#প্রেয়সী♥🥀
#muhtarizah_moumita
#পর্বঃ০৪
৭.
—-” এমন রোগা পাতলা লোককে কেউ চিতাবাঘ বলে ডাকে? হাউ ষ্টুপিড!”
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা কথাটা ভাগ্য সহায় হলো বলে স্যারের কান অব্দি পৌঁছালো না। স্যার গভীর মনোযোগ দিয়ে এসাইনমেন্টে সাইন করছেন। তবে স্যার বাদে বাকি তিনজনের কানে ঠিকই গেলো। বুঝতে পারলাম তিন জোড়া চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অরিন আপু ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে নিবে কি তার আগেই স্যারের পিয়ন বলে উঠলেন,
—-” মাইনষের খাইয়ে-দাইয়ে কাজ কম্য নেই তো করবে ডা কি? এইসব করি বেরায়!”
আমি ফিক করে হেসে দিলাম। অরিন আপু আর কিছু বললেন না। রাই কাঁদো কাঁদো মুখ করে স্যারকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। বুঝতে পারলাম এই মুহুর্তে ওর মাথায় যা ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক একই ভাবে তা আমার মাথায়ও ঘুরপাক খাচ্ছে। পিয়ন আবারও বলে উঠলেন,
—-” আফনেরা আইছেন ক্যান? জলদি কথা কইয়া ক্লাসে যান!”
পিয়নের তাড়া দেখে এবার আমার কলিজা শুকাতে লাগলো। আমায় যে এখনি বাঘের মুখে থাবা দিতে হবে ভাবতেই পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো। আল্লাহ সহায় হও। আমি স্যারকে উদ্দেশ্য করে মৃদুস্বরে ডাকলাম,
—-” স্যার?”
স্যার তাকালেন না! একই ভাবে এসাইনমেন্টের খাতাগুলোতে সাইন করে চলেছেন। আমি, রাই আর অরিন আপুর মুখের দিকে তাকালাম। রাই ভ/য়ের দরুন ঢোক গিলছে বারবার। অরিন আপু কপাল কুঁচকে মুখে হাত চেপে বিরবির করে বললেন,
—-” এভাবে ম্যাঁও ম্যাঁও কেন করছো? ঠিক করো ডাকো?”
মেয়েটার শরীরে কোনো মায়াদয়া নেই! একদম মায়াদয়াহীন একটা মানুষ। আমার মতো এমন ইনোসেন্ট দেখতে একটা বাচ্চা মেয়েকে কিভাবে ফাঁ/সা/তে চলেছে এই বদের হাড্ডি গুলোয়। নাহ্ নিধি, ভ/য় পেলে হবে না বাচ্চু। তোর এই ভ/য়কেই জয় করতে হবে। হবেই হবে। এবার বেশ জোড়ালো গলাতেই ডেকে উঠলাম,
—-” স্যার, লায়লা ম্যামের সাথে আপনার প্রেমলীলা কেমন যাচ্ছে? ভালো তো?”
আমার অতি সাহসে বলে ফেলা কথাটায় ঠিক কত বড় বো//ম ব্লা/স্ট হবে তার কোনো ধারনা নেই আমার। ভ/য়ের চোটে রীতিমতো চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নিয়েছি। রাই আমার ডান হাতটা খামচে ধরে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। অরিন আপু চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির মতো করে আমার দিকে তাকালো। হয়তো তারও ধারনায় ছিলো না আমি এমন কিছু জিজ্ঞেস করে ফেলবো। কয়েক সেকেন্ড অতিবাহিত হলেও স্যারের কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না! ভ/য় টা আরও জাতাঁকলে পিষে নিচ্ছে আমায়। চোখ জোড়া খুললে কোন বাঁশ অপেক্ষা করছে আমার জন্য ভাবতেই অরিন আপুর চুল গুলো গুনতে গুনতে উগলানোর তীব্র বাসনা জাগছে মনে।
—-” অরিন? ক্লাস টাইমে তোমরা আমার এখানে? কোনো দরকার? আর এরা কি নিউ ব্যাচ?”
স্যারের নরম সুরে আমার কাশি উঠে গেলো। কাশতে কাশতে অরিন আপুর দিকে তাকালাম আমি। অরিন অনিচ্ছাকৃত হাসলো। আমার দিকে আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে বলে উঠলো,
—-” জ…জ্বী স্যার!”
