ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনির )
১৬.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ )
পরেরদিন খালার সাথে দেখা করতে মজনু ভাই এলো সকাল সকাল। খালা বেশ ঘটা আয়োজন করেছে। হরেক রকম রান্নাবান্না খাবারদাবার।
কোচিং শেষে বাড়ি ফিরে হল ঘরে শিহাবকে বসে থাকতে দেখল প্রিয়। ভ্রু কুঁচকে এলো সামান্য। প্রিয়কে দেখে শিহাব উঠে দাঁড়ালো। বিনয়ী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ এতো দেরি হলো যে? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোমার!’
শিহাবের কন্ঠে স্পষ্ট অধিকারবোধ। যেন অনেক বছরের পরিচীত। প্রিয় বিস্ময় কাটিয়ে সালাম জানিয়ে বলল,
‘ স্যার আসতে দেরি করেছে তাই দেরি। কেমন আছেন আপনি?’
‘ ভালো থাকি কি করে? সারাদিন শুধু তুমি মাথায় ঘুরঘুর করো।’
কথার অর্থ বুঝল না প্রিয়। গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকলো শুধু। চোখমুখে স্পষ্ট হতভম্ব ফুটে। কথা এড়িয়ে প্রিয় বলল,
‘ আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
ঘরে চলে এলো প্রিয়। গোসল করে বেরিয়ে দেখল তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শিহাব। বিরক্ত হলো প্রিয়। হুট করে তার ঘরে অনুমতি ছাড়া শিহাবের ঢুকে পড়ার ব্যাপারটা একদম পছন্দ হলোনা। বিব্রত হলো খুব। বলল,
‘ আপনি এখানে?’
‘ তোমার অপেক্ষা করছিলাম। লাঞ্চ করবে না?’
কপাল কুঁচকে নিলো প্রিয়। শিহাবের কথাবার্তা আচরণ গায়েপড়া লাগছে তার। বিমূঢ় কন্ঠে বলল,
‘ আপনি লাঞ্চ করে ফেলুন। দেরি হবে আমার।’
‘ সমস্যা নেই আমি এখানে বসছি। তুমি তৈরি হও। এক সাথে লাঞ্চ করবো।’
জবাবে কিছু বলল না প্রিয়। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। অমনি খালার আওয়াজ কানে এলো। দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। দুপুরের খাবার পর। ছাদ ঘুরে দেখার আবদার করল শিহাব। খালা প্রিয়কে ছাদ ঘুরিয়ে দেখাতে বলল। বিরক্ত হলো প্রিয়। খালার কথার পিঠে অমান্য করার সাধ্যি নাই তার। চোখমুখ অন্ধকার করে শিহাবকে ছাদে নিয়ে গেল। মেহমান কিনা! শিহাব ছাদ ঘুরছিল। ছাদ ঘুরে দেখা মূলত বাহানা ছিল। আসল উদ্দেশ্য প্রিয়’র সাথে সময় কাটানো।
ছাদের চেয়ারে বসে ছিল প্রিয়। শিহাব সামনের চেয়ারে বসে কথা বলছে অনবরত। নিজেদের নিয়ে বাড়িয়ে চড়িয়ে গপ্পো করে। প্রচন্ড বিরক্তি বিতৃষ্ণা চেপে ধরেছে প্রিয়কে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ শুনছে। ঘুমে চোখজোড়া টলমল করছে। খালার উপর রাগ হচ্ছে খুব। প্রিয়কে না পাঠালে কি হতো! হাই টানতে টানতে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। গতির ভেতর শতাব্দদের গাড়ি ঢুকছে। চোখমুখ নেচে উঠল প্রিয়’র। ঘুমঘুম ভাবটা মুহূর্তেই কেটে গেল। শতাব্দ কি ঢাকা থেকে ফিরল তবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে রেলিং এর পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। মাথা উঁচিয়ে উঁকি দিলো। খয়রি গাড়িটা থেকে শতাব্দ নামছে। প্রচন্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চোখমুখ মুড়ছে আছে একদম। আচমকা ছাদের দিক চাইল শতাব্দ। প্রিয়’র পাশে শিহাবকে দেখে গম্ভীর করে নিলো মুখ। কপাল কুঁচকে ভিতরে চলে গেল। প্রিয় হতাশ চেয়ে রইল। দুজনকে সন্দিহান দৃষ্টিতে পরখ করলো শিহাব। তাদের মধ্যে কিছু চলছে তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তবে কি চেয়ারম্যানের ছেলে শতাব্দের সাথে প্রিয়’র প্রেম চলছে!
