#চিত্তবৃত্তি : ১+২+৩
#জান্নাতুল_নাঈমা
মামাকে বিয়ে করতে হবে! দু’মাস হলো রজনী মামি মারা গেছে৷ তার শোক কাটিয়ে মামা বিয়ে করতে রাজি হয়েছে! তাও আবার ভাগ্নি মুসকানকে! রক্তের সম্পর্ক নাহোক, মুসকান ছোটোবেলা থেকে তাকে মামা হিসেবেই জানে।
– কক্ষনো না। এই বিয়ে জীবৎকালে সম্ভব না।
বলল মুসকান। যাকে এতকাল মামা বলে ডেকেছে, মামা হিসেবে করেছে অগাধ শ্রদ্ধা, দিয়েছে সম্মান। তাকে স্বামীর আসনে বসাতে পারবে না সে। গা ঘিনঘিন করছে তার। তীব্র লজ্জায়, তীক্ষ্ণ ঘৃণায় মূর্ছা ধরার উপক্রম। পারভিনেরও জেদ মুসকানকে সে ভাইয়ের বউ করবেই৷ বরাবরের শান্ত স্বভাবের মেয়েটা তাই প্রতিবাদ করল৷ পারভিনকে বলল,
– আমাকে জোরজবরদস্তি করলে দাদুভাইকে সব জানিয়ে দেবো৷ কারো সাহায্য না পেলে থানায় যাব। যদি এসব কিছু নাও করি নিজেকে শেষ করে এর জন্য আপনাদের দায়ী করে যাব।
অবিশ্বাস্য সেই প্রতিবাদে ভয় পেল পারভিন। পাল্টা ভয় দেখাতে তাই ভরসন্ধ্যেবেলা যুবতী মেয়েটাকে দয়াশূন্য চিত্তে বাড়ি থেকে বের করে দিল। বলল,
– কাজের মেয়ে হয়ে রাজরানি হওয়ার স্বপ্ন তোর? আমার ব্যবসায়িক ভাইকে বিয়ে করতে এত অসুবিধা? কোন জমিদার আসবে তোকে বিয়ে করতে? জোর করে বিয়ে দিলে থানায় যাবি হুমকিও দিলি? যাহ করব না তোকে ভাইয়ের বউ। আর না ফিরিয়ে নিয়ে যাব ঐ বাড়িতে৷ অচেনা জায়গায় মাঝরাতে যখন শেয়াল, কুকুর ডগডগে শরীরটা খুবলে খাবে তখন বুঝবি কেমন জ্বালা।
পারভিন ভেবেছিল এবারে ভয় পাবে মুসকান। ভয় থেকে রাজিও হয়ে যাবে তার মাঝবয়েসী ভাইকে বিয়ে করতে। কিন্তু সেসব কিছু হলো না। মুসকান নিঃশব্দে ধীরপায়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। ক্রোধ আর অহংকারে জর্জরিত হয়ে পারভিনও আটকালো না মুসকানকে৷ বাড়ির কাজের মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাপের বাড়ি নিয়ে এসেছিল৷ উদ্দেশ্য, বিপত্নীক ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবে৷সারারাত এত বুঝিয়েও রাজি করাতে পারেনি মুসকানকে। আর আজ যখন কাজি ডেকে কবুল বলাতে, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করাতে জবর দস্তি করল। তখন পুলিশের ভয়, মরে যাওয়ার ভয় দেখাল। মোটকথা চৌধুরী বাড়ির মেজো বউ পারভিনের সমস্ত পরিকল্পনা ধূলিসাৎ করে দিয়ে গেল মুসকান৷
.
.
অচেনা শহরে দিকবিদিকশুন্য হয়ে হাঁটতে লাগল মুসকান। টাঙ্গাইল শহরের কোনো কিছুই চেনে না সে৷ মফস্বলের ঐ চৌধুরি বাড়ি আর কাছাকাছি স্কুল, কলেজ ছাড়া কোনো কিছু সম্পর্কেই সে খুব একটা অবগত নয়। এবারই প্রথম মেজো মায়ের সঙ্গে তার বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি মেজো মায়ের মনে এতবড়ো ষড়যন্ত্র চাপা ছিল। সে বাবা-মা হীন, অসহায় বলে এমন একটি ষড়যন্ত্র করতে পারলো মেজো মা?
শিক্ষিত আর মার্জিতবুদ্ধি থাকার দরুন চোখে অজস্র জলেরা ভীড় করলেও উপচে পড়ল না। নিজেকে শান্ত রাখার প্রাণপণে চেষ্টা করল সে। তবে বুকের ভেতরের ভয়টা ক্রমশ তীক্ষ্ণতায় রূপ নিচ্ছে। তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কোনটা পশ্চিম, কোনটা পূর্ব দিক। অচেনা শহুরে রাস্তার যানজট, গিজগিজে মানুষের ভীড় দৃষ্টিগোচর হলো। তবুও মনে হলো পুরো পৃথিবীতে সে একা। পুরোপুরি নিঃসঙ্গ। আর এই মনে হওয়াটাই দ্বিগুণ দিশেহারা করল মেয়েটাকে। সত্যিই তো পুরো পৃথিবীতে সে একা। খুবই একা। কে আছে তার? কেউ তো নেই। চৌধুরী বাড়িতে যে মানুষটা তাকে সবচেয়ে ভালোবাসে সে হলো দাদুভাই। ঐ মানুষটাও তো তার নিজের নয়। ঐ মানুষটার সঙ্গে তার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি দাদুভাই তার নিজের কেউ হতো তাহলে আজ কি তার পরিচয় শুধু চৌধুরী বাড়ির কাজের মেয়ে হতো? মেজো মা যে দুঃসাহস দেখিয়েছে সেই দুঃসাহসটা কি দেখাতে পারতো? যদি সে চৌধুরী বাড়ির মেয়ে হতো?
অসহ্য যন্ত্রণায় বুক ভার হলেও অদৃশ্য শক্তি পেল মুসকান। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত হাতে ধরে হাঁটতে শুরু করল শুধু সামনের দিকে। সহসা স্মরণ হলো ইমন চৌধুরীকে। চৌধুরী বাড়ির ছোটো নাতি ইমনকে।ভারি বুদ্ধিজ্ঞান সম্পন্ন, শক্ত ব্যক্তিত্বের, ন্যায়পরায়ণ ঐ মানুষটাই তো বলেছিল, সব পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে। জীবনের কঠিন মুহুর্তগুলোতে বুকে সাহস, আর মনে শক্তি যোগাতে। ভীরুতা কখনো সফল হতে দেয় না। দুর্বলতা কখনো মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেয় না। সেসব কথা স্মরণ করে মুসকান ভাবলো, সে কোনো আদুরে ঘরের দুলালি নয়। যে আরাম, আয়েশ করে সহজ জীবন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বাঁচবে। সে একটা লড়াকু মেয়ে। যে কিনা আট বছর বয়স থেকেই লড়াই করছে। শুরুতে পেটের খিদে বাঁচাতে, এরপর শরীরের লজ্জা ঢাকতে জামা-কাপড়ের, এরপর বিদ্যা অর্জনের জন্য। আজ লড়াই করল বিকৃত কয়েকজন মানুষের বিরুদ্ধে। এরপরের লড়াই টা কী জানে না৷ শুধু জানে ভীরুতা তাকে সফল হতে দেবে না৷ দুর্বলতাও মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেবে না৷ তাকে যেমন বাঁচতে হবে তেমন সফলও হতে হবে।
দু’মিনিট হাঁটার পর মুসকান দেখতে পেল অল্প বয়সী দু’টো ছেলেমেয়ে হাত ধরে এগিয়ে আসছে। তাকে যখন পাশ কাটাতে যাবে তখনি বুদ্ধি করে, অত্যন্ত নমনীয় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– একটু শুনবেন?
