১.
প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সামনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অসহায়ের খেতাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আর আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অগার অগা মগার মগা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রাই। এই মেয়েটার জন্য জীবনে কখনো সুখের দিন আর দেখা হয়ে উঠলো না আমার। তাকে যে যা বলে বোকার হদ্দটায় সেটাই করতে এক পায়ে রাজি হয়ে যায়। বলি এটা কোনো কথা হ্যাঁ? আর আমাদের ভার্সিটির ফার্স্ট ডে… কোথায় আমরা খুশিতে ঠেলায় ভাল্লাগে করতে করতে পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরে দেখবো তা না, সিনিয়রদের সো কল্ড র্যাগিং এর স্বীকার হয়ে এখানে এসে তসবি গুনতে হচ্ছে। রাগে দুঃখে তো রীতিমতো ড্রেনের পানি তুলে বেয়াদব টা কে গুলোকে সরবত খাওয়াতে ইচ্ছে হয়েছিলো! কিন্তু সেই আশায় যে এক বালতি জল ঢেলে এই বেয়াদব টা আমায় এখানে টানতে টানতে নিয়ে এলো। তাদের কথাতে আমি প্রথমে রাজি হইনি বলেই এখন শা/স্তি স্বরূপ আমায় ভিসির সামনে দাঁড়িয়ে বিনা বাক্যে তাকে দু’দুবার ভেংচি কাটতে হবে। এমন শা/স্তি শুনে তাদের ড্রেনের পানি দিয়ে সরবত খাওয়ানোর বদলে নিজেরেই টানা এক মাস বেহুঁশ হয়ে থাকার তীব্র বাসনা জেগেছিলো। কিন্তু কিছু করার নেই! ভার্সিটিতে টিকতে হলে সিনিয়রদের এমন ছোট খাটো র্যগিংয়ের স্বীকার মানতেই হবে। নিতু আপুর মতে,কোনো স্টুডেন্ট ভার্সিটিতে এসে যদি সিনিয়রদের হাতে র্যাগিং না হয় তবে তার মতো দুর্ভাগা স্টুডেন্ট দুনিয়াতে আর দ্বিতীয় টা হয় না। তাই বলে এমন আবলুস মার্কা ডেয়ার দিয়ে বসবে? ভাবা যায়? তাদের আদেশ অনুযায়ী যদি আমি এমন কাজ না করি তবে তো তারা আমায় ভার্সিটি থেকে আউট করবেন কিন্তু আমার ভ/য় তো অন্য জায়গায়… তাদের আদেশ মোতাবেক যদি এমন কাজ ভুলেও করে ফেলি তবে উনিতো আমায় ভার্সিটি থেকে আউট করবেনই সাথে করে এটাও ইনসিওর করবেন আমি যেন আর কখনো কোনো ভার্সিটিতেই চান্স না পাই। আর তারপর আমার পুরো লাইফ টাই বরবাদ। নাহ্ আর ভাবতে পারছিনা আমি। মাথাটা চক্কর কাটতে কাটতে এক্ষনি জ্ঞা/ন হারাবো। এমন সিচুয়েশনে দাঁড়িয়ে ছোট বেলার সেই প্রিয় গানটা খুব মনে পরে যাচ্ছে, “—আমি জ্ঞান হারাবো, ম/রে যাবো… বাঁচাতে পারবেনা কেউ। হেঁইও, আমি জ্ঞান হারাবো…”
—-” দোস্ত…. আ..আমার খুব ভ/য় করছে রে! কি হবে আমাদের?”
রাইয়ের কম্পিত কন্ঠে এমন বানী শুনতেই গানের মধ্যে খানিক ব্যাঘাত ঘটিয়ে মুখ তুলে তাকালাম আমি। আমার চোখে মুখে ওর জন্য জমে থাকা ফুল ড্রাম ভর্তি রাগ আর বিরক্তির ভাব ও বেশ বুঝতে পেরেই একটা দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে দিলো। যা দেখে ধরে বেঁধে রাখা রা/গ/টা কে আর আঁটকে রাখা সম্ভব হলো না যেন। দাঁতে দাঁত চেপেই চেঁচিয়ে উঠে বললাম আমি,
—-” কি আর হবে? মিষ্টি বিতরন হবে! মসজিদে মসজিদে আমাদের নামে শিন্নী চড়ানো হবে। আমার বেস্টী সিনিয়র দের ভ/য়ে এত বড় একটা কাজ করতে এসেছে তাকে সম্বর্ধনা জানাতে তো এই ভার্সিটির পরিচালক, মহাপরিচালক, সম্পাদক… দুনিয়ার সব মানুষই উপস্থিত থাকবে।”
আমার কথায় ভড়কালো বটে রাই। তবে তা প্রকাশ না করে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
—-” রা/গ/ছিস কেন দোস্ত… আমি তো….”
