❝দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ের পিরিতে বসতে লজ্জা করল না৷ আর কত ঠকাবে মানুষকে৷❞
বিয়ের ছয় মাস পর ঋষির মুখে এমন কথা শুনে থমকে যায় তনু৷ তনুকে জানানো হয়েছে, ঋষির পরিবার তার প্রথম বিয়ের কথা জানেন৷ এটাও জানে তনু একজন ডিভোর্সী মেয়ে৷ সেজন্য তনু দ্বিতীয় বারের মতো ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে৷ তনু কিছু বলার আগেই ঋষি রাগী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
❝আমি ডিভোর্স চাই৷ তোমার সাথে এক ছাঁদের নিচে থাকতে পারব না৷ তোমাদের রক্তে প্রতারণার দাগ লেগে আছে৷ আমি কিছুতেই তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে পারব না৷❞
তনুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ তনুর দুই কূলে ঝড় বয়ে যাচ্ছে৷ কত আশা নিয়ে বসেছিল৷ ঋষিকে আজ খুশীর সংবাদ দিবে। তাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসছে৷ এমন একটা দিনে জীবনটা বেদনায় ভরে উঠবে জানা ছিলনা। তনু ভেজা গলায় বলল,
❝আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে৷ আমরা আপনাদের কাছ থেকে কোন কিছু আড়াল করিনি৷ বিয়েতে আমার মত ছিল না৷ বাবা জানিয়েছিলেন আপনি আমার প্রথম বিয়ের বিষয়ে জানেন৷ সবকিছু জেনেই আমাকে বিয়ে করতে চান৷❞
ঋষি তনুর কাঁধ জোরে চেপে ধরে৷ ব্যথায় তনু বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে৷ চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে জল। মনের কষ্টের থেকে শারীরিক কষ্ট অতি সামান্য। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উচ্চ স্বরে বলল,
❝তোমার বাবা মানুষ ঠকাতে পটু৷ আমি আগে জানতে পারলে তোমার সাথে কখনও নিজেকে জড়িয়ে ফেলতাম না।❞
ঋষির চেচামেচির আওয়াজ শুনে ঋষির বাবা আসিফ এবং ঋষির মা গুলবাহার দৌড়ে আসলেন। ঋষিকে তনুর কাছ থেকে দৌড়ে সরালেন তার বাবা আসিফ৷ গুলবাহার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
❝কি হয়েছে? তনুর সাথে খারাপ ব্যবহার করার সাহস কে দিয়েছে? অমানুষের মতো বউয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে তোর হাত কাঁপল না৷❞
তনু সদূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে৷ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল৷ সাথে সংসার হারানোর তীব্র ভয়৷ ঋষি রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
❝আমাকে কেন বলছে? তোমাদের আদরের তনুকে বল! এর আগেও তার একটা বিয়ে ছিল৷ এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে৷ তার বাবা আমাদের ঘাড়ে পাপ চাপিয়ে দিয়েছেন৷❞
ঋষির কথা শুনে ঋষির মা বাবা দু’জনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ ঋষির বললেন
❝এই মুহুর্তে এসব নিয়ে কথা বাড়ানো ঠিক হবে না৷ যা বলার তনুর বাবার সাথে কথা হবে৷ এখানে তনুর কোন দোষ নেই৷❞
ঋষি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তনুর আরও বিয়ে হয়েছিল৷ যাকে নিয়ে সারাজীবন পথ চলার স্বপ্ন বুনেছিল আজ এক মুহুর্তে সবকিছু ভেঙে গেল৷ কেন একবার বলল না সব কিছু ভুল৷ ঋষিকে ঘরে থেকে টেনে নিয়ে যায় ঋষির মা বাবা৷ তনু ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল৷ উদরের উপর হাত রাখে৷ পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট মাথায় এসে হানা দিয়েছে৷ কথা বের হচ্ছে না৷ বেঁচে থাকার সকল মনোবল ভেঙে গেছে৷ মানুষ কি পারে না নতুন করে স্বপ্ন দেখতে৷ নতুন সুতায় বুনতে পারে না সুন্দর একটা পার্ট৷ কেন সব সময় অতীত এসে আমাদের জীবন ছাড়খার করে দিচ্ছে৷ কান্না করতে করতে কখন তন্দ্রা লেগে এসেছে জানা নেই।
