#প্রেয়সী❤️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ০৬
১১.
—-” আইলা… জ…জাদু!”
টেবিল চেয়ার ছেড়ে সটান হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে এবার নিজেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম কফি পড়া স্যাঁতস্যাঁতে জায়গার উপর। হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে নয় বেহুঁশ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে র//ক্তচক্ষু চাহনি দিয়ে আমায় ভ//স্ম করার বদ মতলব করা লোকটা ভাবে নিধি তিনদিনের জন্য কোমায় ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে। লে নিধি, পুরো প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়া এই লোকের হাতে দাবাং মার্কা একখানা চড় খাওয়ার জন্য।
আধঘন্টা আগে সাদামন নিয়ে লাইব্রেরিতে উপস্থিত হয়েছিলাম। নিউ স্টুডেন্ট বলে কথা। পুরো ভার্সিটির এ টু জেড অব্দি যদি মুখস্থ করে ঠোঁটের আগায় না রাখতে পারি তবে নতুন স্টুডেন্টের ট্যাগটা তো আমৃ//ত্যু থেকেই যাবে। লাইব্রেরিতে ঢুকতেই প্রথমে ফিন্যান্সের একখানা বই নিয়ে বসে পড়লাম লম্বা টুলে। পাশেই বেশ আয়েস করে বসলো রাই। ওর হাতেও বই তবে উপন্যাসের। খুব মনোযোগ দিয়েই দুই বান্ধবী বইয়ের পেইজ উল্টাচ্ছিলাম। এমন সময় এসে হাজির হলো রোগা পাতলা দেখতে একটা ছেলে। হয়তো ক্যানটিনের হবে। আমাদের সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ফিসফাস করে বলল,
—-” আপু কিছু নিবেন চা বা কফি?”
আমি ছেলেটার কথা শুনে রাইয়ের দিকে তাকালাম। রাই আর আমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করল না। সে বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে অর্ডার করে দিলো দুটো কফি। বেশ, খানিক বাদেই হাজির হলো দু’কাপ কফি। ততক্ষণে আমি ফিন্যান্সের বই রেখে রাইয়ের মতোই একখানা উপন্যাসের বই নিয়ে বসে পড়লাম। ছেলেটা সুন্দর মতো কফি দুটো দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেলো। আমিও বেশ মনোযোগের সহিত উপন্যাসে ডুবে পা দুলাতে দুলাতে কফি উঠিয়ে এক ঢোক গিলে নিলাম। ব্যস হয়ে গেলো কাজ। গরম কফি পুরো এক ঢোক গিলে ফেলায় পুরো রুম কাঁপিয়ে মুখ থেকে থুকে ফেললাম কফি। সে কি য/ন্ত্র/ণা!
মুহুর্তেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠল আমার। পুরো মুখ আর গলা সমানে জ্বলতে লাগলো। পাশ থেকে রাইকে হাত বাড়িয়ে ডাকতে নিলে তাকে হাতের নাগালে পেলাম না। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে রাইয়ের দিকে তাকালাম এই উদ্দেশ্য নিয়ে যেন ওকে রাম ধমক দিয়ে পুরো লাইব্রেরিকে জানান দিতে পারি যে গরম কফিতে আমার মুখ পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু হলো না। রাইয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে ওর “হা” মার্কা রিয়াকশনে আমায় অগত্যাই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করতে হলো। আঁড়চোখে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে যা দেখলাম তাতে বোধকরি এমন কিছু ঘটে যাবে জানলে উনাকে সাক্ষী রেখেই পুরো গরম কফিটা ঢকঢক করে গিলে খেতাম। রাফিদ ভাইয়ার সাদা শার্ট টা আর সাদা শার্ট নেই।