অরিন আপুকে বাদ দিয়ে এবার আমি স্যারের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। ভাবনার বিষয়, আমি স্যারকে এতবড় একটা কথা বলার পরেও স্যার এতো টা নর্মাল কি করে? কথাটা আমি যেভাবে বলেছি তাতে স্যারের এতক্ষণে আমাদের সিলিংফ্যানে বেঁধে পেটানোর কথা।কিন্তু না! স্যার পুরো অনুভূতি শূন্য। মুখের ভাব ভঙ্গিমাও বলছে না, স্যার কথাটা শুনে প্রচুর রে/গে গিয়েছেন। ব্যাপার টা গোলমেলে। হজম করতে ক/ষ্ট হচ্ছে। পাশ ফিরে পিয়নের দিকে তাকাতেই ঝাটকা লাগলো আমার। পিয়ন এমন করে তেড়ে বেঁকে খিঁচিয়ে আছে কেন? দেখে তো কেবল এটাই মনে হচ্ছে, তার খুব কষায় ধরেছে। আর সেই কষা বের করতেই সে এভাবে খিঁচিয়ে আছে।
—-” নাম কি তোমাদের?”
স্যারের প্রশ্নে পিয়ন কে নিয়ে আর গবেষণা করা হলো না। মিনমিনে গলায় বললাম,
—-” ন..নীলাদ্রিতা নিধি!”
পেছন থেকে রাই মুখ উঁচিয়ে আমার থেকেও নীচু স্বরে বলল,
—-” আরিফা রাই।”
স্যার একই ভাবে তাকিয়ে রইলেন। আমাদের থেকে নজর ঘুরিয়ে পিয়নের দিকে প্রশ্ন সূচক মুখ করে তাকালেন। পিয়ন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বেশ জোরেই বলে উঠলো,
—-” নীলাদ্রিতা নিধি আর আরিফা ইভা।”
স্যার মুচকি হাসলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-” কে নীলাদ্রিতা নিধি আর কে আরিফা ইভা?”
আমি আর রাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। রাই আমার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলল,
—-” স্যার আমি রাই! (মোটা স্বরে)”
স্যারও হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন,
—-” আচ্ছা আচ্ছা! নাইস টু মিটিং ইউ গাইস।”
আমি চোখ মুখ কুঁচকে পিয়নের দিকে তাকালাম। আমার দিকে তাকিয়ে পিয়ন কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললেন,
—-” স্যারের কানের মেশিনটা আজ ভুল কইরা বাসাত রাইখা আইছে।”
অরিন আপু অসহায় কন্ঠে বললেন,
—-” হোয়াট?”
পিয়ন বলল,
—-” জে। আফনেরা এখন যান। কফাল ডা আফনে গো ভালা। শুকর করেন।”
হাসবো নাকি কাঁদবো? এমন একটা সিচুয়েশনে দাঁড়িয়ে কিরকম রিয়াকশন দিলে আমার সাথে স্যুট করবে? স্যার কানে কালা? মেশিন ছাড়া মোটেও শুনতে পায় না?
বিকট শব্দে হেসে উঠলাম আমি। হাসতে হাসতে রীতিমতো গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। আমার হাসি দেখে রাই আঁতকে উঠে আমার মুখ চেপে ধরে বাইরে নিয়ে এলো। পেছন পেছন অরিন আপুও এলেন। আমি কেন জানিনা হাসি কন্ট্রোল করতে পারছিনা। হাসতে হাসতে কতক্ষণ রাইয়ের গায়ে ঢলে পড়ছি তো কতক্ষন অরিন আপুর গায়ে। আমার হাসিতে বোধকরি অরিন আপুর শরীরে আগুন ধরে গিয়েছে। জ্বা/লা/য় হয়তো ছটফট করছে মনে মনে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা। শুধু অরিন আপু নয় আমি চাই সিনিয়রদের পুরো গ্যাংই আমার হাসি দেখে জ্ব/লে পু/ড়ে ম/রে যাক। বিশেষ করে রাফিদ ভাইয়া।
আমি হাসছি, রাইও হাসছে। শুধু হাসছে না অরিন আপু। আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে উনি রা/গে রীতিমতো ফুঁসছেন। তাতে আমার কি? আমি তো আজ খুব হাসবো।
—–” ভাগ্য আজ তোমার সহায় হলেও নেক্সট টাইম নাও হতে পারে মিস নিধি!”
