#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ১৫
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম
কিরণের আজ কান্না দিবস। বিরতিহীনভাবে সে বাচ্চাদের মতো কেঁদে রীতিমতো ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছে। ফুপিয়ে যাচ্ছে শ্বাসকষ্ট রোগীর মত। আর তার সামনেই অসহায়ের মতো বসে আছে অর্ণব। সে যে চেষ্টা করে নি ব্যপারটা তেমন একদমই না। তার সকল চেষ্টায় শ বালতি খানেক পানি ঢেলে কিরণ নিজমতো কেঁদেই যাচ্ছে। চোখ নাক ফুলে বিচ্ছিরি অবস্থা। তার শুধুমাত্র একটাই দাবি তাকে আদর করতে হবে। অর্ণব বেচারার মতো ফেসে আছে। কিরণের দাবি মানলেও মারাত্মক ঝড় ওঠবে আর না মানলেও এই মুসিবত যাবে না। কোনো ভাবে ঘুমটাও আনানো যাচ্ছে না, আর না পারছে নেশা কাটানোর ঘরোয়া টোটকা খাওয়াতে। অর্ণবের মনে হলো এমন সংকটে বোধ হয় সে কোনোদিন পড়ে নি। কিছু একটা করতে হবে। কিরণের শরীরও খারাপ করার শতভাগ আশঙ্কা রয়েছে। অর্ণব বাহিরে তাকালো। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। এলোমেলো হাওয়া বইছে বাহিরে। বোধ হয় বৃষ্টি হবে। বিগত দিনের খরার বিপরীতে বারিধারা ঝড়বে মুষলধারে। সকল ময়লা ধুয়ে নিঃশেষ হবে। হয়তো এইভাবে তার জীবনেও এক ভারি বর্ষণের আগমন ঘটবে। এখনকার সকল দ্বিধা দন্ড ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে অন্যত্র। জীবনে ভোরের মতো নতুন সূর্য ওঠবে। স্বচ্ছ, সুন্দর প্রভাত আসবে।
বাতাসের প্রভাবে জানালা স্বজোরে বারি খেলো। বারির শব্দে ভাবনায় ছন্দপতন হলো অর্ণবের। কিরণের দিকে তাকালো। মেয়েটাও তার দিকেই তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে। অর্ণব আরেকটু এগিয়ে বসলো। কিরণের দু গাল আলতো করে ধরতেই অদ্ভূত ভাবে কিরণের কান্নার বেগ আরো বাড়লো। অর্ণবের কেন যেনো মনে হচ্ছে কিরণের ভেতরটা জ্যাম হয়ে আছে। সে চাইছে হালকা হতে কিন্তু পারছে না। অর্ণব কিরণের কপালে গভীর চুম্বন দিতেই কিরণ জড়িয়ে ধরলো অর্ণবকে। অর্ণবের গেঞ্জিটার এক পাশ ইতিমধ্যে ভিজে ওঠেছে। মাথায় আলতো করে হাত রেখে বুক থেকে মাথা ওঠিয়ে দিলো। একটু সরে বসলো। এরপর কিরণের হাতের দু বাহু ধরে নিজের কোলে মাথা রেখে শুয়ে দেয়। কিরণও বাধ্য মেয়ের মতো অর্ণবকে অনুসরণ করে যায়। সোফাটায় পা মেলানো যাচ্ছে না। তাই মুড়িয়ে শুয়ে রইলো কিরণ। অর্ণব আলতো করে চুল বিলি কেটে দিচ্ছে। তার ফাঁকে কিরণকে কমল ভাবে ডাকে। কিরণ ওর মুখটা সোজা শুয়ে পরে। অর্ণবের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকায়। অর্ণব পুনরায় কিরণের চুলের মাঝে চুমু দিয়ে প্রশ্ন করে,
আমি তোমায় সেদিন খুব কষ্ট দিয়েছিলাম তাই না?
