বিপরীতে তুমি আমি পর্ব ১৪

0
645

#বিপরীতে_তুমি_আমি
#পর্বঃ১৪
#লেখনি_সুমাইয়া_ইসলাম

কিছুক্ষণ হয়েছে মাত্র মেহরাব নিজের ঘরে এসে বসেছে। কিরণের জন্য বিকেলের দিকে এ বাড়িতে এসেছিল। কাজ শেষে যদিও চলে যাওয়ার সময় তার ছিল কিন্তু মন বাধ্য করেছে থেকে যেতে। আসার কারণ কিরণ হলেও থেকে যাওয়ার কারণ জান্নাত। মাঝের চারটা দিন জান্নাতকে দেখতে পায় নি। নিজের বাড়ি ফিরার পর আর সুযোগ হয় নি প্রিয়তমাকে দেখার। দেখা হওয়ার পর সে তৃষ্ণা বেড়ে গিয়েছিল। তৃষ্ণা মেটানোর লোভটা সামলাতে পারে নি। মনের অবাধ্য হওয়ার স্পর্শধা আর করে ওঠতে পারে নি। তাই থেকে যাওয়াই বাঞ্চনীয়। কিন্তু অফিসের কিছু কাজও রয়েছে যা সম্পূর্ণ করাও অপরিহার্য। নিচে জান্নাতের সাথে চা খেতে খেতে হঠাৎ ফোন পেয়ে সোজা ঘরে চলে এসেছে। সম্প্রতি একটা কেইস হাতে এসেছে। সুরক পেতে বেগ হচ্ছে। চারদিকে লোক লাগিয়ে তারই সন্ধানে আছে। ফোনে কথা শেষে কিছু ডকুমেন্টস চেক করতে টি টেবিলে রাখা ল্যপটপটা হাতে নিল। সোফায় গিয়ে দু পা সটানে মেলে দিয়েছে। পিঠে কুশান দিয়ে আরামে বসেছে। কোলে রাখা ল্যপটপটি। ল্যপটপটি খোলা মাত্রই আচমকা জোড়ে দরজা খোলার শব্দে চমকে ওঠলো মেহরাব। মনিটরে হাত রেখেই চোখ তুলে তাকালো দরজার দিকে। জান্নাত দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অদ্ভুত সে ভঙ্গিমা। কোমরে দু হাত দেওয়া। গাল ফুলে টইটুম্বুর বলা চলে। রাগ দেখানোর যেটুকু চেষ্টা চোখে মুখে রয়েছে তার ফোলানো গাল সেই টুকু চেষ্টাতে বৃথা করেছে। ডাগর ডাগর চোখ দুটোই হালকা লাল। জান্নাতকে ডাক দেওয়া ছাড়া মেহরাব কখনো তার ঘরের ত্রিসীমানাতেও দেখতে পায় না। আজ হঠাৎ সোজা ঘরে দেখে অবাক হলো। উপরন্তু এতো জোরে দরজা খোলা এবং অস্বাভাবিক চিত্র। অবাকে চোখখানা বড় বড় হলো। পর মুহুর্তে জান্নাতের লাল চোখে দেখে চোখের আকার সরু হলো। মেহরাব অবস্থান পরিবর্তন না করেই পূর্বের মতই স্বাভাবিক ঝারির ভঙ্গিতে বললো,

দিনে দিনে ভারি বেয়াদপ হচ্ছিস। এইভাবে অন্যের ঘরের দরজা খোলা কি ধরনের আদব? নক করা শিখিস নি?

