#অস্তিত্ব
#পর্বঃ১৩
#বনলতা
রেড সিগনাল এ এসে গাড়িটা থামল।মাথাটা ঘুরছে আশার।মনে হয় এক্ষুণি বমি হয়ে যাবে।ড্রাইভিং সিটে বসে আছে ইফতি।এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্যহাতে ঘড়ি দেখছে বার সময় দেখছে।আশার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সে।আশাকে পুরো বিধস্ত দেখাচ্ছে। সিটে মাথা দিয়ে চোখটা বন্ধ করে আছে আশা। কপালের ওপর কিছু চুল এসে উড়াউড়ি করছে।এসি গাড়িতে এসে উঠতেই পারেনা।
কপালের চুলগুলো হাত সরিয়ে দিয়ে আশার মাথাটা নিজের বুকে এনে রাখে সে।ক্লান্ত চোখদুটো মেলে তাকিয়ে থাকে ইফতির দিকে।বড্ড উদাস সেই চাহনী।হঠাৎই মুখটা ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে আশা।ইশারায় গাড়ির ডোর আনলক করতে বলে।দরজা খুলে যেতেই দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয় সে।রাস্তার পাশে গিয়ে বমি করে দেয়।গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে আশার কাছে দৌড়ে যায় ইফতি।এলোমেলো আশাকে বুকের ভেতরে আকড়ে নেয়।
সকাল বেলা আশারা যখন খেতে বসে তখন ইফতির ফোনে একটা কল আসে।কলটা রিসিভ করে কথা বলার পরই গাড়ি নিয়ে বের হয় ইফতি।সঙ্গে নেয় আশাকেও।রাস্তায় দু-একবার জিজ্ঞেস করেছে সে, যে তারা কোথায় যাচ্ছে। উত্তরে ইফতি কিছুই বলেনি।সকালে শুধু দুটো আলুর পরোটা আর ডিম ভাজি খেয়েছে আশা।একে তো সে পরোটা খেতে পারেনা,দ্বিতীয়ত গাড়িতে চড়তে পারেনা।সবকিছু মিলিয়ে এই অবস্থা।
সিগনালে সবুজ বাতি জ্বলে গেছে ইতিমধ্যে। গাড়িটা রাস্তার একপাশে পার্কিং করেছে ইফতি।আশা চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে সিটে এসে বসল।সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে জিজ্ঞেস করে ইফতিকে,
“আমাদের যাওয়াটা কি খুবই জরুরি,
গাড়ি রোডে নিয়ে ইফতি শুধু বলে উঠে,
” হুম,খুব জরুরি,
চোঁখটা বন্ধ করে সিটে মাথা ঠেকিয়ে গা এলিয়ে দেয় আশা।নাহ্!তার কিছু ভালো লাগছেনা।
_______________________
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।মোরশেদ মিয়া ভ্যানে করে বাড়ি আসছে।হাতে তার বড় ব্যাগ।ব্যাগে দই এর ভাড়।মিষ্টি আর কাঁচাগোল্লাও নিয়েছে সে।উত্তরপাড়া পার হয়ে কিছুদুর গিয়ে ভ্যান আর এগুতে পারেনা।এগিয়ে যাবে কি করে।সামনে পুলিশ আর সাংবাদিক,মিডিয়ায় গাড়ি।অবাক হয় মোরশেদ। কি হয়েছে যে পুলিশের সাথে আবার সাংবাদিক ও।নদীর পাড়ে এগিয়ে যায় সে।সড়ক থেকে দেখতে পায় দুরে কিছুলোক কান্নাকাটি করছে।তাদের আহাজারিতে আকাশ-পাতাল ভারী হয়ে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে আসে মোরশেদ। অবাক হয় মোরশেদ। কি ব্যাপার ও যতই সামনে এগুচ্ছে লোকজন ততই সরে গিয়ে ওর যাওয়ার পথ ফাঁকা করে দিচ্ছে। আর অশ্রুসজল চোখে সবাই ওর দিকেই চেয়ে আছে।নিজের চোখেমুখে হাত দেয় সে।নাহ্ তেমন কিছু তো হয়নি।তাহলে সবাই ওর দিকেই কেন তাকিয়ে আছে।
