ফিলোফোবিয়া
ঊর্মি প্রেমা ( সাজিয়ানা মুনির)
৮.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)
সেইরাতে পিকনিক থেকে ফিরে পরের দিন সকালেই প্রিয় ঢাকায় চলে গিয়েছিল। মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে জাফর সাহেব ভীষণ ঘাবড়ে যায়। ভোর সকালেই মেয়েকে নিতে চলে আসে ইমান্দিপুরে। পুরো ছুটি ঢাকায় কাটিয়ে গতবিকেলে ফিরেছে প্রিয়। গ্রীষ্মের ছুটি খুব একটা জমেনি তার। বাবা সারাক্ষণ হাসপাতালের কাজে ব্যস্ত ছিল। কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি এবার।
আগামীকাল থেকে ক্লাস। বইপত্র গোছগাছ করছে প্রিয়। এমন সময়ই বাহির থেকে তানহার আওয়াজ ভেসে এলো। খালার সাথে কথা বলছে। প্রিয়’র ফেরার কথা শুনে সকাল সকালই চলে এসেছে। ছুটে এসে ঝাপটি মেরে জড়িয়ে ধরল। হেসে ফেলল প্রিয়। তানহাকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
‘ এতো শক্ত করে কেউ জড়িয়ে ধরে। ম*রে যাবো তো ভাই।’
তানহা ছাড়ল না আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদে গদগদ কন্ঠে বলতে লাগল,
‘ তোকে কতটা মিস করেছি জানিস? এতকিছু হয়ে গেল কিছু জানালি না। কি ভেবেছিস তোরা কেউ না বললে আমি কিছু জানতে পারবো না? ‘
প্রিয় না বুঝার মত করে বলল,’ কি জানানোর কথা বলছিস।’
‘ একদম না বুঝার ভান করবিনা প্রিয়। তোরা পিকনিকে গিয়েছিলি জানিনা আমি? আমি সব জানি। জুবাইদা না হয় কোন কারণে বলেনি। তাই বলে কি তুইও জানাবি না আমায়। আমি কি তোর এতটাই পর?’
শেষ কথা অভিমান জুড়েই বলল তানহা।
‘ যাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা। জুবাইদার জোরাজোরিতে যেতে হয়েছে শেষমেশ। সরি’
‘ ইট’স ওকে।’
ঠোঁট উল্টে উত্তর দিলো তানহা। কিছু একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল,
‘ তুই নাকি ওয়াশরুমে আটকা পড়ে গেছিলি। কপালে নাকি লেগেছে খুব। এই কা*টা দাগটা কি সেদিনকার?’
বলেই প্রিয়’র কপালের ভেসে থাকা শুকনো দাগটার দিক হাত বাড়ালো তানহা। ছুঁয়ে দিয়ে আফসোস সুরে বলল,
‘ ইশ। কতক্ষাণী কেটেছে।’
‘ এত কিছু তুই জানলি কি করে? কে বলল তোকে’ জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল প্রিয়।
‘ কে আর বলবে। সে বলেছে। তোকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়িতে তো সেদিন এত রাত করে বাড়ি ফিরল। বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি জ্বর বাঁধালো।’
প্রিয়’র চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে এলো। তানহার কাছে শতাব্দের এভাবে এক্সকিউজ না দিলেও হতো! প্রিয় তো বলেনি তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। দেরি করে বাড়ি ফিরতে। শতাব্দই তো জোর করল। সেই রাতের স্মৃতি পুরোপুরি মনে না থাকলেও। আবছা আবছা মনে আছে প্রিয়’র। সেদিন শতাব্দের যত্ন করা, তাকে নিয়ে চিন্তা করা মনে গভীর দাগ টেনেছে তার। পূর্বের সব খারাপ লাগাগুলো অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভীষণ বাজেভাবে আ*ঘাত করল। তানহার কাছে এভাবে তুচ্ছ অসহায় না বানালেও পারত তাকে। কি প্রমাণ করল। সে ভীষণ দয়ালু? দানবীর! আচমকাই শতাব্দের উপর প্রচন্ড রাগ হলো প্রিয়’র। মনে খারাপ লাগার নতুন দানা বাঁধতে শুরু করল। কেন এমন হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছেনা সে। তানহার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গল। গম্ভীর মুখ করে বলল,
‘ আমি কি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলাম তাদের? তারা জোর করে নিয়ে গেল!’