ছেলেমেয়ে দু’টো হাসিহাসি মুখে দাঁড়াল। তার ভয়ার্ত মুখখানি দেখে তাদের হাসিটা কিঞ্চিৎ নড়বড়ে হয়ে পড়লে সে পুনরায় নম্র সুরে বলল,
– আসলে আমি কোনটা পূর্ব, কোনটা পশ্চিম বুঝতে পারছি না৷ একটু দেখিয়ে দেবেন?
আশ্চর্য হয়ে গেল অজ্ঞাত মেয়েটা। অজ্ঞাত ছেলেটা পূর্ব, পশ্চিম দিক দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– আপনি কি শহরে নতুন নাকি? কোথায় যাবেন?
মুসকান সংকুচিত হয়ে পড়ল। মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাল সে নতুন। এরপর ছেলেমেয়ে দুটো চলে গেলে হাঁপ নিঃশ্বাস ফেলল। সারাজীবন এক জায়গায় থেকে বড়ো হয়েছে। কখনো দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি। দিক নিয়েও এতটা বিভ্রান্ত হতে হয়নি। গতকাল মেজো মায়ের সঙ্গে এখানে আসার পরই দিক নিয়ে গণ্ডগোল হচ্ছিল। কথার ছলে শুনেছিল স্টেশন থেকে উত্তর দিকে তার বাবার বাড়ি। অর্থাৎ এখন তাকে দক্ষিণ দিকে যেতে হবে। তাহলেই পেয়ে যাবে স্টেশন। স্টেশনে গিয়ে বাস ধরে ঘাটাইল পর্যন্ত আসতে সময় লাগল আড়াই ঘন্টা। যানজটের কবলে না পড়লে আরো আগেই পৌঁছাতো। এরপর বাস থেকে নেমে অটোর জন্য দাঁড়াতেই ডাক শুনল,
– আরে মুসকান আপু না? এত রাতে এখানে কী করো?
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মুসকান। দেখতে পেলো নিবিড়কে। ঈষৎ হাসার চেষ্টা করতেও মুখে হাসি এলো না৷ নিবিড় ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে বলল,
– তোমাকে এমন লাগছে কেন আপু? তুমি এই সময় কোথায় থেকে এলে?
মুসকান যোগ্য কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। অস্বস্তিতে পড়ল খুব৷ আমতা আমতা করে কিছু উত্তর দেবে তার পূর্বেই কারো বিস্মিত কণ্ঠ শুনতে পেল। চমকে ওঠল আচমকা।
– মুসকান! তুমি, তুমি এখানে কী করে? তুমি তো মেজো মায়ের সাথে বেড়াতে গিয়েছ!
চৌধুরী বাড়ির ছোটো নাতি ইমন চৌধুরীকে দেখে গলা শুঁকিয়ে গেল তার৷ ইমন এগিয়ে এলো৷ নিবিড়ের পাশে এসে দাঁড়াল উদ্বিগ্ন চিত্তে। নিবিড় বলল,
– আমিও তাই বলতেছি ভাই। মুসকান আপু এখানে কেন!
মুসকান জড়োসড়ো হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ইমন আপাদমস্তক দেখে নিল মুসকানকে। পরনের সেলোয়ার-কামিজটা কেমন কুঁচকে কুঁচকে হয়ে আছে৷ বাইরে পরার পোশাক এটা না খুব ভালো করে জানে সে। কাঁধে থাকা ব্যাগের একটি চেইন খোলা। এতকিছুর পরও মাথায় গাঢ় সবুজ ওড়নার ঘোমটা যেন নিজ কর্তব্য পালনে অটল। কিন্তু ম্লান মুখের অস্বচ্ছ দৃষ্টিজোড়া অশান্তিতে ঠেলে দিল ইমনকে। ব্যগ্র হলো চিত্ত। কোনো প্রকার প্রশ্ন না করে নিবিড়কে শান্ত গলায় বলল,
– তুই যা আমি আসছি।
নিবিড় চলে গেল পশ্চিম দিকে, বাজার রোডে। ইমন ওর যাওয়ার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুসকানের দিকে তাকাল। অত্যন্ত সহজ, শীতল সে দৃষ্টিতে বরাবরই ভরসা পায় মুসকান৷ আজো পেল। ইমন শান্ত কণ্ঠে বলল,
– আমার সঙ্গে এসো।
.
ফুড ভিলেজে মুখোমুখি বসে আছে ইমন, মুসকান। বড়োসড়ো এই রেষ্টুরেন্টটি ইমনের দুই কাকার। যার একভাগের নাম ফুড ভিলেজ। আরেকভাগের নাম ফুড ফেয়ার৷ তারা বসেছে ফুড ভিলেজে। নিবিড় এখানকার একজন সার্ভেন্ট। রাত হওয়াতে মানুষ জন খুবই কম৷ নিবিড় দু’টো পানির বোতল দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– ভাই কি দেবো?
ইমন সোজা হয়ে বসে মুসকানের দিকে তাকাল। সুক্ষ্ম সে চাহনিতে মুসকান ইতস্তত করল খুব। জড়োসড়ো হয়ে রইল। ইমন নিবিড়কে বলল,
– ফ্রাইড রাইস আর স্প্রাইট দে।
নিবিড় চলে গেল। ইমন কয়েক পল নিশ্চুপ থাকল। নির্বিঘ্নে তাকিয়ে দেখল শুধু মুসকানকে। গভীর কোনো গণ্ডগোল হয়েছে বুঝে নিয়ে সে ব্যাপারে প্রশ্ন করার আগে সহজ কিছু কথা শুরু করল,
– আধঘন্টা হলো টাঙ্গাইল থেকে এসেছি। এখনো বাড়ি যাইনি। একটি গুড নিউজ আছে।
মুসকান জানে ইমনের শিক্ষক পদে চাকরি হয়েছে। এরপরও আরো নতুন কী সুসংবাদ আছে সে জানে না। মনের সকল বিষাক্ত অনুভূতি ধীরেধীরে কাটতে শুরু করল তার। নড়েচড়ে একটুখানি তাকাল ইমনের দিকে। ফর্সা লম্বাটে গালের কালো দাঁড়িতে ইমনকে বেশ সুন্দর লাগছে। ইতিপূর্বে বেশিরভাগ শেভ করাই দেখেছে। এখন দাঁড়ি রাখছে, সাইজ করে কাটছে। হাইস্কুলের শিক্ষক বলে কথা। চেহেরায় সেই ভাবটা তো রাখতেই।
ইমন বলল,
– তুমি যেই স্কুল থেকে এস.এস.সি দিয়েছ আজ আমি সেই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক!