ঝড়ের বেগে কথাটা উড়ে এসে আমার হাসি কেঁড়ে নিতে যথেষ্ট হলো। রাই সটান হয়ে আমার হাত খামচে ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমাদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন রাফিদ ভাইয়ারা। সাদা চামড়ায় যা পড়ে সেটাই নাকি ফুটে থাকে। উনি হলেন তারই জলজ্যান্ত এক উদাহরণ। কালো টি-শার্টের উপর মেরুন রঙের শার্টটা উনার শরীর আঁকড়ে বসে আছে। যেন এই রঙটা কেবল উনার জন্যই বানানো হয়েছে। কেবল উনার গায়ে উঠবে বলেই এতদিনেও কারোর শরীরে এতোটা অ/হং/কা/র করে ফুটেনি এই রঙ। ছেলে মানুষ হয়েও সে এতো সুন্দর কেন? হিং/সে হচ্ছে আমার! চোখের মনিটা মার্বেল পাথরের মতো জলজল করছে। মাথার চুলগুলো সযত্নে পড়ে আছে আড়াআড়ি ভাবে। তার থেকেই কিছু অংশ বিশেষ তাদের বিশেষত্ব ফোঁটাতে বাতাসের তালে তালে কপালের উপর এসে পড়ছে। চোখে ঘন পল্লব। ডার্ক রেড ঠোঁট। দুগালে চেপে আছে খাঁজ খাঁজ দাঁড়ি। সে এক অন্য রকম মায়া তার চোখে মুখে।
—-” তবুও, তোমার অসীম সাহসের জন্য তোমার তারিফ না করে পারছি না!”
উনার বাঁকা হেসে ত্যাড়াব্যাকা কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ল আমার। শঙ্কিত চোখে উনার দিকে তাকাতেই ধাক্কা খেয়ে রাইয়ের দিকে ঝুঁকে গেলাম কিছুটা। পাশে তাকাতে দেখলাম, অরিন আপু বাঁকা হেসে রাফিদ ভাইয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ধাক্কা টা উনিই দিলেন আমায়। বুঝলাম, আগাম বিপদের সতর্ক বানী দিলেন।
৭.
হঠাৎই ঝুম বৃষ্টি হলো খুব। অসময়ে বৃষ্টি! ব্যাপার টা ভীষণ বিদঘুটে। রাস্তা ঘাট কেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। পা ফেলারও জো নেই। তবুও হাঁটছি। সমসময় শহরের ঝনঝট পরিবেশে গাড়িতে চড়তে ভালো লাগেনা। রাইয়ের বাসা অব্দি এসে ওকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে আমিও নেমে গেলাম। হঠাৎ বৃষ্টি দেখে ভিজতে ইচ্ছে হলেও বাবার কথা ভেবে আর হলো না। বাবা সমসময় বৃষ্টিতে ভিজতে বারন করে। কেননা, আমার আবার ঠান্ডায় ব্যামো রয়েছে। বেশি ঠান্ডা লেগে গেলে চেহারা ফুলে উঠে। মনে হয় ঠান্ডার সব পানি চেহারায় এসে জমে গিয়েছে। সেই সাথে মাত্রাতিরিক্ত জ্বর। এই অদ্ভূত রোগের নাম জানিনা আমি। যতদূর শুনেছি, এই নাম না জানা রোগটা মায়েরও ছিলো। একটু ঠান্ডা লাগলেই হতো ব্যস, এমন করুন দশা হয়ে যেত। মা আজ নেই! সেই শোকেই বাবাও দিনকে দিন একটু একটু করে নিজের অস্তিত্ব বিকিয়ে দিচ্ছে। তার শরীর আছে কিন্তু মন নেই। বাবা মায়ের প্রেমের বিয়ে ছিলো। বাল্যকালের প্রথম এবং শেষ প্রেম। পাঁচ বছর প্রেম করে মাত্র দেড় বছর সংসার করেছে মা। আর তারপর আমি অভাগী দুনিয়াতে আসতে গিয়ে মাকে মে/রে/ছি। লোকে বলে আমি অ/ল/ক্ষু/ণে মেয়ে। মাকে খেয়েছি। কেমন শোনায় না কথাটা? আমি কি করে খেলাম মাকে? আমার কারনে মা যে এভাবে হারিয়ে যাবে জানলে তো প্রথমেই রবের কাছে ফরিয়াদ করতাম, আমায় দিও না ওদের টোনাটুনির সংসারে। একটা সন্তান না থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে? দিন শেষে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস। তারপর সব ঠিক! কিন্তু এখন যে তার থেকেও
ভ/য়ং/ক/র বাবার দিন শেষের সময়টা। তখন বুঝি সন্তান না থাকার সুপ্ত বাসনায় কাছের মানুষ টার বুকে মাথা রেখে কষ্ট ভুলতো। কিন্তু এখন যে সেই মানুষ টাই নেই। দিন শেষে যার কোমল স্নিগ্ধ হাসিটা দেখে অনন্তকাল পার করা যেত সেই মানুষ টাই আজ নেই। ভাবলেই খুব ক/ষ্ট হয়। খনিকের সুখের জন্য আমি একটা মানুষের জীবন কেঁ/ড়ে নিয়েছি! কতটা স্বার্থপর আমি! মাঝে মাঝে বাবা কে ভীষণ বলতে ইচ্ছে করে, আমি সরি বাবা!