‘ ওমা! ওদের একটা দায়িত্ব আছে না? ফ্যামিলি পিকনিকে যেয়ে এমন এক্সিডেন্ট ঘটলো। ওরা সেটা দেখবেনা। আমি বুঝিনা বাপু ওর সাথে তোর সমস্যা কিসের। নাম শুনলেই এমন খ্যাঁক করে উঠিস কেন!’
নাকের ডগা লাল করে। ঝাঁঝাল গলায় উত্তর দিলো প্রিয়,
‘ বুঝতে হবেনা তোকে। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পুরুষ তোর বয়ফ্রেন্ড। কিন্তু আমার তাকে পছন্দ না। পছন্দ না মানে একদমই পছন্দ না।’
প্রিয়’কে রেগে যেতে দেখে তানহা চুপ থাকল। একটু সময় নিয়ে ডাকল,
‘ প্রিয়। শুন না! একটা কথা ছিল।’
প্রিয়’র রাগ তখনো কমেনি। দমেছে একটু। আড়চোখে তানহার দিক তাকালো। বেচারির মুখ চুপসে। কথাটা বলতে যেন ভয় পাচ্ছে সে। চোখ বুজে রাগ দমানোর চেষ্টা করল প্রিয়। বলল,
‘ বল। শুনছি।’
তানহা ভয়ে আমতা আমতা করে বলল,
‘ বলছিলাম কি প্রিয়। অনেকদিন হলো আমাদের কোথাও হয়না। শুনেছি হাইওয়ের আছে নতুন রেস্তোরাঁ হয়েছে। বাহিরের লোকরা এসে করেছে। রেস্তোরাঁর ভিতরে নাকি খুব সুন্দর সাজসজ্জা। চলনা আজ বিকালে যাই আমরা।’
প্রিয় স্পষ্ট স্বরে বলল,
‘ খালা মানবেনা।’
‘ জানতাম তুই এই কথাটা বলবি। তাই আগেই ব্যবস্থা করে এসেছি। তোকে না জানিয়ে আগে আন্টি থেকে পারমিশন নিয়ে নিয়েছি।’
‘তুই রেঁস্তোরার কথা বললি আর খালা রাজি হয়ে গেল?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল প্রিয়।
‘ ধুর। রেস্তোরাঁর কথা বলেছি নাকি?’
‘ তাহলে?’
‘ বলেছি আজ আমার বোনের জন্মদিন। মা দাওয়াত করেছে। বিকালে এসে নিয়ে যাবো তোকে।’
বিরক্ত হলো প্রিয়। ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,
‘ আমি যাবোনা তানহা। ভালো লাগে না আমার।’
শুনল না তানহা। মুখ ছোট করে বলল,
‘ জুবাইদার সাথে পিকনিকে গেলি। এখন আমি যেতে বলছি বলে মানা করছিস। জুবাইদাই তোর সব আমি কিছুনা।’
‘ ইমোশনাল ব্লা*কমেইল করে লাভ হবেনা তানহা। এসব ভালো লাগে না আমার।’
‘ যেতে হবেনা তোকে। কেন যাবি? আমি তোর কে?’
মন খারাপ করে উত্তর দিলো তানহা। আড়চোখে দেখল প্রিয়। ফোঁস করে বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ আচ্ছা যাবো। এখন খুশি?’