পুলিশের লোকগুলোর একজন পানিতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নদীর পাড়ে এসে মোরশেদ দেখতে পায় ওর ভাইজান, জাহানারা, নাজমা,মিষ্টি সবাই কান্নাকাটি করছে।জাহানারাকে সামলানো যাচ্ছে না।বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে ওর।হাটুসমান পানি পাড় হয়ে ওপারে যায়।হাতের ব্যাগ তার পরে থাকে নদীর এপারে।জাহানারার হাতদুটো চেপে ধরে মুখে হাত বুলিয়ে বলে ওঠে,
“মায়ার মা,কি হইছে তোমার।মিষ্টি,ভাইজান,ভাবী তোমরাই বা কান্দো ক্যান?আমার মায়া কই।গলাটা ধরে আসে তার।দিশেহারা মোরশেদ পানিতে ভেসে থাকা মায়াকে দেখতেই পায়নাই।মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে।কাঁদতে কাঁদতে হাত ইশারা করে পানিতে ভেসে থাকা লাশটারে দেখায় দেয়।ক্ষণিকের জন্য থমকে যায় মোরশেদের পৃথিবী।দৌড়ে গিয়ে পানি থেকে পাজাকোলা করে তুলে নেয় মায়াকে।পুলিশের হাজারো বাধা সে না মেনেই জড়িয়ে ধরে মায়াকে।
পানিতে কাউকে কোলে নিতে বা টেনে তুলতে কোনো কষ্ট হয়না।ভারী অনুভব হয়না।কারন বায়ুমন্ডল অপেক্ষা পানিতে বস্তুর ওজন হালকা হয়ে যায়।কিন্তু মোরশেদ তো বাবা।একজন বাবার কাছে তার সন্তানের মৃতদেহ সবচেয়ে ভারী।মায়াকে পাঁজা কোলা করে কোলে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সে।পুরুষ মানুষ সহজে কাঁদে না।তারা পাহাড় সমান কষ্টও সহ্য করে নেয়।কিন্তু আজ সে মেয়ে হারিয়েছে। যার মুখে প্রথম বাবা ডাকটা শুনে পিতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিলো সেই কলিজার টুকরার #অস্তিত্ব আজ নেই।
মায়ার পড়নে কালো চুড়িদার।যেটা কাল রাতে ও পড়েছিলো।গলায় ওড়না নেই।ওড়নাটা দিয়ে হাতদুটো শক্ত করে বাঁধা। চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। গলায় মোটা রশি দিয়ে কলসি বাঁধা। এমন দৃশ্য দেখলে কোন বাবা স্থির থাকতে পারে।না, স্থির নেই মায়ার বাবা।চিৎকার করে কান্না করছে সে।আজ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে মোরশেদ বড্ড ক্লান্ত। হালকা পাতলা এই মেয়ের লাশটাকে তার পাহাড় সমান ভারি লাগছে।পানিতে ওভাবেই বসে পড়ে সে। বসার সাথে সাথে ডুবে যায় মায়া। মোরশেদ আবারও তুলে ধরে মেয়েকে।পুলিশের লোকদুটো এসে মায়াকে নিয়ে পাড়ে শুইয়ে দেয়।ফর্সা চেহারাটা একেবারে সাদা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে।গলায় রশিটা বসে গিয়ে তা কালো ছাপ পড়ে গিয়েছে।
