প্রেয়সী পর্ব ৩৪

0
484

#প্রেয়সী 🧡(৩৪)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা

৬৬.

গাল বরাবর পরপর দু’টো থাপ্পড় পড়তে আমার সামনেই হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়ে গেলো অরিন আপু। ভ*য়ং*ক*র রাগে আ*গু*নের লা*ভা গলে গলে পড়ছে রাহিয়ানের চোখ থেকে! আমি ভ*য়া*র্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বিছানা থেকে নেমে ঝাপটে ধরলাম উনাকে! কাশতে কাশতে গলা থেকে বুঝি র*ক্ত বেরিয়ে আসবে এক্ষনি। উনি অস্থির হয়ে শক্ত করে আমাকে নিজের সাথে চেপে ধরলেন! আমার ভাবনাতেও ছিলো না উনি এমন সময় আমার ঘরে আসতে পারেন। আর অরিন আপুও হঠাৎ এমন কান্ড করে ফেলতে পারে! অবশ্য ইদানীং আমার ভাবনাকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেননা, আজকাল যা কিছুই ঘটছে সবই আমার ভাবনার বাইরে।

রাত ৮টা বেজে ১৩ মিনিট। ঘড়িতে সময়টা দেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। রাতে ঘুমটা ঠিকঠাক না হওয়াতে এখন বেশ ক্লান্তই লাগছে শরীরটা। শপিং থেকে বাসায় ফিরে আর রেস্ট নেওয়া হয়নি! তাই হয়তো আরেকটু বেশি ক্লান্ত লাগছে। বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে অনুযায়ী ছেলেরা খুব সহজেই আসতে পারলেও মেয়েদের বেলায় সবাই একটু গোড়ামি সবাই করে। হিয়া আপুর বেলায় তার বাবা যেমন করলেন ঠিক তেমনি অরিন আপু এবং অনন্যা আপুর বেলাতেও করলেন। গতকালই আরফান ভাইয়া আর জিয়ান ভাইয়া আসতে পারলেও, আসতে পারলোনা অরিন আর আর অনন্যা আপু। তবে একদিন পেরোতেই তারাও এসে হাজির হলেন। পুরনো কথা আর মনে না রেখেই আমি অরিন আপুর সাথে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললাম। একই ভাবে রাহিয়ানও নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার খাতিরে ভুলে গেলেন সেদিনের কথা। যদিও অরিন আপুর বলা একটা কথাও আমি তাকে জানায়নি! কেবল বলেছিলাম অরিন আপু তাকে ভালোবাসে। তবে সেটা সত্যিই ভালোবাসা ছিলো নাকি কেবলই কেশবের উসকানি ছিলো সে-ই হয়তো ভালো জানে।

আমি বিছানায় শুইয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। মনে হচ্ছে যেন ঘুম আসবে কিন্তু আসলে ঘুম আসছে না। ব্যাপারটা চরম অশান্তির। হঠাৎই আগমন ঘটল অরিন আপুর। আমি ঘুমাবো ভেবে এক এক করে সবাই রুম খালি করে দিয়ে চলে গেলো। উনাকে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি উঠে বসলাম তৎক্ষনাৎ! মুখে মলিন হাসি দিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে তাকে ডাকলাম। সেও এগিয়ে এলো শুঁকনো মুখে। আমি আবারও ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,

—-” কাউকে খুঁজছেন আপু?”

শুঁকনো মুখ করে থাকা মানুষটা আচমকাই ক্ষে*পে গেলো আমার উপর। আশেপাশে নীরবতা বুঝেই আচমকা গলা চেপে ধরল আমার। আমি বোকা মানুষ ভ*য়া*র্ত চোখে তার আ*ক্রো*শ দেখে ছটফট করতে লাগলাম। কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো আমি হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখেছি! বাবাকে হারানোর মতোই তেমন এক কঠিন দুঃস্বপ্ন! দুর্বল শরীরটা এমন অকেজো হয়ে গেলো যে উনাকে ধাক্কা দিয়েও সরাতে পারছিলাম না! কেবল হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলাম। উনি হিং**স্র চাহনি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলেন,

