বিপরীতে তুমি আমি পর্ব ১

0
1839

বিয়ের লেহেঙ্গা পড়ে হবু বরের জন্য প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর অবশেষে খবর এলো বর আসবে না। সাংঘাতিক ব্যপার না? না। তার থেকেও সাংঘাতিক ব্যপার ঘটিয়েছে বিয়ের কনে নিজেই। পর্দার অপর পাশে সোফায় পায়ের উপর পা, হাতে কাবাবের প্লেট নিয়ে বসেছে। অনায়েসে একটা কাবার মুখে পুড়ে নিয়ে চাবাতে লাগলো। মৌমাছির মতো বিয়ের আসরে গুন গুণ গুঞ্জনে ভরে গেলো। বর আসবে না জেনে কনের থাকা উচিৎ বিমর্ষ অবস্থায়। মূমুর্ষ অবস্থাতেও চলে যায় অনেকে কিন্তু সেখানে এ মেয়ে খাচ্ছে? সাধারণত কোনো বাবা মা চান না তার মেয়ে কোনো পরিস্থিতিতে দুঃখবিলাস করুক কিন্তু কনের পরিবারের লোকজন চাচ্ছেন তাদের মেয়ে একটু কাঁদুক। কমপক্ষে মন টাই খারাপ করে থাকুক। সেগুরে বালি! তারাও জানেন ইহা তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা । কনে মুখের কাবাবটা কেবলি শেষ করেছে। আরো একটা খাওয়া উচিৎ কিনা ভাবছে। মোটা হয়ে যাবে কি আরেকটা খেলে? তখনই পাশে থেকে মামামো বোন তিন্নি এসে প্লেটটা নিয়েই শুনালো শাসনের স্বর,

কিরণ! কি করছিসটা কি তুই? কি চলছে তোর মনে বলবি আমায়? তোর বর আসবে না আর তুই এখানে কবাব গিলছিস?

কিরণ চমৎকার হেসে পাশে থেকে কোল্ডড্রিংসের গ্লাস হাতে নিলো। তিন্নির চোখে মুখে বিরক্ত ও অসহায়ত্বের মেলবন্ধন। কিরণ গ্লাসে একটা চুমুক দিলো। ঘরভর্তি আত্মীয় স্বজন, পরিচিত অপরিচিত লোকের সমাগম। কিরণ তাদের সমালোচনা শুনছে। কেউ মেয়ের দোষ ধরছে তো আবার কেউ পরিবারের। কিরণ একটু নড়ে চড়ে তিন্নির দিকে ঘেষে বসলো। তিন্নি উৎসুক হয়ে তাকালো। এই বুঝি কিছু জানাবে তাকে। সেই আশায় সাড়ে তিন বালতি পানি ঢেলে কিরণ বললো,

পপকর্ণ হলে ভালো হতো বল? ম্যনেজ করতে পারবি?

তিন্নি এবার রেগে উঠলো। কিরণের শরীর ছেড়ে সরে বসে বললো,

ফুপি ঠিকই বলে। তুই আসলেই পাগল হয়ে গেছিস। তোকে সাইক্রিয়াট্রিকস দেখানো উচিৎ।

কিরণ তখনও মুখে হাসি নিয়ে বললো,

তুই খামোখা রাগ করছিস। তোরই বা কি দোষ? ফুপির রক্ত পেয়েছিস। রাগ তো তোর রক্তে। যাই হোক শোন! এমন বাস্তব সিনেমা বিনামূল্যে দেখার সৌভাগ্য জীবনে দ্বিতীয়বার হবে না। তার মধ্যে ভেবে দেখ এই সিনেমার একটা চরিত্রও তুই। সার্পোটেট রোল করছিস। চিন্তা করে চোখ মুখের বারোটা না বাজিয়ে চুপচাপ দেখ কি কি হয়।

তিন্নির রাগ নিয়ন্ত্রনে এলো। সে বুঝেছে কিরণের উপর ওর রাগ তুলোর মতো। কিরণের দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটার মাথায় কি চলছে তা জানার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। মেয়েটা এমন কেন তা ভেবেই তিন্নির মাথা হ্যঙ্গ হয়ে যায়। তিন্নি জানে বর না আসার পিছনে এই মেয়ের নিশ্চিত কোনো কারসাজি আছে। কিন্তু “সে” তো দমে যাওয়ার মতো পাত্র ছিল না। তাকে দেখে তিন্নির মনে হয়েছিল কিরণ বুঝি বশে আসবে। কিন্তু এখানে তো কাহিনীই উল্টে গেলো। কিরণ তিন্নির নীরবতা লক্ষ করে হেসে বললো,
এতো চাপ নিস না। সব জানতে পারবি। আপাতত তুই কিন্তু আন্টিদের শাড়ির বাহার দেখতে পারিস। এক আন্টিকে দেখলাম লাল টকটকে শাড়ি পড়েছে বুঝলি! বয়স তো চল্লিশ পেরিয়েছে কিন্তু মনে হয় ওনি ওনার বয়স ভুলে গেছেন। কোথায় গেলো বল তো? খুঁজে দে তো।