বিস্মিত চোখে তাকাল মুসকান। খুশিতে মুখশ্রীর রঙ পাল্টে গেল তার। অভিভূত স্বরে বলল,
– অভিনন্দন ছোটোসাহেব।
ইমন মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল,
– থ্যাংক’স।
মুসকানের উচ্ছ্বসিত মনে হঠাৎ পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। ক্লাস নাইনে দাদুভাই তাকে পাবলিক স্কুলে ভর্তি করেছিল৷ এরপর হঠাৎ সেখান থেকে বদলি করে গার্লস স্কুলে ভর্তি করালো। কারণ জানতে চাইলে ইমন তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিল,
– তোমার মতো নরম, তুলতুলে মেয়ের জন্য বয়েজ স্কুল নয় গার্লস স্কুলই পারফেক্ট।
সে বরাবরই চাপা স্বভাবের মেয়ে৷ বিশেষ করে নিজের দুঃখ, কষ্ট গুলো কারো সাথেই ভাগ করে না৷ কাউকে কখনো সুখ, দুঃখের কথা বলে না সে। কেউ মারল কি কাটল কাউকে বলবে না। নিজেই সহ্য করে নেবে৷ কেউ তীক্ষ্ণ অপমান করলে মুখবুজে সহ্য করে চলে আসবে। বয়েজ স্কুলে ভর্তির পর প্রথম ক্লাসেই এক ছেলের প্রপোজ পেল। সে তার উত্তরে কিছু না বলে চোখ, মুখ শুকনো করে চলে আসতে উদ্যত হয়েছিল। অমনি প্রপোজ করা ছেলেটা শক্ত করে হাত টেনে ধরে৷ হাতের মুঠোয় কাঁটাযুক্ত গোলাপটা দিয়ে বলে,
– প্রপোজের উত্তর পরে দিলেও চলবে। কিন্তু দশ টাকা দিয়ে কেনা ফুল নিতেই হবে।
মুসকান ফুলটা নিয়েই বাড়ি ফিরেছিল৷ ফেরার পর কাজে এতটা ব্যস্ত ছিল যে সেই ফুলের কথা ভুলেই গিয়েছিল। ইমনের ছোট চাচার বড়ো মেয়ে ইয়াশফার নজরে পড়ে ফুলটি৷ মুসকানকে চেপে ধরে সব সত্যি জেনে নেয় সে৷ আর ইয়াশফাও বড়োভাই ইমনকে সবটা বলে দেয়। এরপরই দাদুভাইকে দিয়ে স্কুল পরিবর্তন করায় ইমন।
নিবিড় খাবার নিয়ে এলো। ওরা দু’জন খেল। খেতে খেতে ইমন প্রশ্ন করল,
– তোমার পড়াশোনার কী খবর? পরীক্ষা কেমন দিয়েছ?
গতমাসেই অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে মুসকানের। সে প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্রী। ইমন জানে পরীক্ষা নিঃসন্দেহে ভালো হয়েছে। তবুও জিজ্ঞেস করল। কারণ প্রয়োজন ব্যতীত এই মেয়েটা একটা কথাও বলে না। কীভাবে যেন তার এই গুণটা মুসকান পেয়ে গেছে! ভাবতেই গোপনে হাসলো ইমন। মুসকান ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,
– ভালো হয়েছে।
এরপর অনেকটা সময় কেটে গেল৷ খাওয়া শেষ এবার ফিরতে হবে৷ কিন্তু মনে স্বস্তি পাচ্ছিল না ইমন৷ মনটা খচখচ করছে তার। শেষে না পেরে মুসকানের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। সিরিয়াস মুখো ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
– একা একা টাঙ্গাইল থেকে ঘাটাইল এলে তবুও রাত করে। বিষয়টাতে রহস্য লুকিয়ে আছে। সেই রহস্যের জট তুমি খুলবে? নাকি মেজো মাকে ফোন করে আমিই খুলব?
সহসা কেঁপে ওঠল মুসকান। চাপা আর্তনাদে বলল,
– না, না।
ইমনকে ভালো করেই চেনে মুসকান। চৌধুরী বাড়িতে সেই ছোট্টবেলা থেকে কাজ করে সে। তার ২১ বছরের জীবনে দু’জন মানুষের খুব বেশি সাপোর্ট ছিল। দাদুভাই, আর ছোটোসাহেব। এই দু’জন মানুষের জন্যই সে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে, পাচ্ছে। এরা না থাকলে আজ তার পরিচয় শুধু গৃহকর্মীই হতো। এরা ছিল বলেই তো আরো একটি পরিচয় হয়েছে। বিদ্যার্থী। সে একজন স্টুডেন্ট। তার জন্য দাদুভাইয়ের পাশাপাশি ইমনও কম লড়াই করেনি। ইমন চৌধুরী অন্যায়ের সঙ্গে কখনোই আপোস করেন না। ন্যায় বলতে করেন না একটুও দ্বিধা। আজ মুসকানের সাথে যা হয়েছে তা যদি ইমন জানতে পারে তাহলে কী হবে বা কী হতে পারে খুব ভালো করেই জানে মুসকান। তার জন্য চৌধুরী বাড়িতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হোক পরিবারের মানুষদের মধ্যে ভয়াবহ ঝামেলা বাঁধুক। সর্বোপরি পারভিনের শশুর বাড়িতে মাথা নত করে থাকতে হোক চায় না মুসকান। কিন্তু ইমনও নাছোড়বান্দা। তাই সে মিথ্যা বলল,
– আমার ওখানে কিছুই ভালো লাগছিল না। আসলে আপনাদের বাড়ি ছাড়া কোথাও এক রাতও কাটাইনি তো৷ তাই খুব অশান্তি লাগছিল। মেজো মাকে খুব অনুরোধ করেছিলাম যাতে আমাকে গাড়িতে ওঠিয়ে দেয়।
– আর মেজো মা তোমার কথা শুনে নিল?