—-” বলেছিলাম না বিয়েটা ক্যানসেল করে দাও!! শুনোনিতো আমার কথা? তাহলে এবার ম**রো তুমি! তুমি ম**র**লে তো বিয়েটা এমনিতেও ভন্ডুল হবে।”

বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার সময়টা ফুরিয়ে আসছে! চোখে জলের বদলে খন্ড খন্ড র**ক্ত জমাট বাঁধছিলো! গলার আওয়াজটা কেমন ফ্যাচফ্যাচ শোনাচ্ছিলো! আর তারপর হঠাৎ করেই রাহিয়ানের আবির্ভাব ঘটল! উনি কোত্থেকে এলেন জানিনা। কিন্তু উনি যে আমার জীবন বাঁচাতে ফেরেশতার মতো হাজির হলেন তা হলফ করে বলত পারি! আমি এখনও কাশছি! ভীষণ ক**ষ্ট হচ্ছে। গলার কাছটাতে এখনও মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা চেপে আছে। এখনও নিঃশ্বাস নিতে ভারী ক**ষ্ট হচ্ছে! উনাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি! আমার কান্নার শব্দ কানে যেতেই উনি পা*গ*লে*র মতো করতে লাগলেন! আমাকে নিজের থেকে টেনে তুলে জড়ানো গলায় বলতে লাগলেন,

—-” খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার জান? প..পানি! পানি খাবে! বসো?বসো বসো। আমি পা..নি দিচ্ছি তোমায়! প্লিজ কেঁদো না নীলাদ্রিতা! কেঁদো না! প্লিজ কেঁ,,দো না!”

রাহিয়ান দৌড়ে গেলেন পানি নিতে। পানি নিয়ে আবারও এসে হাজির হলেন আমার সামনে! আমার হাতে পানিটা দিতে দিতে ততক্ষণে উঠে দাঁড়ালেন অরিন আপু! আমার দিকে তেড়ে আসতেই দাঁড়িয়ে গেলেন রাহিয়ান। অরিন আপুর মুখোমুখি দাড়িয়ে আর পেছন ফিরে আমার দিকে না তাকিয়েই শান্তস্বরে বললেন,

—-” পানি টা খেয়ে নাও নীলাদ্রিতা।”

উনার দিকে ক্ষে**পা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল অরিন আপু,

—-” খুব দরদ নীলাদ্রিতার জন্য তাই না? একটা দুইদিনের মেয়ের জন্য এতো ভালোবাসা কোথা থেকে আসে বল? এতগুলো বছর ধরে যে পা*গ*লের মতো করে তোকে ভালোবেসে এসেছি কই কখনো তো এমন দরদ করিসনি? কেন বলত? কেন তোর জন্য এতকিছু করেও তোর থেকে ভালোবাসা পাইনি! কেন তুই কখনও আমাকে ভালোবাসিসনি রাফিদ?(চিল্লিয়ে) ঐ বিশ্রী কালো দেখতে মেয়েটার মধ্যে তুই এমন কি পেয়েছিস যা তুই আমার মধ্যে পাসনি? আমি তো ওর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী! তবুও কেন ভালোবাসতে পারলি না আমাকে?”

রাহিয়ান থমথমে মুখে কতক্ষণ চেয়ে থেকে আবারও ঠাসস করে একটা চড় বসাল অরুন আপুর গালে। অরিন আপু ঢলে পড়ল খানিকটা! পূনরায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে গালে হাত চেপে হিং**স্র চোখে তাকালো! দ*হ*নের আ*গু*নে পুড়তে পুড়তে আবারও তেতে উঠল সে।