পানি থেকে উঠে আসে মোরশেদ।মেয়ের কাছে গিয়ে বসে পড়ে।পান্জাবীর পকেটে হাত দিতেই বের হয়ে আসে একটা পায়েল।মায়া আর মোরশেদ বাবা মেয়ে হলেও তাদের সম্পর্কটা একেবারে বন্ধুর মতো।মায়া যতটা ওর বাবার সাথে মিল ছিলো ততটা ওর মায়ের সাথেও ছিলোনা।নিজের জামাকাপড়, কসমেটিক অবদি ওর বাবা এনে দিতো।কোথাও গেলে কোনো কসমেটিকস বা জামা কিছু ভালো লাগলে তা মায়ার জন্য আনতে ভুলবে না মোরশেদ। দুরে কোথাও ইসলামি ওয়াজ মাহফিল হলে মোরশেদ যদি যেতো মায়ার জন্য চুড়ি অথবা কানের দুল,মালা কিছু না কিছু নিয়েই আসত।আজ এই পাথর বসানো পায়েলটা খুব ভালো লেগেছে তার। তাইত মায়ার জন্য কিনে নিয়ে এসেছে।
——————————–
পুর্বাকাশে উঁকি দেওয়া সুর্যটা আস্তে আস্তে মাথার ওপরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাংবাদিকদের লোকটা খুবই ঘটা করে ক্যামেরার সামনে কথা বলছে।অবাক হয় মোরশেদ। মৃত্যুটা এদের কাছে স্বাভাবিক। বড্ড স্বাভাবিক। এরা একটা মৃত্যুকে নিয়ে মনোরঞ্জিত করে খবর তৈরি করছে।আচ্ছা ওরা কি জানে এই একটা মৃত্যুতে কত কি হয়ে গিয়েছে।এখানে শুধু একটা মৃত্যুই হয়নি।এখানে মৃত্যু হয়েছে অনেকের বেঁচে থাকার #অস্তিত্ব
#চলবে,,,,,
#অস্তিত্ব
#পর্বঃ১৪
#বনলতা
দামী একটা কার এসে থামল সড়কে।তা থেকে নেমে আসে আশা।লোকজনের ভীর দেখে বুকটা তার ধরফর হয়ে ওঠে।ক্লান্ত বিধস্ত শরীরটা কোনোমতে টেনে নিয়ে চলে যায় নদীর পাড়ে।তাকে কিছু বলতে হচ্ছে না।দেখাতে হচ্ছে না।চোখদুটোতে অপার বিস্ময় নিয়ে সম্মোহনীর মতো পানিতে নেমে ওপারে যাচ্ছে। গায়ের জামাটা ভিজে একাকার। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার।ইমরান,মুহিন,শান্তা,রোজা এমনকি আশার মা বাবা সবাই আছে।সবাই কাঁদছে।আজ যেন কান্নার উৎসব। মায়ার নিথর দেহটা পড়ে আছে পাড়ে।চারদিকে সিল করে দেওয়া হয়েছে।মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে গড়ে যাচ্ছে। আর সহ্য করতে পারেনা সে।পুরো পৃথিবী চক্কর দিয়ে ওঠে তার।চোখদুটো দিয়ে কিছু দেখতে পায়না অন্ধকার ছাড়া।কানে বাজছে কারো হাসির শব্দ।যে খিলখিলিয়ে হেসে বলে যাচ্ছে।বারে বারে মনে পড়ছে এই মায়া পাখির কথা।যে সবসময়ই বলত,
“দোস্ত তুই এত্ত সুন্দর ক্যান,আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে তোর সাথেই প্রেম করতাম,
সকাল থেকে মন আর শরীরের যুদ্ধে এই অবদি টিকে থাকা আশা অঙ্গান হয়ে পড়ে যায় মাটিতে।
_____________________
এম্বুলেন্স এসেছে একটু আগেই। এখনই পোস্ট মোর্টেম এর জন্য নিয়ে যাওয়া হবে মায়াকে।অবাক চোখে চেয়ে আছে তমাল।সবঠিক থাকলে আজ ওরা মায়ার বাসায় যেতো।কদিন পরেই বিয়ে হতো।সংসার হতো।যার স্বপ্ন সে দেখে চলেছে গত পাঁচ বছর ধরে।তার স্বপ্নের দেয়ালে ঘুনপোকার #অস্তিত্ব সে দেখতে পাচ্ছে। যা নিমিষেই শেষ করে দিচ্ছে মায়ার #অস্তিত্ব।