রাইয়ের কথা পুরোপুরি শোনার বিন্দু মাত্র আক্ষেপ আমার না হতেই আবারও ঝাঁ/ঝা/লো কণ্ঠে বলে উঠলাম আমি,
—-” রা/গ/বো কেন? আমাদের তো এখন খুশিতে ধেইধেই করে নাচা উচিৎ তাইনা? ইডিয়ট কোথাকারে!”
রাই আর কথা পাড়লো না। পাড়লো না বললে ভুল হবে পাড়তে পারলো না। আমার রা/গে/র কাছে সে বরাবরই চুপ থাকে। কারন ও খুব ভালো ভাবেই জানে আমি রা/গ/লে দুনিয়ার এক কোনও ঠিক থাকেনা। এ টু জেড শুধু চুরমার করে ভা/ঙ্গ/তেই থাকে।
আমি নীলাদ্রিতা নিধি। বাবার একমাত্র বাধ্য হই অবাধ্য হই, এই একটাই আমি আমার বাবার ছোট্ট ঘরের একটা ছোট্ট প্রান ভোমরা। মা নেই। জন্মের পর সব সন্তানের মতো মাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আত্নীয়দের মুখে শোনা কথায় যতটুকু বুঝেছি সেটা হলো আমার জন্মের সময় নাকি মায়ের প্রচুর ব্লা/ড লস হয়! সময়ের অভাবে ডক্টররা সেটা কভার দিতে পারেননি বলে মাকে আর বাঁচানো যায়নি। আমার জীবনে আমার মা নেই বলে আমার হাজারটা অপূর্ণ ইচ্ছে থাকার কথা হলেও তার বিন্দু মাত্রও নেই। তার কারন হলো আমার বাবা। জীবনে অভাব কি,ক/ষ্ট কি তার সংজ্ঞা টা আজও আয়ত্ত করতে হলো না আমায়। বাবার আর আমার ছোট্ট পাখির বাসাটাতে সব কিছুই আছে। ভালোবাসা, সুখ আনন্দ… সব।
দু/র্ভা/গ্য বলবো নাকি সৌভাগ্য বলবো জানা নেই আমার, তবে বহু অপেক্ষার পর আজ ভার্সিটিতে এসেই এমন গ্যারাকলে আঁটকে যাবো তা যে কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। যাগ কে, এখন কেবল ভিসির বের হওয়ার অপেক্ষা। বের হতেই বিনা বাক্যে তাকে মুখে ভেংচি কেটেই চোর চুরি করে পালানোর মতো করে পালাতে হবে আমাদের। নয়তো জীবন শেষ।
ভিসির রুমের সামনে বেল বাজতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন পিয়ন। আমাদের পাশ কাটিয়েই উনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। স্যার কি এখন বের হবে নাকি ভিতরে থাকবে সেটাই তো সঠিক ভাবে আন্দাজ করতে পারছি না আমি। হাল্কা ঘাড় কাত করে তার রুমের উঁকি মা/র/তে/ই চোখে চোখ আঁটকালো কারোর সাথে। কি হলো ব্যাপারটা? ভিসি স্যার কি কোনো জোয়ান লোক নাকি ভাই? চোখ দুটো এমন আকর্ষণীয় লাগলো কেন?
ভেতরের চোখ জোড়ায় খানিক বিরক্ত উপলব্ধি করতেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। একি করছি আমি? ভিসির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মে/রে তার চোখেই চোখ রেখে হারিয়ে যাচ্ছে। ইয়া মাওলা, এটা যদি অর্নব একবার ভুল করেও জানতে পারে তাহলে তো আমায় উদাম কেলানি দিবো সে। ধ্যাৎ, ভাল্লাগে না। আর কতক্ষণ এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়! আঁড়চোখে একবার তাকালাম রাইয়ের দিকে। বেচারি আমার কথা শুনে সেই থেকেই একদম চুপসে রয়েছে। আপাতত ওর এই চুপচাপ স্বভাবটাতেও যেন প্রচুর বিরক্ত হচ্ছি আমি। ইচ্ছে হচ্ছে গোলমাল পেকে যাওয়া মাথাটাতে ওর হাজারটা বোকাসোকা কথা শুনে ভর্তি করে ফেলি।
—-” কি চাই এখানে?”
