#অস্তিত্ব
#পর্বঃ২৪
#বনলতা
মাটির কলসিতে দড়ি বাঁধতে ব্যাস্ত কালু।আসলাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মায়ার দিকে।অনেক চেষ্টার পর মায়ার ঙ্গান ফিরেছে। ফর্সা চেহারা, ঠোঁটের নিচে কালো একটা তিল,লম্বা লম্বা চুল আর মুখটাতে উপচে পড়া মায়া।নাহ্ মায়া মেয়েটা খারাপ না দেখতে।কিন্তু কিছুই করার নেই। মেয়েটার কপাল খারাপ।আম্মাজানের তাকে পছন্দ নয়।একেবারেই নয়।আপন মনে ভাবে আসলাম।
হাতদুটো পিঠের পেছনের দিকে বাধা হয়েছে ওরই ওড়না দিয়ে।মুখে গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। মায়ার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে।এতক্ষণ কিছু না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছে ওর সাথে কি হতে চলেছে।মুখ থেকে শুধু উ উ শব্দ হচ্ছে। কলসির সাথে শক্ত করে বেঁধে মায়ার সামনে দাড়ায় কালু।মায়া এতক্ষণ কালুকে দেখতে পায়নি।ওকে দেখার সাথে সাথেই পুলকিত হয়।বাঁচার আশা জাগে।পানিতে পড়লে মানুষ সামান্য খড়কুটোকেও আকড়ে ধরে।মায়ার আজ সেই অবস্থা।
“ভাইজান কলসি কি গলার সাথে বানমু?”
নিরস গলায় বলে ওঠে কালু।মাথাটা সে নিচু করে আছে।মায়ার দিকে তাকানোর সাহস তার নাই।ক্ষণিকের জন্য হাত-পা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে দেয় মায়া।কালুর কথাগুলো তার কানে বজ্রকন্ঠের ন্যায় শোনায়।দুটি চোখে ভেসে ওঠে রাজ্যের বিস্ময়।এই কি সেই কালু কাকা যে মায়ার হাত ধরে বলেছিলো তার ঋন কখনও সে শোধ করতে পারবে না।জীবনে কোনো প্রয়োজনে যদি দরকার হয় তিনি নির্দিধায় এগিয়ে আসবেন।অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে থাকে কালুর দিকে।যা আসলামের চোখ এড়ায় না।আপন মনো হেসে ওঠে সে।
“আগে মুখটা খুইলা দে কালু।দ্যাখ ক্যামনে ছটফট করতাছে।শুইনা লই কি কইতে চায়”
কালু নিঃশব্দে মায়ার মুখের গামছা খুলে দেয়।ফরসা গালটা লাল হয়ে গিয়েছে গামছার শক্ত বাঁধনে। মুখের বাঁধন আলগা হতেই কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে মায়া,
“আমারে ছাইরা দেন কাকা।আমারে বাড়ি যাইতে দ্যান।এইখানে আনছেন….”
আর বলতে পারেনা সে।মুখটা খুব জোড়ে চেপে ধরে আসলাম।তার চোখ থেকে যেনো আগুন ঝরছে।সেই ভয়ংকর চাহনি দেখলেই আত্মা শুকিয়ে যাবে যে কারোর।
“চুপ, একদম চুপ। কথা কইবার সুযোগ দিছি তার মানে এই না যে চিল্লাইয়া মানুষ জড়ো করবি।আর একবার জোড়ে কথা কইলে দ্বিতীয় কথা কওনের সুযোগ পাবি না।”
মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় মায়া।আসলাম পর মুখটা ছেড়ে দেয়। হালকা ভেজা মাটিতে বসে পড়ে।
“কাকা আমার দোষ কি?কি করছি আমি?আমারে জানে মাইরেন না কাকা।এর আগে যা কইছিলেন সব অক্ষরে অক্ষরে শুনছি।আপনাগো সব কথাই শুনছি।তাও আমারে জানে মারবেন ক্যান কাকা?”