ফিক করে হেসে ফেলল তানহা। প্রিয়’কে জড়িয়ে ধরে খুশিতে গদগদ করে বলল,
‘ হ্যাঁ। অনেক খুশি। তৈরি থাকবি।বিকাল চারটায় নিতে আসবো আমি।’
আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে চলে গেল তানহা। তানহা চলে যেতেই প্রিয় বারান্দায় গেল। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুজে নিলো প্রিয়। বিদুৎ চলে গেছে। বাহিরে দক্ষিণা বাতাস বইছে।কড়া রোদটা গায়ে লাগছেনা তেমন। এই কাঠফাটা গরমে ঠান্ডা আবেশটা বেশ লাগছে। শরীর জুড়ালেও, মন মস্তিস্কটা বড্ড অশান্ত। এই অশান্তির কেন্দ্রবিন্দু শতাব্দকে ঘিরে। মানুষটাকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছেনা প্রিয়। বাজে অভ্যাস হয়েছে আজকাল। সারাক্ষণ শুধু লোকটাকে নিয়ে ভাবে। তাও যেই সেই ভাবনা না। ভীষণ গভীর চিন্তাভাবনা । চোখ বুঝলেই ভেসে উঠে লোকটার মুখ। ঢাকায় থাকাকালীন ছুটিতে বেশ মনে পড়েছে। দেখার ভীষণ তৃষ্ণা জেগেছে। এসব লক্ষণ মোটেও ভালো ঠেকছেনা প্রিয়’র। শত হোক তানহা ভালোবাসে শতাব্দকে। সেখানে তার প্রতি প্রিয় দুর্বল হয় কি করে! অশান্তি অস্বস্তিতে ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে বুক। এভাবে চলছেনা। চলবেনা! দ্রুত এসব ছাইপাঁশ আবেগ অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তাকে।
বিকাল ঠিক চারটায় রিকশা নিয়ে টিপটপ সেজে তানহা হাজির হয়েছে। রিকশায় বসেই তাড়া দিলো প্রিয়’কে। ঝুমকার হুক লাগাতে লাগাতে প্রিয় রিকশায় চড়ল। প্রিয়কে দেখে তানহা অবাক হলো। চোখ নাচিয়ে বলল,’ বাহ। ট্রেডিশনাল লুকে তো বেশ মানাচ্ছে তোকে। এই কালো বারিশটা কবে কিনলি?’
‘ এবার ছুটিতে মা ধরেবেঁ*ধে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে কিনে দিয়েছে।পুরো কাবার্ড ভর্তি সেলোয়ার-কামিজে। সব গুলোর রঙ বোল্ড আর ডার্ক। শুধু বারিশেরই আটটা কালেকশন আছে। ভাব মা কি পরিমাণ আকৃষ্ট বারিশে।’
চোখেমুখে পড়ন্ত চুল গুলো গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত স্বরে উত্তর দিলো প্রিয়। অবাক হলো তানহা। বিস্মিত কন্ঠে বলল
‘ শুধু বারিশই আটটা! তাহলে তো এবার ছুটিতে তোর বেশ লাভ হয়েছে। যাই বলিস ডার্ক কালারে বেশ মানায় তোকে। ভীষণ সুন্দরী যে।’
‘ হয়েছে আর তেল মাখতে হবে না আপনার।’
পঁচিশ মিনিটের মাথায় রিকশা পৌঁছাল রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর বাহিরে শতাব্দের বাইক দেখে রেগে গেল প্রিয়। অনেকটা চেঁচিয়েই বলল,
‘ তোর বয়ফ্রেন্ডও আসবে বলিসনি তো আগে।’
তানহা থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
‘ ওঁই তো দাওয়াত করেছে তোকে।’
‘ এটা ভালো করিসনি তুই। আগে জানলে আমি কোনদিনই আসতাম না।’
‘ তাই তো বলিনি তোকে।’
প্রিয়’র রাগ বাড়ল। পিছন দিক হাঁটা দিলো। বলল,
‘ আমি এখনি বাড়ি যাবো।’
ছুটে এসে হাত ধরল তানহা।আশেপাশে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে মিনতি স্বরে বলল,’ আশেপাশে সবাই দেখছে। প্লিজ চলে যাস না প্রিয়। আজকেই প্রথম আজকেই শেষ আর কোনদিন মিথ্যা বলবো না তোকে। থেকে যা প্লিজ।’
আশেপাশে তাকালো প্রিয়। সত্যিই লোক দেখছে। বাড়িতে একা যাওয়াটাও ঠিক হবে না এখন। এত তাড়াতাড়ি ফিরে গেলে খালা একশোটা প্রশ্ন করবে। সরু দৃষ্টিতে তানহার দিকে তাকালো। তানহা কাচুমাচু মুখ করে বলল,
‘ এখন কি রাজি করতে তোর পা ধরবো বোন?’