মনে হচ্ছে পানের পিক পড়ে জায়গায় জায়গায় অনেক সুন্দর সুন্দর আকার নিয়েছে। উনাকে সরি বলতেই উঠে দাঁড়াচ্ছিলাম কিন্তু ভাগ্য আমার সঙ্গে আরেক পরিহাস করে বসলো। যা হওয়ার তাই হলো। আমার পরনে সাদা স্কার্টটা উনার শার্টের থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে রূপ পরিবর্তন করে ফেললো। কফির মধ্যে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে উঠতে নিলে কাঁপা কাঁপা হাতে রাই টেনে তুললো আমায়। এগিয়ে এলো আরও একজন ব্যক্তি। সচারাচর চোখে পড়ায় যতদূর মনে হয়েছে উনি রাফিদ ভাইয়ার একটু বেশিই ক্লোজ। হয়তো বেস্ট ফ্রেন্ডও হতে পারে! তবে,উনি এগিয়ে আসতে আসতেই আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। রাফিদ ভাইয়া এখনো একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার অনুভূতি আপাতত পরিষ্কার না! ভ/য় পাচ্ছি নাকি মজা পাচ্ছি বুঝতে পারছিনা। রাফিদ ভাইয়ার এমন চাহনীতে বুক ধড়ফড় করতে লাগলো আমার। মাথা নীচু করে কথা বানাতে লাগলাম। কিছু একটা বলে ম্যানেজ দিতে হবে রে নিধি। নয়তো তুই শেষ। পেছন থেকে কর্কশ সরে ধেয়ে আসলো রূপ ভাইয়ার গলা,
—-” এই মেয়ে! সমস্যা কি তোমার? দেখে কাজ করতে পারোনা? সিনিয়রদের গায়ে এভাবে মুখ থেকে কফি উগড়ে দিলে! হাউ ডিজগাস্টিং ইয়ার!”
অরিন আপু রূপ ভাইয়াকে ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ালেন! বোধকরি উনার হাতে কোন ছোট চায়ের কাপ ছিলো। অরিন আপু চা টা একপ্রকার উড়িয়ে মারলেন আমার দিকে। চা-টা একটু বেশই গরম ছিলো! আমার গলায় পড়ে জোয়াল দিয়ে নেমে গেলো পুরো শরীরে। আমি আঁতকে উঠে মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে পিছিয়ে গেলাম। টেবিলে বারি খেয়ে চেয়ারের উপর বেসামাল হয়ে পড়ে কাতর কন্ঠে গা ঝাড়তে নিলেই অরিন আপু তেড়ে এসে আমার মুখ চেপে ধরেন। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
—-” রি/ভে/ঞ্জ! আশাকরি মনে থাকবে সুইটহার্ট!”
চা পড়ে যতটা না জ্ব/ল/ছে তার থেকেও দিগুন জ্ব/ল/ছে অরিন আপুর কথায়। আমি র/ক্তি/ম চোখে উনার দিকে তাকিয়ে ধাক্কা মে/রে উনাকে সরিয়ে দিলাম। ক্ষেপা বাঘিনীর মতো উনার দিকে তাকিয়ে শক্ত চোয়ালে বললাম,
—-” আমি কফিটা উনার গায়ে ইচ্ছে করে ফেলিনি!”
পেছন থেকে হাসতে লাগলেন সবাই, রূপ ভাইয়া, দিপু ভাইয়া,জিয়ান ভাই আর আর অনন্যা আপু। শুধু নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাফিদ ভাইয়া আর আরফান ভাইয়া। অনন্যা আপু ঠেস মে/রে বলে উঠলেন,
—-” এই শোন তোরা। ও নাকি কফিটা ইচ্ছে করে ফেলেনি!”