ভিসির রুমের দরজায় আধাপাকা চুলের অধিকারী লোকটার মোটাস্বরের এমন প্রশ্নে খানিক চমকে উঠলাম আমরা দুজনেই। পাশ ফিরে রাইয়ের দিকে একবার তাকাতে রাই অসহায় মুখ করে বলল,
—-” ভিসি স্যারের সাথে দেখা করতে চাই!”
লোকটি গম্ভীর চিত্তে আমাদের একবার পর্যবেক্ষণ করলেন। অতঃপর কিছু বলবার প্রয়াস চালাতেই আমি বললাম,
—-” ইম্পরট্যান্ট কাজ ছিলো!”
লোকটি মাথা নাড়লেন। দরজা ঘেঁষে ভেতরে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আবারও ফিরে এসে বললেন,
—-” ভেতরে এসো.. স্যার ডাকছেন।”
আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভিসির বিশাল রুমে তার এসির ঠাণ্ডা বাতাসে নিমেষেই হাত পা ঠান্ডা হতে লাগলো আমার। এসির বাতাস টা বরাবরই আমার কাছে কুৎসিত। এর একটা খুব বাজে ভাবে গ/ন্ধ লাগে আমার নাকে, যার দরুন মাথা ব্যা/থা/র সাথে বমি বমি ভাবটাও হয় প্রচুর। আমাদের সামনে বড় চেয়ারটা নিয়ে বসে থাকা গম্ভীর লোকটার চোখ দুটো দেখতেই তখন ঐ আকর্ষণীয় চোখ জোড়ার কথা মনে হলো। কই উনার চোখ জোড়া তো সেই চোখ জোড়া নয়। তবে কি অন্য কেউ ছিলো?
ভিসি আমাদের সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভয় দিয়ে বলল,
—-” ফার্স্ট ইয়ার?”
স্যারের প্রশ্নে রাই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেও আমি পারলাম না। উদ্দেশ্য উনাকে ইনিয়েবিনিয়ে ভেংচি কাটা। কিন্তু কেমন করে করবো তা? দেখলাম উনি রাইয়ের পানে দৃষ্টিপাত করলেন। এই সুযোগ… দিলাম এক ভেংচি কেটে। আর অমনি উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। এই সেরেছে! দেখে ফেললো কি?
—-” আর তুমি?”
বুঝলাম উনি রাইয়ের হ্যাঁ সূচক উত্তর জেনে আমার কাছে পূনরায় জবাব চাইলেন। এবারও আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলাম। পাশ থেকে রাই আবারও বলে উঠলো,
—-” জ…জ্বী স্যার। আমরা দুজনেই ফ..ফার্স্ট ইয়ার।”
স্যারের নজর এবারও রাইয়ের পানে নিক্ষেপ করতে সুযোগে সদ্ব্যাবহার করে কাটলাম আরেকবার ভেংচি। যাক দেখে নি স্যার। বাঁচা গেল।
—-” গুড। তোমাদের এখানে কোনো প্রবলেম হচ্ছে কি?”
এবার রাই-আমি দু’জনেই তুমুল গতিতে না সূচক মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ –‘না’।
আমাের জবাব খানা স্যারের পছন্দ হলেও ঠিক মানতে পারলেন না মনে হলো। তাই খানিক ভাবান্নিত হয়ে বললেন,
—-” প্রবলেম হলে ডিরেক্ট ভিসির কাছে চলে আসবে ওকে। কোনো দ্বিধা করবেনা একদম।”
আমি আমোদিত গলায় বললাম,
—-” জ্বী স্যার।”
স্যার মিস্টি হাসলেন। বললেন,
—-” ওকে। এখন তবে তোমার এসো। আমার ছোট্ট একটা মিটিং আছে।”
আমরা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললাম,
—-” ওকে স্যার।”
স্যার মাথা নাড়তেই উল্টো দিকে ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি সাথে রাইও। আপাতত সিনিয়রদের ডেয়ার ডান। নেক্সট টাইম যদি ফাউল গুলো এমন আউলা-বাউলা ডেয়ার দেয় তো তবে ডিরেক্ট ভিসির কাছে এসে নালিশ হবে। হুহ্, এখনো চিনোনিতো নিধি কে? দেখাবো আমিও কত ধানে কত চাল।
যাই হোক আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার কিন্তু খুব ভালো। উনাকে দু’বার ভেংচি কেটেও যেন শান্তি। আহ্।
.