‘ তার প্রয়োজন নেই। মনে থাকে যেন এটাই প্রথম এটাই শেষ।’
বলেই চোখ রাঙ্গালো প্রিয়।
রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকে পেছন থেকে সমুদ্রকে হাত উঁচিয়ে ডাকতে দেখে হতভম্ব প্রিয়। পাল্টা জবাবে তানহাও হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে ইশারা করছে। আশেপাশের লোকজন তাকিয়ে আছে। তা দেখে তানহার হাত টেনে প্রিয় চাপা স্বরে বলল,
‘ আস্তে, লোকজন দেখছে। এত লাফালাফি করার কি আছে? যেন তোর বর এসেছে।’
‘ বর না হোক বয়ফ্রেন্ড তো এসেছে।’
তানহা খুশিতে গদগদ করে বলল। বিস্মিত দৃষ্টিতে তানহার দিকে তাকাল। বিমূঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” এটা তো সমুদ্র ভাই’
‘তো?’
‘তুই বলেছিলি চেয়ারম্যানের ছেলে তোর বয়ফ্রেন্ড।’
‘ হ্যাঁ। সমুদ্র কি চেয়ারম্যানের ছেলে না?’
কপাল কুঁচকে উত্তর দিলো তানহা। প্রিয় মাথা ঝারা দিয়ে বোঝানোর স্বরে বলল,
‘ সমুদ্র ভাইয়া তো জুবাইদার ভাই। চেয়ারম্যানের ছেলের শতাব্দ ভাই। যার সাথে তোর প্রেম!’
তানহা বিরক্ত হলো। কন্ঠে বিরক্তি ঠেলে বলল,
‘কি আবল তাবল বকছিস প্রিয়? শতাব্দ ভাইয়ের সাথে আমার প্রেম হবে কেন? দুবছর যাবত সমুদ্রের সাথে আমার প্রেম চলছে। সমুদ্র জুবাইদার জেঠাত ভাই। শতাব্দ ভাই, সমুদ্র আর শাদ তিন জনই চেয়ারম্যানের ছেলে। বুঝেছিস?’
প্রিয় আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময় কাটছে না কোনভাবেই। যেন কোন গোলকধাঁধায় আটকে গেছে সে। তানহার আচমকা ডাকে প্রিয়’র ঘোর কাটল। এতোদিন মাথায় আটকে থাকা ঝটটা হঠাৎ-ই নাই আর। বুকের অস্বস্তি অস্থিরতাটাও উদাও হয়ে গেল।সারা শরীর জুড়ে শান্তির শীতল হাওয়া বইতে লাগল। ‘শতাব্দ’ মুচকি হেসে বিরবির উচ্চারণ করল। আজ এই অপ্রিয় নামও ভীষণ প্রিয় লাগছে প্রিয়’র।
চলবে….
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। তাড়াহুড়ায় চেক করা হয়নি আজ। এক দিন পরপর গল্প দেওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু সত্যি বলতে আপনাদের রেসপন্সে প্রচন্ড হতাশ।