_________________________________________
আযানের প্রতিধ্বনি কানে আসতেই তন্দ্রা কেটে যায় তনুর৷ সবকিছুর ঊর্ধ্বে নামাজ৷ নামাজ ছাড়া মানুষের কোন গতি নেই৷ রুমের জানালা খুলে দিল৷ সকালের শীতল হাওয়া মনকে ভরে দেয়৷ সকল গ্লানি দূর করে দেয়৷ সতেজ মনোবল কাজ করে মনের গহীন কোণে৷ ভোরের আলো এখনও ফুটেনি৷ চারিদিকে এখন ফজরের আযান পড়ছে৷ তনু আল্লাহকে স্মরণ করে বলল,
❝হ্যাঁ আল্লাহ সকালের আলো যেমন মুগ্ধতা বয়ে আনে ঠিক যেন আমার জীবনেও মুগ্ধতা নিয়ে আসে৷ আমার সন্তানকে বাবার ছায়া থেকে আলাদা করবেন না৷❞
দুই ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল৷ ওযু করে নামাজ আদায় করে নিল৷ মুনাজাতে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে অঝোরে কান্না করে যাচ্ছে। ওষ্ঠদ্বয় থেকে শুধু আল্লাহর কথা বের হচ্ছে৷ ভেজা গলায় বলল,
❝হ্যাঁ আল্লাহ! আমি ছাড়া আপনার অনেক বান্দা আছে৷ কিন্তু আমার আপনি ছাড়া কেউ নেই৷ সৃষ্টি কর্তা, পালন কর্তা, রিজিকদাতা একমাত্র আপনি৷ আপনি আমার ছেলের মাথা থেকে বাবা নামক ছায়ার হাত সরিয়ে নিবেন না৷ আমি ঋষিকে খুব ভালোবাসি৷ আমি তাকে ছাড়া জীবহীন মানুষের মতো বেঁচে থাকব৷ হ্যাঁ আল্লাহ! আপনি পাপী বান্দার হাত দু’টো কবুল করেন৷❞
_____________________________________
ডাইনিং রুমে সবাই বসে আছে৷ একপাশে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে তনু৷ তনুর মা বাবা মাথা নিচু করে বসে আছেন৷ ঋষি সবার উদ্দেশ্যে বলল,
❝আমি ডিভোর্স চাই। আমি কিছুতেই তনুর সাথে বাকী জীবন পার করতে পারব না৷❞
তনুর বাবা ঋষির মুখ প্রাণে অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকায়৷ অপরাধী কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
❝জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তিনটাই আল্লাহর হাতে৷ তিনি যদি চান এই বিয়ে কিছুতেই টিকবে না৷ তবে একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না৷ তুমি সে কথা কিভাবে নিবে জানা নেই৷❞
ঋষি সন্দিহান এক পলক তনুর দিকে তাকাল৷ তারপর তনুর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
❝হেয়ালি না করে যা বলতে চান তা বলে ফেলেন৷ আপনাদের বাজে কথা শুনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই৷❞
তনুর বাবা তনুর দিকে চোখ তুলে তাকাতেই তনুর ভেজা আঁখি জোড়া ছলছল করে উঠে৷ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে এদিক ওদিক তাকায়৷ তনুর কাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললেন,
❝আমি স্বীকার করছি আমাদের ভুল৷ এখন তুমি তনুর কাছ থেকে ডিভোর্স চাইছো৷ বেশ! আমরা ডিভোর্স দিব৷ জোর করে কোনদিন ভালোবাসা বা সংসার করা যায় না৷ ডিভোর্স দিলে তনুর বদনাম আরও হবে৷ তবে তার কিছু অংশ তোমার গায়েও লাগবে৷ তোমাকে সমাজ অবশ্য কথা শুনাবে না কিন্তু তনুকে শুনাবে৷❞
ঋষি বিচলিত কন্ঠে বলল,
❝আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না৷ দয়া করে খোলাসা করে সবকিছু বলেন! ঘুরিয়ে কথা বলা আমার মুটেও পছন্দ নয়৷ আপনাকে সম্মান করি বলেই এখনও কিছু বলিনি৷❞