এই কথা বলতে এবার অরিন আপুও সবার সাথে যোগ দিলেন। রা/গে অপমানে আমার গলা জড়িয়ে আসলো। তিক্ত হয়ে নিজেকেই ধিক্কার জানালাম। কেন এলাম লাইব্রেরিতে? আমার তো আগেই ভাবা উচিৎ ছিলো পুরো ভার্সিটি জুড়ে কেবল সিনিয়রদের রাজ। তাই একটু উনিশ বিশ হলেই উনাদের সামনে মাথা ঝোকাতে হবে। আমিই বা কি পা/গ/ল! প্রথম দিন এসেই কত সুন্দর করে এদের সাথে পাল্লা দিয়ে ফেললাম। উনাদের তাচ্ছিল্য করে হাসি আর সহ্য হলো না আমার। লাল স্কার্ফটা দিয়ে ভিজে লেপ্টে থাকা টি-শার্টটা ঢেকে ফেললাম। দু’হাতে চোখ মুছে স্পষ্ট গলায় রাফিদ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,
—-” ক্ষমা করবেন ভাইয়া! আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি এমন কিছু ঘটে যাবে। ক..কফিটা খুব গরম….”
কথাটা পুরোপুরি শেষ করতে পারলাম না। তার আগেই রাফিদ ভাইয়ার ভেজা শার্টটা আমার মুখের উপর আঁচড়ে পড়লো। আমি চমকে উঠে মুখ থেকে উনার শার্ট টা সরাতেই আবারও চমকে উঠলাম। উনি আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। মুখের উপর উনার গরম নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়তেই আমার পুরো শরীর কঁপে উঠলো। উনার আর আমার মধ্যে বোধকরি দেড় ইন্ঞ্চি দূরত্ব। আমি ঢোক গিলে এক পা পিছিয়ে যেতেই উনি রাগী স্বরে বলে উঠলেন,
—-” আগামী কাল ঠিক সকাল ৭ টা বেজে ৩০ মিনিটে শার্টটা আমার চাই! এন্ড অভিয়েসলি নিট এন্ড ক্লিন।”
কথাটা বলেই উনি হাঁটা ধরলেন! আমি গোলগোল চোখে উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। মন বলছে উনি আবারও হঠাৎ করে এসে আমার সামনে দাঁড়াবেন। কারন উনার কথা পরিপূর্ণ হয়নি। কিন্তু এখনো আরও কি কথা বাকি থাকতে পারে জানা নেই।
উনি হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন মনে হতেই কাঁপা কাঁপা হাতে শার্টটা চোখের সামনে তুলে ধরলাম। বুক চিঁড়ে বিশাল আকারের এক দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। মন ভরে নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পেলাম না। মনের কথা মনে রেখেই উনি একটা লাল টি-শার্ট পড়ে ভূতের মতো সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি চমকে উঠে এক পা পিছিয়ে যেতেই উনি আমার দিকে আ/গুনের লাভা ছুঁড়ে বলে উঠলেন,
—-” আমি এখানেই অপেক্ষা করবো। ঠিক ৭ টা বেজে ৩০ মিনিটে।”
আমি এখনো বেহুঁশ হলাম না কেন! সেই আফসোসেই আবারও দীর্ঘশ্বাস আসতে চাইলো। কিন্তু আমিই আর আসতে দিলাম না। চেপে রাখলাম। আমার এই টুকুনি জীবন। তার দশ ভাগের নয় ভাগই যদি থাকে দীর্ঘশ্বাস তাহলে আর রইলো কি জীবনে? কিছুই না?
—-” নিধি!”
একটু দূর থেকে শীতল কণ্ঠে ডাকলেন আরফান ভাই। লে নিধি এবার আরেকদফা বাঁশ খাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যা! উনি আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে রাইয়ের হাতটা টান মে/রে দ্রুত পায়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে গেলাম। আজকের জন্য যা হলো সেটাই অনেক বেশি! এরপর আর কিছু হজম করতে পারবোনা আমি।
১২.