.
.
🌺
২.
ভার্সিটির এরিয়া টা এক কথায় চমৎকার। প্রতিটা ভবন যেন ছোট খাটো এক একটা রাজপ্রাসাদের থেকে কম নয়। এর যেমন রুলস রেগুলেশন ঠিক তেমনই অবাক করার মতো হাজারও একটা মন কাড়া জায়গা। উফ আমি তো পারলে বাবা কে নিয়ে এখানেই থাকতে চলে আসি। পুরো ক্যাম্পাস রাউন্ড দিয়ে কোন চিপায় কক্রোজ মামাদের কত গুলো ঘর বাঁধা আছে সবই একদম ঠোঁটের আগায় ঠূটস্থ করে নিয়ে এলাম। রাই এর ঘ্যানোর ঘ্যানোর ঘ্যান এ আর্টকলা ক্যাম্পাসটার দিকে বহু আশা নিয়ে পা বাড়াতে চাইলেও শেষ অব্দি আর পৌঁছতে পারলাম না।
আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে হাঁটছি আমরা। বেচারীর বেশ চেপে ক্ষিধে পেয়েছে। আজ ভার্সিটির ফার্স্ট ডে বলে আমার খুশির মাত্রাটা এতোটাই ছিলো যে, গত দুদিন ধরেই খুশির ঠেলায় একদম পাগল হয়ে ছিলাম আর সাথে করে রাইটাকে পাগল বানিয়েছি। আর সেই সাথেই আজ তাড়াহুড়ো দেখিয়ে ওকে সকালের ব্রেকফাস্ট টা অব্দি করতে দেয়নি।
—-” কি রে বেশি ক্ষিধে পেয়ে গেলো নাকি? মুখটা কে এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রাখছিস কেন?”
আমার প্রশ্নে রাইয়ের মুখের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে পূর্বের ন্যায়ই মুখটা একই রেখে বলে উঠলো,
—-” রূপ ভাইয়াকে তুই এভাবে না ক্ষে/পালেও পারতিস নিধি!”
“রূপ ভাইয়া” নামটা শুনতেই যেন কান থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে এলো আমার। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
—-” আমি মোটেই ঐ বে/য়া/দব টা কে ক্ষে/পাইনি। বরং সেই আমাদের সাথে মিস বিহেভ করছিলো। বেটা বলে কিনা ভিসিকে যে ভেংচি কেটেছো তার প্রুফ দাও। হোয়াট ননসেন্স! না, তুই আমায় বল উনি যে কাজ আমাদের করতে বলেছেন সেটা কি ন্যা/য় নাকি
অন্যা/য়? উনারা সিনিয়র বলে নতুন স্টুডেন্টদের সাথে র্যাগিং নামক একটা ইস্যু তুলে যা কিছু করবে? আর সেটা আমরা চুপচাপ সহ্য করবো?”
—-” হ্যাঁ করবে। এটা এই ভার্সিটির অন্যতম প্রধান একটা রুলসের মধ্যেই পড়ে।”
পেছন থেকে আচমকা কোনো পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসতেই চমকে উঠলাম আমি। সামনে থেকে রাইয়ের পানে মুখ তুলে তাকাতেই সে বেচারী ভ/য়ে কেঁপে উঠে আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। ওর এমন রিয়াকশন দেখে বুঝলাম এই কন্ঠ অন্য কারোর নয় বরং আমাদের ভার্সিটির র্যাগিং খ্যাত কোনো এক বড় ভাইয়ের। উনারা আবারও চলে এলেন আমাদের কপালে শনি নাচাতে।
#প্রেয়সী ♥️
#লেখনীতেঃমুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#সূচনা_পর্ব
চলবে___