ঢোক চিপে মাথা নাড়ালো মুসকান। তার শ্যামলাটে গালদুটো বিবর্ণ হয়ে এলো। ইমন চাপা নিঃশ্বাস ফেলল। মুসকানের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
– সত্যিটা জানার অপেক্ষা করব।
এটুকু বলেই ওঠে দাঁড়াল সে। ধরা পড়ে মুখটা থমথমে হয়ে গেল মুসকানের। লজ্জায় নত হলো মাথা। কম্পিত বুকে সংকুচিত হয়ে ওঠে দাঁড়াল সে। ইমন ভরাট কন্ঠে বলল,
– চলো।
#চিত্তবৃত্তি : ২
রাত দশটা নাগাদ ইমন, মুসকান বাড়ি ফিরল। দু’জনকে একসঙ্গে দেখে বাড়ির সকলে হতভম্ব। এটা কী করে সম্ভব ভেবে পেল না কেউই। তাদের সমস্ত পরিকল্পনা ধুলোয় মিশে যেন গড়াগড়ি খেতে লাগল। কারো মুখে রা নেই। তাদের হতভম্ব মুখ গুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল করে উপরে চলে গেল ইমন। আর মুসকান মাথা নিচু করে চলে গেল নিচতলায়। তার জন্য বরাদ্দ করা ছোট্ট ঘরটায়। ভাতিজার সঙ্গে কাজের মেয়ে মুসকানকে বাড়িতে ফিরতে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেল মহিউদ্দিন চৌধুরীর। সম্পর্কে সে ইমনের মেজো কাকা। তীব্র মেজাজ খারাপ নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল সে। কল করল বড়ো ভাই মোজাম্মেল চৌধুরীকে।
মোজাম্মেল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে ইমন। খুবই আদরের সন্তান তার। বিয়ের তেরো বছর পর বাবা হয়েছেন তিনি। কিন্তু হারিয়েছেন প্রিয় স্ত্রী ইরাবতীতে। তার শেষ স্মৃতি ইমনকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন মানুষটা। বাবার আদেশে দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার করছেন। পেশায় এডভোকেট। দ্বিতীয় স্ত্রী, একমাত্র পুত্র ইমন আর একমাত্র কন্যা ইনায়াকে নিয়ে টাঙ্গাইল সদরে নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। ইমন কলেজ স্টুডেন্ট থাকাকালীনই মোজাম্মেল চৌধুরী টের পান মুসকানের প্রতি ওর আলাদা দুর্বলতা রয়েছে। সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে ছেলে। যুবক বয়সে ভুল মানুষের প্রতি অনুভূতি আসতেই পারে৷ বাবা হিসেবে তার উচিত ছেলেকে সঠিক পথ দেখানো। সরাসরি সেই পথ দেখাতে পারেনি অত্যাধিক পুত্রস্নেহ থেকে। তাই বুদ্ধি খাঁটিয়ে ফ্ল্যাট কিনে ইনায়াকে ভালো স্কুলে ভর্তির নাম করে পুরো পরিবারকে নিয়েই চলে যায়। ইমন শুরুতে রাজি না হলেও ইন্টার পাশ করার পর অনার্সে টাঙ্গাইল সা’দতে ভর্তির সুবাদে বাবার কাছেই থাকতে শুরু করে। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে বাড়ি আসা বন্ধ করতে পারেনি৷ মুসকানের প্রতি যেই দুর্বলতা সে আঁচ করেছিল তা যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কতগুলো বছর কেটে গেল। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য ওঠে পড়ে লাগল ইমন৷ মোজাম্মেল চৌধুরীর বুকেও ভয় জন্মাতে শুরু করল। না জানি কবে ছেলে এসে আবদার করে বসে, মুসকানকে তার বউ হিসেবে চাই! মানবতার খাতিরে সে নয় বছর আগে মুসকানকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়নি। বরং ছেলেকেই নিজ বাড়ি থেকে দূরে রেখেছে। পরিচয়হীন বাচ্চা মেয়েটাকে চৌধুরী বাড়িতে জায়গা দিয়েছিল তার প্রয়াত মা। মায়ের প্রতি তীব্র শ্রদ্ধাবোধ, নিজের মানবতাবোধ অসহায় মেয়েটাকে বাড়ি ছাড়া করতে দেয়নি৷ কিন্তু আজ সময়টা খুব কঠিন৷ ইমন এখন প্রতিষ্ঠিত। যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে অঘটন। আর যাই হোক পরিচয়হীন এক কাজের মেয়ে তার ছেলের বউ হতে পারে না। চৌধুরী বাড়ির সম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ সে জীবৎকালে করেনি। আর না তার বংশধরদের দ্বারা করতে দেবে। তাই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেছিল মেয়েটার বিয়ের বন্দোবস্ত করবে। তার সে পরিকল্পনাও সফল হচ্ছিল না। কারণ মুসকান বিয়ে করতে রাজি নয়৷ সে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। তার এই ইচ্ছেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে মোতালেব চৌধুরী। ইমনের দাদুভাই। যার কথাই চৌধুরী বাড়িতে শেষ কথা। কিন্তু তার শেষ কথাতে ভবিষ্যতে কতোবড়ো অঘটন ঘটে যাবে আঁচ করছেন মোজাম্মেল চৌধুরী। তাই ভাই মহিউদ্দিন আর তার বউ পারভিনের সহায়তা নিয়েছে সে। তারা দু’জন তাকে নিশ্চিত করেছে মুসকানকে ভালো পাত্রের কাছে বিয়ে দিয়ে বিদায় করবে বাড়ি থেকে।
মহিউদ্দিনের থেকে পাওয়া সংবাদে রুষ্ট হলো মোজাম্মেল চৌধুরী। বলল,
– আমারই ভুল। দায়িত্বটা আমারই নেয়া উচিত ছিল!
বলেই কল কেটে দিল। মহিউদ্দিন ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে স্ত্রী পারভিনকে কল করল। হুংকার দিয়ে বলল,
– তোমার ওপর ভরসা করাটাই ভুল হইছে আমার। মুসকান এখানে এলো কী করে? তুমি ওখানে এখনো কী করো? বসে বসে আঙুল না চুষে সকাল সকাল বাড়িতে এসে পড়বা।
.
.
স্ত্রীর মৃত্যুর পর মোতালেব চৌধুরী বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকেন৷ অনাথদের জন্য একটি আস্তানা তৈরি করেছেন তিনি। অনাথদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। মাত্র নয়জন৷ তাদের দেখভালের জন্য একজন লোক রাখা হয়েছে। পেনশনের অর্ধেক টাকা খরচ করেছেন সেই আস্তানায়। বাকি অর্ধেক ব্যাংকে রেখেছেন। প্রতি মাসে যা লাভ আসে তাই দিয়ে আর যা বেতন পায় তা দিয়ে নিজের এবং আশ্রমের বাচ্চাদের খরচ হয়ে যায়। বাড়ির প্রতি কিঞ্চিৎ মায়াটুকুর জন্যই প্রতি শুক্রবার আসেন। ছেলে, নাতি, নাতনি, বউদের সঙ্গে ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়ে ফের চলে যান আশ্রমে। আজ শুক্রবার। দাদুভাই আসার কথা কিন্তু এলেন না। ইয়াশফা আপুর কাছে শুনেছে, দাদুভাই আজ আসবেন না৷ জরুরি কাজে তিনি ঢাকা গিয়েছেন। এই নিয়ে কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলো মুসকানের। সকাল থেকে রান্নাবান্না করে ক্লান্তও লাগছে খুব। গোসল সেরে বিছানায় শরীরটা এলিয়েছে মাত্র। এমন সময় ইয়াশফা ঘরে ঢুকল। প্রচণ্ড তাড়া দিয়ে বলল,
– এই মুসু ওঠ ওঠ৷ তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছাড় আর আমার এই শাড়িটা পরে ফেল।
চমকাল মুসকান ভ্রু কুঁচকে ওঠে বসল। ইয়াশফা আপুর হাতে থাকা শাড়িটাতে কয়েক পল তাকিয়ে থেকে নম্র স্বরে বলল,
– শাড়ি! শাড়ি কেন পড়ব?
– বারে এমন করে বলছিস যেন শাড়ি পরার মতো জিনিস নয়। যাকগে আসল কথা বলি তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। বড়োবাবা ফোন করেছিলেন। পাত্র নাকি তার চেনা খুব ভালো পরিবারের ছেলে। ব্যাংকে চাকরি করে!