আয়নার সামনে অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি। গলার কাছটাতে লালচে দাগ পড়ে গিয়েছে। চিনচিন করে জ্ব/লে যাচ্ছে সেই সকাল থেকে। একবার তো ঔষধ লাগিয়েছি! মনে হচ্ছে আবারও লাগাতে হবে। পাশে রাখা ছোট টুলটা টেনে ওখানেই বসে পড়লাম। নিজেকে বড্ড অদ্ভুত লাগছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম নিজেকে। গত দু’মাসে খুব একটা যত্ন নেওয়া হয়নি নিজের। আমি বরাবরই নিজের যত্ন নিতে কঞ্জুস! বাবার এতো এতো অভিযোগে যেটুকু করা হয়। আচ্ছা আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতো তবে কি আমার জীবনটা এমন হতো? নাকি একটু অন্য রকম হতো? অন্যরকম তো অবশ্যই হতো! মা-কে তো আমি সবচেয়ে আগে এই প্রশ্ন টা করে করে জ্বা/লি/য়ে মা/র/তা/ম যে কেন আমার ডান হাতের নীচে এই কালো তিনটা সবসময় অদৃশ্য থাকে? কেন হঠাৎ হঠাৎ তার দেখা মিলে? মা থাকলে হয়তো এর উত্তর টা আমি অনেকদিন আগেই পেয়ে যেতাম।
সত্যিই জীবনটা অন্যরকম হতো। আমাদের ছোট্ট সংসারটা একদম গোছালো পরিপূর্ণ থাকতো। বাবা মায়ের খুনসুটি থাকতো। তাদের মিষ্টি মিষ্টি ঝগড়া থাকতো। ঝগড়া করে যখন মা বাবার উপর ভীষণ ক্ষেপে থাকতো তখন আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী সুরে মায়ের মন গলাতাম। না বুঝলে বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বকা দিতাম। মায়ের সাপোর্ট করে বলতাম “হ্যাঁ মা,তুমিই ঠিক।” সত্যি মা থাকলে আমাদের জীবনটা অন্যরকমই থাকতো।
আয়নার মধ্যে থেকেই নিজেকে দেখে বুঝতে পারলাম মাকে ছাড়া নিধি মাঝে মধ্যে বড্ড বেশিই অসহায় হয়ে পড়ে। মাকে ভাবলেই নিধির ঠোঁটের কোনে তৃপ্তিময় হাসি আসে আর চোখ জোড়া ছলছল করে। আনমনেই হেসে ফেললাম। আয়নার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলাম,
—-” আজকাল নিধি মাকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে!”
টুল ছেড়ে উঠে পড়লাম। এখানে বসে বসে ভাবনার জগতে হাতড়ে বেড়ালে চলবে না। ৫ টার দিকে হৃদের সাথে মিট করতে যাবো। অলরেডি ৪ টা বাজে। নিতু আপুকেও তো বলতে হবে। আস্তেধীরে চলে গেলাম নিতু আপুর কাছে। দরজাটা হাট করে খোলা। বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়লাম ওর রুমে। আশেপাশে নজর দিয়ে ওকে কোথাও আবিষ্কার করতে পারলাম না। গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠতে ওয়াশরুম থেকে জবাব এলো,
—-” নিধি, আমি চেঞ্জ করছি ভেতরে। কিছু বলবি তুই?”
নিতু আপুর রুমের দেয়ালে টানানো বড় ঘড়িটার দিকে তাকালাম। ৪টা বেজে ১০ মিনিট অতিক্রম করে ফেলেছে ঘড়ির কাঁটা। আমি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
—-” আমি একটু বেরোবো আপু।”
—-” কোথায় যাচ্ছিস?”
ভেতর থেকে আবারও ভেসে আসলো আপুর গলা। আমি আবারও বলে উঠলাম,
—-” দোয়েল চত্বর থেকে একটু সামনেই। হৃদ আসবে। মিট করতে যাবো।”
—-” এই দাঁড়া দাঁড়া….”