আজ নির্বাচন। গ্রাম জুড়ে চাপা উত্তেজনা। এলোমেলো সব। নির্বাচন কেন্দ্র থেকে খবর এসেছে খানিক আগে। ভ*য়ানক গন্ডগোল হয়েছে সেখানে। মা*রামা*রি হা*তাহাতি হচ্ছে কেন্দ্রের বাহিরে। গভীরভাবে আ*হত, র*ক্তাক্ত কয়েকজন। কো*পাকুপি হয়েছে। কারো হাত খুয়েছে, কার পা। হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অনেকের জীবন সংকটে। এখনো ঠিকঠাক কারো খবর পাচ্ছেনা। পরিস্থিতী ভীষণ বা*জে। নিয়ন্ত্রণে আনার পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে। শুনে হাতপা কাঁপাকাঁপি শুরু করেছে প্রিয়’র। বুক চেপে ধরেছে ভয়ে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে যাচ্ছে হাজারবার।
দুপুরে যখন শতাব্দের সাথে কথা হয়েছিল। বলেছে, এই কেন্দ্রের বাহিরে আছে। এখন অবধি সব ঠিক আছে। সব কেন্দ্র মিলিয়ে জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি। তাদের পক্ষে জনগন। পরিস্থীতি ভালো দেখে বিরোধী দল ক্ষেপেছে। এটা ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। ঝামেলার আশংকা আছে। তাই ফলাফল অবধি এখানেই থাকবে। তারপর আর কথা হয়নি। একটু আগে চেয়ারম্যান বাড়ির লোকজনকে ছুটাছুটি করে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। সেই থেকে আরো বেশি ভয় করছে। তার আবার কিছু হয়নি তো! ঠিক আছে তো শতাব্দ?
চিন্তায় মাথা ভার হয়ে আসছে। বারবার চোখ ভরে আসছে। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। বারান্দায় ছুটে যাচ্ছে বারবার। যদি চেয়ারম্যান বাড়ির কাউকে দেখা যায়। কোন একটা খবর পাওয়া যায়! খালার ফোন থেকে ফোন করছে শতাব্দকে তুলছেনা সে। প্রিয়’র চিন্তা আরো বেশি বেড়ে গেল। ভ*য়ে কেঁদেই ফেলল। খালা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। উত্তরে কিছু খুলে বলল না প্রিয়। বিরবির করে শুধু বলল, ‘ শ.শতাব্দ ভাই ঠিক আছে তো খালা?’
আয়েশা বেগম বিমূঢ় চেয়ে রইল। শতাব্দের প্রতি প্রিয়’র এমন চিন্তা, স্পর্শানুভূতি দেখে আশ্চর্যান্বিত সে। ভীষণরকম অস্বাভাবিক লাগছে। এভাবে চিন্তা, ভয়ে কাঁদতে দেখেনি কখনো প্রিয়’কে। হাউমাউ করে কাঁদছে প্রিয়। তবে কি তার সন্দেহ ঠিক। শতাব্দের সাথে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে প্রিয়? আঁতকে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে প্রিয় কাছে গেল। ফ্লোরে বসে হাতপা ছড়িয়ে কাঁদছে প্রিয়। আয়শা বেগম কাছে যেতে কাঁধ ঝাকিয়ে ভনিতা বিহীন জিজ্ঞেস করল,
‘ আমার দিকে তাকা। আমার দিকে তাকা প্রিয়। শুন, কি হয়েছে তোর?’
আয়েশা বেগমের ভয়ার্ত এলোমেলো আওয়াজ। অশ্রু ভরাক্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়। চোখমুখ অশ্রুতে ভিজে। শক্তিহীন নেতিয়ে আছে সে। আয়েশা বেগম আবার জিজ্ঞেস করল,
‘ শতাব্দের সাথে তোর সম্পর্ক কি? প্রেম করছিস?’