পুলিশের অফিসারটা এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে সবাইকে। হাতে তার অডিও স্পিকার।মোটা ভুড়িওয়ালা পেটে হাত বুলিয়ে এসে দাড়ায় মুহিন আর ইমরান এর কাছে।মায়া সম্পর্কে খুটিনাটি সব জিজ্ঞেস করে।
সাংবাদিক তার হাতের অডিও মাইক্রোফোন টা ধরে মোরশেদের মুখের সামনে।ক্যামেরায় ফোকাস করে ওর বিধস্ত মুখখানা।চোখের কার্নিশ বেয়ে অবিরাম ঝরছে নোনা পানির ঝরনা।সাংবাদিকদের কাথা তার কান অবদি পৌছায়না।মোরশেদ মায়ার পাশে ঠাঁই বসে থাকলেও তার ভাবনায় চিন্তায় সে এখানে নেই।সে তো পড়ে আছে সেই উনিশ বছর আগে।
জাহানারাকে বিয়ের দুমাস পরেই মোরশেদ জানতে পারে পরিবারে নতুন অতিথির আগমন ঘটবে।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওদের কোল আলো করে মায়া আসে ওদের সংসারে। আস্তে আস্তে মায়ার বেড়ে ওঠা,আধো আধো বুলিতে কথা বলা,নরম হাত দিয়ে বাবার হাতটা ধরে মুখে পুরে দেওয়া,একপা দুপা করে হাটতে শেখা,আস্তে আস্তে বড়ো হয়ে ওঠা সব,সবই কল্পনায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
ছোটবেলায় ঠিক যেমনটা করে মায়া ওর বাবার হাতটা ধরে হাঁটত, আজ ঠিক তেমনটা করেই মোরশেদ মায়ার হাতটা আঁকড়ে ধরে।নরম হাতটা একেবারে শীতল হয়ে গিয়েছে। হঠাৎই হাতের বাধন আগলা হয়ে যায়।হাতটা ছুটে যায়।মায়াকে দুজন মিলে ধরে স্টেচারে তুলছে।রাস্তায় এম্বুলেন্স রাখা আছে।স্তম্ভিত ফিরে মোরশেদের। মায়া চলে যাচ্ছে। একেবারে চলে যাচ্ছে। আর কখনও দেখা পাবেনা তার।
আজ থেকে শেষ। সব শেষ। ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে কেউ আর বারেবারে গিয়ে ডাকবেনা।মাহফিলে যাওয়ার সময় কেউ ফিসফিস করে বলে দেবেনা,”বাবা আমার জন্য কিছু এনো কিন্তু, “জামাকাপড় কিনতে গেলে আহ্লাদী সুরে কেউ বলবে না,” বাবা দেখোতো কোনটাতে আমায় বেশি ভালো লাগবে, তুমি যেটা বলবে সেটাই নেবো,”
গায়ের জামাকাপড় গায়েই শুকিয়ে যায়।তবু শুকায় না মোরশেদের মনের জ্বালা।মনটা তার ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে।
__________________
সুর্য মাথার ওপরে গনগন করে তাপ ছড়াচ্ছে। বারান্দায় বসে আছে মোরশেদ, জাহানারা,মিষ্টিসহ আরো আত্নীয় স্বজন।উঠোনে জড়ো হয়েছে পাড়ার লোকজন।এইতো সকালেই যারা মায়ার নিখোঁজ সংবাদে মায়ার চরিত্রের খুটিনাটি বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছিলো,এখন তারাই মায়ার অস্তিত্বের বিলীনে হাহাকার করছে।মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী।কালক্রমে সভ্যতার বিকাশ ঘটলেও বেশিরভাগ মানুষের মনের সুষ্ঠ স্বাভাবিক বিকাশ আজ অবদি ঘটেনি।পাশে থাকতে তারা কোনো কিছুর মুল্যায়ন করতে চায়না,গুরুত্ব দেয়না।অথচ তা যখন হাতের নাগালের বাহিরে যায় তখন তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে হাহাকার করে।আজও তার ব্যাতিক্রম ঘটল না।
#চলবে