নিতুর আপুর ব্যস্ত কন্ঠ ভেসে আসতে আমি চিন্তিত মুখে ওয়াশরুমের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিতু আপুর হঠাৎ ব্যস্ততার কারন বুঝতে পারলাম না। কট করে শব্দ করে দরজা খুললো আপু। চেয়ারের উপর হাতের তোয়ালেটা ছুঁড়ে ফেলে পরনে জামাটা টানতে টানতে এগিয়ে এলো আমার দিকে। ঘড়ির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বলল,
—-‘ আমিও ঐদিকেই যাচ্ছি। এলিফ্যান্ট রোডের দিকে।তোর রাফিন ভাইয়া আসবে। চল একসাথেই যাই?”
—-” এলিফ্যান্ট রোড! কিন্তু আপু আমি তো ঐদিকে যাবো না। দোয়েল চত্বরের কাছেই যে কফি শপ আছে ওখানেই বসবো।”
—-” আরে বোকা তোকে এলিফ্যান্ট রোড যেতে বললাম নাকি? বললাম আমরা একসাথেই বের হতে পারি। তুই ওখান থেকে নেমে পড়লি আর আমি ঐ দিকে চলে গেলাম!”
—-” ওকে। কিন্তু রাফিন ভাইয়া হঠাৎ এলিফ্যান্ট রোডে কি করছেন? তোমরা তো অলওয়েজ এদিকটাতে মিট করো?”
নিতু আপু স্মিত হাসলো। আলমারি খুলে পার্স আর ওড়না বের করে আমার পাশে রেখে বলল,
—-” ওর কোনো এক ফ্রেন্ড নাকি গেট টুগেদারের আয়োজন করেছে। সেখানেই যাবো।”
—-” তুমি একাই এলিফ্যান্ট রোড থেকে যাবে নাকি ভাইয়া তোমায় নিতে আসবে?”
—-” বলেছে তো নিতে আসবে যদি ফ্রেন্ডদের সাথে আঁটকে না পড়ে। আর আঁটকে পড়লে আমিই চলে যাবো সমস্যা তো নেই!”
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। বললাম,
—-” সমস্যা তো নেই তবে একটু চিন্তা হয় বুঝলা!”
আমার কথা শুনে আপু ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বলল,
—-” চিন্তা? কিসের চিন্তা?”
আমি মুখ কুঁচকে বললাম,
—-” এই যে এতো সাজছ? রাস্তা ঘাটে মানুষ গুলো তাদের কাজ বাজ ভুলে না আবার তোমার পেছনে ছুটতে থাকে সেই চিন্তা বুঝলা!”
নিতু আপু হেসে ফেললো। চোখে আই লাইনার দিতে নিয়ে আবারও থেমে গেলো। আমাকে তাড়া দিয়ে বলল,
—-” এতো চিন্তা করতে হবেনা। এবার জলদি গিয়ে রেডি হয়ে নে।”
আমি স্মিত হেসে মাথা দুলালাম। নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলে নিতু আপু আবারও বলে উঠলো,
—-” নিধু আজ তুই মেরুন রঙটা পড়িস।”
আমি ভ্রু বাঁকিয়ে বললাম,
—-” মেরুন?”
নিতু আপু মাথা নেড়ে বলল,
—-” হু। তোকে জম্পেশ মানায় রঙটায়।”
—-” হাওয়া দিচ্ছ?”
আমার কথায় আপু গাল ফুলিয়ে বলল,
—-” আমি তোকে হাওয়া দিবো? এটা তুই ভাবতে পারলি?”