রাহিয়ানের কলার চেপে রা*গে ফুঁসে উঠতেই আবারও এক রাম চড় মা*র*লে*ন রাহিয়ান! আমি এবার গ্লাস ফেলে দাঁড়িয়ে গেলাম! থাপ্পড়ের আ*ঘা*তে অরিন আপুর দু’টো গালেই স্পষ্ট দাগ বসে গেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে উনার হাত চেপে ধরে আকুতি ভরা চোখে তাকালাম! কি হচ্ছে এসব? অরিন আপু অ*ন্যা*য় করলেও উনি একজন পুরুষ মানুষ হয়ে কিছুতেই একটা মেয়ের উপর হাত উঠাতে পারেননা! এটা ঠিক নয়! যদি শা*স্তি দিতে হয় তবে অন্য ভাবে দিক! তবুও এভাবে নয়। আমার আকুতিভরা চাহনিতে উনি ভ্রুক্ষেপ ঘটাতে পারলেন না। আমাকে পাশ কাটিয়ে আচমকাই অরিন আপুর গলা চেপে ধরলেন উনি! আমি আঁ*ত*কে উঠে মুখ চেপে ধরলাম। অরিন আপু ছটফট করতে লাগলেন তৎক্ষনাৎ! অরিন আপু হাত-পা ছোড়াছুড়ি করেও উনাকে নাগাল পাচ্ছেন না। আমি আবারও ছুটে গেলাম উনার দিকে। উনার শক্ত হাতটা ধরে টানাটানি করতে লাগলেই উনি হিং*স্র চোখে তাকালেন আমার দিকে! আমি ভ*য় পেয়ে চুপসে গেলাম। উনার চোখে দাউদাউ করে আ*গুন জ্ব*ল*ছে। উনি অরিন আপুকে এতো সহজে কিছুতেই ছাড়বেন না।

—-” তোর প্রশ্নগুলো বেশ ছিলো। কেন আমি তোকে ভালোবাসিনি? কাউকে ভালোবাসতে হলে তার মধ্যে রূপ নয় যেটা প্রয়োজন সেটা হলো তার সুন্দর মনমানসিকতা! যা তোর আজও নেই আর আগেও কখনো ছিলো না! তুই ভাবলি কি করে তোর মতো এত নীচু মন-মানসিকতার একটা মানুষকে রাহিয়ান রাফিদের মতো একটা ছেলে ভালোবাসবে? সব সময় তো বেশ বড়াই করে বলিস আমি হলাম বিশ্ব সুন্দরী, আমার মতো এতো সুন্দরী দুনিয়াতে আর দুটোও নেই! আচ্ছা কখনও তোর মাথায় এটা আসেনি রূপ তো আল্লাহর বরকত দানে পেয়ে গিয়েছি কিন্তু মানসিকতাটা নিজের থেকেই পরিবর্তন করতে চেষ্টা করি! আমি সেদিনও তোকে কিছু বলিনি অরিন যেদিন তুই রাইয়ের ব্যাপারে রূপের কাছে উল্টাপাল্টা কথা বলে ওদের সম্পর্কটা ভে/ঙে দিয়েছিস। আজ যে রাই আর রূপ আলাদা সেটা কেবলই তোর জন্য!”

উনি থামলেন। রা*গে,হিং*স্র*তা*য় উনার অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে! এদিকে আমি হতবিহ্বল চোখে কেবল উনার কথা শুনে যাচ্ছি। বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল রাই আর রূপ ভাইয়ার কথাটা শুনতেই! তার মানে এই মেয়েটার জন্য রাই আর রূপ ভাইয়ার এই বিচ্ছেদ!

