#অস্তিত্ব
#পর্বঃ২০
#বনলতা
মায়া মায়া মায়া।এই একটা নামে আমার ঘৃণা চলে আসে।আসবেই না কেনো।ও আমায় ভালোবাসুক আর না বাসুক, ওতো আমার স্বামী।একজন মেয়ে কখনও তার স্বামীর মুখে অন্যের নাম সহ্য করবে না।আমিও করিনি।অনেকবার দাদীজানকে জিজ্ঞেস করেছি মায়ার সম্পর্কে। দাদীজান এর একটাই উত্তর ছিলো।মায়া নাকি এক চরম বেয়াদব মেয়ের নাম।যে নাকি এই বড়বাড়ির কলিজায় হাত দিয়েছিলো।ব্যাস এতটুকুই।মায়া কোথায় আছে,কিইবা করছে আমার এই প্রশ্নের উত্তরগুলো কখনও পাইনি।
এভাবেই দিন যায়।মাঝে মাঝেই দেখতাম ওই কৃষ্ণচুড়ার গাছের নিচে এক লোককে দাড়িয়ে থাকতে।পলকহীন দৃষ্টিতে যেন সে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে।প্রথম প্রথম ভয় পেয়ে ছাদ থেকে নেমে এসেছিলাম।তারপর আমার মাথায় অদ্ভুত ভাবে আটকে যায় এই লোকটি।কে সে?আর কেনই বা আমার দিকে এমন করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।হাজারও প্রশ্ন জমা হয় মনের ভেতরে।যেগুলোর উত্তর জানা নেই।একদিন ওর ফোনে বহু আগের একটা ম্যাসেজ দেখতে পাই।
“ভালোবাসা চাইনা,
শুধু এতটুকু ঘৃণা কইরো,
যতটুকু ঘৃণাতে এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারি,
এই ঘৃণাতেই যেন এই মায়ার অস্তিত্ব টিকে থাকে,”
~মায়া
দিনটা ছিলো আষাঢ় মাসের এক বিকাল।যেদিন
একজনের সাথে আমি লুকিয়ে দেখা করি।লোকটা আমারই শ্বশুড়বাড়ির বিশ্বস্থ কেউ। আর মায়ার বিষয়ে সব জানতে পারি।একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া সব নির্মম ঘটনা জানতে পারি।আরো আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন জানতে পারি মায়া আর এই দুনিয়ায় নেই।রোজ যে মানুষটাকে আমি মায়া মায়া বলতে শুনি সেই মায়ার কোনো অস্তিত্ব হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ মনে রাখেনি।বরং কেউ অত্যন্ত সন্তপর্ণে মায়ার অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছে।মায়া যেই নামটাকে আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করে এসেছি সেই নামের সাথে যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে তা এতটা বেদনাদায়ক তা বুঝতেই পারিনি।অনেক আফসোস হয়েছিলো সেদিন।সারাটা রাত কেঁদে কেঁদে শুধু একটা কথাই ভাবছিলাম যে শুধু মধ্যবিত্ত হওয়ার কারনে একজন মানুষ তার নিজের প্রাণটুকু হারিয়ে ফেলেছে।
একটা বিষয় মনে হয়ে সেদিন খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম যে সবকিছু জানার পরেও তমাল কেন চুপচাপ। এতটা বছর ধরে চলতে থাকা মামলায় তমাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন স্বাক্ষী। এ বিষয়ে তাকে যখন বলেছিলাম ও বলেছিলো,”আমরা যা চাই তা পাইনা।কিন্তু নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে গেলে তা আমার হাতের মুঠোয় চলে আসে।আফসোস,তা সময় থাকতে পাই না।”
পাঁচ মাস আগে আমার দাদি শ্বাশুড়ি মারা যায়।তার কয়েকদিন পরে দাদীর আলমারি গোছগাছ করতে গিয়ে একটা নয় পুরো পাঁচ পাঁচটা ডিভোর্স পেপার পাই।প্রত্যেকটা পেপার ছিলো আমার শ্বাশুড়ি সহ চারজন চাচীশ্বাশুড়ির নামে। এই কাগজগুলো দেখে আমি অনেকটা অবাক হয়েছিলাম।অনেক অনুনয় বিনয় করে এশার মায়ের কাছে জানতে পেরেছিলাম।আমার স্বামী এই মামলার অন্যতম স্বাক্ষী ছিলো।কিন্তু আমার দাদী-শাশুড়ি মৃত বাতাসি বিনি আর তার ছোটছেলে আসলাম শেখ তাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলো, যদি সে স্বাক্ষী দেয় তবে পাঁচ জনকেই তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।তাই সে আর স্বাক্ষী দেয়নি।
আমার কাছে প্রতিটা কথার প্রমাণ আছে।এই আসলাম শেখের অনেক কথা, কল রেকর্ড আছে যা আমি বহু কষ্টে এডভোকেট শান্তাকে দিয়েছি।আমি বিচার চাই।মায়া হত্যার বিচার।এই কলিকে প্রতিনিয়ত জীবন্ত হত্যার বিচার চাই।তারা অনেক জীবন নষ্ট করেছে।এই কলি যাকে বিয়ের পর শুধু টাকা পয়সা আর শাড়ী গয়নায় সুখি থাকতে হয়েছে।মায়া যে মারা গিয়েছে।ওর বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন,বন্ধুবান্ধব।আমার স্বামী যে কিনা প্রতিনিয়ত এক অস্তিত্ব খুজে বেড়ায় যে কিনা এই পৃথিবীতেই নাই৷
আমি আজ সুখি নই।আজ একমাস হয়ে গেলো সে আবারও চলে গেছে সুদুর ভার্জিনিয়া। তার জীবনে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।আমার কল্পনার উপন্যাসের হাজারো পৃষ্ঠায় সে থাকলেও তার চিন্তা ভাবনাও কখনও আমি আসতে পারিনাই।ভালোবাসাটা কি অন্যায়।যদি অন্যায় হয় তাহলে পৃথিবীর মানুষ কেনো একেওপরকে ভালোবাসে।পুরো চার চারটা বছর ধরে একজন মানুষকে ভালোবেসে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।মায়া তো মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু আমি, আমি তো না পারছি মরতে আর না পারছি তার জন্যে অপেক্ষা করতে।এই অপেক্ষা আমার কাছে রক্তক্ষরণ অপেক্ষা।
#চলবে