অস্তিত্ব,পর্ব:১০

0
879

#অস্তিত্ব
#পর্বঃ১০
#বনলতা

ঘরটাতে মিটিমিটি নীল আলো জ্বলছে। বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে আশা
।পুরো বিছানা জুড়ে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো।বেলি ফুলের সুবাসে পুরো ঘর মেতে আছে।ভারী বেনারসী আর গয়নার আড়ালে আশা অস্বস্তি বোধ করছে।ঘুমের চোটে দুচোখ যেন বুজে আসছে।কাল সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি।লম্বালম্বি করে ওপর থেকে খাটের পায়া পর্যন্ত বেলি ফুলের মালা গেঁথে সাজানো হয়েছে রুমটা।আশা আলতো হাতে দুই তার মালা সরিয়ে দেয়ালে টাঙানো ঘড়িতে তাকালো। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে এখন রাত দেড়টা বাজে।এবার বড্ড বিরক্ত লাগছে তার।আর কতক্ষণ সে এমন মুর্তির মতো বসে থাকবে।এমন পোশাকে অভ্যস্ত নয় সে।

হঠাৎই দরজাটা ঠেলে ভেতরে আসে ইফতি।গায়ের নীল রংয়ের শেরওয়ানি।আশা চমকে ওঠে।চোরের মতো চুপিচুপি দেখতে থাকে।আচ্ছা একজন স্বামী হিসেবে কেমন হবে ইফতি।আর তার ব্যাবহারটাই বা কেমন।মাথায় পাগড়িটা খুলে ওয়ারড্রবের ওপর রেখে দেয় ইফতি।শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। যশোর থেকে নারায়ণগঞ্জ। এতদুর জার্নি করে শরীর মন উভয়ই ক্লান্ত।

ব্যাগ থেকে একটা নীল সুতি শাড়ি বের করে আশাকে দেয় সে।হাতে একটা টি-শার্ট আর টাউজার নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দেয়।প্রায় বিশ মিনিট পর বের হয় সে।ইতিমধ্যে আশা গায়ের গয়নাগুলো খুলে হাতে শাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।ও যেন ইফতিরই বের হবার অপেক্ষায় ছিলো।ইফতি বের হওয়ার পরই আশা ঢুকে যায় ওয়াশরুমে।আশার ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে যায়।

রুমে ইফতি নেই।আশা ভাবে না।এই ছোটখাটো বিষয় এ তার ভাবতে আর ভালো লাগে না তার।যা ঘটছে বা ঘটবে তা সুষ্ঠ স্বাভাবিক ভাবে ঘটতে দেওয়াই ভালো।যা হবে তা হবেই।অযথা আহাজারিতে তা পাল্টাবে না।গোসল করে ভালো লাগছে।এখন লম্বা একটা ঘুম দিলে বেশ হবে।প্রায় পাঁচ মিনিট পর রুমে আসে ইফতি। হাতে দুই কাপ কফি।আশা ড্রেসিং এর সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে।

———————————-

মাত্রই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো শান্তা।মনটা খুব খারাপ লাগছে তার।বিয়েতে যতটা না মজা করেছে তার থেকে বেশি খারাপ লাগছে এখন।শান্তার বড়বোন উর্মি।বিয়ে করে হাজবেন্ড এর সাথে লন্ডন থাকে।এখানে এসেছে বেড়াতে।বসন্তের কোকিলের মতো কালভদ্রে হঠাৎ দেখা পাওয়া যায় তাদের এই বাংলাদেশে।এবার উর্মি শান্তাকে ওর সাথে লন্ডন নিয়ে যাবে।কথাটা প্রথমে উর্মির বর নিলয়ই বলেছিলো।শান্তার ইচ্ছে বড় হয়ে সে একজন লইয়ার হবে।যার কারনে নীলয় আর উর্মি শান্তাকে ওদের সাথে নিয়ে যেতে চায়।আর পাঁচদিন পর ওদের ফ্লাইট।