উনি আবারও বলতে লাগলেন,

—-” বুুঝলাম, তুই না হয় আমাকে ভালোবাসিস বলে নিধির সাথে এমন জ*ঘ*ন্য আচরণ করেছিস কিন্তু রাই আর রূপের দোষ কি ছিলো? আমি সেদিনও তোকে কিছু বলিনি যেদিন জানতে পেরেছিলাম অনন্যা আর ইভানের সম্পর্কটা ভে*ঙে যাওয়ার পেছনেও কেবল একমাত্র তু-ই দায়ী! ইভানের কাছে গিয়ে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের নামে এমন সব কথা বলেছিস যে ইভান অনন্যার সাথে ওর সম্পর্ক ভে*ঙে দিতে বাধ্য হয়েছে! এরপরও তুই জানতে চাস আমি তোকে কেন ভালোবাসিনি? কারন গুলো তোর সামনে সব তুলে ধরলাম। এবার বল এরপরও আমি তোর মতো এমন একটা নোং**রা মনের মানুষকে কি করে ভালোবাসতে পারি? শুধু এখানেই শেষ নয় অরিন! তুই এতোটাই খারাপ যে কেশবের মতো একটা ছেলের সাথে হাত মিলিয়েছিস! নিধিকে এই বিয়ে ভে*ঙে ফেলার জন্য নানান ভাবে মানসিক ট*র্চা*র করেছিস! কেশবের হাত ধরে বিদেশ পাড়ি দিতে বলেছিস! আমি এই সব কিছু জানা স্বত্বেও তোকে কোনো দিনও একটা পাল্টা প্রশ্ন করিনি! ভেবেছিলাম মানুষ সবসময় এক থাকে না! তুইও থাকবি না। একদিন ঠিকই তুই পাল্টাবি, তোর এই স্বভাব গুলো পাল্টাবে। কিন্তু না, আমি ভুল! তুই বরাবরের মতো আজও আমাকে ভুল প্রমান করে দিলি! আজ তোর সত্যি আর বাঁচার পথ নেই। আমার হাত থেকে তোকে বাঁচাতে পারবে এমন কারোর জন্ম আজও অব্দি হয়নি! তুই আমার কলিজায় হাত রেখেছিস! আমার কলিজাকে তুই আ*ঘা*ত করেছিস! মে**রে ফেলতে চাইতেও তোর বাঁধল না বিবেকে। কিন্তু নিয়তি বলেও কিছু হয় তাই না? যেখানে তুই শুধু আ*ঘা*ত করেই যাবি আর পাল্টা আ*ঘা*ত কখনও পাবিনা তা তো হয় না!”

উনার মুখে একটার পর একটা কথা শুনতে আমার মাথায় চক্কর কেটে উঠল! কি বলছে মানুষটা। অরিন আপু মানুষটা এতোটা নোং*রা মনমানসিকতা কি করে পো*ষন করে! কখনও কি নিজের মধ্যে অপরাধ বোধও কাজ করে না?

আমার পা থেকে মাথা অব্দি কাঁপতে লাগল। আমি আর নিতে পারছিনা এসব। নিজেকে কেমন পা*গ*ল পা*গ*ল লাগছে আমার! ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়তেই দৌড়ে এলো অনন্যা আপু,ফাহিম ভাইয়া, নিতু আপু রাই! আমি চমকে উঠে তাদের দিকে তাকাতেই দরজার সম্মুখে একগাদা মানুষ চোখে পড়ল। তারা কখন এলো? আমি তো কোনো শব্দ পাইনি! পেছন থেকে ভীর ঠেলে দৌড়ে এলো আরফান ভাইয়া, জিয়ান ভাইয়া, আর রাফিন ভাইয়া। রাহিয়ানকে আরফান ভাইয়া আর রাফিন ভাইয়া ধরে টেনে পেছনের দিকে আনার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন। ততক্ষণে অরিন আপুর ম*র*ন দশা! ফর্সা মুখখানা র*ক্তশূণ্য হয়ে বি*ভৎ*স লাগছে। আরফান ভাই রাহিয়ানকে একটু সরাতে পারলেই অরিন আপুকে হেঁচকা টানে বের করে আনলেন জিয়ান ভাইয়া! অরিন আপুর গলা থেকে হাত সরে যেতেই কাশতে কাশতে বেহাল অবস্থা হয়ে গেলো তার। রাহিয়ান আবারও তার দিকে তেড়ে যেতেই আরফান ভাই তাকে টেনে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

—-” রাফিদ কি করছিস টা কি তুই? পা*গ*ল হয়ে গেলি নাকি? মেয়েটা ম**রে যাবে তো!”