“দোষ তোর কিছুই নাই আপাতত আমার কাছে।তোর একটাই দোষ আম্মাজানের কাছে তা হলো তোর চান্দের লাকান সুরত।আর আম্মাজান চায়না তুই তমালের সামনে ঘুরঘুর করিস।তার এটা পছন্দ নয়”।
” কাকা আমারে ছাইড়া দ্যান।জীবনে কোনোদিন আমারে দেখতে পাইবেন না।আর আমারে কাল দেখতে আসবো।সব ঠিক করা আছে কাকা।বিয়ে হলে কালই চলে যাবো। আর কোনোদিন এই অতসীপুর আসবো না।জীবনেও না।”
আসলাম নিশ্চুপ। তার মুখে কোনো কথা নাই।এতক্ষণ কখন জানে শেষ করে দিতো।কিন্তু বাতাসি বিনির কড়া আদেশ ও যেন মরন নিজে থেকে চায়।বাঁচার আকুতি নিয়ে আফসোস করতে করতে মরে।আসলামকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে মায়া আবারও বলে ওঠে,
“কাকা আপনার না একটা মাইয়া আছে।তারে যদি কেউ মারত আপনার ক্যামন লাগত।আমিও তো কারো মাইয়া।গত পাঁচ বছর ধরে কখনও কোনোদিন মনের ভুলেও তারে আমি কল দেই নাই।কথা কই নাই।আমি হারানোর ব্যাথা সইতে পারবো।কিন্তু আমি না থাকলে আমার আব্বারে কে দেখবো।এই দুনিয়াডা খুব সুন্দর। আমি এখন মরতে চাইনা।আমি বাঁচতে চাই।”
চোখের পানিতে যেনো ভেসে যাচ্ছে মায়ার মুখ।গুনগুনিয়ে কান্নার আওয়াজ ছাপিয়ে হঠাৎ কালু কেঁদে ওঠে।থামতেই চায়না।কালুও কাঁদে। মায়াও কাঁদে। আসলামের বড় বিরক্ত লাগে।হঠাৎই থেমে যায় কালু।উঠে গিয়ে কলসিটা পানি পুর্ন করে আনে।মায়ার গলার সাথে কলসীটা শক্ত করে বাঁধে। মায়া ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। তাকাতে পারছেনা।বুকটাতে অসহনীয় ব্যাথা হচ্ছে। চোখে ভাসছে একে একে সবকিছু। তমালের সাথে দেখা হওয়া, প্রেমের শুরু,বাবা-মায়ের আদর,বোনের সাথে করা খুনসুটি, তমালের চলে যাওয়া,হুমকি-ধমকি,একাকী জীবন। সবকিছু শেষে যখন সে একা বাঁচতে শিখলো, বিচ্ছেদের ব্যাথা সইতে শিখলো,নিজের জীবনের তুচ্ছ বিষয় বাদ দিয়ে অল্পতেই খুশি থাকা শিখলো তখনই তার জীবনের অস্তিত্ব নিভে যাওয়ার সময় এলো।
“ভাই মুখটা কি আবারও গামছায় বানমু,”
“নাহ্,বান্ধনের দরকার নাই।মরনের ভয় ওর চোক্ষে মুখে থাক,একটু চেঁচাইতে দে,জানের ভিক চাইতে দে,পরানের অস্তিত্ব নিভা যাওনের আগে চিল্লাইয়া দুনিয়াডারে জানাইতে দে,”
“ভাই চিল্লানি শুইনা যদি মানুষ আহে,”
“এই ভরদুপুর রাইতে শুধু তেনারাই বিলাপ কইরা কান্দে।কোনো মানুষ না।তাই কেউ আইবোনা।যদি চিল্লানিও শুনে এই গরমে গায়ে ক্যাথা জরাইয়া চুপ কইরা থাকবো।”
গ্রীষ্মের মৌসুম।নদীতে অল্প সামান্য পানি। গলায় বাঁধা আছে ভরা কলসী।পাজাকোলা করে মায়াকে এনে ফেলে দেয় সেই অল্প পানিতে তাও কোমড় অবদি হবে।সহজে কেউ ডুবে মরবে না।কিন্তু মায়ার হাতটা পেছনে বাধা,গলায় ভরা কলসী বাঁধা, লম্বা কোমর অবদি চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া ও কোনোমতেই উঠতে পারেনা।আনুমানিক দশ সেকেন্ড সময় পর আসলাম মায়াকে টেনে পাড়ে নিয়ে আসে।প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া নিঃশ্বাসটা প্রাণভরে শ্বাস নেয়।