—-” এই মেয়ে, একটু শুনবে?”
অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো মেয়েলি ডাকে ঘোর কাটলো আমার। মাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তেই ডাকটা মায়ের বলে আবিস্কার করে ফেললাম। মুহুর্তেই আশেপাশে নজর দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ টার খোঁজ চালালাম। দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন মা বেশী এক সুন্দরী রমনী। তার চোহারা দেখে আচমকাই কারোর মুখটা যেন ভেসে উঠতে চাইলো চোখের সামনে। মস্তিষ্ক সম্মতি দিলো না। ব্রেইনও এত দ্রুত কাজ করলো না! আমি শঙ্কিত মনে ঘুরে দাঁড়ালাম। উনি হাতে দুটো ইয়া বড় বড় গিফ্ট বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। মুখে ম্লান হাসি দিয়ে বললাম,
—-” জ্বী বলুন?”
আমার সহিত উনিও মিষ্টি হাসলেন। কোমলস্বরে বললেন,
—-” আসলে আমি পথ ভুল করে ফেলেছি! এটা দোয়েল চত্বরের উত্তর পাশ তাই না?”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই উনি ব্যস্তভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
—-” একদম ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছি! আসলে আমি পূর্ব পাশ হয়ে এলিফ্যান্ট রোড থেকে যেতে চাচ্ছি! কিন্তু কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না! ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছি। তুমি প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করবে?”
উনার অনুরোধ শুনে খুব মায়া হলো আমার। বেচারী রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে হয়তো। চারপাশে শীতল পরিবেশেও ঘামছেন উনি। আমি স্তিমিত হেসে উনাকে আস্বস্ত করে বললাম,
—-” অবশ্যই সাহায্য করবো আন্টি। আপনাকে এভাবে করে বলতে হবেনা। আপনি আসুন আমার সাথে! আচ্ছা আপনার সাথে আর কেউ আসেনি? আপনি একাই এসেছেন?”
—-” একা বলতে আমার ড্রাইভার আমার সাথেই ছিলো। খানিকক্ষণ আগেই আমি নেমে গেলাম গাড়ি থেকে। ড্রাইভার আমায় খুব নিখুঁত ভাবেই বুঝিয়ে দিলো, ম্যাম এখান থেকে এখানে যেতে হবে। কিন্তু আমি সেই ঠিকই গুলিয়ে ফেলেছি।”
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
—-” ড্রাইভার আপনাকে মাঝরাস্তায় একা রেখে কোথায় গেলো?”