আমি আর জবাব দিলাম না। মুখে বাঁকা হাসি এঁটে নিজের রুমে চলে এলাম। আপুর সাথে গপসপ দিতে দিতে আরও পনেরো মিনিট অতিবাহিত করে ফেলেছি। এবার আর লেট করা যাবেনা। আলমারি থেকে মেরুন রঙের স্কার্টটা বের করে ঢুকে গেলাম ওয়াশরুমে। ফটাফট চেঞ্জ করে সোজা এসে দাঁড়ালাম ড্রেসিং টেবিলের সামনে। চুলগুলো ছেড়ে দিতেই পিঠের উপর ঝেকে বসলো সবাই। বাতাসের তালে তালে তাদের চুল-ছেঁড়া ঝগড়া দেখে মনে মনে হেসে ফেললাম আমি। চোখের নীচে সরু করে কাজলের রেখা টেনে দিলাম। কানে দুটো গোল গোল এয়ারিং ঝুলালাম। একহাতে একগাদা চুড়ি আর অন্য হাতটা পুরোই শূন্য রাখলাম। এটাই আজকালকার ফ্যাশন সবাই বুঝেনা! নিতু আপুর মতে মেরুন রঙটা আমার উপর জম্পেশ মানালেও আমার মন বলছে এই রঙটা রাফিদ ভাইয়াকেই বেশি ফুটিয়ে তুলে। সেদিন তার পরনে এই রঙের শার্ট টায় কতটা মারাত্মক লাগছিলো ভাবলেই…..
আর ভাবতে পারলাম না। মনের মধ্যে কামড় মে/রে মনে পড়ে গেলো উনার সাদা শার্ট টার কথা! এই রে, শার্ট টা তো এখনো ধোঁয়াই হলো না! এখনো না ধুয়ে দিলে ঐ দাগ তো কখনোই উঠবেনা বাচ্চে। এবার আমি কি করবো? সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে! বাইরে যাবো নাকি রহিমার মায়ের মতো বসে বসে উনার শার্ট কাচবো?
ইয়েস…. আইডিয়া! শার্ট টা তো আমি রানিকে দিয়ে গেলেই পারি। ও ঠিক সুন্দর করে দাগ উঠিয়ে দিবে। যতক্ষনে আমি বাসায় ফিরবো ততক্ষণে তো উনার শার্ট শুঁকিয়ে মচমচ করবে। আহা নিধি এতো বুদ্ধি কই রাখিস রে তুই? যেই ভাবা সেই কাজ। রানিকে ডেকে দিয়ে দিলাম শার্ট টা। বলেছি ভালো করে দাগ গুলো উঠাতে পারলে গিফ্টস্ও পাবে। ও তো খুশিতে গদগদ হয়ে গেলো। এবার ঠিকই ভালোমতো ধুয়ে দিবে।
ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে খুশির জোয়ারে ভাসা বাদ দিয়ে ফোনটা নিয়ে বসে পড়লাম। হৃদই হবে, এই ভেবে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মস্তিষ্ক চিৎকার পেড়ে বলে উঠলো,
—-” নিধি নিঃশ্বাস ফেলিস না পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।”
আমি ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছি। স্ক্রিনে ভাসছে সেই অপরিচিত নাম্বারটা! লোকটার কথা তো আমি কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ভুলেই গিয়েছিলাম! মনটা সায় দিচ্ছে না কল টা রিসিভ করতে। আবার কাটতেও পারছিনা! তাই চুপচাপ পাশে ফেলে রাখলাম ফোনটা। একের পর এক কল বেজেই যাচ্ছে। হাতের মধ্যে নিশপিশ করছে রিসিভ করতে। আঁটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে ফোনটা কানে তুললাম এবার। অত্যন্ত বিনয়ী সুরে বললাম,
—-” এবারও যদি পরিচয় না দিয়ে কলটা কেটে দেন তবে পরের বার কল করতে আর এই সিমটা ইউজ করতে পারবেননা। কেননা, কল টা কেটে যাওয়ার ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আপনার এই সিমটার জন্য আমার কন্টাক্টের ব্লক লিস্টে সবচেয়ে সুন্দরতম জায়গাটা তার হবে।”
কথা গুলো একনাগাড়ে বলে শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মনের মধ্যে লাড্ডু ফুটলো যেন। এবার নিঃশ্চই বেটায় ব্লক খাওয়ার ভয়ে পরিচয়টা দিয়ে দিবে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলোনা। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অধৈর্য্য গলায় বলে উঠলাম,
—-” পরিচয় না দিলে সমস্যা নেই। থাকুন আপনি। আমি আপনাকে ব্লক করে দিচ্ছি।”
—-” তুমি একজন মুক্তি যোদ্ধা জানা ছিলো না তো!”