পাড়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে অল্প হালকা পানি প্রায় হাটু অবদি পানিতে চিৎ করে ফেলে দিয়ে বুকে পা দিয়ে পানির নিচে ধরে রাখে আসলাম।মায়া অস্থির ভাবে মুখটা নাড়াতে থাকে।দমটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার।চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আবারও টেনে তুলে আসলাম মায়াকে।বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে মায়া পারেনা।ভেজা চুলগুলো মুখের ওপরে লেপ্টে আছে।যার কারনে ভালো করে নিশ্বাস ও নিতে পারছেনা সে।হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,
“জীবনের আঠারোটা বছর গেলো কখনও আব্বারে জড়াইয়া বলা হয় নাই আব্বা আমি তোমারে অনেক ভালোবাসি।তোমারে ছাইরা থাকতে পারমু না।অনেক কথা কইছি এই কথা কই নাই। এই কথাটা কওনের সময় দ্যান আমা…”
আবারও পা দিয়ে বুকে লাথি মেরে নিচে ধরে রাখে মায়াকে।আবারও টেনে তুলে।জানটা মনে হয় বের হয়ে যাবে মায়ার।এত কষ্ট দেওয়ার থেকে একেবারে মরে যাওয়াই ভালো।
“মারে কখনও কই নাই মা আমি ভালোবাসি তোমারে।বড়আম্মা, বড়আব্বা,ভাইয়ারেও কখনও কওয়া হয় নাই।অনেক ভালোবাসি ওগো।জীবনের শেষ সুযোগ দ্যান আমারে।আমার মিষ্টি,…”
“চিন্তা করিসনা সব ভালোবাসা শেষ হইয়া যাবো। তোর অস্তিত্ব কেউ মনে রাখবো না মায়া।তোর মা বাপের লাইগা মিষ্টি আছে, তোর জ্যাঠার লাইগা শাহীন-শামীম আছে।আর তমালরে তো বিয়া দিমু।”
মানুষের জান সহজে বের হতে চায়না।রুহ যেন নাকের ডগায় তবুও অসহ্য যন্ত্রণায় মৃত্যুকষ্ট হচ্ছে। পানিতে বুদবুদ করে ওঠার পরিমাণ কমে যাওয়া দেখেই আসলাম দুহাতে মায়াকে টেনে তুলে।মুখটা মায়ার মুখের কাছে নিয়ে বলে ওঠে,
“না মায়া এত সহজেই তুই মরতে পারিস না।আজ মাথায় খুন চাপছে। সবচাইতে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হইবো তোর।”
হো হো করে হেসে ওঠে আসলাম।হাসির শব্দে পাড়ের গাছে থাকা একঝাঁক পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়াল দেয়।মায়া শ্বাস ক্ষীণ হয়ে এসেছে।মৃত্যু তার চোখের সামনে। আসলাম যেন স্বয়ং মৃত্যুদূত।জীবন-মরনের মাঝখানে মায়া।ভালোবাসাকে বড়ই অভিশপ্ত মনে হচ্ছে তার।কেনো মায়ার বাঁধনে জড়ালো সে।কেনই বা তমালের প্রতি এতো ভালোবাসা তার।মরনের সময়ও তার মুখটা সামনে ভাসছে।খুকখুক করে কেশে ওঠে মায়া।কাশতে গিয়ে অনুভব করে তার শরীরের ভেতরে কোনো শক্তি নেই।মরনের স্বাদ সে অনুভব করতে পারছে।এত যন্ত্রণাদায়ক হয় কেনো মৃত্যু। মানুষ এই পৃথিবীতে আসতেও কাঁদে আবার যাইতেও কাঁদে।
মায়া কিছু বলে ওঠে কিন্তু তা কর্ণগোচর হয়না আসলামের।মায়ার মুখে কান পাতে আসলাম।অস্ফুট স্বরে মায়া বলছে,
“কারো অস্তিত্ব মাইরা কেউ নিজের অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখতে পারেনা।বিচার তো হইবো একদিন,হয় এই দুনিয়ায় না হয় ঐ দুনিয়ায়। এশা….”
গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে পানিতে চেপে রাখে মায়াকে।বেশি সময় নেয়নি সে।শরীরটা নিস্তেজ হয়ে যায়।থেমে যায় ধস্তাধস্তি।মায়ার বুক থেকে পা সরিয়ে নেয় আসলাম।ভেসে ওঠে মায়া।পাড় থেকে কলসী নিয়ে আসে কালু।কলসীটা পুনরায় ভরে মায়ার গলায় বেঁধে দেয়।নদীর পানি বিদ্যমান জায়গায় যাকে লোকজন বুড়ির ঘর বলে জানে ওখানে রেখে আসে মায়াকে।কলসীর ভারে উপুর হয়ে হালকা ডুবে থাকে মায়া।দিনের আলোতে কেউ ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে।
চারদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে স্থান ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেয় আসলাম।কালু ওই রাতের আকাশের দিকে একমনে চেয়ে থাকে।মানুষ নাকি মারা গেলে আত্মা হয়ে চারপাশে ঘুরতে থাকে।তাহলে কি মায়াও ওর আশেপাশেই আছে।কই সে তো দেখতে পাচ্ছে না।নাকি এটা শুধুই ভ্রান্ত ধারনা।চারদিকে আজান পড়বে একটু পরই।দুই একজায়গায় দিয়েছে।বুড়ির ঘরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কালু।এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতেই হবে।সে পারেনি নিজের সন্তানের মায়া ত্যাগ করে মায়াকে বাঁচাতে। কিন্তু কেউ তো আছে যে এর সুরাহা এনে দিতে পারবে।
নদীর ধার দিয়ে বড়বাড়িতে চলে আসে তারা।এখন সভ্য মানুষ হওয়ার পালা।শুদ্ধ ভাষায় মার্জিত ভাবে বিনয়ী ব্যাবহার দেখানোর শুরু। কলপাড়ে গিয়ে গোসল সেড়ে নেয় দুইজনে।টুপি পড়ে রওনা দেয় মসজিদের দিকে।নামাজ পড়তে হবে।আল্লাহর কাছে দোআ করতে হবে যেনো ভালো থাকে আপনজনেরা।
#চলবে
#অস্তিত্ব
#পর্বঃ২৫
#বনলতা
বড়বাড়ির সামনের পাকা সড়কে এসে থামল এম্বুলেন্স। সাথে পুলিশের গাড়িও আসে।এশার সামনে বসে আছে আসলাম।হাতে হাতকড়া। পুলিশের গাড়ি থেকে নেমে আসে শান্তা।সড়কের সাথেই লাগোয়া বাড়িটা বড়বাড়ি।বাড়ির ভিটেটা গোল আকৃতির। বাড়ির সামনের উত্তরদিকে দাড়িয়ে আছে বড় এক শতবর্ষী কৃষ্ণচুড়ার গাছ।গাছের একটু এপাশে বাধাই করা বাতাসি বিনির কবর।মাঝামাঝিতে বড়বাড়ির বড় লোহার গেইট।গেইটের পাশে লেখা আছে শেখ ভিলা,বড়বাড়ি।লেখাটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো শান্তা।চলে গেলো সরাসরি বাড়ির ভেতরে।উঠোনে এনে রাখা হয়েছে এশাকে।আসলাম এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে এশাকে ঢেকে দেওয়া ওই কালো ওড়না দিয়ে।সবকিছু কেনো জানি মিলে যাচ্ছে। মরার আগে মায়া অস্ফুটস্বরে বলেছিলো “কারো অস্তিত্ব মাইরা কেউ নিজের অস্তিত্ব টিকাইয়া রাখতে পারেনা। বিচার হবে একদিন। হয়তো এইপাড়ে নয়তো ওই পাড়ে।”