প্রিয় উত্তর দিলো না কোন। ডর ভয়ে লজ্জায় মাথা ঝুকে অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। খালা চিন্তিত। অধৈর্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি প্রিয়! শতাব্দের সাথে তোর কিসের সম্পর্ক?’
শেষ কথাটা বেশ ধমকে বললেন। এবারো নিশ্চুপ প্রিয়। রেগে গেলেন খালা। কাঁধ ঝাকিয়ে শক্ত ধমকে চেঁচিয়ে বলল,
‘ কিছু জিজ্ঞেস করছি প্রিয়! উত্তর দে!
খালা রাগে হাত উঁচু করতেই ডুকরে কেঁদে ফেলল প্রিয়। হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠলো। জড়সড় বসে আছে প্রিয়। কান্না ভেজা চাপা কন্ঠে বলল,
‘ আমি তাকে ভালোবাসি খালা।’
আয়েশা বেগম বিস্ময়ের চরম পর্যায়। ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। প্রিয়’র কথা গুলো গরম শিসার মত কানে ঢুকছে তার। কিছু ভেবে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল হ্ঠাৎ। ফিসফিস করে বলল,
‘ এটা হতে পারেনা। তুই শতাব্দকে ভালোবাসতে পারবিনা। এটা অসম্ভব। অসম্ভব!’
এই শীতেও প্রচন্ডরকম ঘামছে সে। ভারী ভারী নিশ্বাস পড়ছে। হাঁপিয়ে উঠেছে। প্রেসার বেড়ে গেল কি?
একটু সময় নিয়ে শান্ত হলো। রাশভারি কন্ঠে বলল,
‘ এটা সম্ভব না প্রিয়। অসম্ভব। এসব বাদ দে। ভুলে যা শতাব্দকে।’
‘ আমি পারবোনা খালা। ভালোবাসি তাকে।’
প্রিয়’র স্পষ্ট উত্তর। উত্তরে ভড়কে উঠলেন তিনি। প্রিয়’র চোখের দিকে তাকালেন। চোখে আজ কোন ভয় নেই তার। কন্ঠে জড়িয়ে আছে সামান্য লজ্জা, জড়তার প্রলেপ। অদ্ভুত, নিদারুণ সাহস নিয়ে মেয়েটা কথা গুলো বলছে। এইটুকু মেয়ে এত সাহস পাচ্ছে কোথা থেকে? এই সাহসের কি নাম দিবে? বেয়াদবি! নাকি উঠতি বয়সের চরম বোকামি। তিনি নিজেকে শান্ত করলেন নরম বোঝানোর স্বরে বললেন,
‘ এসব প্রেম, ভালোবাসা খানিকের মোহ সব। এখনো তোর পুরো জীবন পড়ে। অল্পবয়সের সামান্য আবেগে গা ভাসালে সব বি*নাশ হবে। আজীবন ধুকে ধুকে ম*রতে হবে।’
শক্ত বনে বসে আছে প্রিয়। খালার কোন কথা কানে তুলছেনা সে। হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে আয়েশা বেগম উঠে দাঁড়ালো। বললেন,
‘ তুই না বুঝতে চাইলে আমার আর কিছু করার নেই। তোর বাবাকে জানাতে হবে সব। ওদের মেয়ে ভরণপোষণ করে এতবড় করেছে। ভালো ভবিষ্যতের জন্য ভরসা করে আমার কাছে পাঠিয়েছে। বিশ্বাসঘা*তকতা করতে পারবোনা তাদের সাথে। সবটা জানাতে হবে তাদেরকে। তারপর যা করার তারা সিদ্ধান্ত নিবে।’
বলে ঘর থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ালো। প্রিয় আরো জোরে কেঁদে উঠল। হামাগুড়ি দিয়ে তড়িঘড়ি পা জড়িয়ে ধরল। ঝাপটে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল,
‘ খালা, খালা বাবাকে জানাবেনা প্লিজ। জানাবেনা তুমি। বাবা জানলে ঢাকায় নিয়ে যাবে আমাকে।কোন দিন ইমান্দিপুরে আসতে দিবেনা আর। তুমি যা বলবে সব সেই ভাবে চলবে। আমি তার সাথে কথা বলবোনা। দেখা করবো না। এখানে থেকে শুধু দূর থেকে একটু দেখবো খালা। প্লিজ জানাবেনা বাবাকে।’
প্রিয়’র কান্নাভেজা এলোমেলো অগোছালো কথায় থমকে গেল খালা। চোখ চিকচিক করছে জলে। অনেক বছর আগের কিশোরী নিজেকে দেখছে। একদিন এমন ভাবেই বাবার পা জড়িয়ে কাউকে চেয়েছে। আকুতি মিনতি করেছে। দুর্বল হয়ে পড়ল সে। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল আবার। কাঁপাকাঁপি হাতে প্রিয়’র কান্নাভেজা মুখটা তুলল। ভেজা কন্ঠে আওড়াল,
‘ শতাব্দ’ই কেন? এই প্রেম বি*নাশ আনবে।’
‘ আসুক।’
‘ য*ন্ত্রণায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হবি!’