না শিখি নি। শিখবোও না। বেশ করেছি খুলেছি জোরে। আবারো খুলবো। চারশবার খুলবো। তোর কি? তুই যে মিনিটে মিনিটে আমাকে ডেকে কাজ করাস সেইটা কোন ধরনের ভদ্রতা? এই আদব দিয়েছে তোর বউ? ও হ্যা বউ… আমি কি তোর বউ যে আমাকে দিয়ে এতো কাজ করাস? আমি ছোট বলে এতো অত্যাচার করিস আবার আমাকে বেদ্দপ বলিস? তুই বেদ্দপ, তোর বউ বেদ্দপ, তোর আঠারো গোষ্ঠী বেদ্দপ। এই ছোট মানুষ তোকে অভিশাপ দিচ্ছে জীবনে ভালো বউ পাবি না। তোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গ্রফাইট বানিয়ে দেবে এমন বউ পাবি। খারুছ, রাক্ষস বেটাআআআআআআ!

জান্নাত মেহরাবের দিকে আঙ্গুল তাক করে এক নাগারে কথা বলে আবারো কোমরে হাত দিলো। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হাঁপিয়ে ওঠেছে খুব। নিজের স্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। অবস্থান তার আগের যায়গায়ই। মুখোভঙ্গি পরিবর্তন হয় নি এতটুকুও। কিন্তু তার বিপরীত পাশের মানুষের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে সম্পূর্ণ রূপে। জান্নাতের বুলেটের মতো কথা যেন তার মাথার প্রায় চার ইঞ্চি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কান রীতিমতে বাংলা তালা লেগেছে। কি বলে গেলো এতোক্ষণ এ মেয়ে? অবিশ্বাস্য চাহনিতে জান্নাতের দিকে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ল্যপটপ সরিয়ে নেমে ধপাধপ পায়ে এগিয়ে গেলো জান্নাতের দিকে। মেহরাব এগিয়ে যেতেই জান্নাত হঠাৎ দৌড়ে চিৎকার করে ওঠে,

আম্মুওওও! রাক্ষস খেয়ে এলোওওও

মেহরাব আরো একবার অবাক হলো। তবে অবাক হলেও পেছন থেকে দ্রুত জান্নাতের হাত ধরে ফেলেছে। এক হাত দিয়ে মুখ চেপে আরেক হাত দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরেছে। মেহরাবের বলিষ্ঠ দেহের মাঝে জান্নাতের ছোট্ট, নরম দেহখানা পেরে ওঠে না। ব্যর্থভাবে মুচড়ে ওঠলেও মেহরাব পরিশ্রমহীন ভাবে জান্নাতকে একপ্রকার কোলবালিশের মতো উঁচু করে নিজের ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে। জান্নাতে রুমে এনে ছেড়ে দিয়েছে। দরজাটাও বন্ধ করে নিয়েছে। জান্নাত রুমে এসে ছাড়া পেতেই পুনরায় চিল্লানোতে মেহরাব জোড়ে সোড়ে ধমকে উঠলো। এ ধমক জান্নাতের কাছে মনে হলো বুঝি কোনো দৈত্য তার সামনে দাঁড়িয়ে গর্জে ওঠেছে। ভয়ে নিচে পা ছড়িয়ে বসে পড়লো। ঠোঁট বেকিয়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠতেই মেহরাব বেকুব হয়ে গেল। জান্নাতের অস্বাভাবিক আচরণে সে নির্বাক হয়ে গিয়েছে। কি বলবে কি করবে? জান্নাত বাচ্চাদের মতো কেঁদেই যাচ্ছে। নাক টেনে যাচ্ছে ক্রমাগত। মেহরাব বোকা হয়েই জান্নাতকে ধরে উপরে বসাতে চাওয়ায় জান্নাত পুনরায় চিল্লিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে,

তু তুমি তুমি বটগাছের দৈত্যের মতো চিল্লালে কেন? আমার আত্মা তো ওড়ে চলে গেল। আমি এখন মরে যাব। আমার জামাই বিধবা হয়ে যাবে।

ননসেন্সের মতো কথা বলবি না। কি আজে বাজে বকছিস? কি হয়ে..

