায়রির ভেতর থেকে একটা ছবি বের করে মিষ্টি।প্রতিবছর চৈত্রমাসে ওদের ওখানে মেলা বসে।কোনো এক চৈত্রের দুপুরেই তোলা ছবিটি।মায়া তখন ক্লাস টেনে পড়ত।মিষ্টি বোধহয় তখন ওয়ানে কিংবা টুয়ে পড়ে।ছবিটা মুখের সামনে ধরে রাখে মিষ্টি।
হাত দিয়ে চোখের পানিগুলো মুছে কাতর কন্ঠে বলে সে,
“আপু,জানিস তোর মিষ্টি আজ অনেক বড় হয়েছে।মাছের মাথা বিনা ঝগড়ায় আমার গলা দিয়ে নামে না রে।তুই আয় একবার।জানিস আমি না একা একা পুরো ডিম খেতে পারিনা।তুই আয় না একবার।বিশ্বাস কর আর কখনও মাছের মাথা নিয়ে ঝগড়া করব না।ভাজা ডিম নিয়েও না।সব তুই খাস।তবুও একবার আয় না রে।আমার তোকে বড্ড প্রয়োজন।”
ডুকরে কেঁদে ওঠে মিষ্টি। এই কান্নাতে মেতে আছে পুরো প্রকৃতি।চারদিকে চাপাকান্নার শব্দ মনে হয় ঝড় তুলেছে।মিষ্টির কান্নার শব্দ ছাপিয়ে জোড়ে কোথাও বাজ পড়ে।বৃষ্টির তোড় কখনও বাড়ে কখনও কমে।শুধু কমে না বুকের ভেতরে রাখা কারো রক্তক্ষরণ স্মৃতির মরন যন্ত্রণা।
~সমাপ্ত~