তিন্নি উঠে গেলো। এ মেয়ের কথা শুনলে নিশ্চিত সে পাগল হয়ে যাবে। তাই চলে যাওয়াই উত্তম। আসন ছেড়ে দুই কদম দিতেই কানে ভেসে আসলো উচ্ছাসের আওয়াজ। তিন্নি আগ্রহে দ্রুত বাহিরে চলে গেলো। আর কিরণ বসে রইলো ভ্রু কুচকে অসীম কৌতুহল নিয়ে। হঠাৎ করে এমন অপরিচিত দৃশ্য নাটকে উদ্ভব হলো কি করে? এমন কিছু তো তার স্ক্রিপটে ছিল না। বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগলো। আচ্ছা এখন দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখে আসলে কেমন হয়? কৌতুহলের ঝোঁক সামলাতে না পেরে সোফা ত্যাগ করে পর্দা সরিয়ে নিলো। অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখেই কিরণের মাথায় বিনা মেঘে বর্জপাত হলো। বরপক্ষ এসেছে? চিরপরিচিত সোনালী শেরওয়ানি ছেড়ে গাঢ় নীল রঙ্গের শেরওয়ানি পরিধান করে সুপুরুষের মতো বর বেশে তার দোরগোড়ায় এসে দাড়িয়ে আছে তার হবু বর, অর্ণব শাহরিয়ার। কিরণ হতবিহ্বল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্ণবের দিকে। এ যেন রাতের সূর্য! অসম্ভব কোনো দৃশ্য। প্রবেশের টাকা নিয়ে যেখানে পুরো বিয়ে বাড়ির হৈ হৈ আওয়াজ সেখানে কিরণে অভ্যন্তরিন দুনিয়ায় কলরবমূখর হলো ‘ হায় হায় ‘ শব্দে। সাত পাঁচ ভেবে পুনরায় অর্ণবের দিকে তাকাতেই দেখলো অর্ণবও তাকিয়ে আছে। কিরণের চোখে চোখ পরতেই সূক্ষ্ম হাসি দেখা দিলো অর্ণবের মুখে। কিরণের প্রতি রক্তকণিকায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লো মহামারির মতো। পর্দা ছেড়ে সোফায় বসে পড়লো। অর্ণব হাসছে! পর্দার আড়াল থেকে তাকে খুঁজে নিয়ে দেখে হাসছে! ফোনের সূক্ষ্ম আওয়াজে ধ্যান ফিরলো কিরণের। ম্যসেজ চেক করতেই মেজাজের মাত্রা আরেক পারদ উপরে উঠে গেলো। অর্ণবের নীরব ঘাতকের স্ব জোর আওয়াজ,

চেক মেট!

কি সাংঘাতিক ব্যপার! যেমন তার চোখের তেজ তেমনই তুখর মস্তিষ্ক। এতোকিছু করেও আটকে রাখা গেলো না। খেলা যেখানে সে শেষ ভেবেছিলো সেখানে অর্ণব সৈন্য দিয়ে মন্ত্রী ফেরালো কোর্টে। রাজাকে চেকও দিয়ে দিলো । কিরণের এখন নিজের চুল নিজেই ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। এবার যে তাকে বিয়েটা করতেই হবে। তার থেকেই বেশি ভাবাচ্ছে সে হারতে চলেছে। তার সাজানো নাটকের স্ক্রিপ্ট বদলে গেছে। এক নাটকে দু দুজন পরিচালক? হতেই পারে না।
কিরণের কপালে হাত। এ মুহুর্তে আর কিছু করা সম্ভব নয়। তিন্নির মতো নিজের মাথাটাকেও নিরেট অনুভব হচ্ছে। ঠিক তখনই ঘায়েবি আওয়াজ ভেসে এলো কানে,

দানটা ভালো ছিলো, সূর্যরাণী! দারুণ খাটিয়েছো আমায়। এর শোধ রাতে তুলবো। বি প্রিপিয়ার্ড।

বিশাল স্টেজের এক পাশ কনের ও আরেক পাশটা বরের আসনের জন্য বরাদ্দ। মাঝখানটায় দেয়াল তুলে রেখেছে রঙ্গিন কাপড়ের পর্দা ও ফুল। কিরনের আসনের চারপাশটা রঙ্গিন কাপড়ের পর্দা। কনে কিনা! পর্দার আড়ালে থাকা বাঞ্ছনীয়। সেই পর্দারই অপরপাশ থেকে অর্ণবের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। কিরণ লক্ষ করলো তার বুকের ভেতর দামামা বাজছে। পা কাঁপছে। কপালের ছোট ছোট চুলগুলোর গোড়া ভিজে ওঠেছে ঘামে। নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখতে সফল হচ্ছে না। কিভাবে সে পরিস্থিতি সামালো? সে তথ্য না জানা অবধি কিরণের কৌতূহলী মন শান্তিতে নিঃশ্বাস ও নিতে পারবে না। অর্ণবকে রাতে আগে সে একা পাবে না। কিন্তু রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এতো ধৈর্য কিরণের কস্মিনকালেও ছিলো না আর না এখন আছে। তাই বিলম্ব না করে ফোনটা হাতে নিয়ে অবিলম্বে ম্যসেজ করে ফেললো,

এলেন কি করে?