অর্ণবের আদুরে কন্ঠে কিরণ আবারো ঠুকরে কেঁদে ওঠে। কান্না জড়িত কন্ঠ নিয়ে উত্তর দেয়,
হ্যা তো! খুব। জানেন আপনি সেদিন যখন আপনি আমাকে কলেজের বট গাছটায় আসতে বলেছিলেন তখন আমি ভেবেছিলাম অবশেষে আপনি আমায় বলবেন আমায় ভালোবাসেন। হৃদ, তিন্নি, আমার বাকি বান্ধবীরাও বলেছিলো এইটা। তার আগের দিন রাতটা আমি নির্ঘুম কাটিয়ে ছিলাম। উত্তেজনায় চোখের পাতা এক করা ছিল দুষ্কর ব্যপার। মনে হচ্ছিল ঘড়ির কাটার গতি কেউ ধীর করে দিয়েছে। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে গিয়ে যখন ওঠে দেখলাম দেরি হয়ে গিয়েছে তখন ঝড়ের বেগে রেডি হয়ে স্কুলে চলে গিয়েছিলাম। ক্লাসগুলোও অসহ্য লাগছিল। আপনাকে দেখার, কথা বলার, এতোদিনের না বলা প্রেমের ব্যক্ত মুহুর্তের জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠেছিলাম। আচ্ছা আপনার মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা?
অর্ণব মুচকি হাসলো। যা কোনোদিন ভুলে নি তা নতুন করে মনে করার প্রশ্নই আসে না।
অর্ণব ও কিরণ একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিল। স্কুল ও কলেজ একই সাথে। কিরণ তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। অর্ণব উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। একই প্রতিষ্ঠানে হলেও কাকতালীয় ভাবে ওদের দেখা কখনো হয় নি। তবে কিরণের খুবই ইচ্ছে ছিল সে দেখবে অর্ণবকে। অর্ণব কলেজে ওঠে সেই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। ভালো ছাত্র হওয়ার দরুণ শিক্ষকদেন প্রিয় হতেও খুব বেশি সময় লাগে নি। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়ায় খ্যতি ছড়ায় আরো বেশি। অমায়িক ব্যবহারের জন্য শিক্ষকদের কাছে, সহযোগীপূর্ণ হওয়ায় সহপাঠীদের নিকট এবং আকর্ষণীয় হওয়ায় কিশোরীদের নিকট বেশ জনপ্রিয় হয়। তবে কিরণের অর্ণবকে দেখার আকর্ষণ কারণ এদের মধ্যে একটাও নয়। কারণের সৃষ্টি হয় প্রতিহিংসা থেকে। কিরণের উপস্থাপন ভঙ্গিমা শুরু থেকেই অতুলনীয়। ছোট্ট থেকেই প্রতিষ্ঠানের যেকোনো ধরনের অভ্যর্থনা পাঠ করার ভূমিকা সে খুবই পটুত্বের সাথে পালন করতো। সেই বারও এলাকার নতুন এমপিকে ক্রিড়া অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে অভ্যর্থনায় তার পাঠ করার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তা পরিবর্তন করে দেওয়া হলো অর্ণবকে। কিরণের কিশোরী মন অভিমানে আর অনুষ্ঠানেই গেল না। পরদিন স্কুলে যেতেই শোরগোল শোনা গেল। সকল যায়গা অর্ণবের প্রশংসায় ম ম করছে। অর্ণব দারুণভাবে তার স্থান দখল করে অভ্যর্থনা পঠ করেছে। পুরো অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। তার কথা বলার ভঙ্গিমায়, কন্ঠের অধিক সুনাম শোনা গেল কিশোরীদের কাছ থেকে। সেই থেকে শুরু হলো অর্ণবকে দেখার আগ্রহ। ভবন আলাদা হওয়ায় অর্ণবকে খুঁজে বের করা কিরণের নিকট একটু কষ্টেরই ছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন কলেজ ভবনের বারান্দা দিয়ে হাঁটছিল কিরণ ও তিন্নি। তখনই পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠলো,
এই কোঁকড়া চুল! স্কুল ড্রেস!
কিরণ পেছন ফিরলো। স্কুল ড্রেসে আপাতত এখানে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু কোঁকড়া চুল! এ আবার কেমন ডাক? কিরণ ভ্রু কুচকে পিছন ঘুরে তাকালো। তার সামনে বেশ লম্বা সুদর্শন এক ছেলে দাঁড়ানো। সাদা হাফ হাতা শার্ট। হালকা নীল রঙ্গের প্যান্টের সাথে কালো সু। এইটা ওদের কলেজের ইউনিফর্ম। দু পকেটে হাত রেখে সোজা দাঁড়িয়ে আছে। চোখের সরু দৃষ্টি কিরণের কিশোরী মনে বিঁধে লাগলো। ছেলেটি ওভাবে দাঁড়িয়েই বলে ওঠলো,
কোন ক্লাসের স্টুডেন্ট?