খুব করে কাদতে ইচ্ছে করছে শান্তার। একদিকে নিজের স্বপ্ন অন্যদিকে মা-বাবা,ভাইয়া,আর প্রাণের চেয়ে প্রিয় বন্ধুমহলের স্বকীয় প্রাণ।আচ্ছা কতদিন লাগবে ওর পড়া শেষ করতে।উকিল হতে গেলে কি দেশেই পড়াশোনা করে হওয়া যায় না।শান্তা না থাকলে কি ওর বন্ধুমহল মনে রাখবে ওকে।নাকি ভুলে যাবে।শান্তার জায়গায় অন্য বন্ধু বানিয়ে নেবে তারা।আচ্ছা ওদের থেকে দুরে থাকলে উন্নত জীবন কাটাতে পারবে সে।কিন্তু কথায় কথায় পান্তার মা বলে কে রাঙিয়ে দেবে তাকে।একদম নীট এন্ড ক্লীন হয়ে চোখে চশমা লাগিয়ে বিঙ্গের মতো ভঙ্গি করে কথা বললে ঢঙী লইয়ার কে বলবে তাকে।

জানালার থাইটা সরিয়ে দিতেই চাঁদের স্নিগ্ধ আলো প্রবেশ করে ঘরের ভেতরে।অভিমানি কন্ঠে বলে ওঠে শান্তা, “ও চাঁদ,তুমি কি জানো আমি রাগ করেছি বড়মা আর উর্মি আপুর ওপর।চাঁদ আমিতো থাকবোনা,চলে যাবো লন্ডন। ওখানে বুঝি তোমার লন্ডন এর চাঁদভাই থাকে।শোনোনা আমি কোনোদিন ভুলবোনা।মায়া,আশা, মুহিন আর আমার রাগী ভাইয়ার কথা।তোমায় কথা দিলাম।কিন্তু ওরা আমায় মনে রাখবে তো,

——————————-

শোয়া থেকে উঠে বসে মুহিন অন্ধকারে হাতড়িয়ে মোবাইল এর ফ্ল্যাশটা জ্বালায়।অনস্কীনে জ্বলজ্বল করে ওঠে ছয়প্রাণের মুখ।ছবিটা আজকেই তোলা।মায়াকে আজ একটু বেশিই মায়াবী লাগছিলো।চোখ ফেরানো দায় ছিলো।জানালাটা আস্তে করে খুলে দিয়ে চাঁদের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে।অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে “আলহামদুলিল্লাহ,আজ মায়াকে চাঁদের মতো সুন্দর লাগছিলো।হয়তো চাঁদের থেকে একটু বেশি।কারন মানুষতো “আশরাফুল মাখলুকাত”।অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব।সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সেরা।দু’হাতে চাঁদের আলো অনুসরণ করে চাঁদ বরাবর হাতটা নিয়ে গিয়ে হাত দিয়েই চাঁদ মুঠোবন্দীর ভঙ্গিমা করে।হাতটা আলতো করে কাছে নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে ওঠে,” চাঁদ তুমি কি জানো আমি তাকে চাই,

———————————-

নির্ঘুম চোখে ফ্লোরে বসে আছে মায়া।বিছানায় শুয়ে আছে মিষ্টি। কি মায়াবী লাগছে তাকে।আচ্ছা ও কি বিয়ের পরও এমন করে মিষ্টির কাছে আসতে পারবে।মিষ্টি ওকে ছাড়া থাকবে কেমন করে।মিষ্টির যে প্রতিটা ক্ষণে মায়াকে চাই।আস্তে করে মিষ্টির কপালে চুমু খায় মায়া।

ধীরে ধীরে গিয়ে দাড়ায় জানালার কাছে।জানালার গ্রিল ভেদ করে জোসনার আধো আলোয় অর্ধ-আলোকিত হয়ে আছে পুরো ঘর।গ্রিলে মাথাটা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে থাকে মায়া।নিজের এই টানাপোড়েন এর জীবন নিয়ে ভাবতে থাকে।আচ্ছা ভালোবাসলে কি সুখি হওয়া যায়না।যদি সুখি হওয়া যায় তাহলে ও কেনো হলোনা।ওকি ভালোবাসতে ব্যার্থ।