অর্ণব যেনো এরই অপেক্ষায় ছিল। ঠোঁটে সেই হাসি নিয়েই খানিক সময় তাকিয়েই রইলো ফোনের দিকে। ইচ্ছাকৃত সে দেরি করছে। অর্ণব জানে কিরণের অধৈর্যের সীমা। কিরণের অস্থিরতা তার বেশ লাগে। কিয়ৎক্ষণ বাদ পুনরায় কিরনের মেসেজ এলো,

মজা নিচ্ছেন? ইচ্ছে করে রিপ্লাই দিচ্ছেন না।

অর্ণবের মন চাচ্ছে হু হা করে হেসে নিতে। তবে পরিবেশ তাকে সে অনুমতি দিচ্ছে না। মেয়ের মাথায় বুদ্ধি আছে। অবশ্য বুদ্ধি না থাকলে কেউ অমন সাংঘাতিক কাজ করেও না।

কিরণ অধীর আগ্রহে বসে আছে অর্ণবের উত্তরের আশায়। এতোদিন সংশয়ে ছিল কিন্তু আজ নিশ্চিত হলো এ ব্যটা ভিষণ ধুরন্ধরবাজ। কিরণের মন প্রাণ বলছে ওঠে গিয়ে অর্ণবের কলার চেপে সব উত্তর জেনে নিতে। তাহা কি আর সম্ভব? অপেক্ষা! অপেক্ষা! কেবলি অপেক্ষা! মিনিট পাঁচেক পর অর্ণবের উত্তর এলো। কিন্তু এ কি! উত্তর তো পেলোই না উল্টো আরো যেন চিন্তায় পড়ে গেলো। তিন্নি এসে কিরণকে চিন্তিত দেখে কিছু বলার আগেই খেয়াল করলো ফোনের দিকে। ফোনটা কেঁড়ে নিয়েই পড়তে লাগলো। ম্যসেজটা এমন ছিল,

একজন ডিফেন্সার নিজেকে ডিফেন্স করতে না পারলে দেশ কিভাবে ডিফেন্স করবে বলো তো ? বোকার মতো প্রশ্ন! তোমার কাছ থেকে এতো বোকা প্রশ্ন আশা করি নি।

তিন্নি আঁড়চোখে কিরণের দিকে তাকিয়ে বললো,
তুই আবার কোনো গোলমাল করেছিস?

কিরণ তিন্নির দিকে ভাবলেশহীন ভাবে তাকালো। সে তো জানতো অর্ণব সরকারি চাকুরিজীবী। সে যে প্রতিরক্ষাবাহিনীর লোক তা জানা ছিল না। ভালোমতো ফেঁসে গেলো। এদের যা মস্তিষ্কের বেগ! আলোর বেগে চলে। কিভাবে কি করবে এখন? দীর্ঘ নিঃশ্বাসে নিজেকে স্থির করে তিন্নিকে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলো,

সে যে ডিফেন্সের তা কি তুই জানতি?

তিন্নি মুচকি হেসে কিরণের পাশে শরীর হেলিয়ে বসে উত্তর দিলো,

তুই বাদে সবাই জানে।

কিরণ এতোক্ষণে আন্দাজ করেছে ব্যপারটা। কাঁদায় পড়েছে ব্যপারটা তা না। সবাই মিলে নামিয়েছে। পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো,

কোন বাহিনী?

তিন্নি বেশ মজা পাচ্ছে কিরণের এই বেচারা চেহারাটায়। কি মায়াবি লাগছে মেয়েটাকে! মেয়েটা নরম হলে খুব কি ক্ষতি হতো? কেন যে এতো অবাধ্য তার অঙ্কই মিলাতে পারে না। আবারো মুচকি হেসে কিরণের দিকে ঘুরে বসে। কিরণের নরম নরম গাল দুটো টেনে নিচু স্বরে বলে,

বাসর ঘরে গিয়ে ভাইয়ার থেকেই জেনে নিস ওনি মেজর, কমোডোর নাকি ক্যপ্ট্যান।

#বিপরীতে_তুমি_আমি
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_সুমাইয়া_ইসলাম

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। উৎসাহের স্বার্থে মন্তব্য কাম্য। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here