মেহরাবের ধমকে জান্নাত আবারো কুচকে গেল। মেহরাব জান্নাতের ভয় পাওয়া দেখে থেমে যায়। নরম হয়ে পুনরায় জান্নাতের দু বাহু ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয়। জান্নাত তখনও ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মেহরাব দু হাঁটু গেড়ে সামনে বসে পড়ে। আলতো করে দু গালের পানি মুছিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,

কি হয়েছে জান? এমন করছিস কেন? এইভাবে কান্না করছিস কেন? আমার ওই টুকু ধমকে এতো কান্না করিস নি তো আগে।

জান্নাত লম্বা করে নাক টেনে কান্না জড়িত কন্ঠেই বলে,

তুমি ভাবিকে স্পেশাল জিনিস এনে দিসো। আমাকে দাও নাই। ভাবি কত্ত ভালোবাসে বলে ওই জিনিস দিয়ে শরবত বানিয়ে খাইয়েছে। কিন্তু ওই জিনিস একদম পঁচা। ভাবির শরবত পঁচা বানায়ে দিছে। আমার একটু ভাললাগছে আবার একটু খারাপ লাগছে। কিন্তু এখন আরো খেতে মন চাচ্ছে।

জান্নাতের কথায় মেহরাবের মাথায় বাজ পড়লো। পিচ্চি এই মেয়েটা এতক্ষণ নেশার প্রভাবে বিরূপ আচরণ করে যাচ্ছে। মাথার ভেতরটা হ্যং হয়ে গেল যেন মুহুর্তেই। জান্নাতের দিকে অসহায় হয়ে তাকায়। এজন্যই যে মেয়ে টু শব্দ করতে পারে সে মেয়ে এতো বড় বড় কথা বিনাবাধায় বলে গেল। কিন্তু হঠাৎ কিরণ ওকেই শরবতটা খাওয়াতে গেল। মেহরাব জানতো কিরণ ও অর্ণব সংক্রান্ত আভ্যন্তরিন বিষয়ের ক্ষেত্রে কিরণ ওই দ্রব্য ব্যবহার করবে। তারমাঝে জান্নাত কেন ফেঁসে গেল তার উত্তর জানতে ব্যকুল হয়ে এলো মেহরাবের মন।
জান্নাত ওর ভেজা ভারি পল্লব দিয়ে ডাগর ডাগর করে তাকিয়ে আগে মেহরাবের দিকে। মেহরাব এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে যাচ্ছে। হঠাৎ হাতে সূক্ষ ব্যথা পেতেই মেহরাবের চিন্তা ভাঙ্গে। জান্নাত চিমটি দিয়েছে। চিমটি দিয়েই গাল ভরে হেসে উঠে। মেহরাব খেয়াল করলো জান্নাতকে মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। মুখের লাল আভা যেন সেই সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছি। চোখে জান্নাতের সারা মুখে বিচরণ করে। লাল হয়ে আসা নাক আর উল্টে ফেলা ঠোঁটের দিকে চোখ পড়তেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় মেহরাবের। অদৃশ্য চৌম্বকের আকর্ষণ অনুভব করছে। নিজের অনৈতিক টানে নিজের কাছেই ভীষণভাবে লজ্জিত হলেও পরক্ষণেই মন বেহায়ার মতো আবারো নিষিদ্ধ চাহিদায় মেতে ওঠতে যায়।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাকে মনের অবাধ্য হতেই হবে। মস্তিষ্কের কথা শুনতে হবে। বিলম্ব না করে মেহরাব জান্নাতের সামনে থেকে ওঠে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস প্রক্রিয়া চালিয়ে জান্নাতের দিকে ঘুরে তাকায়। মেয়েটা এখনো একই ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি অদ্ভুত! এইভাবে তাকানোর কি আছে? অপর পাশের মানুষ তার এই চাহনিতেই যে বেসামাল হয়ে পরে। মেহরাব ইতিমধ্যে মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। তুমুল পর্যায়ে আছে। জিততে হলে রুম ত্যাগ করতেই হবে। সিদ্ধান্ত নিতেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। বাহির থেকে দরজা আঁটকে নিচে নেমে গেল রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে। একটাই কাজ, জান্নাতের নেশা কাটিয়ে নিজের নেশায় বাঁধ লাগানো।