আসলাম চোখ শুষ্ক।পানি আর বোধহয় নেই।নেই আহাজারি।মায়া এশা কথাটা পর্যন্ত গিয়ে সেদিন আর বলতে পারেনি।কি বলতে চেয়েছিলো মায়া এশাকে নিয়ে।শান্তা পুলিশের লোকটাকে হাতে রাখা কাগজটা দেয়।লোকটা এক নজরে পুড়োটা পড়ে দুজন কনস্টেবলকে নির্দেশ দেয় আসলামের হাতের হাতকড়া খুলে দেওয়ার জন্য।তবে সার্বক্ষণিক আসলামের পাশে পুলিশ পাহারা থাকবে। আসলামকে সাময়িকভাবে পুরো আটচল্লিশ ঘন্টা অস্থায়ী মুক্তি দেওয়া হয়েছে।কোর্টের আদেশে যখন-তখন আদেশ তুলে নেওয়া যেতে পারে।শান্তা চায় আসলাম এই সময়টুকুর মধ্যেই নিজের মেয়ের অস্তিত্বের বিলীনের স্বাক্ষী হোক।
আসলাম পুলিশের হাতদুটো চেপে ধরে।ধরা গলায় বলে ওঠে,
“স্যার,হতকড়াটা খোলার কোনো প্রয়োজন নেই।আমার আটচল্লিশ ঘন্টার ছুটিও চাইনা। আমাকে জেল হাজতে নিয়ে চলেন।শুধু বিনিময়ে এশাকে ফিরিয়ে দিন”
শেষের দিকে আসলাম এর কন্ঠ সচ্ছ,পরিষ্কার। কোনো জড়তা নেই তাতে।নির্বিকার চাহনী।
কেউ হাসছে।চিৎকার করে হাসছে।তার হাসিতে মত্ত চারপাশ।
“কিরে আসলাম আজ কেমন লাগছে?সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কেমন?ঠিক কতোটা কষ্ট হচ্ছে তোর?”
আসলাম খুঁজে পায়না কে হাসছে আর কেই বা কথাটা বলছে।
পুলিশের লোকজন এশাকে পোস্ট মর্টেম এর জন্য স্টেচারে তুলে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়।তৎক্ষনাৎ আসলাম টেনে ধরে স্টেচার।না সে নিয়ে যেতে দেবেনা তার মেয়েকে।ছুটে আসে লোকজন।টেনে ধরে আসলামকে।পাগলের ন্যায় আসলাম জড়িয়ে থাকে ওর মেয়েকে।প্রাণহীন দেহটা শীতল হয়ে গিয়েছে।চিৎকার করে কাঁদছে আসলাম। সে আজকে মেয়ে হারিয়েছে। ওর কলিজার টুকরা ওর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।সবাই মিলে ছাড়াতে চায় আসলামকে এশার থেকে।আসলাম নাছোড়বান্দা। জোড়পূর্বক ছাড়িয়ে এশাকে নিয়ে চলে যায় তারা।স্টেচারে এশার মৃতদেহ। বিকেলের দক্ষিণা বাতাসে নিষ্প্রাণ এশার চুলগুলো উড়ছে।মৃদু ধাক্কাধাক্কিতে হাতদুটো দুপাশে নেমে গিয়ে চুলের সাথে প্রায় পেচিয়ে গিয়েছে।আসলামের কল্পনায় ভেসে ওঠে,হাতবাঁধা অবস্থায় মায়ার চুলগুলো যেমন করে ওর হাতে মুখে পেচিয়ে ছিলো আজও তেমনি হচ্ছে। তারমানে এশারও তো শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এশাকে নিয়ে ওরা প্রায় কৃষ্ণচুড়ার গাছ পর্যন্ত পৌছে গিয়েছে। দৌড়ে ছুটে যায় আসলাম।হঠাৎই থেমে যায় সে।চোখ তার আটকে যায় লোহার গেইটে।মোরশেদ দাড়িয়ে আছে।আজব মোরশেদের চোখের পানির বিন্দুকেও আসলামের কাছে ভৎসনা আর বিদ্রুপ ঠেকছে।মোরশেদ বুঝি খুশি হয়েছে।কিন্তু কাঁদছে কেনো।সারাদিনের ধকল সইতে পারে না আসলাম।পড়ে যেতে চায়।পড়ার আগেই ধরে ফেলে কালু।আসলাম মুর্ছা যাওয়ার আগে শুনতে পায় কেউ ওর কানে কানে বলে চলেছে,
“কাকা আপনে কইছিলেন না যে এই মায়ার অস্তিত্ব কেউ মনে রাখবো না।কিন্তু নিয়তির বিধান বুঝি অন্যরকম ছিলো। তাইত আজ পাকাপোক্ত ভাবে আমার অস্তিত্ব আপনের লগে মিইশা গেলো।যহনই এশার কথা মনে পড়ব,তহনই এই মায়ার কথা মনে পড়ব।যতদিন বাইচা থাকবেন ততদিন মায়া বাইচা থাকব”