অজানা শঙ্কায় মুসকানের সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠল৷ ঢোক গিলে বলল,
– আমি ওদের সামনে যাব না।
ইয়াশফা বিরক্ত হলো। জোর খাঁটিয়ে বলল,
– মুসু এমন করিস না৷ বড়োবাবা তোর জন্য সম্বন্ধ দেখছে। তুই সামনে না গেলে বড়োবাবাকে অপমান করা হবে। আর বড়োবাবাকে অপমান করলে ছোটোভাইয়া তোকে ছেড়ে কথা বলবে না।
তীব্র অনীহা থাকা সত্ত্বেও শাড়ি পরতে হলো। অপেক্ষা করতে হলো পাত্রপক্ষের জন্য। শুক্রবার থাকার কারণে বাড়িতে উপস্থিত মেজো কাকা, মেজো কাকি। তার দুই ছেলে ইমরান, আনিস। আর ছোটো কাকি মানে ইয়াশফার মা আর অভ্র ভাই। তাদের উপস্থিতিতে পাত্রপক্ষরা এলো। দুপুরের খাবার পর্ব শেষ হলে মুসকানকে আনতে চলে গেল ইয়াশফা৷ ড্রয়িংরুমে সোফাতে বসে আছে পাত্রের বাবা, মা, আর ফুপু। তাদের সামনে আনা হলো মুসকানকে। নত মাথায় দুরুদুরু বুকে এসে দাঁড়াল মুসকান। সালাম দিল সকলকে। এরপর ইয়াশফা তাদের পাশের সোফায় বসিয়ে দিল মুসকানকে। সে দাঁড়িয়ে রইল পাশেই। যেন সাহস পায় মুসকান।
পাত্রের ফুপু জিজ্ঞেস করল,
– তোমার নাম কী?
মুসকান ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,
– মুসকান জান্নাত।
– ওও। পড়ালেখা কতদূর?
– অনার্স প্রথম বর্ষ থেকে ফাইনাল দিয়েছি।
– ওও। তা তুমি কতদিন ধরে এই বাড়ি কাজ করো?
পান চিবাতে চিবাতে বাঁকা চোখে তাকিয়ে প্রশ্নটি করলেন ফুপু। তার এ প্রশ্নের ধরনে স্পষ্ট বোঝা গেল পাত্রী দেখতে এসে সে খুব একটা সন্তুষ্ট নন। মুসকান এহেন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থতমত খেল৷ সে নিজেও জানে না কবে থেকে এ বাড়িতে কাজ করে। সে কে? কোথায় থেকে এ বাড়িতে এসেছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজো কেউ দেয়নি তাকে। যখনি কাউকে এ প্রশ্নগুলো করেছে সবাই বলেছে, তারা জানে না৷ এ ব্যাপারে যিনি সঠিক জানেন তিনি বেঁচে নেই। বহু বছর আগেই পরলোকগমন করেছেন। এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হলে দাদুভাইও এড়িয়ে যায় তাকে৷ তার এমন কোনো স্মৃতি মনে নেই যা থেকে সে বুঝবে সে কে বা কোথায় থেকে এসেছে। তার বাবা, মা কে? তার সত্যিকারের পরিচয় কী? কোনোকিছুই জানে না। শুধু স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সে এ বাড়ির কাজের মেয়ে। ছোট্টবেলায় প্রথম মেজো কাকিই সবার কাছে তার পরিচয় দিয়েছে কাজের মেয়ে৷ তখন থেকেই সে বুঝতে শিখেছে সে এ বাড়ির কাজের মেয়ে৷ রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল মুসকান৷ চারপাশে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষীণ স্বরে বলল,
– জানা নেই।
পাত্রের ফুপু অবাক হলো। পাত্রের মায়ের দিকে তাকিয়ে ফের প্রশ্ন করতে উদ্যত হলে পাত্রের মা তার হাত চেপে ধরল। গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস করে বলল,
– আপা এসব প্রশ্ন কইরেন না। এইগুলা দিয়ে আমাগো কাজ নাই। মোটা টাকার যৌতুক পামু এই তো বেশ। এতোকিছু ঘেঁটে দেখা লাগব না। মেয়ে দেখতে মাশাআল্লাহ। শিক্ষিত আবার কাজ, কামেও পটু। লম্বা, চওড়া শরীর, আমার অম্লানের সাথে বেশ মানাবো।
পাত্রের ফুপু আর প্রশ্ন করলেন না। শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন মুসকানকে। সহসা ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলো ইমন। তার উপস্থিতিতে মুখে হাসি ফুটল অভ্রর। কারণ সেই ইমনকে জানিয়েছে মুসকানকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। যা শুনে এক মুহুর্তও দেরি করেনি ইমন। দাদুভাই ঢাকা যাওয়ার পর সে গিয়েছিল আশ্রমে। দাদুভাই না আসা পর্যন্ত ওখানেই থাকার কথা তার। এরই মধ্যে বাড়ি থেকে এমন শোক সংবাদ পেয়েছে৷ হ্যাঁ মুসকানকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসা তার কাছে শোকই বটে। যার জন্য নিজেকে তীলে তীলে গড়ে তুলল। যাকে নিজের জন্য গড়ে তোলার জন্য আড়ালে এত এত সেক্রিফাইস। তাকে কিনা অন্য কেউ বউ করার জন্য দেখতে এসেছে? চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল ইমন। আকস্মিক তার আগমনে ভড়কে গেল মেজো কাকা। মেজো কাকি আমতা আমতা করে বলল,
– আরে আরে ইমন যে। আসো বাবা আসো। বসো ওখানে। মুসকানকে এনারা দেখতে এসেছেন।
সহসা চোখ খুলল ইমন। মেজো কাকির দিকে তাকাল অগ্নি চক্ষুতে। তার দৃষ্টি দেখে গলা শুঁকিয়ে গেল পারভিনের। ঢোক গিলে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। ইমন পারভিনের থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাল মেজো কাকার দিকে। এমনিতেই এদের প্রতি ক্ষেপে আছে সে। সেদিন পারভিন মুসকানকে নিয়ে কেন বাপের বাড়ি গিয়েছিল। ওখানে ঠিক কী কী ঘটেছে। সবটাই জেনে গেছে ইমন। ইয়াশফার মাধ্যমে কৌশলে মুসকানের মুখ থেকে সত্যি কথা বের করেছে। ঘৃণ্য সেই কাজের জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি পারভিনকে। ইমনও মাথা ঠাণ্ডা করে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিল। এরই মধ্যে আরেক কাণ্ড।
মেজো কাকা ইমনের দৃষ্টি দেখে সচেতন হলো। বলল,
– ইমন, ভাইয়ের পছন্দ করা পাত্র। কথা বলে দেখ। ভাইয়ের পছন্দ তো আর মন্দ হতে পারে না।
ভ্রু কুঁচকে গেল ইমনের। বিস্মিত হয়ে তাকাল পাত্রের দিকে। আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বিরবির করল,
– বাবা ঠিক করেছে! হঠাৎ সে কেন এসবে জড়াবে?