শুধুমাত্র কালো রঙের একটা শার্ট পড়ে কাবার্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিরণ। তার হাতে ফোনের টর্চ জ্বালানো। সারা ঘরে এছাড়া বিন্দু মাত্র আলো নেই। তার সামনে কাবার্টের কাচের গ্লাসটা সম্পূর্ণ খোলা। পায়ের নিচে পড়ে আছে বেশ কয়েটা জামা কাপড়। অর্ণবের পায়ের শব্দে কিরণ হাতের লাইট টা অর্ণবের দিকে তাক করে ড্যব ড্যব করে কেবল তাকিয়েই রইলো।

এদিকে অর্ণব ঠায় দাঁড়িয়ে। প্রেয়শীর আবেদনময়ী চিত্রে রক্তকণিকায় যেন শিহরণ জেগে যাচ্ছে। নিউরন কেঁপে কেঁপে ওঠছে। হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যাচ্ছে সময়ের গতির দ্বিগুণ হারে। হাতে থাকা লেবুর রসের গ্লাসটা শক্ত করে চেপে ধরলো। তার অনুভূতি তো বৈধ তবুও কেন বেড়াজালে আটকে পড়ছে তারা? বিবেকের জন্য! অর্ণব কিরণকে চায় তার সম্মতিতে, তার সঞ্জানে। কিরণ তাকে ভালোবাসে তাতে তিল পরিমাণের সন্দেহ অর্ণবের নেই। কিন্তু আজ তাদের ভালোবাসার মাঝে শক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে অভিমানের দেয়াল। অর্ণব ঢোক গিয়ে কাঁপা পায়ে রুমে প্রবেশ করলো। রুমের লাইট জ্বালাতেই কিরণকের চোখ কুচকে এলো। দৃশ্যমান হলো রুমের চিত্রও। ঘরময় পোষাকের ছড়াছড়ি। কিরণ নিজের সব পোষাক বের করে কিছু সোফায়, কিছু বিছানায়, কিছু নিচে ফেলে রেখেছে। অর্ণবের পোষাকও বাদ পড়েছি তা থেকে। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে। হাতের গ্লাসটা বেড টেবিলে রেখে নিচে ফেলে রাখা জামাগুলো উঠিয়ে চলে গেলো কিরণের কাছে। অর্ণবকে কাছে আসতে দেখে কিরণের ঠোঁট দেখা মিললো চওড়া হাসি।

দেখেন তো! আমায় কেমন লাগছে? সুন্দর না?

কিরণের কন্ঠে মাদ*কতার টান পেলো। চোখের দৃষ্টিটাও কেমন নেশালো হয়ে ওঠেছে। বুকের উপরের দুই বোতাম খোলা। যার ফলে বুকের ডান দিকের লাল এক তিল জ্বলজ্বল করছে । অর্ণবের মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। কিরণকে খেয়াল করতেই নিজের ভেতর ভেতর ক্রমশ বেসামাল হয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু তাকে যে অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। আর কোনো ভুল বোঝার আশঙ্কা সে রাখতে চায় না। অর্ণব লম্বা শ্বাস নিল। শুষ্ক ঠোঁটটা জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে চোখে মুখে কাঠিন্যতা ফুটিয়ে বলে,

মোটেও ভালো লাগছে না।

হাতে থাকা কিরণের একটা জামা এগিয়ে দিয়ে পুনরায় বললো,

নিজের জামা পড়ে এসো। এসব পঁচা জামা পড়তে হয় না।

কিরণ ভ্রু দুটো কুচকে ফেললো। তৎক্ষনাৎ গাল ফুলিয়ে বললো,

না! এইটা সুন্দর জামা। আমায় সুন্দর লাগছে। তুমি আমায় হিংসা করছো তাই না? তোমার জামা তোমার থেকে বেশি আমায় সুন্দর লাগছে। আচ্ছা যাও! আমি না ইট্টু পরেই দিয়ে দিবো তোমাকে।