কলেজের বড় ভাই দেখে কিরণ নম্রতার সহিত উত্তর দিলো,
এইট।
কলেজ ভবনে স্কুলের ছাত্রী হয়ে এরকম ভুতের মতো ঘুরছো কেন? ক্লাস নেই?
না ভাইয়া। টিফিনের বিরতি চলছে।
কাউকে খুঁজতে এসেছো?
কিরণ একবার তিন্নির দিকে তাকালো। তিন্নি বরাবরই ভিতু প্রকৃতির। মাথা দিয়ে বারণ করার পরও কিরণ ওর দিকে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে সামনের ছেলেটাকে বলে,
জ্বি ভাইয়া! দ্বিতীয় বর্ষের অর্ণব নামের একজন ভাইয়াকে খুঁজতে এসেছি।
কিরণের উত্তরে ছেলেটির কপালে ভাজ পড়লো। কন্ঠে গম্ভীরতা নেমে এলো।
অর্ণবকে চেনো কিভাবে? কে হয় তোমার?
কিরণ হেসে অকপটে জবাব দিল,
আমার মামাতো ভাই হয় আবার বয়ফ্রেন্ডও। আপনি কি একটু বলতে পারবেন ওনার শাখাটা কোনদিকে?
কিরণের জবাবে ছেলেটির মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়লো। কিরণকে সরু চোখে পা থেকে মাথা অবদি দেখে নেয়। এরপর ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
কিন্তু আমার তো কোনো ফুফাতো বোন এখানে পড়ে না। আর আর যে প্রেমিকা আছে সেটাও জানা ছিল না।
কিরণের চোখ অবাকে গোল গোল হয়ে গেল। তার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিই অর্ণব। তিন্নি ভয়ে কিরণের হাত ছেড়ে পিছন ঘুরে এগিয়ে গেল। কিরণ পড়ে গেল মহা ঝামেলায়। ছোট্ট মস্তিষ্ক কিভাবে দুষ্টুমি করতে হয় জানলেও ধরা খেলে সামলাতে হয় কিভাবে তা জানে না। তবুও চেষ্টা করতে জোর করে হেসে বলে,
না না আপনার কথা বলি নি। আরেকটা অর্ণব আছে।
নেই। দ্বিতীয় বর্ষে আমি ছাড়া আরো কোনো অর্ণব নেই।
এবার কিরণ পরলো ভিষণ ফেসাদে। ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো। অর্ণব যদি তাকে ধরে নিয়ে যায় শিক্ষকদের কাছে তাহলে কি হবে? ভয়ে ভয়ে অর্ণবের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই অর্ণবের কঠিন মুখশ্রী দেখে আরো সিঁটিয়ে গেল। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে তওবা করে নিল। এরকম কাজ বেঁচে থাকতে আর করবে না। শুধু এবার বাঁচিয়ে দিক। আমতা আমতা করতেই হঠাৎ অর্ণব ঝুকে গেল। কিরণও ভয়ে পিছিয়ে গেল। অর্ণবকে অনুসরণ করে নিচে তাকাতেই দেখলো অর্ণব কিছু একটা কুড়িয়ে নিল। অর্ণব সোজা দাঁড়িয়ে ডান হাতটা এগিয়ে দিতেই দেখতে পেলো ওর হাতের স্বর্ণের ব্র্যসলেটটা। তৎক্ষনাৎ কিরণ নিজের বাম হাত চেক করে দেখলো তার হাত ফাঁকা। কিরণের বাবার দেওয়া খুবই বিশেষ একটা উপহার এইটা। বিলম্ব না করে কিরণ একপ্রকার থাবা দিয়েই ব্র্যসলেটটা নিয়েই দৌড়ে পালিয়ে যায়। পালালেই যেন বাঁচে সে । দৌড়ে সিড়ির কাছে আসতেই হাসির শব্দে পেছন ফিরে। অর্ণব কোমর ধরে হাসছে। কিরণের কিশোরী মন থমকে যায়। হৃৎস্পন্দন লাফিয়ে যেন বাহিরে এলো বলে। অদ্ভুত, অজানা অনুভূতির সাথে পরিচয় হয় সেদিন। বসন্তের প্রথম কুড়ি অংকুরিত হয় কিশোরী মনে। সব ভুলে শুধু চোখে ভাসতে থাকে অর্ণবের চমৎকার হাসি, চোখের ধারালো দৃষ্টি।
চলবে~