নিজের বিষাক্ত অনুভূতি সংযত করে নিল ইমন। ধীরপায়ে গিয়ে বসল মুসকানের মুখোমুখি সোফাটায়। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল নত মাথায় বসা মুসকানের দিকে। এ প্রথম শাড়ি পরেছে মুসকান। ভাবল সে। কী যন্ত্রণা! মুসকান প্রথম শাড়ি পড়ল তাও কিনা পাত্রপক্ষদের জন্য! মেজাজ বিগড়াতে শুরু করল তার। চোখ, মুখের অবস্থা এমনিতেই বিধ্বস্ত। এবার সেই বিধ্বস্ত মুখটা ধীরেধীরে রক্তিম হতে শুরু করল। এরই মধ্যে ক্রোধের আগুনে ঘি ঢেলে দিল পাত্রের ফুপু। সে মুসকানকে বলল,
– দেখি মেয়ে ওঠে দাঁড়াও দেখি চুলগুলো দেখি।
মুসকান ওঠল না। কিঞ্চিৎ মাথা উঁচিয়ে ইমনের রাগান্বিত মুখটা দেখল। চোয়াল দ্বয় শক্ত হতে শুরু করল ইমনের। ইয়াশফা মুসকানকে খোঁচা দিল। ফিসফিস করে বলল,
– দাঁড়া, দাঁড়াতে বলছে তো।
তার তাগাদায় ওঠে দাঁড়াল মুসকান। ফুপু ওঠে এসে মাথার ঘোমটা সরিয়ে কোমর ছোঁয়া চুলগুলো সর্ব সম্মুখে উন্মুক্ত করে দিল। ইমনের বুকটা কেঁপে ওঠল তৎক্ষনাৎ। চোখের সামনে মুসকানকে বেড়ে ওঠতে দেখেছে। কিশোরী বয়স থেকে মেয়েটা কখনো তার সামনেও ঘোমটা ছাড়া আসেনি। বাইরের লোকদের সঙ্গে মেশেনি। কোনো পুরুষ মানুষ তো দূরে থাক। অথচ আজ কিনা অনায়াসে এই মহিলাটি এতগুলো মানুষের সামনে ওর ঘোমটা খুলে দিল! তীব্র এক ক্লেশ অনুভব করল সে। মুসকানের মুখেও তীব্র যন্ত্রণার ছাপ। খেয়াল করল ওর হাত মৃদু মৃদু কাঁপছে। লম্বা চুলগুলো দেখে পাত্রের মা ভীষণ খুশি হলেন। পাত্রও বেশ সন্তুষ্ট। তা তার মুখের লাজুক হাসি দেখেই টের পেল সকলে। এবার ফুপু মুসকানকে একটু হেঁটে দেখাতে বললেন। যা শুনে মুসকান সহ ইমন বিস্মিত হলো। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না ইমন। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– হেঁটে দেখাবে মানে? মেয়ে তো খোঁড়া নয়।
পাত্রের মা অবাক হয়ে তাকাল। বলল,
– এগুলোই নিয়ম বাবা। আমাদেরও এভাবে দেখানো হয়েছে।
ইমন চোখমুখ শক্ত করে কিছু বলতে যাবে অমনি মেজো কাকা তাকে শান্ত থাকতে বললেন। এদিকে মুসকান হেঁটে দেখানোর পর পাত্রের ফুপু ওর ডান হাত টেনে তালু টিপতে শুরু করলেন। বললেন,
– দেখি হাত শক্ত না নরম। শক্ত হলে বুঝা যাবে মেয়ে কর্মঠ।
এ পর্যায়ে সহ্যের সমস্ত সীমা অতিক্রম হয়ে গেল যেন। তীব্র ক্রোধে তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল ইমন৷ ফুপুর হাত থেকে মুসকানের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে হুংকার ছাড়ল,
– ব্যস অনেক হয়েছে! এই মুহুর্তে আপনারা বেরিয়ে যাবেন।
উপস্থিত সকলে কেঁপে ওঠল। পাত্র স্বয়ং দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,
– এ কী অসভ্যতা!
ইমন হিংস্র বাঘের মতো পাত্রের দিকে তাকাল। ডান গালে থাপ্পড় বসালো কষিয়ে। কলার চেপে ধরে রিরি করে বলল,
– অ্যাঁই শা’লা, এতক্ষণ যেমন চুপ করে ছিলি এখনো চুপই থাকবি। বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে আসছিস নাকি বাজারে পণ্য? অসভ্যতার দেখেছিস কী তুই রা’স্কেল!
#চিত্তবৃত্তি : ৩
পাত্রপক্ষরা যেন পালিয়ে বাঁচল! চৌধুরী বাড়িতে এখন থমথমে পরিবেশ বিরাজিত। সকলে চুপচাপ নিজ ঘরে অবস্থান করছে। ড্রয়িংরুমে মুখটা কঠিন করে বসে আছে ইমন। মুসকান নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে গেছে। কেউ জানুক, না জানুক ইমন জানে মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে। বহু বছরের চেনা স্বভাব। আজ নিশ্চয়ই বিপরীতে যাবে না?
নিয়ম করে সন্ধ্যা নামল। বাড়ির মেজো বউ, ছোটো বউ রাতের খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে এলো। তিনবেলা রান্নাবান্না মুসকানই করে। তারা টুকটাক কাজ করে শুধু। আজ মুসকানকে রান্না থেকে রেহাই দিল৷ বুঝে নিল মেয়েটার মন ভালো নেই। এরওপর
ইমন তখনো ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে। ফলশ্রুতিতে মুসকানকে ডাকার সাহস একেবারেই হলো না। বাড়ির প্রত্যেকে ইমনকে বেশ সমীহ করে চলে৷ মা মরা ছেলেটাকে দাদু আর বাবা মাথায় করে রাখে। সম্মুখে তারা দু’জনই চোখ তুলে দু’টো কঠিন কথা বলে না। আর এরা তো কোন ছা। খাওয়ার সময় মেজো কাকা ইমনকে ডাকল। ইমন বলল তার খিদে পায়নি৷ খিদে পেলে সে নিজেই খেয়ে নেবে। কেউ আর কথা বাড়ালো না। যে যার মতো খেয়েদেয়ে বিদায় নিল। বাড়ির একটা মানুষও মুসকানের খাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করল না। ভাবতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ইমনের। মনে মনে বলল,
– আজ যদি তুমি বেঁচে থাকতে মা, নিশ্চয়ই এদের মতো করতে না? আর যদি ভুল করে করতে তাহলে আমি শুধরে দিতাম৷ এতগুলো বছর হয়ে এলো তবুও এদের শোধরাতে পারলাম না৷ কারণ এরা আমাকে ভয় পেলেও ভালোবাসে না।
সহসা মোবাইলটা বেজে ওঠল। পকেট থেকে যন্ত্রটি হাতে নিতেই স্ক্রিনে ইংরেজি অক্ষরে বাবা শব্দটি দৃশ্যমান হলো৷ রিসিভ করে ফোন কানে ধরতেই মোজাম্মেল চৌধুরী স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
– বাবা রাতের খাবার খাওনি কেন?
ইমন জানে তার বাবার কাছে তাকে নিয়ে সব আপডেট মেজো কাকা আর মেজো কাকি পাঠায়। তাই অবাক হলো না। স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল,
– খিদে পায়নি বাবা৷ আপনি খেয়েছেন?