ক্ষে*পা*র উপর পাল্টা জবাব দিলেন রাহিয়ান,

—-” আমার সামনে থেকে সরে যা আবির! ওকে আজ আমার হাতে ম*র*তে*ই হবে। ও যা করেছে তা…”

—-” মানছি ও অ*ন্যা*য় করেছে রাফিদ কিন্তু তাই বলে তো ওকে আমরা এভাবে শা*স্তি দিতে পারিনা!”

রাফিন ভাইও কথার রেশ টানলেন আরফান ভাইয়ের।

—-” একদমই তাই রাফিদ। ওর যেকোনো ভুলেই আমরা ওকে এভাবে শা*স্তি দিতে পারিনা।”

রাহিয়ান মানলেন না কারোর বারন। উনি হিং**স্র চোখে অরিন আপুর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললন,

—-” রাহিয়ান রাফিদ চাইলে সব পারে।”

অবস্থা বেগতিক বুঝেই জিয়ান ভাইয়া অরিন আপুকে রুম থেকে বের করে দিলেন। রাহিয়ান অরিন আপুর যাওয়ার পানে তেড়ে যেতে নিলেই তার হাত ধরে ফেললাম আমি। টলমলে চোখে উনার সামনে দাঁড়াতেই মানুষটা নরম হয়ে গেলেন মুহুর্তেই। হয়ত বুঝলেন তার এই কঠিন রুপে আমার ভীষণ ভ*য় হচ্ছে। উনি আমার দু’গালে হাত রেখে কপালের মাঝখানে ছোট্ট করে ভালোবাসার পরশ একে শান্ত কন্ঠে বললেন,

—-” কিচ্ছু হয়নি নীলাদ্রিতা। সব ঠিকাছে। ভয় নেই আমি তো আছি সবসময় তোমার জন্য।”

আমি মুখ উঁচিয়ে উনার তাকাতেই আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ল উনার হাতে। উনি কোমল হাতে আমার চোখের জল টুকু মুছে দিয়ে সবার সামনেই আলতো করে জড়িয়ে নিলেন।

৬৭.

হলুদের জন্য স্টেজ করা হয়েছে ছাদে। বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির বাইরের গেট থেকে শুরু করে বাড়ির গার্ডেনও সাজানো হয়েছে চমৎকার রূপে। আর এসব কিছুর মাঝেই হলুদের বিশেষ উপলক্ষে ছাদটাকে করে তুলেছে ছোট্ট একখানা তাজমহল। চারপাশে ফুল,লাইটিং,বিভিন্ন রঙ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে ছাদটাকে।

সময় ঠিক ৭টা। আমি নিজের ঘরেই আছি। সাজসজ্জার পর্ব চলছে। নিয়ম মাফিক আমার পোষাক আজ সবই হলুদ। হলুদ রঙের দুই পার্টের লেহেঙ্গাটা রাহিয়ানের পছন্দে কেনা। উনার পছন্দের তারিফ এখন লোকমুখে। লেহেঙ্গার ডিজাইনটা যেই দেখছে সেই হা করে মিনিমান পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে আমায় দেখে। অতঃপর ছোট্ট একখানা মুচকি হাসি দিয়ে বলে রাহিয়ানের পছন্দ আছে কিন্তু। গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠার কথা হলেও বিপরীতে লজ্জায় লাল হতে হয় আমাকে। আমার পাশে অতিশয় ভদ্রমহিলারা লজ্জায় মে*রে ফেলছে আমায়। দেখেছো, হলুদ রঙ গায়ে উঠতেই ভীষণ ফুটেছে মেয়ের চেহারা,আমাদের রাহিয়ান দেখলে তো আজই বিয়েটা করে ফেলতে চাইবে গো! লাল বেনারসি অব্দি হয়তো আর ক/ষ্ট করতে হবে না!