কিরণের কথায় অর্ণবের হাসি পেলো। কিন্তু তা দেখাল না। কিরণকে ঠিক করা এখন বেশি প্রয়োজন। ওকে সামলানোর থেকে বেশি দরকার নিজেকে সামলানো। কিরণ তো সপেই দিচ্ছে কিন্তু অজান্তে। তাই নিজেকে আটকে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অর্ণব নিজের অনুভূতি চেপে কিরণের কাছে চলে এলো। একহাত ধরে টেনে ধরতেই কিরণ নিজের আরেক হাত তার উপরে রেখে পিছনে হেলে পড়ে। অর্ণব পেছনে তাকালো। চোখ দুটো সরু করতেই কিরণ চিল্লিয়ে বলে ওঠে,

দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনি না ঘুরছেন! আমার মাথার ভেতরও ঘুরছে। ওই ছাদ ঘুরেছে। আমার পা ঘুরছে। আমি কিভাবে হাটবো?

কিরণের কন্ঠ কান্নায় জড়িয়ে গেল। নাক টেনে হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো। অবাক হয়ে বলে,

আল্লাহ! আপনার হাত কতগুলো হয়ে গেছে। এতোগুলো হাত আপনার? আল্লাহ! এখন আমার কি হবে?

অর্ণব কিরণের প্রতিটি প্রতিক্রিয়া মনোযোগ সহ দেখে গেল। তার প্রেয়সীর যে এতো সুন্দর আরো একটা রূপ আছে তা হয়তো এমন ঘটনা না ঘটলে জানা হতো না। অর্ণবের ইচ্ছে হলো এ সময়টাকে ফ্রেমে বন্ধি করতে রাখতে। এ সময় যখন স্মৃতি হয়ে যাবে তখন সে নীরবে, একান্তে এ স্মৃতিচারণ করবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো সে কাজ করার মানুষ নেই এবং আনাও সম্ভব নয়। তাই আর না ভেবে অর্ণব স্বাভাবিকভাবে কিরণকে বলে,

কিছুই হবে না তোমার। ঠিক হয়ে যাবে। আসো আমার সাথে। যাদু করে ঠিক করে দিচ্ছি।

কিরণ বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ আসলো। দু বাহু ধরে বসিয়ে দিল বিছানায়। নিজেও বসে পড়ে কিরণের সামনে। বা হাত দিয়ে টেবিলে রাখা গ্লাসটা কিরণের সামনে ধরে নরম গলায় বলে,

এইটা পুরোটা শেষ করো। দেখবে সব ঘুরা বন্ধ হয়ে যাবে।

কিরণ দু হাত দিয়ে গ্লাস ধরে। লেবুর রসটা খানিকটা মুখে দিতে চোখ মুখ কুচকে গ্লাসটা টুক করে ফেলে দেয়। ঘটনার আকষ্মিকতায় অর্ণব চমকে ওঠে। গ্লাসের দিকে তাকিয়ে কিরণের দিকে তাকায়। ফোস করে নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজের কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুল গুলো আঙ্গুল দিয়ে পেছনে ঠেলে দিতেই কিরণ শার্টের কলারটা কাঁধের দিকে নামিয়ে বলে ওঠে,