সময়টা পাঁচ বছর আগের। কিশোরী মায়া তখন ভীষণ দুরন্ত ছিলো।সেই দুরন্তপনায় পাগল ছিলো তমাল। খুব করে পাগল ছিলো।কিশোরী বয়স।নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।আস্তে আস্তে সে বুঝতে শেখে তাদের এই প্রেমপ্রীতির মাঝে আস্ত দেয়ালটাই ছিলো অর্থ- বৈভব।ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হঠাৎই দুরে চলে যায় তমাল।অনেকটাই দুরে। একেবারে ধরাছোঁয়ার বাহিরে।আর ওর বাসার লোকজনের অকর্থ্য গালি-গালাজ আর অশালীন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে যায় মায়ার ফ্যামিলি।বিষয়টা পাঁচ কান হয়ে যায়।সবাই ছি ছি করতে থাকে।যেন পৃথিবীতে মায়ায়ই প্রথম যে প্রেমেতে খুব করে পড়ে যত্ন করে মরেছে।

পারিবারিক কলহ আর অশান্তির মাঝে ডুবে থাকা মায়া আশা করে বসে থাকে যেন তমাল একটু সাড়া দেয়।কিন্তু দিনের পরে দিন চলে যায়।মাস যায়।কিশোরী মনে জমে থাকা অভিমান ভেঙে গুড়িয়ে তা জমাটবাধা শক্ত আবদ্ধে পরিণত হয়।এই আবদ্ধ কে প্রেম ভালোবাসা বলে না।এটা কে বলে অবহেলায় হেরে যায় মন।ব্যার্থ এক উপন্যাস।

এই পাচটা বছরে মায়ার আচরণে বা কথায় তমাল বা তার কোনো গল্প কথা আভাস কিছুই ছিলোনা।কিন্তু মনে মনে ছিলো।মায়া তো পুরে কয়লা হয়ে গিয়েছে।ওর মনটা এতটাই পুরেছে যে সেখানে পোড়ামনের বন তৈরি হয়েছে। ভালোবাসাটা হবে বলে আর মনে হয়না।পাঁচটা বছর কিন্তু কম সময় নয়।মায়া নিত্য তা হিসেব করে রেখেছে।আবার ভুলও করেছে।কিন্তু মনে রাখাটা ভুলে যায়নি।

দুরের ওই চাঁদ যেন মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসছে।বড়ো মায়াবী সেই হাসি।পাঁচবছর আগে এমন হাসিতেই পাগল হয়েছিল তার কিশোরী মন।আজ এই হাসিকেই অভিশাপ মনে হচ্ছে তার। তমাল অনেক কষ্ট দিয়েছে মায়াকে।অনেক।এতটাই যে তা ভালোবাসার সাথে নিত্য নতুন ঝগড়ার পসরা সৃষ্টি করে।তাদের মধ্যে নিত্যনতুন যুদ্ধ হয়।যে যুদ্ধের আজ অবদি কোনো সুরাহা মেটেনি।

হাতটা জানালার গ্রিল দিয়ে বাহিরে বের করে দেয়।আচ্ছা জোসনা রাতে কি কখনও বৃষ্টি হয়।কি জানি,মায়াতো দেখেনি।তবুও ওর মনে হচ্ছে এখন বৃষ্টি হওয়াটা জরুরি। নইলে ওর হাত বের করে দেওয়াটা অনর্থক। হাতদুটো ভাঁজ করে
চাঁদ এর দিকে চেয়ে থাকে মায়া।কাল তাকে দেখতে আসবে।পছন্দ হলে আংটি পড়াবে।চোখের পানি টুকু হাতদিয়ে মুছে বলে ওঠে মায়া,”ও চাঁদ, স্বাক্ষী থেকো।ওই ছেলেটাকে আমার চাইনা।এই ভালোবাসার উপন্যাসে আমি আর সে মিলে কখনও আমরা হতে চাই না।হতে পারিনা। কখনও না।আমরা দুজন যেন অন্য কারো গল্পের আমি তুমি হয়ে বেঁচে থাকি।আজ থেকে তার অস্তিত্ব আমি মুছে ফেললাম।খুব যতনে মুছে ফেললাম,