তনুর বাবা পুনরায় বললেন,
❝তুমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছো৷ তোমাকে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই৷ কেননা তুমি ভালো মন্দ বুঝতে পার৷ আমার কথা হলো তুমি তনুকে ডিভোর্স দিয়ে আবার বিয়ে করবে। তখন কি তোমার দ্বিতীয় বিয়ে হবে না৷ তুমি কি সেই আগের মতোই থাকবে৷❞
ঋষির মা গুলবাহার কথার মধ্যে বলে উঠলেন,
❝আপনি কিন্তু আমার ছেলেকে কথার মায়াজালে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন৷ সোনা আংটি যেমনই হোক তেমনই ভালো৷ আমি চাইনা আমার ছেলে তনুর সাথে সংসার করুক৷ আপনারা ডিভোর্সের ব্যবস্থা করেন৷❞
তনুর বাবা তনুর মুখপ্রাণে তাকালেন৷ তনু শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ লুকিয়ে কান্না করছে৷ চোখের ইশারায় ভরসা দিয়ে বললেন,
❝যেহেতু ডিভোর্স চান, ডিভোর্স হবে৷ তবে সবকাজ আপনাদের করতে হবে৷ আমরা কোন কাজ করতে পারব না৷ আর হ্যাঁ কোর্টে আবেদন করেন৷ কোর্ট অনুযায়ী ডিভোর্স না হওয়া অব্দি তনু এই বাড়িতেই থাকবে৷ ডিভোর্সের পর আমরা তনুকে নিয়ে বাড়িতে চলে যাব৷❞
তনুর বাবা কথা ঠিক মেনে নিতে পারল না৷ কারণ তনু এই বিয়ে ভাঙতে চাইনা৷ তাই তারা যেমনটা বলবে তাই হবে৷ গুলবাহার চৌধুরী মৃদু হেসে বললেন,
❝তা নয় হয় ঠিক আছে৷ দেনমোহরের টাকা…..❞
তনুর বাবা সম্পুর্ন কথা বলতে দিলেন না৷ গুলবাহারের কথার মধ্যে বললেন,
❝আপনাদের দেনমোহরের টাকা দিতে হবে না৷ আমার মেয়ে আমার কাছে বুঝা হয়নি৷ আমি আমার মেয়ের জীবনকে আর নষ্ট করতে চাইনা৷❞
________________________________________
দেখতে দেখতে কেটে যায় পাঁচ দিন৷ পাঁচ দিন ঋষি তনুর সাথে একটাও কথা বলেনি৷ তনু কথা বলার চেষ্টা করলে ঋষি এড়িয়ে গেছে৷ ঋষি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে তনুকে৷ ঋষির কথা হলো বিয়ের পর হলেও ঋষিকে কথাটা জানানোর উচিত ছিল৷ কেন অন্য মানুষের কাছ থেকে জানতে হবে? ঋষি ডিভোর্স পেপার নিয়ে তনুর রুমে প্রবেশ করল৷ তনু ঘরের এক কোণে বসে কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করছিল৷ ঋষির উপস্থিতি বুঝতো পেয়ে কোরআনের কিছু আয়াত পড়ে রেখে দিল৷ পরবর্তীতে সেখান থেকে পড়তে পারে৷ তনু মৃদু স্বরে বলল,
❝কিছু বলবেন? না মানে হুট করে এই ঘরে আসলেন তো৷❞
ঋষি অন্য দিকে তাকিয়ে জবাব দিল,
❝হ্যাঁ! সোফার উপর ডিভোর্স পেপার রাখা আছে৷ আমি সাইন করে দিয়েছি৷ তুমি সাইন করে দিলেই আমি কোর্টে জমা দিতে পারি৷❞
❝আপনি সত্যিই আমাকে ডিভোর্স দিবেন৷ তবে আপনাকে একটা অনুরোধ করলে রাখবেন!❞
সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঋষির দিকে৷ এই বুঝি ঋষি মানা করে দিবে৷ তনুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
❝কিসের অনুরোধ? রাখার মতো হলে চেষ্টা করব।❞
❝আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আবার ভাবার অনুরোধ রইল৷ আপনার ভাবনার সঠিক জবাব আসলে আমি সাইন করে দিব৷ কোন অভিযোগ রাখব না৷❞
ঋষি কথা না বাড়িয়ে চলে আসে৷ দরজার কাছে আসতেই তনু বলে উঠল,
❝এখন আমাদের সম্পর্কে ভাটা এসে হানা দিয়েছে৷ পরিবারের মানুষ মেনে নিতে সময় লাগবে৷ কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে হারালে আশি বছর পরেও আফসোস করতে হয়৷❞
#সম্পর্কের_প্রণয়
#পর্ব_০১
#নুর_নবী_হাসান_অধির