– তোমার মা ডাকছে। আমি শুনলাম তুমি এখনো খাওনি। তাই আমারো খাওয়ার মুড চলে গেছে৷ কী হয়েছে বাবা তুমি যা করেছ একদম ঠিক করেছ। ওভাবে যারা মেয়ে দেখে তাদের সঙ্গে এমনটাই করা উচিত। আমাদের ঘরেও তিনটা মেয়ে আছে। ইয়াশফা, ইমা, ইনায়া। মেয়েরা আমাদের কাছে অতি মূল্যবান সম্পদ। মুসকান তো আমাদের মেয়ের মতোনই।
তাচ্ছিল্য হাসলো ইমন। আমাদের মেয়ের মতোন আর আমাদের মেয়ে দুটো কথায় বিস্তর ফারাক। তাচ্ছিল্যটা এখানেই এলো ইমনের। তার বাবা কি বলতে পারতো না আমাদের ঘরে চারটা মেয়ে? পরোক্ষণেই ভাবল, মুসকানের প্রতি তার যে অনুভূতি সেই অনুভূতি সবার আসবে না। মুসকানকে সে যতটা গুরুত্ব দেয় সেই গুরুত্ব তার পরিবারও দেবে। এমন আশা করাটাই ঠিক নয়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল সে। বলল,
– ঠিক আছে বাবা। আপনি চিন্তা করবেন না৷ আমি কিছুক্ষণ পরই খেয়ে নিব। আপনি খেয়ে বিশ্রাম করুন।
বাবাকে আর কথা বলার সুযোগ দিল না ইমন৷ কেটে দিল ফোন। ইয়াশফা বোতলে পানি ভরে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল। সে বাঁধ সেধে বলল,
– ইয়াশফা, এদিকে আয়।
হোঁচট খাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল ইয়াশফা৷ ভীতু চোখে তাকাল ভাইয়ের দিকে। ইমনের দৃষ্টি সহজ, স্বাভাবিক অথচ চোয়াল দুটো শক্ত। ইয়াশফা বারকয়েক ঢোক গিলে তার সামনে দাঁড়াল। ইমন বলল,
– দোষ তুই করেছিস অবশ্যই করেছিস। কিন্তু নিজ ইচ্ছেতে নয়। তাই এত ভয় পাওয়ার দরকার নেই। স্বাভাবিক থাক।
– কী দোষ করেছি ছোটো ভাইয়া?
আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল ইয়াশফা৷ ইমন চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। স্পষ্ট গলায় বলল,
– মুসকানকে অন্যের জন্য শাড়ি পরিয়েছিস, চোখে কাজল লাগিয়েছিস, ঠোঁটে গোলাপি রাঙা লিপস্টিকও লাগিয়েছিস। এত বড়ো বড়ো দোষ করে ভুলে গেলি?
হকচকিয়ে গেল ইয়াশফা। ইমন মৃদু হাসলো। বলল,
– পাশে বোস।
ইয়াশফা চট করে বসে পড়ল। কোলের ওপর রাখল বেগুনি রঙের ওয়াটার বোতল। সহসা ইমন সহজ গলায় বলল,
– তোর মাথায় বুদ্ধি একটু কম জানতাম। তাই বলে এতটা জানতাম না। শোন, ঐ ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে যে মেয়েটা কাঁদছে সে তোর ভাইয়ের খুব আদরের। আর এই আদরটা তোকে ইমাকে, ইনায়াকে করা আদরের থেকে ডিফারেন্ট।
বিস্ফোরিত চোখে তাকাল ইয়াশফা। মুখ হা হয়ে গেল তার। বলল,
– এটা কীভাবে সম্ভব ভাইয়া! ও আমাদের বাড়িতে কাজ করে। তোমার মতো মানুষ ওকে কীভাবে? আমি তো এতদিন অন্যকিছু ভাবতাম। মুসু দাদির খুব আদরের ছিল, প্রিয় ছিল। এ বাড়িতে দাদিই এনেছিল ওকে। তাই ভেবেছি তুমি আর দাদুভাই দাদির জন্য ওকে এত আদর করো, সাপোর্ট করো।
– এই পৃথিবীতে সব সম্ভব ইয়াশফা।
– কিন্তু ভাইয়া মানুষ কী বলবে? আমাদের তো একটা সম্মান আছে। তাছাড়া বড়ো বাবা কি মেনে নেবে?
– যেখানে আমি ওকে চাই সেখানে বাবা মানতে বাধ্য৷
অবাক হলো ইয়াশফা। এতদিনের সব গড়মিল এক নিমিষেই বিলীন হয়ে গেল৷ থমকানো স্বরে শুধু বলল,
– দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে তুমি মুসকানকে কেন ভাইয়া? ও তো তোমার স্ট্যান্ডার্ডের না।
– কীসের স্ট্যান্ডার্ড! আমি মানুষ, তুই মানুষ সেও মানুষ। আর বলছিস কাজের লোক? এই পৃথিবীতে কোনো কাজই ছোটো নয়। আর মুসকানের যে যোগ্যতা রয়েছে সেটা তোর বা ইমারও নেই। তোরা এখনো বাবার ইনকামের ওপর নির্ভর৷ আজ পর্যন্ত এক টাকা রোজকার করেছিস? নিজের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারবি? পারবি না। কিন্তু ওকে দেখ, সেই ছোট্টবেলা থেকে নিজের দায়িত্ব নিজেই নিচ্ছে। এই যে আজ পড়াশোনা করে এতদূর এসেছে কার টাকায়? ওর নিজের টাকায়। কাজের বিনিময়ে এ বাড়ি থেকে এক পয়সাও পারিশ্রমিক নেয় না। পড়াশোনার জন্য খরচ দেয় দাদু। আর এটা ওর প্রাপ্য। তিনবেলা সবাইকে রেঁধে খাওয়াচ্ছে। যে যা অর্ডার করছে সঙ্গে সঙ্গে তাই করে দিচ্ছে। এইসব গভীরে চিন্তা করতে করতে এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে বিশ্লেষণ করতে করতে কবে যেন, সবচেয়ে সস্তা পোশাক পরা মূল্যবান মানুষটা আমার হৃদয় কেড়ে নিল।
স্তম্ভিত ইয়াশফা। ভয় দৃষ্টিতে আশপাশে তাকাল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
– এভাবেও ভালোবাসা হয়?
ইমন ওঠে দাঁড়াল। তাকাল মুসকানের ঘরের বন্ধ দরজার পানে। নিঃশব্দে দু’টো হাত প্যান্টের পকেটে গুজে দিল। দৃষ্টি ঠাঁই রাখ বদ্ধদ্বারে। বলল,
– ভালোবাসা অতো হিসেব নিকেশ করে হয় না৷ ভালোবাসা সব সময় স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করেও হয় না। ভালোবাসার সম্মোহনী শক্তি সব প্রতিকূলতাকেই হার মানায়। সমাজের চোখে যা অসংগতিপূর্ণ, প্রেমের ক্ষেত্রে তা খুব সহজেই আশকারা পায়।
ইয়াশফাও ওঠে দাঁড়াল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
– এতদিন জানতাম আমাদের ছোটো ভাইয়া সবার থেকে আলাদা মানুষ। খুব অমিশুক, গম্ভীর আর কঠিন ব্যক্তিত্বের। আজ জানলাম, অসাধারণ হৃদয়ের অধিকারী। তুমি অনন্য ভাইয়া। তোমার মতো করে যদি সবাই ভাবতো পৃথিবীটা আজ অন্য রকম হতো।
এ পর্যন্ত বলেই হঠাৎ উত্তেজিত হলো ইয়াশফা। বলল,
– সত্যি আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না মুসকানকে তুমি ভালোবাসো… যেই রকম ভালোবাসলে ও আমাদের ভাবি হবে সেই রকম ভালোবাসো ওকে!