—-” অ্যা….(বোকা গলায় প্রশ্ন করলাম আমি)
—-” এই যে ফোন রেখে যুদ্ধে চলে যাও। এতোবার করে কল দিয়েও তোমার খোঁজ পাওয়া যায়না! বলি একজন এসিস্ট্যান্ট রাখলেও তো পারো। তাহলে তো তোমার কাজে হেল্প হয়ে যায়!”
আমি ফুঁসে উঠলাম। ঝাঁঝাল কন্ঠে বললাম,
—-” এই এখানে কি ফাজলামো হচ্ছে হ্যাঁ? আপনি কে ঠিক করে বলুন তো?”
—-” আমি?(শীতল কন্ঠে)”
—-” হ…হ্যাঁ আপনি! বলুন ঠিক করে? কে আপনি?”
—-” খুব জ্বা/লা করছিলো তাই না?”
—-” অ্যা…. জ..জ্বা/লা করছিলো! জ্বা/লা করছিলো মানে কি?”
আমার প্রশ্নের জবাবে ওপাশে আবারও নীরবতা। আমি রে/গে গিয়ে আবার কিছু বলতে নিলে উনি গলা খাঁকারি দিয়ে আবারও আকর্ষণীয় গলায় বলে উঠলেন,
—-” ঔষধ টা লাগিয়ে নিও। একবার নয়, জ্বা/লা না কমলে বারবার লাগাবে। ভুল যেন না হয়। আব….আর পারলে নিজের একটু যত্ন নিও। অনেক তো হলো জীবন নিয়ে অবহেলা!”
লোকটার কথা গুলো আমার মাথার ঠিক কয়েক হাত উপর থেকে ছুটে গেলো। বুঝতে পারলাম না। ভেবেছিলাম বেটাকে ধমকে উনার পরিচয় আদায় করবো। কিন্তু উনার তিন তালের কথা শুনে নিজেই তো সবটা গুলিয়ে ফেললাম। নাহ্, এটা একটু বেশি বেশি হচ্ছে! উনার পরিচয় আমায় বের করতেই হবে। গলা ঝেড়ে বেশ আয়েস করে ফোনটা আবারও কানে তুললাম। চোখে মুখে রাগ ফুটিয়ে তুলে যেই মাত্র হ্যালো বলবো ওপাশ থেকে বিকৃত ভাবে ফোন কাটার তিনটা শব্দ ভেসে আসলো। ব্যস আমার নিঃশ্বাস আবারও আঁটকে গেলো। লোকটা তো বেশ পাঁজি! উনার কথা শেষ হতেই মুখের উপর কলটা এভাবে কেটে দিবে? দাঁড়া বেটা… বিরক্তের শীর্ষে পৌঁছে ডায়েল করলাম নাম্বারে। আজ তো উনাকে আমি দেখেই নিবো। কিন্তু কোথায় কি? আমার আশায় এক বালতি জল ঢেলে গতকালের মতোই সেই মহিলা রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো,
—-” দুঃখিত! আপনার কাঙ্খিত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না! Sorry! The number you dialled is currently unreachable!”
বুক চিঁড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। আত্মসম্মান নামক বস্তুটিতে বেশ ধারালো ভাবে সুচ ফুটালো। লোকটার কার্যকলাপে বেশ গুরুতর ভাবে আঘাত হানলো মনে। মনে মনে তো ঠিকই করে ফেললাম আরকবার কল দিক না লোকটা, এবার আমিই উনার মুখের উপর কল কেটে দিবো।
#চলবে_________________
[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]