——————————–

বিছানায় শুয়ে থেকে আমোদের প্রহর গুনছে বাতাসি।তার যোগ্য ছেলে গিয়েছে পাখি ধরতে।আজ পাখি শিকার করতেই হবে।বাতাসি আবার হার্টের রোগি।নইলে ও নিজের চোখে স্বয়ং স্বশরীরে দেখত পাখির ছটফটানি। আর মিটিয়ে নিতো তার বহু দিনের জ্বালাময় ক্রোধের আগুন।যা দাউদাউ করে জ্বলছে এতদিন ধরে।কুটিল হেসে চাঁদের দিকে তাকায়।বলে ওঠে,ও চাঁদ আমার বদলে তুই দেখে নিস মায়াবী পাখীর ছটফটানি,

—————————–
বারান্দায় বসে আছে আশা আর ইফতি।কফি ইতিমধ্যে শেষ। চাঁদের আলো আর স্নিগ্ধ বাতাসে এক মনেরম দৃশ্য। দুরের চাঁদ দেখে মুচকি হাসে ইফতি।মনে মনে বলে,”চাঁদ এটা আমার বউ,একদম চাঁদের মতো সুন্দর। এই সুন্দর মানুষটাকে আগলে রাখতে চাই সারাজীবন। স্বাক্ষী রাখলাম তোমায়,

ইফতির হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আশা।আশ্চর্য ছেলেটা হাসলে গালে সুন্দর গর্ত হয়।কি দেখে হাসছে ছেলেটা।ওই চাঁদকে দেখে।হতাশ হয় আশা।ইফতির মতো ও তাকিয়ে থাকে ওই চাঁদের দিকে।হয়ত ও একদিন এই ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলবে।নাকি পারবে না।দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবে,এই চাঁদ কি জানে ভালোবাসা একবার আসে নাকি বারবার আসে,

———————————-

তমাল জানালা খুলে জোসনা গায়ে মেখে হাতে গিটার এর সুর তুলেছে।মনে ভীষণ আনন্দ তার।বহু দিনের স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে। আজ বাড়ির সবাই রাজি।কালই যাবে তারা মায়াদের বাসায়।এখন মায়া তো নাই।তাই ওই চাঁদকেই গান শোনাচ্ছে তমাল,

তুমি মোর জীবনের ভাবনা
হৃদয়ের সুখের দোলা,
নিজেকে আমি ভুলতে পারি
তোমাকে যাবেনা ভোলা,

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায় ইমরান এর।খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে।উঠে গিয়ে দেখে আসে শান্তাকে।নাহ্ শান্তা ঠিক আছে।একটা খারাপ লাগা শুরু করে ইমরান এর মনে।কদিন পরে আর দেখতে পারবেনা এই ছোট্ট বোনটাকে সে।পুরো উঠোন জুড়ে জোসনায় মাখামাখি।মায়ার কথা মনে পড়ে তার।ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে হাসির আভা। চাঁদের দিকে চেয়ে ভাবতে থাকে। কে বেশি সুন্দর। ওই চাঁদ নাকি ওই মায়া।আনমনে বলে ওঠে সে,

“ও চাঁদ,
কে বেশি রুপসি,
তুমি নাকি আমার প্রেয়সী❤️

—————————

হাতে কলসি নিয়ে নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলছে দুজন মানব।অন্যজনের হাতে দড়ি।মাঝে মাঝে চাঁদের দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে,নাহ্ আজ এই কাজের স্বাক্ষীটা বরং চাঁদই থাক।

আশ্চর্য একটাই পৃথিবী। একটাই চাঁদ। অথচ কতগুলো মানুষ আর কতগুলো ভাবনা।এত ভাবনা দেখে চাঁদই হতবাক।হায়রে মানুষের মন!

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here