ঈষৎ হাসলো ইমন। তার দৃষ্টি এখনো মুসকানের ঘরের বদ্ধদ্বারে স্থির। তবুও ইয়াশফার কথায় উত্তর দিল। বলল,
– ভালোবাসা জিনিসটা দমকা হাওয়ার মতো। হুট করেই মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। মানুষের মন এমন এক জিনিস যা কখন, কিভাবে কার ওপর ভালোলাগা বা ভালোবাসা তৈরী করে ফেলে যে মানুষ টা নিজেও টের পায় না। কার মন কখন কিভাবে কারো মাঝে আটকে যায় তা হয়তো কোন হিসেব নিকেশ করে মেলানো সম্ভব হয় না। হুট করেও প্রেমে পড়া যায়, কিন্তু সেই হুট করে প্রেমে পড়ে যাওয়া মনটা কে দীর্ঘস্থায়ী কেবল আসল প্রেমিক -প্রেমিকারাই করতে পারে। ঠিক যেমন হুট করে পৃথিবীর বুকে বৃষ্টির আগমন ঘটে, মানুষের হৃদয়েও হুট করে প্রেম, ভালোবাসার আগমন ঘটে। বুকের ভিতর কারো প্রতি মুগ্ধতা জমতে জমতে যখন পাহাড় হয়ে যায় তখন তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। আমি আঁটকেছি ওর মুগ্ধতায়। বুকে জমিয়েছি ওর প্রতি মুগ্ধতার পাহাড়। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি ভালোবাসা কখনো গুটিগুটি পায়ে আসে, কখনো আচমকা এসে যায়। ভালবাসা একদিনেও হতে পারে যদি সেই ভালোবাসা কে একজনম আঁকড়ে ধরে বাঁচার ক্ষমতা রাখো।
ইমনের প্রেম, ভালোবাসার কথা শুনে ইয়াশফা কেমন একটা ঘোরে চলে গেল৷ বর্তমানে কোনো পুরুষের মনে, কোনো নারীর প্রতি এমন প্রেম যে বিরল। এতদিন ইমনের মধ্যে আদর্শ মানুষ দেখেছে ইয়াশফা৷ আদর্শ সন্তান, ভাই হিসেবেও জেনেছে। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে মাকে বলতে শুনেছে,
– ইমনকে অনুকরণ করো। তার বোন হয়ে এমন রেজাল্ট করতে লজ্জা করে না?
আদর্শ ব্যক্তিত্বের তার ছোটো ভাইয়াকে প্রথমবারের মতো আদর্শ প্রেমিক হিসেবে নিশ্চিত করল সে। মনে মনে ভাবল, মুসকান কী ভাগ্যবতী! পরোক্ষণেই মনে পড়ল মুসকান তো এসব জানে না। জানলে কী মেনে নেবে? ইমনের মতো ছেলেকে না মেনে নেয়ার কথা কোনো মেয়ে ভাবতে পারে? পারে বোধহয়। এই যে মুসকানকে নিয়ে শঙ্কা হচ্ছে। কেন হচ্ছে? মুসকান যে ধরনের মেয়ে শঙ্কা হবারই কথা। ইমন পুরো পরিবারের বিরোধীতা করলেও মুসকান এই পরিবারের বিরোধীতা করতে পারবে না। ইমন, মুসকানের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো বাঁধা এই পরিবার। চৌধুরী পরিবার। যৌক্তিক এই চিন্তা মুখে প্রকাশ করল ইয়াশফা। বলল,
– মুসকান যদি তোমাকে গ্রহণ না করে?
বুকের খুব গভীরে হোঁচট খেল ইমন। মুখ ফিরে তাকাল ইয়াশফার দিকে। রাশভারি গলায় বলল,
– এটা আমার চিন্তা, আমার সমস্যা। এসবে তুই মাথা ঘামাবি না৷ তুই জাস্ট মাথায় রাখবি ও আমার কে। ওকে?
ঘাড় কাত করল ইয়াশফা। ইমন বাঁকা হাসলো। বলল,
– ও খায়নি গিয়ে বল রাতের খাবারটা খেয়ে নিতে।
.
.
ইয়াশফা ম্লান মুখে মুসকানের ঘর থেকে ফিরে এলো। ইমনকে বলল,
– ভাইয়া ওর খিদে নেই বলল। অনেক বলেছি কিন্তু যে না সেই না। না আর হ্যাঁ হলো না।
মুখটা আবারো গম্ভীর হলো ইমনের। বলল,
– এক কাজ করতে পারবি?
– কী?
– অভ্র বাদে প্রত্যেকের ঘর বাইরে থেকে লক করে দিবি। যখন আমি বলব তখন গিয়ে খুলে নিজের ঘরে চলে যাবি।
ইয়াশফা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। বোকা হয়ে বলল,
– কেন?
– খুব বেশি প্রশ্ন করিস তুই। যা বলেছি কর।
– ওকে ওকে৷
বলেই ইয়াশফা চলে যেতে উদ্যত হয়েও ফিরে এলো। ইমনের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে বলল,
– আচ্ছা ছোটো ভাইয়া, সবার দরজা লক করব। কিন্তু অভ্র ভাইয়ারটা কেন নয়?
অতিরিক্ত কৌতুহল, অতিরিক্ত প্রশ্ন ইয়াশফার। ইমন কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– কারণ তুই আজ যা জানলি অভ্র বহু আগে থেকেই তা জানে। এবার যা বলেছি কর গো নাও!
ইয়াশফা বুঝল ইমনের রাগান্বিত ভাব৷ তাই চটজলদি প্রস্থান করল তার সামনে থেকে। লেগে পড়ল নিজের কাজে। ইমন নিচ থেকে তীক্ষ্ণ চোখে সবটা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এরপর দৃঢ়চিত্তে পা বাড়াল মুসকানের ঘরে। দরজার সামনে গিয়ে বুঝল দরজা খোলাই। তবুও সে ঢুকল না। হাত মুঠ করে কপাটে টোকা দিল দুইবার। মৃদু কেশে শান্ত কণ্ঠে বলল,
– আসব?
ক্রন্দনরত মুসকান চমকে তাকাল। ত্বরিত নিজের চোখ, মুখ মুছে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পুনরায় শুনতে পেল ছোটো সাহেবের গলা,
– ভেতরে আসার অনুমতি না দিলেও চলবে কিন্তু তুমি তুমি বাইরে না এলে চলবে না। খিদে পেয়েছে আমার এসে খাবার গরম করে দিয়ে যাও৷ বেড়ে খাওয়ার অভ্যাস যে নেই তা নিশ্চয়ই জানো?
চলবে…
®জান্নাতুল নাঈমা