লাইক এমন টাইপ কথা গুলো যখন শুনি তখন মনের ভেতর কি বি*ভ*ৎ*স রমকের যে হাতুড়ীর বারি পরতে থাকে তা কেবল আমিই জানি! এই অতিশয় ভদ্রমহিলা গুলো যাও একটু চুপ করে থাকবেন কিন্তু আজ আর চুপ থাকবেনা রাই,নিতু আপু,রিম্মি আপু,হিয়া আপু আর অনন্যা আপু। তারা আমাকে লজ্জায় লজ্জায় মে*রে ফেলবেন বলে বিক্ষোভ শুরু করেছেন একেবারে। সত্যি বলতে আমার এখন রুম থেকেই বের হতে ইচ্ছে করছেনা!

তাজা গাঁদাফুলের টিকলিটা ক্লিপ দিয়ে আঁটকাতে আঁটকাতে হঠাৎ মুখ টিপ হাসতে লাগলেন অনন্যা আপু। আমি প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে তার দিকে তাকাতেই প্রশ্ন ছুড়লেন নিতু আপু,

—-” কি গো অনু, হাসছ কেন?”

অনন্যা আপু টিকলির কাজ শেষ করে মুখে হাত চেপে আমার পাশ ঘেঁষে বসল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল,

—-” নিধিকে আজ এত্তো বেশি কিউট লাগছে কেন বলোতো? তবে কি বিয়েটা আজই হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?”

পেছন থেকে রিম্মি আপু অনন্যা আপুর কথার রেশ টেনে বলল,

—-” আমি তো জানি মেয়েদের বিয়ের দিনই সবচেয়ে বেশি কিউট লাগে। এটাই নিয়ম!”

নিতু আপু বলল,

—-” আমিও তো তাই জানি! তবে কি…”

নিতু আপুর কথার মাঝেই রাই বলে উঠলো,

—-” না গো না! আমাদের নিধিকে আজ হলুদে এতো সুন্দর লাগছে ভাবো কাল লাল বেনারসিতে কতটা মা*রা*ত্ম*ক সুন্দর লাগবে। আজকের চেয়েও অধিক সুন্দর লাগবে।”

আমি গোলগাল চোখ করে সবার দিকে তাকালাম। আস্তেকরে বললাম,

—-” তোমরা আমায় নিয়ে এতো গবেষণা করছো কেন বলোতো? প্লিজ এবার তো চুপ করো!”

আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো সবাই! অনন্যা আপু হাসতে হাসতে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,

—-” বিয়ের কনে হলে তাকে এগুলো শুনতে হয় সোনা। শুধু এগুলো নয় আরও অনেক কিছু শুনতে হয়। কি গো বলবো না কি? হু হু? বলি?”

আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে মুখ চেপে ধরে বললাম,

—-” ধ্যাৎ!”

আর ওমনি দেখা মিলল তাদের ঝংকার তোলা হাসি। হাসতে হাসতে সবাই ঝাপটে ধরল আমায়।

স্টেজের মাঝ বরাবর পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছি আমরা দুজন। উনিও হলুদ শেরওয়ানী পড়ে আছেন। দেখতে বেশ লাগছে কিন্তু। দুই হাতে জায়গা পেয়েছে হলুদ রঙের দুটো ফুল। মাথার চুল গুলো ছাদের মৃদু বাতাসে বার-বার উড়ে এসে কপালের সাথে লেপ্টে বসে পড়ছে। চোখ জোড়া চিকচিক করছে খুশির আমেজে। মুখে মন কাড়ানো মিষ্টি হাসি। চঞ্চল ঠোঁট জোড়া একজন আরেকজনের উপর চেপে আছে। এক এক করে সবাই হলুদ মাখিয়ে যাচ্ছেন সেই সাথে তার কানে কানে কিছু বলেও যাচ্ছেন। বিশেষ করে তার বন্ধুগন। উনি কথাগুলো শুনতে শুনতে আঁড়চোখে আবার আমাকে দেখে নিচ্ছেন। অতঃপর মুচকি হাসি দিয়ে পলক ঝাপটাচ্ছেন। এমন কান্ড দেখে স্টেজের নীচে বেশিরভাগ মানুষই মুখ টিপে টিপে হাসছেন। আমি বুঝতে পারছিনা সবাই হঠাৎ করে আমাকে এতো লজ্জায় কেন ফেলছে!

#চলবে____________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here