আমার গরম লাগছে।

কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কিরণের আগের রূপই কি কম ছিল যে এখন সে আবার এমন রূপ দেখাচ্ছে! কাঁধের কাপড় সরিয়ে ফেলতেই সেখানে অবস্থিত ছোট এক কালো তিল আবারো নজরে পরলো। অর্ণব শীতল চোখে চেয়ে রইলো। আগুনের পাশে মোম রাখলে মোম গলবেই। অর্ণবের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। শুষ্ক এক ঢোক গিয়ে ঝুকে গেল কিরণের দিকে। এক হাত দিয়ে কিরণের কোমর চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। অপর হাত গুজে দিলো ঘাড়ের চুলে মাঝে। বুকের পাশের লাল তিলটায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। কিরণের সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। অর্ণবও অনুভব করলো কিরণের শরীরের কাঁপন। কিরণের অবচেতন মন উষ্ণতায় অর্ণবের জামা আঁকড়ে ধরলো। অর্ণবের স্পর্শ ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগলো। বুকের তিল থেকে কাঁধের তিলে দীর্ঘ সময় চুমু দিয়ে গলা দিয়ে ওঠে এলো অধরে। বিপরীত শক্তির আকর্ষণের মতো অর্ণবের অধর জোড়া কিরণের অধরের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। অর্ণবের মাঝেও আর নিয়ন্ত্রের শক্তি অবশিষ্ট নেই। নিজের সাথের যুদ্ধে হেরে শায় দিতে চললো কিরণের অবচেতন প্রেমের ডাকে। কিরণের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাতেই অর্ণব অনুভব করলো কিরণের হাতজোড়ার বাঁধন আরো শক্ত হয়ে এসেছে। হৃৎযন্ত্র যেন লাফিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইলো। মস্তিষ্ক হয়ে এলো শূন্য প্রায়।

মিনিট খানেক যেতেই অর্ণব হঠাৎ খেয়াল করলো কিরণের গাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে পানি। অর্ণবের ধ্যান ভাঙ্গলো। নিজ কর্মে ভিষণ ভাবে রাগ হলো নিজের উপর। কিরণের থেকে সরে গিয়ে ব্যকুল কন্ঠ দু গাল ধরে বলে ওঠলো,

আমি দুঃখিত বউ! ভিষণ দুঃখিত। আবার কষ্ট পেলে আমার জন্য?

কিরণকে ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। নিজের ব্যর্থায় রেগে টেবিলের পায়ায় স্বজোরে আঘাত করতেই টেবিল ল্যম্পটা পড়ে মুহুর্তেই চুরমার হয়ে গেল। অর্ণবের পায়ের নখটাও আঘাত পেয়ে ফুলে গেল। কিন্তু তাতে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অপরাধবোধে চারপাশ থেকে চেপে ধরছে। এখানে থাকা আর চলবে না। রেগে রুম থেকে বের হতে যাব তখনই কিরণের কান্নার শব্দে থেমে যায়। অস্থির হয়ে পেছন ঘুরতেই কিরণ দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। অর্ণব কিরণের এহেন কান্ডে জমে যায়। কিরণের কান্নার গতি বাড়তেই অর্ণবের অস্থিরতা বাড়ে। কিন্তু বলার মতো কোনো ভাষায়ই পায় না। এদিকে কিরণ কান্না করে রীতিমত হিচকি তুলে ফেলে। কিরণের অবস্থা বেগতিক দেখে অর্ণব কিরণে কোলে তুলে সোফায় বসায়। কিরণ অর্ণবের মুখোমুখি বসেই কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,

আ আ আবার আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন আপনি। যাবেন না পি প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হয়। বুকের ভেতর ব্যথা করে। সা সাত বছর আগে আপনি যখন আমাকে না বলে চলে গিয়েছিলেন; জানেন! আমি না খুব কেঁদেছিলাম। আপনি আমায় ভালোবাসেন নি। আমায় কেন ভালোবাসেন নি অর্ণব? কেন বলে ছিলেন আমায় ভালোবাসেন না আমায়? জানেন আমি সেদিন থেকে কতদিন আকাশ দেখতে পারি নি?

অর্ণবের বুকে চিনচিন ব্যথা করে উঠলো। কিরণের চোখের জলের ফোটার সাথে সাথে যে ব্যথা ক্রমশ তীব্র হওয়া শুরু করছে। অসহ্য লাগছে এ কান্না। এ কান্না আবেগের নয়, আহ্লাদের নয়। এ কান্না কিরণের না বলা কষ্টগুলো। চেপে রাখা অভিমানগুলোর। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার তীব্র যন্ত্রণার। তখনই মস্তিষ্কে উদয় হলো কিরণের বলা শেষ কথায়। ‘ কেন আকাশ দেখতে পারে নি?’

চলবে ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here