উনি একহাতে শাড়ির কুঁচি আগলাতে আগলাতে বললেন,
—-” আমার ছেলের ভার্সিটিতে।”
উনার দুইহাতে সবটা সমালাতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে উনার হাত থেকে গিফ্টের একটা বক্স আমার হাতে নিয়ে বললাম,
—-” আপনার হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে আন্টি। আমি আপনাকে সাহায্য করছি।”
আমার সহানুভূতিতে উনি খুব খুশি হলেন। ঝকঝকে দাঁতের হাসি দিয়ে অমায়িক সুরে বললেন,
—-” আসলে সমস্যা হলো, এমনিতে আমি বাসা থেকে একদমই বের হইনা আর বের হলেও গাড়ি নিয়ে যাই। যেখানে যাওয়ার ড্রাইভার নিয়ে যায়। গাড়ি ছাড়া কখনো বের হওয়া হয়না। তাই রাস্তা ঘাটও সেভাবে মুখস্থ না। আজ আমার মেজ বোনের মেয়ের এনগেজমেন্ট। সেখানেই হঠাৎ যাওয়া পড়লো। এদিকে আবার আরেকটা সমস্যা হলো! ছেলে আর তার বাবা কে নিয়ে! রাহিয়ানের বাবা যে গাড়ি করে গিয়েছেন সেটা তাকে অফিসে পৌঁছে আড়াই টা নাগাদ রাহিয়ানের ভার্সিটির সামনে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজ উনার মিটিং আছে বাহিরে তাই গাড়ি আর গেলো না। আর রাহিয়ান সকালে আবার বাইক না নিয়েই চলে গেলো! কারন আবির ওকে ড্রপ করতে এসেছিলো
কি একটা সমস্যা দেখো, তাই আমি ভাবলাম রাস্তা তো বেশি নয়, আর ওদিকে সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে! ছেলেটা কি করে ফিরবে? তাই গাড়িটা পাঠিয়ে দিলাম।”
আমি কুঞ্চিত কপালে উনার দিকে তাকালাম। বিরস মুখে বললাম,
—-” আপনার ছেলে তো বাচ্চা নয় আন্টি? সে তো কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করতে পারতো? আপনি না হয় বাসায় পৌঁছেই উনাকে গাড়িটা পাঠাতেন? আর আপনার ছেলের বাসায় ফেরার তাড়া বেশি থাকলে সে না হয় রিক্সা করে চলে যেতো। সমস্যা তো ছিলো না! শুধু শুধু আপনি এভাবে প্রবলেমে তো পড়তেন না বলুন?”
উনি হেসে উঠলেন। একদম খোলা মনের হাসি। হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকালে আমি সামনের দিকে ইশারা করে বললাম,
—-” আপনার এলিফ্যান্ট রোড এসে গিয়েছি। এখান থেকে একটা বেবি ট্যাক্সি বা সিএনজি করে আপনি ঠিকানা বলে চলে যেতে পারবেন। আর সমস্যা হবেনা আশাকরি।”
উনি সামনের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদুহেসে বললেন,
—-” খুব উপকার করলে মা! তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ!”
আমি মলিন হেসে উনার দিকে বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
—-” নেক্সট টাইম থেকে কিন্তু এমন আর করবেন না আন্টি। আজ হয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করেছি। আমার মতো মানুষরা অবশ্য আপনাকে সাহায্য করবে কখনো না করবেনা। কিন্তু যারা আমার মতো নয় তারা কিন্তু ঝোপ বুঝে কোপ মা/র/তে ভুলবে না। আর আপনি একা অসহায় মা,কিছু করতেও পারবেন না। বুঝলেন? সো নেক্সট টাইম থেকে ছেলেকে গাড়ি পাঠাবো এতে চিন্তা না করে আগে নিজের গন্তব্যে সঠিক ভাবে পৌঁছবেন। দ্যেন ভাববেন। ছেলেকে গাড়ি পাঠাবেন কি পাঠাবেন না। কেমন?”
উনি আবারও হাসলেন। বুঝিনা বাপু, মায়েদের মতো মানুষ গুলো কথায় কথায় এতো হাসে কেন?
উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—-” ঠিকাছে মা, আমি তোমার কথা সর্বদা মাথায় রাখবো।”
আমি ঠোঁটের ভাজে মিষ্টি হাসি জুড়ে বললাম,
—-” ভালো থাকবেন আন্টি। আসি।”
উনি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে আমার হাত থেকে গিফ্টের বক্সটা নিয়ে নিলেন। আমি উল্টো দিকে ঘুরে বড় বড় ধাপ ফেলে এগোতে লাগলাম। বহুবছর পর আজ হঠাৎ এই মানুষ টা কে দেখতেই মা মা এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগছে মনে। বুক চিঁড়ে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসতে আরেকবার পেছন মুড়ে তাকালাম। ততক্ষণে উনি সিএনজি ধরে উঠে গেলেন। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই অদূরে হারিয়ে গেলেন উনার সবুজ রঙের সিএনজি টা।
#চলবে_____________________
[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]