‘ রাজি আছি।’
‘ নিঃ*স্ব করে দিবে সব।’
‘ অভিশাপ দিচ্ছো?’
‘ না, বাস্তবতা দেখাচ্ছি।
‘ এইটুকু যন্ত্রণা পেয়ে যদি তাকে পাওয়া যায়। এই যন্ত্রণাকে হাজারবার কবুল।’
প্রিয়’র ব্যাকুল চোখজোড়ায় করুণ আকুলতা। ব্যর্থ নিশ্বাস ফেলল আয়েশা বেগম। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে গাল বেয়ে ঝরলো। টলমল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের ঘরের দিক পা বাড়ালো। পেছনে বসে রইল প্রিয়। নিশ্চুপ, শব্দহীন অশ্রু ঝরালো।
রাত আটটা বাজতে চলেছে। ঠান্ডা ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে প্রিয় শুয়ে। চোখজোড়া এখনো ভিজে। অশ্রু গাল গড়িয়ে ফ্লোরে ঝরছে টপটপ। বিকালের পর খালার সাথে কথা হয়নি আর। না শতাব্দের কোন খবর পেয়েছে। এক আকাশ হতাশা জুড়ে পড়ে আছে নিমিষ। আচমকা ঢোল বাজনার আওয়াজ ভেসে এলো কানে। এলোমেলো হাতে ওড়না খুঁজে। তড়িঘড়ি উঠে। বারান্দার দিকে ছুটে গেল সে। শতাব্দের বাবা শাহরিয়ার খাঁন তৃতীয় বারের মত বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। ফুলের মালা পড়ে ব্যান্ড, বাজনা নিয়ে আসছে।
শতাব্দকে দেখছেনা কোথাও। ছটফট করছে প্রিয়। খানিক বাদেই ভীড়ের মধ্যে শতাব্দকে দেখলো। গলায় মালা পড়ে গাড়ির সানরুফ খুলে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে জয়ের হাসি। হাত উঁচিয়। আশেপাশে সবাই বাপ ছেলের ছবি তুলছে। চিন্তা মুক্ত হলো প্রিয়। ছোট শ্বাস ফেলল। হ্ঠাৎ অন্ধকারে শতাব্দের হাতে সাদা ব্যান্ডেজে চোখ আটকাতেই। আঁতকে উঠল প্রিয়। অনেক বড়সড় ব্যান্ডেজ। খুব বেশি আঘা*ত লেগেছে কি?
প্রিয়দের বাড়ির সামনে গাড়ি করে বিজয় মিছিল যাওয়ার সময় চোখাচোখি হলো। প্রিয়’র ফোলাফোলা অশ্রুভেজা চোখমুখ দেখে কপাল কুঁচকে নিলো শতাব্দ। খটকা লাগলো তার। মোবাইল বের করে কল করল প্রিয়’র নাম্বারে।
চলবে……
( এই গল্পের কোন ক্যারেক্টার বা সংলাপ অতিরিক্ত না প্রতিটি ক্যারেক্টার একে অপরের সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত। যা দ্বিতীয় খন্ডের শেষ অবধি থাকবে।)
তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করেছি, চেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই সবার মতামত জানাবেন।
টাইপোগ্রাফি : Afroja Akter jhuma বান্ধবী🌺