_________________
কালুর মেয়েটার বয়স যখন এগারো।তখন চাপড়ে ছোট-বড় সবারই কলেরা হইলো।সেবার চাপড়ের বিলের আশেপাশের পুকুরগুলোতে বেশ আগাছা হয়েছিলো।আগাছা দমনে আর রাক্ষুসে মাছ নিধনে অনেক বেশি পরিমানে কীটনাশকসহ আরো বিষাক্ত ঔষধ দেওয়া হয়।বাতাসের প্রবাহ্ আর অমাবস্যা-পুর্নিমার জন্য সেবার বন্যায় চাপড়ের সব চাপকল পানিতে আধাডোবা হয়।ওই পানি খেয়েই কলেরায় আক্রান্ত হয়।কালুর মেয়েটা মারা যায়।আরো পাঁচ-ছয়জন মারা যায়।কিন্তু কালুর মনে চলে অন্য ভাবনা।
_________
ঘড়িতে দশটা বাজে।হাসপাতালের বারান্দায় বেঞ্চিতে বসে আছে এক মানব।চোখ তার জ্বলছে। সারারাত নির্ঘুম থাকার কারনে মাথাতেও হালকা ব্যাথা হচ্ছে। ক্রমেই ব্যাথাটা বেড়ে চলছে।বুকের ভেতর কষ্টরা দামাদা বাজিয়ে চলেছে।হাতে থাকা দামী ফোনটার অনস্কীনে জ্বলজ্বল করছে এশার মুখ।ছবিটা ওর ভার্জিনিয়া যাওয়ার আগের।হাতের ফোনটা পকেটে রাখতে গিয়ে খেয়াল হয় কালকের প্যান্টটা চেন্জ অবদি করা হয়নি।ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে সে।ওপরের দিকে তাকিয়ে চুলগুলো দুহাতে মুষ্টিবদ্ধ করে চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করে সে।ছেলে মানুষের যে কাঁদা বারন।সকল বাধা নিষেধ উপেক্ষা করেও দুফোটা তপ্ত চোখের জ্বল গড়িয়ে পড়ে গাল দিয়ে।
সাদা হাফ গাউন আর মাথায় সাদা স্কার্ফ পড়া একটা মেয়ে এগিয়ে আসে ছেলেটির দিকে।হাতে কিছু কাগজ পত্র আর ফাইল দেখা যাচ্ছে।
“আপনি কি তমাল শেখ?”
“হুম বলুন”
“আপাতত এখানে সই করুন আর আমার সাথে চলুন”
“হুম”
নিঃশব্দে সইটা করে দেয় তমাল।কাল যখন কলি ফোন করে আসলামের গ্রেফতারের খবর দেয় তখনও সে নির্বিকার। কিন্তু এশার কথা শোনার সাথে সাথেই এমারজেন্সিতে ডাবল পেমেন্ট করে টিকিট কেটে চলে এসেছে।যখন বড়বাড়ি পৌছায় তখন সকাল সাতটা বাজে।আবারও রওনা হয় সদরের সরকারি হাসপাতালে।
হাসপাতালের অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে।আগে হাসপাতালের সাথে লাগোয়া ভাবে মর্গ ছিলো কিন্তু এখন তা পৃথক করা হয়েছে। মর্গের ভেতর আসতে থাকে তমাল।কান্নারা আজ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হোক তারা জয়ী হতে চায়।ফ্রিজিং লং বক্স থেকে টেনে বের করে আনা হয় এশার দেহ।সাদা কাপড় দিয়ে জড়ানো।মুখখানা থেকে কাপড় সরিয়ে দেয় কেউ।উন্মুক্ত গলা আর মুখ থেকে বরফের শীতল ধোয়া উড়ে যায়।ফর্সা কপালে সেলাইয়ের দাগ।এদৃশ্য চোখে দেখে সহ্য করতে পারেনা তমাল।হাত দিয়ে মুখ চোখ ঢেকে নেয়।সেতো পারেনা বোনের প্রাণহীন দেহ চোখে দেখতে তাহলে শাহীন-শামীম কি করে সহ্য করেছিলো তাদের বোনের লাশ।
#চলবে